এভাবে আর কতদিন? ঘরে থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাচ্ছি। জানিনা করোনা থেকে কবে মুক্তি পাবো! তবে পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই একঘেয়ে জীবন থেকে নিজেকে সতেজ রাখতে ছোট খাটো ট্যুর-এ বেরিয়ে পড়ি। প্রতিবারের মতো এবারও ছুটির দিনগুলো কাটাতে চললাম 'চারমূর্তি' খ্যাত টেনিদার কাঁকড়াঝোরে। কাঁকড়াঝোর মানে শুধুই জঙ্গলের হাতছানি। কাঁকড়াঝোর মানে শাল মহুয়ার বুনো গন্ধ গায়ে মেখে পাহাড় আর গাছেদের সংসারে রোমাঞ্চকর পথে ঘুরে বেড়ানো। কাঁকড়াঝোর মানে কিছু সহজ সরল আদিবাসী মানুষজনের অনাড়ম্বর জীবনযাপন চাক্ষুষ করা। সব মিলিয়ে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়ার সব রসদই মজুত রয়েছে কাঁকড়াঝোরে। আঞ্চলিক ভাষায় 'কাঁকড়া' শব্দের অর্থ পাহাড় আর 'ঝোর' শব্দের অর্থ জঙ্গল। সত্যি কি তাই? হ্যাঁ একদমই সত্যি! পাহাড় ঘেরা বিস্তীর্ন জঙ্গলের মাঝে নিরিবিলি আর শান্তিতে বেড়ানোর একটা আদর্শ জায়গা।
 |
| কাঁকড়াঝোর মানে শুধুই জঙ্গলের হাতছানি |
করোনা আতঙ্ক ভুলে একঘেয়ে জীবনে একটু অক্সিজেন জোগাতে উৎপলকে সঙ্গে করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম শাল, পিয়ালের বনের দিকে। মেদিনীপুর শহর ছাড়িয়ে ভাদুতলার মোড় থেকে টার্ন নিয়ে লালগড় হয়ে দহিজুড়ি, সেখান থেকে সোজা শিলদা মোড় পেরিয়ে চলে এলাম বেলপাহাড়ি ইন্দিরা চকে।
আমাদের ডেস্টিনেশন 'কাঁকড়াঝোর'; তবে তার আগে ঘুরে নেবো 'লালজল'। 'লালজল'..... নামটা শুনেই কেমন যেন একটা নেশার ঘোর চলে এলো। একদম ঠিক, এই লালজলের নেশায় গাড়ি ছুটে চললো বাঁশপাহাড়ির দিকে। প্রকৃতির নেশায় ঘোর লেগেছে। এইতো কিছুদিন আগে এই 'বারোমাইল' জঙ্গলের রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে দলমা থেকে ঘুরে এলাম। তবুও মন ভরেনি, তাই আবার ছুটলাম। ভুলাভেদা, যাতিহারা পেরিয়ে চলে এলাম জামতলগোড়া। সিআরপিএফ ক্যাম্পের পর আরও একটু এগিয়ে যেতেই পড়ল লালজল মোড়। এখান থেকে প্রায় দু-কিলোমিটার ভিতরে লালজল গ্রাম। মেন রোড ছেড়ে ডান দিকের ভাঙাচোরা লাল মেঠো রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। বহু কসরত করে গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে গেলাম লালজল গ্রামে।
 |
| পৌঁছে গেলাম লালজল গ্রামে |
ঝাড়গ্রামের পর্যটন মানচিত্রে এক উল্লেখযোগ্য নাম 'লালজল'। দেওপাহাড়, রানীপাহাড় আর সিংলহর পাহাড় দিয়ে ঘেরা ছোট্ট এক গ্রাম লালজল। বাড়িঘরের বালাই নেই। গুটিকয়েক গ্রাম্য বাড়ি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। কিন্তু কি আছে এই লালজল গ্রামে?
শুনেছি এই লালজল গ্রামের দেওপাহাড়ে রয়েছে আদিম মানুষের গুহা। রাস্তার একপাশে বোর্ডে লেখা 'লালজল দেবী পাহাড়'। জঙ্গলঘেরা এক পাথরের পাহাড়। আমাদের আকর্ষণ এই লালজল দেবী পাহাড়কে ঘিরে। লালজল দেবী পাহাড়ের প্রকৃত নাম 'দেওপাহাড়'। পাহাড়ের কোলে একটা আশ্রম আছে। সাধু-সন্ন্যাসীদের বসবাস ওখানে। গুহার ঠিক একধাপ নিচে একটা দুর্গা মন্দির।
 |
| পাহাড়ে চড়ার রাস্তা, পাশেই দুর্গা মন্দির |
আশ্রমের ঠিক পাশেই গাড়ি পার্ক করে মন্দিরের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। এপর্যন্ত উঠতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি। এরপর একটা ছোট ট্রেক। পাহাড়ের খাঁজ ধরে সতর্ক ভাবে উঠতে হবে। মন্দিরের পাশ দিয়ে এবার পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম, লালজলের নেশায় উঠে চলেছি। বড় বড় পাথরের খাঁজ ধরে আস্তে আস্তে পাহাড়ের উপরের দিকে উঠছি। ভয়, আগ্রহ, বিস্ময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেশ একটা রোমাঞ্চ বোধ করছিলাম। পাথরের খাঁজে খাঁজে পা রেখে আমরা এক গুহার সামনে এসে হাজির হলাম। এটাই আদিম মানুষের গুহা। গুহার মুখ এতটাই সঙ্কীর্ণ যে হামাগুড়ি দিয়ে গুহার মধ্যে ঢুকে দেখা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়।
 |
| পাথরের খাঁজে পা রেখে এগিয়ে যাওয়া |
লালজল গুহার সম্বন্ধে কোথাও বিশেষ কিছু তথ্য পায়নি। পাহাড়ে ওঠার মুখে সাইনবোর্ডটাতে লেখা রয়েছে লালজল দেবী পাহাড়ের প্রতিষ্ঠাতা রামস্বরূপ দেবশর্মা। পাহাড়ের আবার প্রতিষ্ঠাতা! লেখাটা পড়ে কেমন যেন একটা লাগলো। কিন্তু কে ছিলেন এই রামস্বরূপ দেবশর্মা? বহুদিন আগে আনন্দবাজারে প্রকাশিত একটা লেখা পড়ে যেটুকু জানতে পেরেছি তা হলাে... ষাটের দশকে রামস্বরূপ দেবশর্মা নামে এক সন্ন্যাসী লালজলে এসে এই গুহায় আশ্রয় নেন। গুহায় একটি চিতাবাঘও ছিল। জনশ্রুতি, ওই চিতাবাঘের সঙ্গেই নাকি গুহায় থাকতেন সন্ন্যাসী রামস্বরূপ। রামস্বরূপের উদ্যোগে লালজলে বাসন্তী পুজোর প্রচলন হয়। এখনও সেই বাসন্তী পুজোর চল রয়েছে। রামস্বরূপ মারা গেলে দেওপাহাড়ের কোলেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
 |
| দূরে ঐ পাহাড় মিশেছে নীল আকাশে |
গুহার সামনে একটা চাতালের ওপরে দাঁড়িয়ে ছবিটবি তোলার পর উৎপল বললো চলো এবার উঠতে হবে পাহাড়ের চূড়োয়। পাহাড়ের চূড়োয় ওঠা বেশ কষ্টসাধ্য। ভাবলাম আমি এখান থেকেই ফিরে যাব। একটু পরেই হৈহৈ করে স্থানীয় কিছু কিশোর-তরুণ এসে হাজির, তারা এই লালজলের নেশাটাকে আরও বাড়িয়ে দিল।
 |
| স্থানীয় কিশোর-তরুণের দলের সাথে |
ওই কিশোর-তরুণদের অনুপ্রেরণায় পাহাড়ের চূড়োয় উঠতে শুরু করলাম। আবার চড়াই শুরু। চড়াই ভাঙতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। হাঁফ ধরে যাচ্ছিল দ্রুত। শেষে পাহাড়ের চূড়োয় পৌঁছাতে সক্ষম হলাম। একেবারে পাহাড়ের চূড়োয় যে ছোট্ট চাতালটার ওপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি দেখি সেটাই পাহাড়ের চূড়োর শেষ পাথর।
 |
| পাহাড়ের চূড়োয় শেষ পাথরে দাঁড়িয়ে আছি |
চলে এসেছি নাগরিক সভ্যতা থেকে দূরে প্রকৃতির কোলে। আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে! দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ উপত্যকা, দূরে কখনও দৃশ্যমান ছায়া-আবছায়ায় রানীপাহাড় আর সিংলহর পাহাড়ের সারি। এই রূপ শুধু চোখ ভরে দেখার। প্রকৃতির সাথে মিশে গেলাম।
 |
| জঙ্গলঘেরা এক পাথরের পাহাড় |
কিছুক্ষন এই দৃশ্য উপভোগ করার পর ফটোশেসন করে নিচে নামতে শুরু করলাম। একটু অসাবধান হলেই পা হড়কে যেতে পারে। সাবধানে পাথরের খাঁজে খাঁজে পা রেখে নিচে নেমে এলাম। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে যে পথে এসেছিলাম, চললাম সেই পথেই। আবার মেন রোডে ফিরে এলাম।
 |
| লালজল ছেড়ে চললাম সেই পথেই |
লালজল ত্যাগ করে আবার বাঁশপাহাড়ির পথে এগিয়ে যাচ্ছি নির্জনতার সন্ধানে। বিখ্যাত শিয়াড়বিন্ধা চড়াই পেরিয়ে চাকাডোবা মোড়ে পৌঁছে গেলাম। এখান থেকে ছুরিমারা হয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে কাঁকড়াঝোরের দিকে। চাকাডোবা থেকে কাঁকড়াঝোরে যাওয়ার এই পথটা বেশ রোমাঞ্চকর। এই পথে নির্জনতাই বড় প্রাপ্তি, মানুষজনের দেখা খুব একটা মেলে না। ঘন সবুজ জঙ্গলের মধ্যে নির্জন রাস্তায় পাখির ডাক ছাড়া প্রায় কিছুই শুনতে পাচ্ছি না।
 |
| ময়ূরঝর্ণা এলিফ্যান্ট রিজার্ভ ফরেস্ট |
পাহাড় আর জঙ্গলের অকৃত্রিম সৌন্দর্য আর নির্জনতাকে সঙ্গী করে চলেছি। মনে হচ্ছিল এ পথে গাড়ি চলা যেন শেষ না-হয়। দৃশ্যপট ক্রমশ পাল্টাচ্ছে, ঢেউখেলানো পাহাড় দেখা যাচ্ছে, বাড়ছে সবুজের ঘনত্ব। কখনও ছবি তোলার জন্য ব্যস্ত, আবার কখনও প্রকৃতি উপভোগ করে এগিয়ে যাচ্ছি। নিজে চালক হওয়ায় যেখানে খুশি দাঁড়ানো যায়, ছবি তোলা যায় ইচ্ছেমতন। বকডুবা জঙ্গলের মধ্যে গাড়ি চালিয়ে ময়ূরঝর্ণা গ্রাম পার হয়ে চলে এলাম সিআরপিএফ ক্যাম্প যাওয়ার রাস্তায় শালবনের মাঝে 'কাঁকড়াঝোর গেস্ট হাউসে'।
 |
| চলে এলাম কাঁকড়াঝোরে |
কাঁকড়াঝোরের এই নতুন গেস্ট হাউসের জায়গায় ছিল গোলবারান্দা সহ সুন্দর ছিমছাম এক বনবাংলো 'বনানী'। গাছমছমে জঙ্গলের মাঝে বন দফতরের ওই বাংলোতেই শ্যুটিং হয়েছিল নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদার কাহিনি অবলম্বনে 'চারমূর্তি' সিনেমার। প্যালারাম, ক্যাবলা আর হাবুলকে নিয়ে সেই বনবাংলোয় উঠেছিল টেনিদা। আজ আর তার অস্তিত্ব নেই। 'চারমূর্তি' ছবিতে টেনিদা আর তার তিন সঙ্গী হাওয়া বদলের উদ্দেশ্যে যে ঝন্টিপাহাড়ে গিয়েছিলো সেটা বাস্তবের এই কাঁকড়াঝোর। এই সিনেমার বেশিরভাগ আউটডোর শুটিং হয় এখানের পাহাড়-জঙ্গলে।
 |
| 'কাঁকড়াঝোর গেস্ট হাউস' |
গেস্ট হাউসের কাছে যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার থেকে একটু দূরে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। মারো পাহাড়, খচলা পাহাড়, লাকাইসিনি পাহাড় নাম সব। ঘন শাল-মহুয়ার জঙ্গল, ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু-একটা শিমুল বা অন্য কোনও গাছ। নির্জন প্রকৃতির রাজ্যে নেই কোন কোলাহল, কোন কৃত্রিমতা। কেবল প্রকৃতির অপার সজীবতা অনুভব করা আর বুক ভরে তাজা অক্সিজেন নেওয়া। দুপুর সাড়ে বারোটা, দোকানপাট কিছুই নেই। লাঞ্চের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার কাম রাঁধুনি সৌমিত্রদাকে ম্যানেজ করে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে ফেললাম। সৌমিত্রদার কাছে জানতে পারলাম, সামনে একটা দারুণ স্পট আছে, নাম দুরাসিনি ড্যাম। আর তার পাশেই একটা ‘জাগ্রত’ কাল ভৈরব মন্দির। খাবার রেডি হতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে। অতএব গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি ভৈরব মন্দিরের খোঁজে।
 |
| 'চারমূর্তি' সিনেমার শুটিং লোকেশন |
'চারমূর্তি' সিনেমার কৃষ্ণকায় ঝন্টুরামকে মনে আছে কি? যাকে প্রথম দর্শনেই ভূত ভেবে ভয় পেয়ে ভিরমি খেয়েছিল টেনিদা। সেই ঝন্টুরামের চরিত্রে অভিনয়কারী গোপীনাথ মাহাতোর বাড়িতেই গড়ে উঠেছে হোমস্টে। 'চারমূর্তি' সিনেমার ছোট্ট একটি দৃশ্যে পাকানো গোঁফওলা গাড়োয়ানের চরিত্রে দেখা গিয়েছিলো এই গ্রামেরই বাসিন্দা গোপীনাথ মাহাতোকে। গেস্ট হাউস থেকে ওদলচুয়ার দিকে খানিকটা যেতেই রাস্তার ধারে পড়লো গোপীনাথ মাহাতোর মাটির দোতলা বাড়ি। গোপীনাথবাবু প্রয়াত হয়েছেন, ভাইপো মধুসূদন মাহাতো এখন হোমস্টের দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন।
 |
| গোপীনাথ মাহাতোর বাড়ি |
গোপীনাথবাবুর বাড়ির সামনের সোজা ঢালাই রাস্তাটা চলে গেছে লাকাইসিনি পাহাড়ের দিকে। খানিকটা এগিয়ে মেন রোড ছেড়ে ডান হাতে একটা সরু রাস্তায় ঢুকে পড়ি। গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার সৌমিত্রদার কাছে জানতে পেরেছিলাম যে এই পথেই ভৈরব থান। কিছুটা এগিয়ে দেখি এক জায়গায় বেশ কিছু হোমস্টে, জায়গাটা একটু ঘিঞ্জি মতো। এখানেই 'চারমূর্তি' হোমস্টে। 'চারমূর্তি' হোমস্টের নাম অনেকের কাছে শুনেছি। গ্রামীণ বাড়ির আদলে তৈরি হোমস্টের তিনটি রুম যথাক্রমে প্যালা, হাবুল ও ক্যাবলা - টেনিদার এই তিন শাগরেদের নাম অনুযায়ী রাখা হয়েছে। প্রতিটি রুমের ভিতরে রয়েছে টেনিদার কাহিনীর নানা ছবি। কোলকাতার একটি পর্যটন সংস্থার প্রধান সিন্টু ভট্টাচার্য স্থানীয় গ্রামবাসীর জমি লিজ নিয়ে এই হোমস্টে গড়ে তুলেছেন। দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন ওই জমির মালিক মধুসূদন মাহাতো ও ঠাকুরদাস মাহাতো।
 |
| 'চারমূর্তি' হোমস্টে |
চারমূর্তি হোমস্টে পার হয়ে চলে এলাম। খানিকটা যেতেই শুরু হলো পুরো লাল মাটির উঁচু নিচু এবড়ো খেবড়ো রাস্তা। খুব সতর্কতার সঙ্গে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। গাড়ির চাকার দাগ দেখে ভাবলম এই রাস্তায় গাড়ি যায়। সামনে সাহস করে এগোলাম। কিছুটা যাবার পরই রাস্তাটা ঘুরে ছোট একটা মাঠ মতো জায়গায় এসে পড়ল। একটা ভৈরবের থান। জঙ্গলের মধ্যে জীর্ণ পরিত্যক্ত এক ভাঙ্গা ঘর দেখে মনে হলো ওটা হয়তো পুরানো মন্দির। পাশে ছোট্ট একটা ঘর, এটাই এখন মন্দির। মন্দিরের সামনের বোর্ড দেখে বুঝলাম আমরা এখন ঝাড়খণ্ডে আছি।
 |
| চলেছি নির্জন থেকে নির্জনের দিকে |
সামনের মাঠে গাড়ি রেখে আমরা নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম। দূরে পাহাড় আর নীচে ছোটো বড় পাথরের ওপর জলের ধাক্কা খেতে খেতে ঢিমে তালে বয়ে চলেছে 'ভৈরবী' নামের এক ছোট্ট নদী। নদীর জল বাঁধ দিয়ে আটকানো, এর নাম দুরাসিনি ড্যাম।
 |
| ছবির মতো সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ |
সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ, যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো। নদীর জলে খয়ে যাওয়া পাথরের অবিন্যস্ত লুকোচুরি, জলের সাথে। পিকনিকের আদর্শ জায়গা। জলের মধ্যে পড়ে থাকা পাথরের উপরে দাঁড়িয়ে চললো কিছুক্ষণ ফটোসেশন।
 |
| প্রকৃতির যেন এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেখছি |
আমাদের দেখে কিছু কচিকাঁচার দল জুটল। চোখে মুখে খুব সরলতা আর দারিদ্রের ছাপ। অপুষ্টিতে ভুগছে তা দেখে সহজেই বোঝা গেলো। সঙ্গে খাবার ছিলো না, অগত্যা খুচরো কিছু টাকা দিয়ে যতটা সম্ভব হয় সাহায্য করলাম। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর গেস্ট হাউসে ফিরলাম। ফিরে এসে দেখি আমাদের খাবার রেডি হয়ে গেছে। খানিকপরেই টেবিলে গরম গরম খাবার চলে এলো। দেশী মুরগীর মাংস তো আছেই, তার সাথে ভাত, ডাল, ঝুরি আলু ভাজা, তরিতরকারি, শেষপাতে আবার চাটনি। আহা! এই জঙ্গলে আর কি চাই। খাওয়াদাওয়া সেরে গাড়ি নিয়ে আবার রওনা দিলাম।
 |
| খেলায় মাতোয়ারা কচিকাঁচারা |
কাঁকড়াঝোরকে পিছনে ফেলে ওদোলচুয়ার (স্থানীয় লোকেরা বলে উদুলচুয়া) দিকে চলেছি কেটকি ঝর্ণা খুঁজতে। দূরে ঢেউখেলানো ছোট ছোট পাহাড়, নিচে সবুজ উপত্যকা। দুইদিকের পাহাড়ের চাপে কখনো সরু হয়ে গেছে উপত্যকা। জায়গায় জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো চাষের জমি। কোথাও ধান কাটা হয়ে গিয়েছে, আবার কোথাও অল্পস্বল্প চাষ হয়েছে। শাল-মহুয়ার জঙ্গলের মাঝে নাম না জানা ছোট ছোট গ্রাম। বেশিরভাগই সাঁওতাল গ্রাম। মাটির বাড়ি আর বাড়ির দেওয়ালে সুন্দর নকশা আঁকা। রোজকার মতোই গ্রামের মেয়েরা বাবুই ঘাসের দড়ি পাকিয়ে চলেছে এক মনে। দেখতে দেখতে সুন্দর আঁকা বাঁকা রাস্তায় এগিয়ে চলেছি আমরা। এখানে গুগল ম্যাপ ঠিক মতো কাজ করছে না। অল্প সময়ের মধ্যেই মাকুরভুলা, কদমডিহা, বুড়িঝোর, সিঙ্গাডুবা, চিরাকুটি গ্রাম পেরিয়ে আমরা অনেকটা পথ এগিয়ে চলে যাই। কেটকি ঝর্ণায় কোন দিকে যাবো, পথ খুঁজে পাচ্ছি না। কোনও দিকনির্দেশও দেখতে পেলাম না। স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলাম কেটকি ঝর্ণা সিঙ্গাডুবা গ্রামে। গাড়ি ঘুরিয়ে ফের চললাম সিঙ্গাডুবার দিকে। হঠাৎ দেখলাম রাস্তার ধারে একটা সাইন বোর্ড, তাতে লেখা "সিঙ্গাডুবা"। ডান দিকে চোখ মেলে দেখি একটা বড় বটগাছ।
 |
| নজরকাড়া মাটির দেওয়াল |
মেন রোড ছেড়ে বটগাছের উল্টোদিকের রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। গ্রামের ভিতর দিয়ে গোরু, ছাগল, মুরগী তাড়াতে তাড়াতে এগিয়ে যাচ্ছি। এক জায়গায় এসে দেখি রাস্তাটা দু'ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। বোঝা যাচ্ছে না কোন দিকে যাবো, জিজ্ঞেস করার মতোও কেউ নেই। হঠাৎ দেখি এক খুদে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে ইশারা করছে, বুঝে গেলাম ঐ দিকেই যেতে হবে।
 |
| 'কেটকি ঝর্ণা'! পথের শেষে তার ঠিকানা |
গ্রাম ছাড়িয়ে লাল এবড়ো খেবড়ো মেঠো রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে হাজির হলাম এক নির্জন জনমানব শূন্য লেকের ধারে। নামে ঝর্ণা হলেও আসলে এটা একটা জলাশয়। স্থানীয় লোকের ভাষায় ঝর্ণা মানে লেক বা বড় পুকুর।
 |
| হাজির হলাম কেটকি লেকের ধারে |
চেরাং পাহাড়ের কোলে কেটকির জলাশয়টা অনেকখানি জায়গা জুড়ে। চারপাশে এক অপরিসীম নিস্তব্ধতা, কেবল জঙ্গলের ভিতর থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে অজানা পাখির কুজন। শীতের মিঠে রোদ গায়ে মেখে লেকের আশেপাশে ঘুরে কিছু ছবি তুললাম। নীরব, নির্জন, কোলাহলমুক্ত এইরকম একটা মায়াময় পরিবেশে কার না দু-দণ্ড বসতে ইচ্ছে করে। উৎপল লেকের ধারে সবুজ ঘাসে গা এলিয়ে দিয়ে বসে পড়লো।
 |
| নিস্তব্ধতার আর এক নাম 'কেটকি লেক' |
নাহ, এখানে আর আর বেশিক্ষন থাকা যাবেনা। দিনের আলো কমে আসছে। অনেকখানি রাস্তা যেতে হবে, দেরি করা ঠিক হবেনা। এবার আমাদেরও ফিরতে হবে। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে রওনা দিলাম। কেটকি থেকে বেরিয়ে আবার মেন রোডে ফিরে এসে এগিয়ে চললাম চাতন ডুংরির দিকে। মনের পাতা আর ক্যামেরায় বন্দি হয়ে রইল কেটকি ঝর্ণার নয়নাভিরাম সেই সব দৃশ্য।
 |
| এক মায়াময় পরিবেশ |
আমাদের এই ট্রিপে শেষ গন্তব্য, চাতন ডুংরি সানসেট পয়েন্ট। সেখানে একটা আদিম মানুষের গুহা আছে বলে শুনেছি। কিন্তু চাতন ডুংরি কোথায় তা আমাদের সঠিক জানা নেই। রাস্তায় কোনও সাইন বোর্ডও চোখে পড়ছে না। চারদিকে একটা লোকও নেই জিজ্ঞেস করার জন্য। ফলে গুগল ম্যাপের উপরে ভরসা করেই এগোতে থাকলাম। গুগল ম্যাপও ঠিক মত কাজ করছে না। রাস্তা প্রায় শুনশান। এরকম অবস্থায় হঠাৎ করেই দেখা পেলাম এক গ্রামবাসীর। তার কাছে লোকেশনটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। বিশেষ কিছু লাভ হল না। একটু এগোতেই আর এক গ্রামবাসীর সাথে দেখা। ওনার কথায় আমরা চাতন ডুংরি পেরিয়ে চলে এসেছি। অচেনা জায়গা হলে যা হয়। গাড়ি ঘুরিয়ে আবার চললাম সেদিকে। কোদাপুরার কাছে রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি থামালাম। গুগল ম্যাপ বলছে, সানসেট ভিউ পয়েন্ট এখানে পাহাড়ের উপরে। কিন্তু রাস্তা কোথায়? এদিক সেদিক খোঁজাখুঁজি করে দেখা গেলো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা সরুপথ পাহাড়ের উপরে উঠে গেছে। ওই পথে পায়ে হাঁটা ছাড়া কোনো গাড়ির যাওয়া সম্ভব নয়। মুশকিলটা হল ওটাই রাস্তা কিনা সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এখন কোনদিকে যাব কি করব! কিছুই তো বুঝে উঠতে পারছি না।
 |
| চলেছি চাতন ডুংরি-র পথে |
গুগল ম্যাপ ওপেন করে আবার সামনে এগােতে থাকলাম। মেন রোড ধরে কিছুটা এগিয়ে ঢুকে পড়লাম একটা সরু লাল মাটির রাস্তায়। দু'ধারে ঝোপঝাড়, ডালপালাগুলো যেন রাস্তাটাকে আগলে রেখেছে। ঘন ঝোপ গাড়ির গায়ে ছোঁয়া দিয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করে ঐ রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে ঢুকে পড়লাম এক আদিবাসী গ্রামে। এই গ্রামে এসেই রাস্তা শেষ, এখান থেকে একটা রাস্তা আছে বটে কিন্তু সে রাস্তায় গাড়ি যাবেনা। রাস্তার এক পাশে গাড়ি দাঁড় করে ভাবছি কী করব! জনা কয়েক গ্রামবাসী আমাদের দেখে কৌতূহলী চোখে এগিয়ে এলো, তাদের সাথে আলাপও হল। ওদের কাছ থেকে জানলাম পাহাড়ের উপরে সানসেট পয়েন্ট। পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। গ্রাম ছাড়িয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে দেখি একটা রাস্তা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে। আমি উৎপলকে বললাম আর এগিয়ে কাজ নেই। এখান থেকেই ফিরে চলো। গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম এক ফাঁকা মাঠের মধ্যে। দিন ক্রমে ফুরিয়ে এল; দেখি সূর্য প্রায় অস্ত গেছে, লাল আকাশটা আস্তে আস্তে কালচে নীল হয়ে যাচ্ছে। একটু একটু করে এক সময়ে সূর্য পাহাড়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল। আমরাও ফিরে আসার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে আবার মেন রোডে চলে এলাম। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে এলাম বেলপাহাড়ির ইন্দিরা চকে। মেন রোডর উপর চায়ের দোকানে গলা ভিজিয়ে আর অপেক্ষা না করে সোজা বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।
 |
| ঢুকে পড়লাম এক আদিবাসী গ্রামে |
» থাকার ব্যবস্থা
কাঁকড়াঝোরে বেড়াতে গিয়েছেন... ভাবছেন থাকবেন কোথায়! এখন কাঁকড়াঝোরে থাকার জন্য একটি সরকারি গেস্ট হাউসের পাশাপাশি বেশ কিছু বেসরকারি হোমস্টে রয়েছে। এখানে হোমস্টেগুলো জঙ্গলমহলের নিজস্ব সংস্কৃতি দিয়ে সাজানো সাদামাটা বাড়ি। মনে রাখবেন হোটেলের মতো সব আধুনিক সুযোগ সুবিধা এখানে পাওয়া যাবেনা।
» কাঁকড়াঝোরে থাকার হোমস্টে- কাঁকড়াঝোর গেস্ট হাউসঃ- +৯১ ৯৪৭৬১২৫৪২৯, +৯১ ৯৭৩৪৮০২০৭৯, +৯১ ৭৩১৮৮১৫৫৯৭
- মাহাতো হোমস্টেঃ- (মাটির দো-তলা বাড়ি) +৯১ ৮৭০৯৮৩৪৩৮৫
- চারমূর্তি হোমস্টেঃ- +৯১ ৯৮৩৬৮৩০৩৪২, +৯১ ৬২৯১৩৭৭১৫৪, +৯১ ৯৮৩১৩০৯৫১২
- কাঁকড়াঝোর হোমস্টেঃ- +৯১ ৯৪৭৪৯৪৬০৯৯, +৯১ ৮১০১৪৫০০৭২
- কাঁকড়াঝোর ইকো ক্যাম্পঃ- +৯১ ৭৪৩৯৯০৮০৩৮, +৯১ ৯৮৩০৯৪৪৯৯০, +৯১ ৯০৭৩৯১১০৩৭
- শালবাড়ি হোমস্টেঃ- +৯১ ৭০০৩৪৫৭৫১৫
- ধিতাং হোমস্টেঃ- +৯১ ৯৮৩৬৬৯০৭৫৪
» কাঁকড়াঝোরের বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান- ভৈরব থান ও দুরাসিনি ড্যাম
- কেটকি লেক
- ময়ূরঝর্ণা
- আমঝর্ণা
- আমলাশোল গ্রাম
» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল
Khub sundor
ReplyDeleteঅসাধারণ।
ReplyDelete‘ডি-লা-গ্রান্ডি-মেফিস্টোফিলিস’....‘ইয়াক ইয়াক ইয়াক’।
Deleteখুব সুন্দর বর্ণনা করেছেন স্যার। খুব ভালো লাগলো আপনার ব্লগ টি পড়ে। আমার বাড়ি এখানে বুড়িঝর গ্রামে। অসাধারণ !
ReplyDelete