 |
| পাহাড়ে কোলে বাসাডোরা গ্রাম |
বাসাডোরায় দেখি রাস্তার পাশে জনাকয়েক যুবক দাঁড়িয়ে। প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলাম না..., এক আদিবাসী যুবক একগাল হেসে আমাদের গাড়ি আটকে ৫০ টাকা দাবি করলো। প্রশ্ন করতেই সে জানালো সরকার থেকে কোনো সাহায্য না পেয়ে তারা নিজেরাই পরিশ্রম করে এই রাস্তাটা গাড়ি চলাচলের উপযোগী করে তুলেছে। পারিশ্রমিক হিসেবে এই টাকাটা তাদের দিতে হবে। ২০ টাকা, ৩০ টাকা... এভাবে বেশ কিছুক্ষণ তর্ক বিতর্কের পর দেখলাম সময় নষ্ট না করে ৫০ টাকা দিয়ে দেওয়াই ভালো। অতএব পাঁচটা দশ টাকার নোট হাতে গুঁজে দেওয়ার পর ওই রাস্তায় যাওয়ার ছাড়পত্র মিলল। এরপর অত্যন্ত খারাপ কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে আমরা এসে পৌঁছালাম ধারাগিরি ঝর্ণার সামনে...
 |
| ধারাগিরি পৌঁছালাম |
গাড়ি পার্কিং করে নামতেই দেখি গ্রামের কচিকাঁচারা আমাদের ঘিরে ধরেছে, চেহারায় দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট... ব্যপারটা ঠিক একটু পরে বুঝতে পারলাম, ওই খুঁদেরাই এখানের গাইড... ঝর্ণার কাছে তারাই নিয়ে যায়। আমাদের কোনো গাইড প্রয়োজন নেই বললেও তারা নাছোড়বান্দা। ঠিক আছে, যেকোনো একজন আয় আমাদের সাথে... ব্যাস শুরু হয়ে গেলো এবার নিজেদের মধ্যে ঝগড়া। আমরাও ওদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে জঙ্গলের পথে হাঁটা লাগলাম।
 |
| পাথুরে রাস্তায় সাবধানে পা বাড়িয়ে চলেছি |
কিছুটা এগোতেই দেখি একটা সরু নালা পেরোনোর জন্য তার উপর গাছের ডাল দিয়ে বানানো রাস্তা। নালার অপরদিকে গুটি কয়েক বাচ্চা টোল আদায়ের জন্য বসে আছে। সেই ডালপথ দিয়ে যেতেই তারা এগিয়ে এলো। "এই, দশ টাকা দে ...", "কেন রে ??...", এই ব্রিজটা ওদের বানানো সেই জন্য টোল দিতে হবে। শেষমেশ ওই খুঁদে বাচ্চার দলকে টোল দিয়ে রেহাই পেলাম। হেঁটে চলা পথ, বেশ মজাদার ও রোমাঞ্চকর।
 |
| ধারাগিরি ঝর্ণা |
ধারাগিরিতে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ছবিটবি তুলে আবার রওনা দিলাম বুরুডি লেক ও ড্যামের উদ্দেশ্যে। ধারাগিরি থেকে একটু এগুতেই রাস্তার একপাশে দেখি একটি ময়ূরী দাঁড়িয়ে। এই দৃশ্য দেখে আমরা না থেমে চলে যেতে পারিনি, গাড়ি থেকে নামলাম। স্থানীয় এক ছোকরা বললো এই বনে খুব ময়ূর দেখা যায়। ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারলাম না। ক্যামেরা বের করে ফটাফট ছবি তুলতে শুরু করে দিলাম।
 |
| ধারাগিরির পথে ময়ূরী |
এদিকে বুরুডিতে কার্তিকদার হোটেলে এসে দেখি আমাদের দুপুরের খাবার রেডি। মাটির রান্নাঘরের একধারে পরপর চেয়ার টেবিল পাতা। লেকের হাওয়ায় ছাউনির একধারে বসে কাঠের উনুনে রান্না করা গরম গরম ভাত, ডাল, সব্জি, আলুভাজা, দেশি মুরগির ঝোল, পাঁপড় ভাজা আর আমড়ার চাটনি সব মিলিয়ে ১৫০ টাকা! আর কী চাই...।
 |
| কার্তিক ভুঁইয়ার হোটেল |
রান্নাটা বেশ সুস্বাদু হয়েছিল। খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়লাম ড্যামের ওপর ঘুরতে। ঘাটশিলার ভ্রমণের সেরা আকর্ষণ এই বুরুডি লেক। নির্জনতা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও বুনো গন্ধের এক অদ্ভুত মাদকতা মেশানো রয়েছে এই বুরুডিতে।
 |
| নেমে গেলাম লেকের জলকে ছুঁতে |
ট্যুরিস্টের চাপ নেই, তাই লোকজনের বিশেষ আনাগোনা নেই। যদিও শীতকালে পিকনিকের সময় শান্ত কোলাহলহীন এই জায়গার চেহারাটাই পাল্টে যায়। মনপ্রাণ ভরে আমরা লেকের সৌন্দর্য্য উপভোগ করলাম। ছবির মত সুন্দর পাহাড়-ঘেরা ছোট্ট এক লেক। টলটল করছে পরিষ্কার স্বচ্ছ জল। আর সেই জলে সামনের পাহাড়ের ছবি প্রতিফলিত হওয়ার দৃশ্যটি একেবারে অনবদ্য।
 |
| স্বচ্ছ টলটলে জল |
শান্ত লেকের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে ড্যামের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছি। ড্যামের পাড়ে বাঁধানো সিঁড়ি দেখে ইচ্ছে হলো লেকের জলকে ছুঁতে। টলটলে জলে হাত না ছুঁয়ে ফিরে আসা যায় না। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলাম। ঘাটে বেঁধে রাখা প্যাডেল বোটে পা দুলিয়ে চললো ইচ্ছেমত ফটোশুট।
 |
| ড্যামের ধারে কিছুক্ষণ |
বুরুডি লেক থেকে ফেরার পথে দেখলাম ড্যামের পাশে পর্যটকদের জন্য বিনোদন ও বিশ্রামের একটা জায়গা তৈরি হয়েছিল কিন্তু এখন সেটা পরিত্যক্ত। আমরা চললাম ঘাটশিলা শহরের দিকে... আমাদের গন্তব্য 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসের অপু-দুর্গা চরিত্রের স্রষ্টা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বসতবাটি। ঘাটশিলা শহরের কলেজ রোড ধরে চলেছি। একটু এগিয়ে রাস্তার পাশে ডানদিকে তালা বন্ধ অবস্থায় দেখতে পেলাম 'বিভূতি স্মৃতি সংসদ ভবন'। মেন রোডের ধারে একতলা বাড়িটি বিভূতীভূষণের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি একটি লাইব্রেরী। লাইব্রেরি ভবনের সামনে তাঁর একটি মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে লাইব্রেরীটা একবার চক্কর কেটে চললাম ডাহিগোড়ার দিকে। রেল ব্রিজ পেরিয়ে ডাহিগোড়ার রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি।
 |
| বিভূতি স্মৃতি সংসদ ভবন |
ব্রিজ ছাড়িয়ে চলে এলাম ডাহিগোড়ায় 'রামকৃষ্ণ মঠে'। ভাবলাম মঠের ভিতরটা তাহলে একটু ঘুরে আসা যাক। রাস্তার সাইডে গাড়ি রেখে গেট পেরিয়ে চলে এলাম রিসেপশন অফিসে। এখানে থাকার বিষয়ে খুঁটিনাটি আলোচনা করে রিসেপশন থেকে বেরিয়ে মঠ চত্বরটি একটু ঘুরে দেখলাম। পরিষ্কার-পরিছন্ন, শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ; সত্যিই মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। গাছ ভরা থোকা থোকা রঙীন ফুল আর তার মিষ্টি গন্ধে যেন মন জুড়িয়ে যায়। ঘাটশিলা বেড়াতে গিয়ে যারা ভাবছেন থাকবেন কোথায়! এরকম সুন্দর জায়গায় থাকার জন্য অবশ্যই যোগাযোগ করতে পারেন এই 'রামকৃষ্ণ মঠে'।
রামকৃষ্ণ মঠের বুকিং পদ্ধতিটা একটু অন্যরকম। ওয়েবসাইটে গিয়ে অথবা ই-মেইল পাঠিয়ে বুকিং পাওয়া যাবে কিনা জেনে নিতে হবে। ওয়েবসাইট : rkmathghatshila.org ই-মেইল : ghatshila@rkmm.org অথবা rkmathgts@gmail.com
এসি নন-এসি দুরকমেরই রুম পাওয়া যায়। সিঙ্গেল, ডাবল, ট্রিপল, ফোরবেড, ডরমেটরি সব রকমের রুম আছে। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার সহ মোট পাঁচবারের খাবার নিয়ে বর্তমানে একজনের একদিনের থাকা খাওয়া খরচ এসি রুমের জন্য ৭০০ টাকা এবং নন-এসি রুমের জন্য ৫০০ টাকা এবং ডরমেটরি ৪০০ টাকা।
 |
| রামকৃষ্ণ মঠ |
মঠ থেকে বেরানোর একটু পরেই আমরা সার্কাস ময়দানের গা ঘেঁষে বাঁদিকের একটা গলি রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। রাস্তাটি 'অপুর পথ' হিসেবে পরিচিত। এই 'অপুর পথ' ধরেই পৌঁছে গেলাম ডাহিগোড়ায় বাঙালির আবেগের ঠিকানা বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ি। বিভূতিভূষণ বরাবরই প্রকৃতি প্রেমিক ছিলেন। ঘাটশিলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে এখানে একটি বাড়ি কেনেন। টালির চালের একতলা বাড়ি। এটাই ছিল বিভূতিভূষণের ঘাটশিলার ঠিকানা।
 |
| বিভূতিভূষণের বসতবাটি 'গৌরীকুঞ্জ' |
বাড়িটারও একটা গল্প আছে। ঘাটশিলার এই বাড়িটি বিভূতিভূষণ নিজের ইচ্ছেই কেনেননি। বিষয়,আশয়, সম্পত্তি কেনা এসব ব্যাপারে তাঁর খুব একটা আগ্রহ ছিল না। বাড়িটা আগে ছিল অশোক গুপ্তের। উচ্চ শিক্ষিত গুপ্ত সাহেব ছিলেন একজন বিলেত ফেরত আদর্শবাদী শিক্ষাবিদ। গুপ্ত সাহেব ঘাটশিলার গ্রাম্য নির্জন পরিবেশে এই বাড়িটি তৈরি করেন। অবসরপ্রাপ্ত জীবনে অশোক গুপ্ত এই বাড়িটিতে বিকলাঙ্গ ও মানসিক অপরিণত শিশুদের জন্য একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। ঐ সময়ে গুপ্ত সাহেব আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়ে বিভূতিভূষণের কাছে পাঁচশত টাকা ধার নিয়েছিলেন। বেশ কয়েক বছর পর, একদিন গুপ্ত সাহেব বিভূতিভূষণকে জানালেন যে তিনি ওই ঋণের টাকা জোগাড় করতে পারেননি। পরিবর্তে ঘাটশিলায় যে বাড়িটা তৈরি করেছে সেই বাড়িখানা নিয়ে নিয়ে যেন তাকে ঋণমুক্ত করেন। একখানা বাড়ির দাম মাত্র ৫০০ টাকা ভেবে প্রথমে বিভূতিভূষণ প্রচণ্ড আপত্তি জানালেও পরে বাড়িটি গুপ্ত সাহেব তাঁকে রেজিষ্ট্রি করে দিয়ে গেলেন। বিভূতিভূষণ তাঁর প্রথম স্ত্রী গৌরী দেবীর স্মৃতিরক্ষার উদ্দেশ্যে বাড়ির নাম রাখলেন 'গৌরীকুঞ্জ' এবং তিনি শেষ জীবন পর্যন্ত এখানেই কাটিয়েছিলেন।
 |
| গৌরীকুঞ্জে প্রদীপদার সঙ্গে |
গৌরীকুঞ্জের গেট খোলায় ছিল, রাস্তার মোড়ে একটি কর্ণারে গাড়ি রেখে গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকেই দেখি ছোট্ট সবুজ মাঠ, তুলসিমঞ্চ ও একটি আম গাছ, গাছটি সাহিত্যিক বিভূতিভূষণের ভাই নুটবিহারী লাগিয়েছিলেন। বাড়ির সামনে চোখে পড়লো বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের একটি আবক্ষ মূর্তি। মূর্তির পাশেই রয়েছে বসার জন্য কংক্রিটের তৈরি একটি বেঞ্চ। অতিথি বলতে কেবল আমরা তিনজন। উন্নয়ন সমিতির সদস্য তথা গৌরীকুঞ্জের দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রদীপ-দা (প্রদীপ ভদ্র) আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। ভীষণ ভালো মনের মানুষ। সহজেই মানুষের সাথে মিশে যান। জুতো খুলে প্রণাম করে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলাম।
 |
| শিল্পীর তুলিতে বাড়ির দেওয়াল |
শিল্পীর তুলিতে বাড়ির দেওয়ালে ফুটে উঠেছে তাঁর জীবনের নানা ঘটনাবলি। এই বিভূতি-সদনেই লেখকের রন্ধন কক্ষ, বিশ্রাম কক্ষ এবং শয়ন কক্ষ এই তিনটি ঘর নিয়ে তৈরি হয়েছে একটি সংগ্রহশালা। সংগ্রহশালার ওই তিনটি ঘরে সযত্নে রাখা আছে লেখকের ব্যবহৃত কয়েকটি পোশাক, চিঠি, লেখকের রচনাবলী ও কিছু পুরানো ছবি এবং লেখকের নিজের হাতে লেখা 'পথের পাঁচালি'র পাণ্ডুলিপি; রয়েছে দেওয়াল পত্রিকাও।
 |
| লেখকের ব্যবহৃত পোশাক |
প্রদীপ বাবুর কাছে গৌরীকুঞ্জের বিষয়ে অনেক কিছুই জানতে পারলাম। বিভূতিভূষণের এই বাড়িটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল। বছরকয়েক আগে 'গৌরীকুঞ্জ উন্নয়ন সমিতি'-র সভাপতি তাপস চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে এবং বিভূতি-পুত্র তারদাস বন্দোপাধ্যায় ও পুত্রবধূ মিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় পুরাতন জরাজীর্ণ টালির বাড়িটির সংস্কার করা হয়েছে। গৌরীকুঞ্জের এই বিভূতি-সদন যাঁরা দেখতে আসেন তাঁরা একটি খাতায় নিজেদের মন্তব্য ও স্বাক্ষর করেন এবং উন্নয়নের জন্য যথাসাধ্য অর্থসাহায্যও করে থাকেন। এই সকল রক্ষণাবেক্ষণের বেশীরভাগটাই অনুদানের ওপর ভরসা করে চলছে।
 |
| বিভূতিভূষণের পুরাতন বাড়ি |
গৌরীকুঞ্জ চত্বরে গঠিত হয়েছে 'তারাদাস মঞ্চ'। বিভূতিভূষণের পুত্র তারদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে এই মঞ্চের নামকরণ হয়েছে। সপ্তাহের একটি দিন, রবিবার সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত এই তারাদাস মঞ্চে কচিকাঁচাদের নিয়ে শতরঞ্জি পেতে বসে পাঠশালা। নাম দেওয়া হয়েছে 'অপুর পাঠশালা'। বিভূতিভূষণের পুত্রবধূ মিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্মতিতে গৌরীকুঞ্জ উন্নয়ন সমিতি এই বাংলা শেখার অবৈতনিক স্কুলটি স্থাপন করেছে। ঝাড়খণ্ডের মূল সংস্কৃতিটাই বাংলা কেন্দ্রিক। কিন্তু আজ সেখানে বাংলা ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রদীপ বাবুর মতো কিছু বাংলা অনুরাগী মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে বরেণ্য সাহিত্যিকের এই স্মৃতিটুকুকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের এই বাড়িটি হেরিটেজ তালিকায় স্থান পেতে সরকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য প্রতিটি পর্যটকদের কাছে সেই দাবি তুলে ধরার আবেদন জানিয়ে যাচ্ছেন।
 |
| 'অপুর পাঠশালা' |
গৌরীকুঞ্জের মাটি ছুঁয়ে সাহিত্য-মনীষীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা চলে এলাম মৌভান্ডারে। এখানেই রয়েছে 'হিন্দুস্তান কপার লিমিটেড' বা এইচসিএল-এর ফ্যাক্টরি। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সুবর্ণরেখা নদী। নদী পেরোলেই 'রাতমোহনা'। কপার ফ্যাক্টরির গা ঘেঁষে সুবর্ণরেখার ওপর মোহন কুমারমঙ্গলম ব্রিজ। নতুন ব্রিজের পাশাপাশি পুরানোটাও রয়েছে।
 |
| 'হিন্দুস্তান কপার লিমিটেড' ফ্যাক্টরি |
কুমারমঙ্গলম ব্রিজ পেরিয়ে ডান দিকে আরও খানিকটা গিয়ে রাতমোহনার পাড়ে একটা গাছের ছায়ায় গাড়ি দাঁড় করলাম। গাড়ি থেকে নেমে ক্যামেরা বের করতে গিয়ে স্বরূপের তখন খেয়াল হলো গৌরীকুঞ্জে ক্যামেরাটা ফেলে এসেছে। প্রদীপদার মোবাইল নম্বরটা আমার কাছে ছিল, সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে ক্যামেরার ব্যাপারটা জানিয়ে রাখলাম। গাড়িতে আমার ডিএসএলআরটা ছাড়া সঙ্গে আরও একটা ক্যামেরা ছিল। সেটা সাথে নিয়ে নেমে গেলাম নদীর কাছে।
 |
| মোহন কুমারমঙ্গলম ব্রিজ |
নদীর পাড়ে একদিকে শ্মশান আর শ্মশানের পিছনেই ছোট্ট একটা ঝর্ণা..., ঝর্ণার জল সশব্দে উপর থেকে আছড়ে পড়ে মিশেছে সূবর্ণরেখা নদীতে। নদীর বুকে ছোট বড় অনেক পাথর খন্ড তার মধ্যে বহু পুরোনো একখানা ব্রিজ ভেঙে পড়ে রয়েছে। আর সেই ভাঙা ব্রিজের ফাঁকা অংশের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা নদীটি।
 |
| রাতমোহনায় নদীর ঝর্ণা |
কয়েকটা বাঁশের তৈরি খাঁচা ঐ ভাঙা ব্রিজের একপাশে নদীর মধ্যে রাখা, সেখানে দেখা গেলো কয়েকজন মাছ ধরছে। সাহস করে ভাঙা ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে গেলাম সেই মাছ ধরা দেখতে। এখানে নদীতে মাছ ধরার পদ্ধতি দেখবার মতো। আমরা যেভাবে মাছধরা দেখে অভ্যস্ত তার থেকে একদম আলাদা রকমের।
 |
| চলছে মাছ ধরা |
একদিকে ঝর্ণা অন্যদিকে সূবর্ণরেখা নদীর স্রোতের মধ্যে চলছে মৎসজীবিদের মাছ ধরা পর্ব, কিছু দূরে ছোট বড় পাহাড় টিলা। মন ভরানো এমন প্রাকৃতিক দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি না করে কি থাকা যায়? অতএব এখানে বেশ কিছুক্ষণ সময় ধরে চললো ফটোসেশন।
 |
| 'রাতমোহনা' |
সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। সন্ধ্যে নামছে আকাশে, দুচোখে প্রশান্তির ছোঁয়ায় আমরা ফেরার পথ ধরলাম। এদিকে স্বরূপ আবার গৌরীকুঞ্জে ক্যামেরা ফেলে রেখে এসেছে, অতএব গাড়ি শহরের রাস্তা ধরে চললো। ডাহিগোড়ায় সার্কাস ময়দানের কাছে মোড়টায় গাড়ি থেকে নেমে স্বরূপ একাই পায়ে হেঁটে চলে গেলো ক্যামেরা আনতে। অনেকক্ষণ ধরে আমরা অপেক্ষা করছি রাস্তার মোড়ে। একসময় দেখি ক্যামেরা হাতে গৌরীকুঞ্জ থেকে বেরিয়ে আসছে স্বরূপ, মুখে স্বস্তির এক স্মিত হাসি। আমাদের বললো, প্রদীপ বাবু এক কথায় অসাধারণ সহযোগী ও সৌহার্দ পূর্ণ মনোভাবের। পর্যটকদের ফেলে আসা মোবাইল ক্যামেরা সব যত্ন সহকারে রেখে দেয়।
ঘাটশিলার প্রসিদ্ধ মিষ্টির স্বাদ নিতে হলে অবশ্যই যেতে হবে ডাহিগোড়া রোডের 'শ্রী গণেশ কালাকাঁদ'-এ এবং রসমালাই-এর জন্য কলেজ রোডের 'রতন সুইটস'-এ
ফিরে চলেছি ডাহিগোড়ার পথ ধরে। রামকৃষ্ণ মঠ পেরোতেই হঠাৎ চোখে পড়ল ছোট্ট একটা দোকান ''গণেশ মিষ্টান্ন ভান্ডার'। স্বরূপের কাছে নামটা আগেই শুনেছিলাম। এনারা কালাকাঁদ ছাড়া অন্য কোনো মিষ্টি তৈরিও করে না। ঘাটশিলায় এসেছি আর গণেশের কালাকাঁদ না নিয়ে ফেরা যায় নাকি? গাড়ি থামিয়ে সোজা দোকানে। গিয়ে দোকানের মালিকের কাছে শুনলাম আগে থেকে অর্ডার না দিলে পাওয়া যায়না। আজ অর্ডার দিলে আগামীকাল পাওয়া যাবে। বাড়িতে নিয়ে যাবো বলে অনেক আশা করে গিয়েছিলাম; সত্যি বলতে কি, আমাদের চরম হতাশ করলেন। আমাদের গাড়ি কিছু সময় পর কলেজ রোড ছেড়ে শহরের বাইরে মুম্বাই রোডে উঠে পড়লো। ভালো রাস্তা পাওয়ার সাথে সাথে গাড়ির গতিও বেড়ে গেলো। হেডলাইটের জোরালো আলোয় রাতের অন্ধকার চিরে গাড়ি হুহু করে ঘাটশিলা ছেড়ে ক্রমশ কোলকাতার দিকে ছুটে চললো।
 |
| 'ফেরার পথ ধরলাম' |
» থাকার ব্যবস্থা
ঘাটশিলায় থাকার সবচেয়ে ভাল জায়গা ঝাড়খন্ড ট্যুরিজমের ট্যুরিস্ট লজ 'বিভূতি বিহার' ও 'রামকৃষ্ণ মঠ'। ঘাটশিলায় মধ্য মানের বেশ কয়েকটি হোটেল ও লজ আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুহাসিতা রিসর্ট, হোটেল সাফারি, হোটেল জে. এন. প্যালেস, হোটেল আশ্রয়, হোটেল স্নেহলতা, হোটেল হাভেলি স্টেশন এর কাছে হোটেল আনন্দিতা প্যালেস, হোটেল আকাশদীপ এছাড়া রয়েছে সুবর্ণরেখা নদীর পাশে রিসর্ট অন্বেষা, হোটেল রিভার ভিউ, ধারাগিরির কাছে আরণ্যক রিসর্ট।
» ঘাটশিলার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হোটেলের ওয়েবসাইট ও মোবাইল নম্বর- বিভূতি বিহারঃ- +৯১ ৬৫৮৫২২৬৫০৬, +৯১ ৯০৯৭৭২২৬০০
- রামকৃষ্ণ মঠঃ- +৯১ ৯৪৭১৭৯৪২৪৩
- সুহাসিতা রিসর্টঃ- +৯১ ৯৭৭১৮৩১৮৭৭
- হোটেল আনন্দিতা প্যালেসঃ- +৯১ ৬৫৮৫২২৫৬২৪
- হোটেল আকাশদীপঃ- +৯১ ৯৪৩১৫৪৩৯৬৮
- আরণ্যক রিসর্টঃ- +৯১ ৭৩৬৭০৭০২০৩
» ঘাটশিলার বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান- বুরুডি লেক
- ধারাগিরি ফলস্
- বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের বসত বাটি 'গৌরীকুঞ্জ'
- ফুলডুংরি পাহাড়
- ডাহিগোড়ায় শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ
- বিভূতি স্মৃতি সংসদ ভবন (লাইব্রেরি)
- ঘাটশিলা রাজবাড়ি ও সূর্য মন্দির
- চিত্রকূট পাহাড়
- রাতমোহনা
- সিদ্ধেশ্বর পাহাড় ও রাণীমার চাতাল
- রঙ্কিণী দেবীর মন্দির (জদুগোড়া)
- নারওয়া ফরেস্ট
- গালুডি ড্যাম
» গৌরীকুঞ্জ খোলার সময়
সকাল ৯:০০ টা থেকে দুপুর ১:০০ টা এবং দুপুর ৩:০০ টে থেকে বিকেল ৫:৩০ টা পর্যন্ত
» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ- প্রদীপ ভদ্র - গৌরীকুঞ্জ উন্নয়ন সমিতি)
BURUDI, DHARAGIRI, RAATMOHONA, GOURIKUNJO, GHATSHILA, PURBA SINGBHUM, JHARKHAND
No comments:
Post a Comment