আবার গাড়ি এগিয়ে চললো। স্টেশন পেরিয়ে শহরে যখন ঢুকলাম ঘড়িতে তখন প্রায় সকাল এগারোটা বাজে। পুরুলিয়া শহরে উৎপলের বোনের বাড়ি থাকায় বেশ সুবিধেই হলো। বিগবাজারের ঠিক উল্টোদিকেই বাড়ি। পুরুলিয়া এই প্রথম এলাম। কলকাতা থেকে এতো দূরে এই শহরে কি নেই! সমস্ত বড় বড় শপিং মল থেকে শুরু করে নামিদামি ব্র্যান্ডের শোরুম সব আছে। ভীষণ ভালো লাগলো এই শহরটাকে। উৎপলের ভগ্নিপতির রয়্যাল এনফিল্ডটা নিয়ে দুজনে মিলে বেরিয়ে পড়লাম সাহেব বাঁধের দিকে।
জাতীয় সরোবর সাহেব বাঁধ এখন পুরুলিয়ার অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান হয়ে উঠেছে। এর সৌন্দর্যের হাতছানি এড়াতে পারে না কেউ। এই সাহেব বাঁধের ছোট্ট একটা ইতিহাস আছে। অবিভক্ত মানভূমের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার কর্ণেল টিকলে পুরুলিয়া শহরের জল কষ্ট দূর করার জন্য পঞ্চকোট রাজের সম্মতি নিয়ে ঐ পুকুরকে কেন্দ্র করে একটা জলাশয় তৈরি করেন। ১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দে জেলবন্দী কয়েদি ও কিছু দিনমজুর লাগিয়ে কৃত্রিম লেকের মতো এক বিশাল সরোবর খননের কাজ শুরু করেন। এরপর পাঁচ বছর ধরে চলে এই খনন কাজ। ১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দে খননের কাজ শেষ হলে কর্নেল টিকলে সাহেবের নাম অনুসারে পঞ্চকোট রাজের ঐ পুকুরটা 'সাহেব বাঁধ' নামে পরিচিত হয়। এই সরোবরের আরও একটা নামও রয়েছে – 'নিবারণ সায়র'। জেলার বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ঋষি নিবারণ চন্দ্র দাশগুপ্তের স্মরণে এই সাহেব বাঁধের নাম পরিবর্তন করে 'নিবারণ সায়র' করা হয়।
সাহেব বাঁধের পাশেই থাকা সূর্য মন্দির দর্শন করে চারপাশটা ঘুরে দেখলাম। সরোবরের চারদিক ঘিরে রয়েছে কালো পীচের রাস্তা। বিশাল জলাশয়ের মাঝে রয়েছে একটা দ্বীপ এবং দক্ষিণ দিকের অপর দ্বীপটাতে তৈরি হয়েছে বনবিভাগের মনোরম পার্ক 'সুভাষ উদ্যান'।
সাহেব বাঁধের উত্তর প্রান্তে নর্থ লেক রোডে 'শিকারা পয়েন্ট'-এ ঢুকে দেখি কাশ্মীরের শিকারাতে চড়ার মতো এখানে ব্যবস্থা রয়েছে। একেবারে কাশ্মীরি কাপড়ে মোড়া গদি দিয়ে তৈরি এক একটা শিকারায় পাঁচ জন করে বসতে পারবেন। টিকিট কাউন্টারের এক কর্মীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, শিকারাতে চড়ার জন্য এক ঘন্টার জন্য ভাড়া পাঁচশো টাকা এবং তিরিশ মিনিটে তিনশো টাকা।
 |
| পর্যটকের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে |
সাহেব বাঁধ থেকে ঘুরে এসে উৎপলের বোনের বাড়িতে জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হলো। বেশ কিছুক্ষণ বসে গল্পগুজব করে কাটিয়ে দুপুর দেড়টা নাগাদ আবার বেড়িয়ে পড়লাম অযোধ্যার পথে। অযোধ্যা পাহাড় বেড়াতে এসে সব জায়গা একসাথে ঘুরে দেখা খুবই কঠিন। সময় ও দুর্গমতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অযোধ্যা পাহাড়ে ওঠার জন্য এখন অনেকগুলো রুট আছে। পুরুলিয়া-টামনা-সিরকাবাদ হয়ে, বলরামপুর-বাঘমুণ্ডি হয়ে, সুইসা-বাঘমুণ্ডি হয়ে, ঝালদা-বেগুনকোদর হয়ে আসা যায়। আবার উরমা-ঘাটবেড়া হয়েও আসা যায়। এখন আরও নতুন রাস্তা তৈরি হয়েছে। তবে প্রধান প্রবেশপথ দুটো; একটা পুরুলিয়া শহরের দিক থেকে সিরকাবাদ হয়ে অন্যটা বাঘমুণ্ডির দিক থেকে থেকে বাড়রিয়া হয়ে। পুরুলিয়া শহর থেকে যাওয়ার ফলে আমরা সিরকাবাদের রাস্তাটাকেই বেছে নিলাম। তাছাড়া বলরামপুরের রাস্তাটাও ছিল খারাপ। সিরকাবাদ হয়ে অযোধ্যার জার্নিটা ভারী সুন্দর। বাঘমুণ্ডির রাস্তায় কিছুক্ষন চলার পর টামনা মোড় থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে ছেড়ে ডানদিকে টার্ন নিয়ে চললাম সোজা হিল টপের দিকে। দু'পাশে চাষের ক্ষেত আর তার মধ্যেই একের পর এক আদিবাসী গ্রাম ছাড়িয়ে গাড়ি কালো পিচ-ঢালা রাস্তায় এগিয়ে চলল অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে। সিরকাবাদ অতিক্রম করার পর চোখের সামনে ভেসে উঠল পাহাড়ের সারি। অনেকটা অঞ্চল জুড়ে এই অযোধ্যা পাহাড়ের বিস্তার।
 |
| চলেছি অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে |
পুরুলিয়ার অন্যতম প্রধান পর্যটনকেন্দ্র হল এই অযোধ্যা পাহাড়। বহু বছর আগে, অরণ্যবেষ্টিত এই অঞ্চলে যাযাবরের মত ঘুরে বেড়ানো দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর বিরহোড় উপজাতিরা আশ্রয় গ্রহণ করে। তারপর সাঁওতালরা এখানে আসে। এখানের উপজাতি অধিবাসীরা পাহাড়কে দেবতা হিসেবে মনে করে। সাঁওতালি ভাষায় অযোধ্যা পাহাড়কে 'আয়োদিয়া' বলে। যার অর্থ, অযোধ্যা মা সকলকে অতিথিশালার মত এই পাহাড়ে আশ্রয় দিয়েছেন। অযোধ্যা সিং নামে আগে এখানে একজন ভূমিজ জমিদার ছিলেন, যার নামে এই অযোধ্যা পাহাড়ের নামকরণ হয়েছে বলে কথিত আছে।
 |
| ভেসে উঠল পাহাড়ের সারি |
এখানে বিচিত্র সব পাহড়ের নাম গোর্গাবুরু, চামতাবুরু, কড়াকুবুরু, মাঠাবুরু, গজবুরু এইরকম আরো অনেক নাম আছে যা শেষ করা যাবে না। সাঁওতালি ভাষায় এই 'বুরু' কথার অর্থ পাহাড়। এক একটা পাহাড়ের চূড়ায় এক এক বুরুর অধিষ্ঠান। এদের মধ্যে গোর্গাবুরু কে ছাড়িয়ে চামতাবুরু এখন অযোধ্যা পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু চূড়া। আবার এর সঙ্গে রয়েছে কিছু অনুচ্চ বিচ্ছিন্ন পাহাড় যা এখানের উপজাতিদের ভাষায় ডুংরি নামে পরিচিত। উসুলডুংরি, ফলডুংরি লাহাডুংরি আরো কত কি।
 |
| উঁচু-নিচু টিলার সমাহার |
হিল টপের দিকে যত এগোচ্ছি ততই যেন বিস্ময় বাড়ছে, দুরের পাহাড় ক্রমশ কাছে আসছে। একসময় শুরু হল পাহাড়ি পথ বেয়ে উপরে ওঠা। গাড়ি উঠতে শুরু করল চড়াইতে। কিছুক্ষন পর এক জায়গায় দেখি সর্পিলাকারে পাকদন্ডীর মতো হেয়ার পিন টার্ন নিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে অরণ্যের মধ্যে দিয়ে। এঁকে বেঁকে ঘুরে ফিরে চলেছি আরও উপরে।
 |
| পাহাড়ি পথ বেয়ে উপরে ওঠা |
শুরু হল দুদিকে ঘন জঙ্গল। চারদিকে শুধু জঙ্গল ঘেরা ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের পাহাড় আর পাহাড়। পথে পড়লো ময়ূর পাহাড়। ময়ূর পাহাড়কে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চললাম। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর শুরু হল জনবসতি। পাহাড়ের মাথায় টেবিল টপের মতো বেশ খানিকটা আধা-সমতল অঞ্চল নিয়ে জনবাসতি। একজায়গায় কতগুলো বাস পার্কিং করা দেখে মনে হলো এখানেই বাসস্ট্যান্ড। বুঝতে পারলাম অযোধ্যা হিল টপ গ্রাউন্ডে পৌঁছে গেছি।
 |
| হেয়ার পিন টার্ন |
আলো পড়ে গেলে লোয়ার ড্যাম ভিউ পয়েন্ট থেকে ভাল দেখা যাবে না। অতএব সূর্য ডোবার আগে লোয়ার ড্যাম ঘুরতেই হবে। সোজা চলে গেলাম লোয়ার ড্যামের দিকে। গোটা পাহাড় ছেয়ে আছে বিভিন্ন গাছে। সবুজ গাছে ভরা জঙ্গলকে ভেদ করে আঁকা বাঁকা রাস্তা ধরে চলেছি। অযোধ্যা পাহাড় যেন এক 'সবুজ রাণী' – সৌন্দর্যের এক অপরূপ ডালি সাজিয়ে নিয়ে বসে রয়েছে এখানে প্রকৃতি। এভাবে চলার পথে হাঠৎ চোখে পড়ল একটা ফাঁকা ময়দানে গ্রামের কিছু ছেলে খেলাধুলো করছে। অদূরে দেখা যাচ্ছে আপার ড্যাম। হিল টপ গ্রাউন্ড থেকে আপার ড্যামে পৌঁছনোর এই রাস্তাটা এককথায় অনবদ্য।
 |
| ওভার ফ্লো ব্রিজ |
আপার ড্যামে ঢোকার মুখে ওভার ফ্লো ব্রিজের একপাশে গাড়ি রেখে লেকের কাছে গেলাম। ব্রিজের একপাশে ড্যামের সুনীল জলরাশি, অন্যদিকে সবুজের সমারোহ। সবুজের মাঝে লেকের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মন ভরে গেলো। ওভার ফ্লো ব্রিজ থেকে রাস্তার একটা ছোট্ট টার্ন নিতেই একেবারে লেকের পাশে চলে এলাম। লাল রঙের রেলিং দিয়ে ঘেরা ড্যামের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে এগিয়ে চলেছি। দোকান পাট নেই কিন্তু এই গরমেও ড্যামের উপর পর্যটকের উপস্থিতি ছিল বেশ নজরকাড়া।
 |
| অপার ড্যামের উপর দিয়ে চলেছি |
আপার ড্যাম ছাড়িয়ে সুন্দর আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথে নামতে থাকলাম। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা ভিউ পয়েন্ট দেখে সেখানে দাঁড়ালাম। এটাই লোয়ার ড্যাম ভিউ পয়েন্টে। এখানে বামনি নদীর জলধারাকে আটকে তৈরি হয়েছে লোয়ার ড্যাম PPSP বা পুরুলিয়া পাম্প স্টোরেজ প্রকল্প। এই লোয়ার ড্যামেরে জল পাম্প করে আপার ড্যামে নিয়ে যাওয়া হয়, তারপর আবার উপর থেকে নীচে ফেলে সেই জলের গতিকে কাজে লাগিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে জলবিদ্যুৎ তৈরি করা হয়। বামনি নদীর ওপর এই ড্যামটা ভারী সুন্দর। লম্বা একহারা লেকটা দূর পাহাড়ে গিয়ে মিশেছে। নীচে গ্রামগুলোকে উপর থেকে ঠিক ছবির মতোই সুন্দর দেখাচ্ছে।
 |
| লোয়ার ড্যাম |
ভিউ পয়েন্ট থেকে নীচে চোখ যেতেই দেখি আরো একটা ছোটো ড্যাম। এর পোশাকি নাম কেষ্ট বাজার ড্যাম হলেও প্রচলিত নাম লহরিয়া ড্যাম। আগে এই ড্যামের জলের মূল উৎস ছিল কেষ্ট বাজার নালা। বামনী নদীর ওপর ড্যাম দেওয়ার পর এখন লোয়ার ড্যাম এর জল এই কেষ্ট বাজার ড্যামে আসে। আরো নেমে চলে এলাম কেষ্ট বাজার ড্যামের কাছে। কেষ্টবাজার ড্যামের পাশেই রয়েছে লহরিয়া শিব মন্দির সহ অন্যান্য মন্দির। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের পথে। আমাদেরও ফিরতে হবে এবার।
 |
| কেষ্ট বাজার ড্যাম |
ধীরে ধীরে সূর্যের আলো কমে আসতে লাগলো। সূর্য ঢলবে এখনি। পাহাড়ের কোলে সূর্যাস্ত দেখবো বলে আর দেরি না করে এবার চললাম আপার ড্যামে।
 |
| আবার চললাম আপার ড্যামে |
আবার খাড়াই পথ ধরে চলেছি অপার ড্যামের দিকে। সুন্দর বাঁধানো রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে গেলাম আপার ড্যামে। ড্যামের একদিকে পাথর দিয়ে বাঁধানো পাড় ঢালু হয়ে নেমেছে লেকের জলে। বিশাল সেই লেকের ওপর সবুজ পাহাড়ী দ্বীপ, তার পিছনে পাহাড়ের সারি। অন্যদিকে থরে থরে সাজানো পাহাড়ের পর পাহাড় যেন সবুজ গালিচা পেতে আছে প্রকৃতি। নিচে বহু দূরে আবছা মতো দেখা যাচ্ছে লোয়ার ড্যাম। একঘেঁয়ে জীবন থেকে বেরিয়ে একটু মুক্ত পরিবেশে শ্বাস নেওয়ার জন্য অন্যান্য পর্যটকদের মতো আমরাও এসেছি প্রকৃতির মাঝে, পাহাড়ের কোলে। লেকের জলে, পাহাড়ের মাথায় তখন শেষ বিকেলের আলো। আকাশে ছড়িয়ে আছে রক্তিম আভা। অসাধারণ সেই ভিউ দেখার জন্য আপার ড্যামে তখন ভিড় করেছে পর্যটকরা।
 |
| খাড়াই পথ ধরে চলেছি |
ড্যামের উপর এক জায়গায় গাড়ি পার্কিং করে আমরাও সেই পর্যটকদের ভিড়ে মিশে গেলাম। কেউ আনন্দে গান ধরেছে 'লাল পাহাড়ির দেশে যা... রাঙা মাটির দেশে যা...', আর সেই গানের তালে পা মিলিয়ে নাচছে একদল সুবেশী তরুণী। মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।
 |
| আপার ড্যাম |
পাহাড়ের কোলে ঢলে পড়া লাল টকটকে সূর্যের অস্ত যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। একটা সময় হয়তো সূর্যেরও ক্লান্তি লাগে। অনেক দূরে পাহাড়ের ওপারে একসময় ডুব দিলো সূর্য। সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলে, সেদিনের মতো আমাদের ঘোরা শেষ।
 |
| পাহাড়ের কোলে ডুব দিলো সূর্য |
থাকার জায়গা এখনো ঠিক হয়নি। গাড়িতে উঠে চলে এলাম হিলটপে হোটেল খুঁজতে। আমাদের প্রথম পছন্দ ছিল সিএডিসি-র গেস্ট হাউস। প্রকৃতির মধ্যে সৌন্দর্যে ভরা সাজানো ক্যাম্পাসের ভিতরে 'নীহারিকা', 'মালবিকা', 'বিভাবরী' এরকম বেশ কয়েকটা গেস্ট হাউস রয়েছে। সিএডিসি-র রিসেপশন কাউন্টারে যোগাযোগ করলে বলল কোনো রুম খালি নেই কেবল 'তৃষা'-র স্যুটটা খালি আছে। একদম নিরাপদ জায়গা; ফ্যামিলি নিয়ে থাকতে হলে এর কোনো তুলনা হয় না। রুম দেখে আমাদের খুব পছন্দ হল। ঘরগুলো যথেষ্ট পরিষ্কার ও সাজানো গোছানো। তবে শুধুমাত্র রাত্রিটা কাটানোর জন্য আমাদের গুনতে হয়েছিল প্রায় আড়াই হাজার টাকার কাছাকাছি। গাছপালা দিয়ে সাজানো বিশাল বাগান, পরিবেশটা এক কথায় চমৎকার। সারাদিন পথ চলার ধকলে শরীরে ক্লান্তি ছড়িয়ে ছিল তাই ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে শুয়ে পড়লাম।
 |
| 'তৃষা'-য় আমাদের রাত্রি যাপন |
সকালে ঘুম থেকে উঠে সারা দিনের বেড়ানোর প্ল্যান করে নিলাম, এর মধ্যে আবার দুপুরের মধ্যে উৎপলের ঝালদা যাওয়ার প্ল্যান আছে। স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করেই বেড়িয়ে পড়লাম। হিলটপ থেকে বেরিয়ে আপার ড্যাম যাবার রাস্তাকে বামপাশে ফেলে শালবনের পথ ধরে চলেছি অযোধ্যা পাহাড়ের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন ক্ষেত্র মার্বেল লেকের উদ্দেশে। সকালবেলায় এই পাহাড়ের চারিদিকের দৃশ্য অসাধারণ। এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি পাহাড়ে জিপিএস সঠিক রাস্তা দেখায় না। বেশ গোলকধাঁধার মতো রাস্তা। মার্বেল লেকে যাওয়ার সময় জিপিএস অনুসরণ করে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা, এক জায়গায় পথহারা হয়ে ভুল রাস্তায় চলে গেলাম। পরে এক পর্যটকের সহায়তায় জঙ্গলের পথ ধরে খানিক দূর গিয়ে মিলল মার্বেল লেক যার অপর নাম ইকো পয়েন্ট। মার্বেল লেকের প্রকৃত নাম দুলগুবেড়া বা দুর্গাবেড়া লেক।
 |
| চলেছি মার্বেল লেকের দিকে |
লেকের স্বচ্ছ নীল জলের জন্য পর্যটকদের কাছে এটা ব্লু-লেক নামেও পরিচিতি লাভ করেছে। মার্বেল লেক আসলে একটা পাথরের খাদান। পুরুলিয়া পাম্প স্টোরেজ প্রোজেক্টের সময় এখান থেকেই পাথর ভেঙে নিয়ে গিয়ে তৈরি করা হয়েছে ড্যামগুলো। বিস্ফোরণ করে পাথর ভাঙতে গিয়ে সেই পাথরের খাঁজে তৈরি হয় এই লেকটা। চারিদিকে উঁচু পাথরের টিলার মধ্যে লেকের সৌন্দর্য্য অতুলনীয়। গ্রামের কয়েকটা বাচ্চা দেখি ওই টিলার উপর থেকে লাফ দিয়ে লেকের জলে স্নান করছিলো। চারদিকে একটা থমথমে নিস্তব্ধতা। একটু শব্দ করলেই প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে।
 |
| মার্বেল লেক |
মার্বেল লেকের এই মনোরম দৃশ্য দেখার জন্য লেকের পাশে রয়েছে একটা ওয়াচ টাওয়ার। ছায়াহীন লেকের পাড়ে প্রচন্ড রোদে নাজেহাল অবস্থা। মার্বেল লেকে কিছু ছবিটবি তুলে এবার আমরা চললাম বামনি ফলস দেখতে।
 |
| ওয়াচ টাওয়ার |
মার্বেল লেক থেকে আরও কিছুটা এগিয়ে রাঙা মোড়ের নেতাজি মূর্তির কাছে ডান দিকের রাস্তাটা চলে গেছে বাগমুণ্ডির দিকে। শাল, সেগুন,পলাশের গা ঘেঁষে সবুজ জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলেছি। তবে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করলো পলাশ। এভাবে খানিকক্ষণ চলার পর বামনি ফলসের কাছে এসে গাড়ি থামালাম।
 |
| জঙ্গলে ঘোরা পাহাড়িপথ |
রাস্তাটা এখানে বেশ চওড়া। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য অনেকটাই জায়গা রয়েছে। এদিকে প্রচন্ড গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। সামনের একটা দোকানে দেখি চায়ের কেটলি থেকে ধোঁয়া উঠছে। এক কাপ ধূমায়িত চায়ের তৃপ্তি যেন তখন একটু খানি শান্তির চুমুক। চা-দোকানির পরামর্শ অনুযায়ী একটা জলের বোতল কিনে এগিয়ে গেলাম ফলসের দিকে। অযোধ্যা পাহাড়ের বিভিন্ন ফলসের মধ্যে মূল আকর্ষণ বলা যায় এই বামনিকে।
 |
| গাড়ি পার্ক করে ফলসের দিকে এগিয়ে গেলাম |
এক নির্জন প্রকৃতির বুকে দুরন্ত এই বামনি ফলসটা বেশ বড়। তিন ধাপে নীচে নেমে গিয়েছে। প্রতিটা ধাপ একটা আরেকটার থেকে বেশ নীচে। অগুনতি পাথুরে সিঁড়ি ভেঙে অনেকটাই নীচে নামতে হয়। স্থানীয় দোকানদারের কাছে জানলাম, বামনি ফলসের উপর থেকে একদম নীচের ধাপে নামতে মোটামুটি সাতশো সিঁড়ি ভাঙতে হয়। প্রথম ভিউ কিছুটা নেমে। খুব সাবধানে পা ফেলে ছোট সিঁড়ি ভেঙে আস্তে আস্তে কোনোরকমে প্রথম ভিউ পয়েন্টে পৌঁছালাম। এই পর্যন্ত সকলেই নামতে পারেন। পাহাড়ের ঢালু গায়ে পাথরের বুক চিরে অবিরাম ধারায় ঝরে পড়েছে বামনির জলধারা আর সেই জলধারার নেই কোনো বিরাম। শুধুই সময়ের স্রোতের মতই বয়ে যাওয়া, ফিরে আসার অবকাশ নেই। সামনে বিরাট লেক।
 |
| বামনি ফলস |
প্রথম ভিউ পয়েন্ট থেকে লেকের দিকে অর্ধেক নামার পরে আর দ্বিতীয় ফলস দেখতে যাওয়ার সাহস হলো না, কারণ নিজেরাই গাড়ি চালিয়ে যাব যদি কোনো অঘটন ঘটে যায় তাহলে মুশকিল হতে পারে। এবার উঠতে হবে। খাড়া সিঁড়ির কয়েক ধাপ উঠে বুঝতে পারলাম যে কাজটা খুব সহজ নয়। বেশ কষ্ট হল উপরে উঠে আসতে। অনেক জায়গায় দম নেওয়ার জন্য দাঁড়াতে হল। উপরে উঠে একটা ছোট্ট দোকানের চেয়ারে হেলান দিয়ে বুক চেপে বসে পড়লাম, শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। লেবু জল খেয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক হলে আবার যাত্রা শুরু করলাম। পাহাড়ি পথ শেষ করে নেমে এলাম পাহাড়ের ঢালে বাঘমুণ্ডির বাড়রিয়া গ্রামে।
 |
| বামনি লেক |
চড়িদা মুখোশ গ্রাম
অযোধ্যা পাহাড়ের মূল দ্রষ্টব্যগুলো এই বাঘমুণ্ডির দিকেই। এখানে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে সবুজের বুকে মিশে থাকা অযোধ্যা পাহাড়ের দৃশ্য সে এক অন্যরকম অনুভূতি সৃষ্টি করে। বাঘমুণ্ডি পেরোনোর পর দুই ধারের রূপ এবার বদলে গেলো। সুন্দর রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম ঝালদার দিকে। বাঘমুণ্ডি থেকে কিছুটা যাওয়ার পর আমাদের স্বাগত জানালো চড়িদা মুখোশ গ্রাম। চড়িদা বা চোড়দা এখন খুবই জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। কোলকাতা সহ বাংলার মানুষের কাছে যার পরিচিতি ‘মুখোশের গ্রাম’ বলে। প্রখ্যাত ছৌ শিল্পী গম্ভীর সিং মুড়ার সৌজন্যে আজ বিখ্যাত এই চড়িদা গ্রামটা।
 |
| 'ছৌ' নাচের মুখোশ |
'ছৌ' নাচ বা 'ছো' নাচ বা 'ছ' নাচ একপ্রকার ভারতীয় আদিবাসী রণনৃত্য। ছৌ নাচের এরকম নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকমের মত রয়েছে। ড. পশুপতি প্রসাদ মাহাতো ও ড. সুধীর করণের মতে এই নাচের নাম 'ছো', আবার বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত ও ড. বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতোর মতে এই নাচের নাম 'ছ'। আবার ওড়িশার ময়ূরভঞ্জে এই নাচকে ওড়িয়া-উচ্চারণরীতিতে 'ছও' বা 'ছউ' বলে। তবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভের পর এই নৃত্যটা 'ছ' বা 'ছো' নামের পরিবর্তে প্রখ্যাত লোকতত্ববিদ ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের দেওয়া 'ছৌ' নামটাই জনপ্রিয় হয়। যদিও তিনি তাঁর বাংলা সাহিত্যের প্রথম সংস্করণে 'ছো' শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন। আমাদের কাছে 'ছৌ' নাচের আদি উৎস এই পুরুলিয়া মনে হলেও কিন্তু 'ছৌ'-নাচের উদ্ভব কোথায় ঘটেছিলো তা সঠিক জানা যায়নি। 'ছো' নাচকে মোটামুটি দু'ভাবে ভাগ করা যায় 'পাইক' নাচ এবং 'মুহা' নাচ। পাইক নাচ মূলত যৌথ রণনৃত্য এই নাচে মুখোশ ব্যবহৃত হয় না আর 'মুহা' নাচ মূলত একক নৃত্য এবং এতে মুখোশ ব্যবহার করা হয়। পুরুলিয়া, ধলভূম, ঝাড়গ্রাম অঞ্চলে মুখোশের প্রচলিত নাম 'মুহা' বা 'মহড়া'। এই 'ছো' নাচের পিছনে অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যে এটা একটা বিশেষ উৎসবের সঙ্গে যুক্ত। সেই উৎসবটা হলো 'গাজন'। পশ্চিমবঙ্গের ওড়িশা ঝাড়খন্ড সীমান্তবর্তী কোনো কোনো অঞ্চলে এই উৎসবকে বলা হয় 'মাড়ো', 'মাড়ো' কথাটা রূঢ়ি অর্থে গাজন। আবার ওড়িশার ময়ূরভঞ্জে প্রচলিত ওড়িয়া ভাষায় বা সিংভূমের ধলভূম অঞ্চলে অথবা পশ্চিমবঙ্গের গোপীবল্লভপুরের কোনো কোনো অংশে 'ছো' শব্দটার মৌলিক অর্থ 'সং'। গাজনের 'সং' অর্থাৎ গাজনের 'সং' নাচ বললে যা বোঝায়, 'ছো' নাচ বললেও তাই বোঝায়। মূলত এই নাচ ছিল হরপার্বতীর বিবাহ উৎসবকে অনুকরণ করে 'সং' নাচ। গাজনের এই 'সং' নাচই আসলে 'ছো' নাচের ভিত্তিভূমি। 'ছো' নাচের বিশেষত্ব হচ্ছে তার মুখোশ। তবে 'ছো' নাচ শুধু মুখোশ নাচ নয়, মুখোশ ছাড়াও এই নাচ হয়। আগে 'ছৌ' নাচে মুখোশের ব্যবহার ছিল না। মুখে কাপ-ঝাপ মেখে (কালি-ঝুলি) 'আলাদা-ছো' অথবা 'মেল-নাচ' করা হত। গম্ভীর সিং মুড়ার বাবা এবং ঠাকুরদা বিনা মুখোশেই 'ছৌ'-নাচ পরিবেশন করেছেন। তবে এখনকার 'ছৌ' নাচে মুখোশ লাগবেই। এই মুখোশের ব্যবহার এসেছে বাঘমুণ্ডির মুখোশ শিল্পী অবিনাশ সূত্রধর-এর হাত ধরে। 'ছৌ' এর প্রসারের সাথে সাথে মুখোশের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
 |
| চড়িদা মুখোশ গ্রাম |
রাস্তার দু'পাশে সারি সারি দোকান। নানা ধরণের উজ্জ্বল রঙের মুখোশে সেজে উঠেছে গ্রামটা। প্রতিটি শিল্পীর বাড়ির সামনেই রয়েছে দোকান সেখানেই চলছে মুখোশ তৈরির কাজ, সেখানে মুখোশ বিক্রিও হচ্ছে। আবার ইচ্ছে হলেই দোকানের পাশে রাখা বেঞ্চে বসে মুখোশ বানানোর প্রক্রিয়াও দেখা যেতে পারে। রাস্তার মোড়ে একপাশে গাড়ি রেখে ছৌ মুখোশের মিউজিয়াম দেখতে গেলাম।
 |
| ছৌ মুখোশের মিউজিয়াম |
চড়িদার এই দোতালা ছোট্ট মিউজিয়ামটিতে প্রবেশ অবাধ। কিভাবে শুরু হয়েছিল এই মুখোশ শিল্প তা জানতে হলে এই মিউজিয়ামে আসা দরকার। প্রায় দেড়শো বছর আগের কথা। বর্ধমান জেলা থেকে কয়েকটা সূত্রধর পরিবার এসে চড়িদা গ্রামে বসতি শুরু করেছিল। ভাদু সহ বিভিন্ন দেবদেবীর মুখোশ গড়িয়ে দেওয়ার শর্তে তৎকালীন বাঘমুণ্ডির রাজা মদনমোহন সিং দেও তাদের থাকার জন্য জমি দিয়েছিলেন। রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হলো এখানে মুখোশ নির্মাণ শিল্প। ছৌ-নাচের মুখোশগুলো শুধু মাটি দিয়ে হয় না। মুখোশ তৈরির মূল উপকরণ দোঁয়াশ মাটি, জল, পুরোন খবরের কাগজ, ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো, তেঁতুল বীজের গুঁড়ো, ময়দার আঠা, হলুদ, খড়িগোলা রঙ, বার্নিশ, পুঁতি, জরি, পালক, রাংতা আর নানাবর্ণ রঙের সঙ্গে সাধারণ যন্ত্রপাতি। মাটি গদ, কাগজ চিটানো, কাবিজ লেপা, কাপড় সাঁটান, থাপি পালিশ, খুশনি খোঁচা বা নাক মুখ ও চোখ তীক্ষ্ণ করা এবং সাজানো এই সব প্রক্রিয়ার সাহায্যে গড়ে তোলা হয় মুখোশ। আগে ময়ূরের পালক ব্যবহৃত হলেও এখন তা নিষিদ্ধ। মোটামুটি গণেশ, দুর্গা, শিব, অসুর, মারীচ, শ্রীকৃষ্ণ, হনুমান, মা দুর্গা, ভীম, হিড়িম্বা, রাম-রাবণ, বাঘ-সিংহ, বকাসুর প্রভৃতির আদলে তৈরি হয় এই মুখোশগুলো। আজও প্রাচীন ঐতিহ্যধারা অনুসরণ করে এইসকল মুখোশ তৈরি হচ্ছে। তবে এখন বাজারে চাহিদা থাকায় শিল্পীরা চিরাচরিত মুখোশের পাশাপাশি ঘর সাজানোর জন্যও সাঁওতাল দম্পতির মুখ, নানা পশু-পাখি, ময়ূর এই পদ্ধতিতে তৈরি করছেন। যা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমরাও বড় রাস্তার ধারে 'দুর্গাচরণ ছৌ মুখোশ সেন্টার' থেকে ঘর সাজানোর জন্য গণেশ ও একজোড়া সাঁওতাল দম্পতির মুখোশ কিনে গাড়িতে চেপে রওনা দিলাম।
 |
| একটু মুখোশের আড়ালে |
আমাদের গন্তব্য ছিল বাঘমুণ্ডি ব্লকের কালিমাটি মোড়ের কাছে 'বিবেকানন্দ বিকাশ কেন্দ্র' স্কুলটিতে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চড়িদার সীমানা পেরোতেই বদলে গেল চারপাশের পরিবেশ। প্রকৃতি এখানে বেশ রুক্ষ, কেমন যেন একটা হাল্কা মেঠো বুনো গন্ধ। চারদিকে অনুচ্চ টাঁড়, আর সেই রুক্ষ টাঁড়ের মধ্যে পলাশ, তাল আর খেঁজুর গাছ। তবে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে পলাশ। ছোট-মাঝারি-বড় নানান আকারের পলাশ গাছ সারাটা এলাকা জুড়ে। মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্ত ভাবে তাল আর খেজুর গাছ খাড়া হয়ে একাকী দাঁড়িয়ে আছে।
 |
| পলাশের দেশে ঢুকে পড়েছি |
পলাশ বনের মধ্যে দিয়ে মিশকালো পিচ রাস্তায় গাড়ি ছুটিয়ে চলেছি। একটু দূরে বড় পাহাড় শ্রেণী অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। মাঝে মাঝে দু'চারটে আদিবাসী গ্রাম। রুক্ষতা আর সৌন্দর্যের অপরুপ মিশ্রণ দেখতে দেখতে চলেছি। সঠিক ঠিকানা না জানায় কালিমাটি পেরিয়ে গেলাম। তপোবন মোড় থেকে ঝালদার দিকে কিছুটা যাওয়ার পরই রাস্তার দু'পাশে দেখি একরাশ লাল। শুরু হলো রঙের খেলা। বুঝলাম, পলাশের দেশে ঢুকে পড়েছি। পলাশ মানেই পুরুলিয়া। আর এই পলাশের টানেই ছুটে আসে বহু মানুষ। যেদিকে চোখ যায় শুধুই পলাশ আর পলাশ। যেন রাস্তার দু'পাশে থোকায় থোকায় আগুন লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
 |
| পলাশ মানেই পুরুলিয়া |
আমাদের গাড়ির সাথে রীতিমতো পাল্লা দিচ্ছে সেই পলাশ গাছের সারি। গাড়িতে তখন গান বেজে চলেছে 'পিঁদাড়ে পলাশের বন, পালাব পালাব মন...'। আর একটু এগোতেই বান্ধডির জঙ্গল। দূরে জারগো বুড়ি পাহাড়। একটা 'বিউটি স্পষ্ট' দেখে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ি। রাস্তা থেকে পাহাড়ের গোড়া পর্যন্ত যতদূর দেখা যায় শুধু লাল পলাশের বন। টাঁড় জঙ্গলের বিরাট এলাকা জুড়ে ছোট-মাঝারি-বড় নানান আকারের পলাশ গাছ। বসম্তকালের শেষ, যেন কেউ পলাশ ফুল বনে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এতো ঘন লাল ভাবা যায় না! পলাশের এই অপরূপ শোভা দেখে মন ভরে গেলো। চোখ খুলে মন ভরে উপভোগ করার পাশাপাশি কিছু ছবিও তুললাম। শুরু হলো আবার এগিয়ে চলা। এরপর জারগো, ইচাগ মোড় পেরিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ঝালদা।
 |
| জারগো বুড়ি পাহাড় |
ঝালদার বিরসা মোড়ে পৌঁছে বিবেকানন্দ বিকাশ কেন্দ্রের তত্বাধায়ক অরবিন্দ ভট্টাচার্য মহাশয়কে ফোন করলাম। উনি আমাদের জানালেন আমরা স্কুল ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে এসেছি। আমাদের কালিমাটিতে যেতে হবে। অগত্যা কি আর, করি আবার গাড়ি ব্যাক করে ঘুরিয়ে নিয়ে হাওয়ার বেগে ছুটিয়ে চললাম বাঘমুণ্ডির দিকে। যাইহোক পৌঁছে গেলাম কালিমাটির মোড়ে। কালিমাটির মোড় থেকে ডানদিকে টার্ন নিয়ে চলে এলাম বিবেকানন্দ বিকাশ কেন্দ্রে। বাঘমুণ্ডি ব্লকের বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রচুর অসহায়, দুস্থ বাচ্চাদের নিয়ে অরবিন্দ বাবু এই আবাসিক স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি এই অঞ্চলে এরকম আরো কয়েকটা স্কুল তৈরি করেছেন। অতিথি আপ্যায়নের সুন্দর ব্যবস্থা করেছিলেন। আগে থেকেই আমাদের জন্য লাঞ্চের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। সুন্দর ঘরোয়া রান্না। প্রায় ঘন্টা খানেক পরে আবার রওনা দিলাম ঝালদা মোড়ের দিকে। ঝালদা ছাড়িয়ে আমরা এখন বাড়ির পথে। পিছনে পাহাড়ের সারি ফেলে গাড়ি ছুটে চলেছে রাঁচি-পুরুলিয়া হাইওয়েতে। পুরুলিয়া শহরের ভিতর দিয়ে যখন বাঁকুড়ার রাস্তা ধরেছি তখন দুধারের অন্ধকার যেন ঘন হয়ে সরে আসছে কাছে। হুড়ার পরে রাত্রি নামলো। গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে ধলডাঙ্গা বিষ্ণুপুর হয়ে পৌনে এগারোটায় ঘরে ফিরলাম।
 |
| পিছনে পাহাড়ের সারি ফেলে গাড়ি ছুটে চলেছে |
» প্রয়োজনীয় তথ্যঅযোধ্যা পাহাড়ে বেশ কয়েকটা দ্রষ্টব্য আছে, তবে সেগুলো দেখতে চাইলে একটু সময় নিয়ে বেরোতে হবে। সীতাকুণ্ড, পিপিএসপি আপার ও লোয়ার ড্যাম, মার্বেল লেক, বামনি ফলস, কেষ্ট বাজার ড্যাম, লহরিয়া শিব মন্দির, টুরগা ফলস, টুরগা লেক, ডহরি খাল, পাখি পাহাড়, পারডি লেক, মুরগুমা ড্যাম, ময়ূর পাহাড়, খয়রাবেড়া ড্যাম এবং চড়িদা মুখোশ গ্রাম এগুলো না দেখলে অযোধ্যা পাহাড় ভ্রমণ অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।
» থাকার ব্যবস্থাঅযোধ্যা পাহাড়ের হিল টপে এবং পাহাড়ের নীচে বাঘমুণ্ডিতে থাকার জন্য অনেক হোটেল ও লজ আছে। কিন্তু সাধ্যের মধ্যে সেরা ঠিকানা হিল টপে সিএডিসি'র ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্স। এখানে কম বেশি বিভিন্ন রেঞ্জের থাকার ব্যবস্থা আছে। নীহারিকা, মালাবিকা, মানসী, মালঞ্চ, অনামিকা, বলাকা, বিভাবরী, উপেক্ষিতা এরকম বিভিন্ন নামের গেস্টহাউস রয়েছে। এছাড়াও তৃষা ও অপরাজিতা দুটো স্যুট আছে। আহারাদির জন্য রয়েছে হিল টপ হোটেল, হিল ভিউ হোটেল, হোটেল পরিবার, জয় শ্রীগুরু হোটেল, জগবন্ধু হোটেলে।
- সিএডিসি গেস্ট হাউসঃ- +৯১ ৩২৫২২২৫৭২৬, +৯১ ৩৩২২৩৭৭০৪১, +৯১ ৮০০১৯৩৪০৫৮, +৯১ ৭৫০১৫২৪৩৪৫
- কুশলপল্লী রিসর্টঃ- +৯১ ৯৮৩১২৬০৬০৬, +৯১ ৯৭৩৫১৫১৫১৫
- অযোধ্যা পাহাড় ইয়ুথ হোস্টেলঃ- +৯১ ৬২৯২২৪৮৮৭০
- অযোধ্যা হিল টপ টুরিস্ট লজঃ- +৯১ ৯৬৩৫০৭৬০৫৯
- অযোধ্যা হিল আর্কেডঃ- +৯১ ৯৮৩১৯৭৬৪৫২
- অযোধ্যা গেস্ট হাউসঃ- +৯১ ৮৩৪৮৬৯৩৪০০, +৯১ ৯৪৩৪০৩৩১৪৫
- হোটেল পলাশঃ- +৯১ ৯৯৩২৩৪৩৪৫০, +৯১ ৭৭৯৭৬৬৪৪২১, +৯১ ৭৩১৯৮২৯১৮৫
- ভারত সেবাশ্রম সংঘঃ- +৯১ ৩২৫২২০২৮৯৪, +৯১ ৯৬৩৫১১৪৯৯৮, +৯১ ৯৪৩৪৮৭৭৫৭০
- বিরস মুন্ডা রিসর্টঃ- +৯১ ৯০০২৪৬২৫৮৯, +৯১ ৭৬৭৯৮৭১৪৩৫
- আলপনা লজঃ- +৯১ ৭০৪৭৯৭২১৯৩
- দীপশিখা লজঃ- +৯১ ৯৫৬৪১৬৯৫৯১, +৯১ ৮৯৭২১৩১০৭৯
- দুর্গা লজঃ- +৯১ ৮০০১৩৯১২২৩
- পরিবার লজঃ- +৯১ ৮১৫৯৮৫০০৪৪, +৯১ ৯৫৬৪৮৯৩৭০০
- আলপনা লজঃ- +৯১ ৭০৪৭৯৭২১৯৩
- পার্বতী লজঃ- +৯১ ৮৬১৭০৫৯৫৩৪, +৯১ ৯৫৯৩৫৪২২৫৪
- অমিত হোমস্টেঃ- +৯১ ৯৭৩৫৯৩৮৪৩১, +৯১ ৬২৯৪৪৫৭৫০৬
- সুদীপা হোমস্টেঃ- +৯১ ৮৯৭২৪৩০২৭১, +৯১ ৭৮৬৩৯৭৪১৮৭
- সান হোমস্টেঃ- +৯১ ৭০৭৬৩০৭৮৩০, +৯১ ৮৯৭২০৮০৫১৭
- হোটেল হিল কুইনঃ- +৯১ ৯৯৩২৭৯০০১৩
- বীণাপাণি আবাসনঃ- +৯১ ৭৪৭৭৩৩৩৬১৩
- আরণ্যক লজঃ- +৯১ ৯৯৩২৭২৫৫৫৫, +৯১ ৯৭৩২৩৯৪১১৫
- অযোধ্যা হিল ভিউ লজঃ- +৯১ ৯০০৭৫০৯৯৫৫, +৯১ ৯৮৩০৫১৩০৩৮
- মানভুম ট্যুরিস্ট লজঃ- +৯১ ৯৭৩৪৭৭৬৮৯৪
- শুভম ট্যুরিস্ট লজঃ- +৯১ ৮০০১৬৮০৮৫৭, +৯১ ৯৭৭৫৩৮৯০০১
- কঙ্কা টুরিস্ট লজঃ- +৯১ ৯৭৩২১৩৪৬৫৬
- রেনুকা লজঃ- +৯১ ৯৬৪৭৫৯৫০৭৩, +৯১ ৯৭৩২০৮৯০৪১
- শ্রী দুর্গা লজঃ- +৯১ ৯৭৭৫৩৬৩৮৩৩, +৯১ ৯৯৩৩৯০৭৩৪৮
- হিল পয়েন্ট লজঃ- +৯১ ৯৪৭৪৫১০৭৪৭
- কল্পনা অযোধ্যা ট্যুরিস্ট লজঃ- +৯১ ৮৯৪৬০০৩১২৫, +৯১ ৯৮০০৯৩৮৯৭১
- কান্তি লজঃ- +৯১ ৮৯৪৪৯৫৩৬৭৮, +৯১ ৯৭৩২২২৭৬২০, +৯১ ৯০০২৯৪৫১২৭
- রঘুনাথ টুরিস্ট লজঃ- +৯১ ৮৬১৭৮৮৫৪২৭, +৯১ ৯৬৪৭৬১৩৩৩৯
- শোভালয় টুরিস্ট লজঃ- +৯১ ৯৭৩৩২৩০৩২২, +৯১ ৭৩৬৩৯৬৩৫২৬
- ষ্টার লজঃ- +৯১ ৯০০২১১৪৭০১, +৯১ ৯১২৬৯৫০৫০৮
- অযোধ্যা ফুট হিলসঃ- +৯১ ৯৪৩৪৬৯১২৫০
- ছৌ-বুরু হোমস্টেঃ- +৯১ ৯৭৩২২৯৪৫১৫, +৯১ ৯৬৩৫৭৭৩৩০১
- অযোধ্যা গেস্ট হাউসঃ- +৯১ ৮৯১০৯৭২০১৪
- পলাশ কুসুমঃ- +৯১ ৯৭৩৩২৮৩৬৮১
- অভয়া রেস্ট হাউসঃ- +৯১ ৮৭০৯৩৮০৮০৪, +৯১ ৮৬১৭৬৩০১৫৬
- পলাশ আবাসনঃ- +৯১ ৭৭৯৭৭৬৬৪৪২১, +৯১ ৮৬১৭৩৪৮৩২৩, +৯১ ৭৩১৯৮২৯১৮৫
- অম্বিকা রেসিডেন্সিঃ- +৯১ ৯৭৩২০০৬৫৯০
» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ- 'অহল্যাভূমি পুরুলিয়া' - দেবপ্রসাদ জানা, 'পুরুলিয়া' - তরুণদেব ভট্টাচার্য্য)
AJODHYA PAHAR, PURULIA, BAGHMUNDI, JHALDA, WEST BENGAL
No comments:
Post a Comment