গুপ্ত অবস্থা থেকে প্রকাশ্যে এসেছিলেন বলে দেবীর নাম 'গুপ্তমণি'। এখানে বনচন্ডী গুপ্তমণি নামে খ্যাত। কারও কাছে তিনি বনদেবী, আবার কেউ বলেন বনদুর্গা। মূলত লোধা, শবর সম্প্রদায়ের আরাধ্য দেবী হলেও মা গুপ্তমণি সাধারণ মানুষের কাছে দুর্গা রূপেই পূজিত হন। ঝাড়গ্রামের কাছে কোলকাতা-মুম্বাই ন্যাশনাল হাইওয়ের ধারে রয়েছে এই বনচন্ডীর মন্দির। দেবীর নামেই জায়গাটার নাম গুপ্তমণি। স্থানীয়দের কাছে এই মন্দির খুবই জাগ্রত। বহু দূর দূরান্ত থেকেও মানুষ বিভিন্ন মনস্কামনা নিয়ে পুজো দিতে আসে এই মন্দিরে। কোনও উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ পুরোহিত নন, পূজো করেন লোধা-শবর সম্প্রদায়ের পুরোহিত। লোধা পুরোহিতকে বলা হয় দেহুরি। জঙ্গলমহলের দেবী এই 'গুপ্তমণি'-র পরিচিতি বাংলা ও ওড়িশা ছাড়িয়ে দক্ষিণভারত পর্যন্ত বিস্তৃত। কথিত আছে, ঝাড়গ্রামের জঙ্গলে গাছের নীচে গুপ্ত অবস্থায় গোপন-পথ পাহারায় থাকতেন দেবী দুর্গা। স্থানীয় বিশ্বাস, মা গুপ্তমণি পথের দুর্ঘটনা থেকে মানুষকে রক্ষা করেন। তাই অধিকাংশ গাড়ির ড্রাইভার ও যাত্রীরা নিরাপত্তা কামনায় এই মন্দিরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেবীকে খুশি রাখার জন্য দেবীস্থান লক্ষ্য করে খুচরো টাকা প্রণামি হিসাবে ছোড়েন। ইতিহাস আর স্থানীয় গল্প-মিথের মিলমিশে গড়ে ওঠা এই দেবীস্থান থেকে কিছুদিন আগে ঘুরে এলাম...
 |
| চলেছি অজানা কোনো উদ্দেশ্যে |
শনি-রবি ছুটির দিনগুলোতে ইদানিং আমি ও উৎপল মাঝে মাঝেই একটু বেরিয়ে পড়ি অজানা কোনো স্থানের উদ্দেশ্যে। এভাবেই ঠিক গত শনিবার উৎপল আর আমি দুজনে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের পথ পরিক্রমা শুরু হলো, গাড়ি আপন গতিতে চলতে শুরু করলো। নিরুদ্দেশের পথিকের মত অজানা পথে ভেসে চলেছি। গন্তব্য জানা নেই। রাস্তায় বেরিয়ে কোনদিকে যাবো ঠিক করতে পারছি না। উৎপল বললো লোধাশুলির দিক থেকে চলো একবার ঘুরে আসি। আমিও সহমত পোষণ করলাম। খড়্গপুর চৌরঙ্গী পেরিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে জামশেদপুরের দিকে। বহু বছর আগে খড়্গপুরে থাকাকালীন এই রাস্তায় গেছি তারপর আর যাওয়া হয়নি। কংক্রিটের ঝাঁ-চকচকে রাস্তাটা সদ্য বাই লেন থেকে ফোর লেন রাস্তায় পরিণত হয়েছে। নিমপুরার কাছে এসে দেখি জায়গাটা একেবারে পরিবর্তন হয়ে গেছে। কালাইকুণ্ডা পেরিয়ে রাস্তার আশেপাশে জঙ্গল আর প্রকৃতির সবুজ বন্যা দেখে চোখ-মন জুড়িয়ে গেল। রাস্তায় একটা সুন্দর বাঁকে খোলা সবুজ মাঠে বিচরণ করা অসংখ্য গরুর পাল দেখে উৎপলকে গাড়ি থামাতে বললাম। সেখানে প্রকৃতিকে পেছনে রেখে নানাভাবে ল্যান্ডস্কেপ ছবি তুলতে থাকলাম। রাস্তার ধারে নানারকম বুনো আগাছার ঝোপঝাড়ে ঠাসা। সেই ঝোপের মধ্যে দেখি অদ্ভুত সুন্দর নীল রঙের অসংখ্য বুনোফুল ফুটে আছে। গুগল লেন্স অ্যাপে সার্চ করে দেখলাম সে ফুলের নাম নীলকাঠি। কেউ কেউ একে বলে নীলের ঝি। দীর্ঘ সরু সবুজ জটার বুনো সুন্দরের বাহার দেখে তাকেও ক্যামেরা বন্দি করতে ছাড়লাম না।
 |
| সবুজ মাঠে বিচরণ করা অসংখ্য গরু বাছুর |
দূর আকাশে দেখি কালো মেঘ ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। গাড়িতে উঠে বসলাম, সুন্দর মসৃন রাস্তা দেখে উৎপল নিজেকে আর সামলাতে পারছে না। মন তখন বলে উঠলো 'চলো যাই চলে যাই দূর বহুদুর'। গাড়ি এগিয়ে চলেছে। সামনে বালিভাষায় পড়লো টোলপ্লাজা। টোল পার হতেই গাড়ি আবার ছুটতে শুরু করল। এভাবে কখন লোধাশুলি ছাড়িয়ে বহুদূর চলে এসেছি জানিনা।
 |
| বালিভাষা টোলপ্লাজা |
ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে অনেকটা রাস্তা চলে এসেছি। পথে পড়ল এক ছোট্ট নদী – 'ডুলুং'। ব্রীজ পেরিয়ে একটা মোড় দেখে গাড়ি থামালাম। দেখি একটা রাস্তা বামদিকে টার্ন নিয়ে গোপীবল্লভপুরের দিকে চলে গেছে। সেখানে কর্মরত এক ট্রাফিক পুলিশকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম জায়গাটার নাম ফেকো মোড়। অর্থাৎ আমরা লোধাশুলি ছাড়িয়ে প্রায় সতেরো কিলোমিটার দূরে চলে এসেছি। গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আবার ফিরে চললাম। ফেরার সময় উৎপলকে বললাম এদিকে যখন এসেছি তখন গুপ্তমণিতে মায়ের দর্শন করেই যায়। এ দিকে, দিনের আলো কমে আসছে সেটা খেয়ালই ছিল না। গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দিলাম। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গাড়ি ফিরে চলেছে দ্রুত গতিতে। লোধাশুলি ছাড়িয়ে গাড়ি এসে থামলো গুপ্তমণি মন্দিরের সামনে।
 |
| চলে এলাম গুপ্তমণিতে |
ন্যাশনাল হাইওয়ের একদম গা ঘেঁষেই এই মন্দির। গাড়ি থেকে নেমে চললাম মায়ের দর্শন করতে। জায়গাটা শুনশান। পাঁচটা বেজে গেছে, আলো ততক্ষনে অনেক কমে এসেছে। করোনা আতঙ্কের কারণে লোকজন সেরকম নেই বললেই চলে। আশপাশে কয়েকটি পুজোর সামগ্রীর দোকান ছাড়া আর কিছুই দেখা গেলো না। গেটের বাইরে জুতো খুলে মন্দির চত্বরে প্রবেশ করলাম। ছোট্ট একেবারে সাদামাটা মন্দির। দেখে মনে হলো খুব বেশী দিনের পুরাতন নয়। ভেতরে হাল্কা আলোতে মায়ের অবস্থান কোনওরকমে দেখা গেলো। স্থানীয় লোকেদের কাছে জানা গেলো মন্দিরের ভেতরে বহুবার বৈদ্যুতিক আলো লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু প্রতিবারই সেই চেষ্টা বিফল হয়েছে। আসলে গোপনীয়তাই বোধহয় এই দেবীর পছন্দ তাই হাল্কা আলো পছন্দ করেন আর সেই কারণেই মন্দিরে জ্বলে শুধুই মোমবাতি আর প্রদীপ। আজও প্রচলিত নিয়ম অনুয়ায়ী এখানে দেবীর প্রতিমা নয়, পুজো হয় একটা পাথরের। আড়াল করে রাখা গুপ্তপথের ওই পাথরেই হয় দেবী চন্ডীর পুজার্চনা। তবে মূল পাথরের দেবী এখন গৌণ হয়ে পড়েছে। মন্দিরে উপাস্য দেবতা হিসাবে রয়েছে একটি পাথরের মূর্তি যা দেবী মনসা রূপে পূজিত হয়। এছাড়া রয়েছে দেবী দুর্গার ধাতুমূর্তি ও একটি সিংহবাহিনীর মূর্তি। মন্দিরের ভেতর ও বাইরের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন দেবদেবীর খোদাই চিত্র।
 |
| দেবীর মন্দির |
গুপ্তমণির আর্বিভাবের ইতিহাস
গুপ্তমণির আর্বিভাব সম্পর্কে ইতিহাস-মিথের অনেক গল্পকথা প্রচলিত আছে। একসময় শুকনিবাসার এই জায়গাটা ছিল গভীর ঘন জঙ্গলে ঢাকা। মূলত লোধা-শবর সম্প্রদায়ের বাস ছিল। শিকারই ছিল যাদের একমাত্র জীবন ও জীবিকা। এই শুকনিবাসা গ্রামে শবর সম্প্রদায়ের নন্দ ভক্তা একদিন স্বপ্নাদিষ্ট হন। দেবী চন্ডী তাঁকে স্বপ্নে বলেন, শুকনিবাসার জঙ্গলে মাটির মধ্যে তিনি গুপ্ত অবস্থানে রয়েছেন। তিনি নিত্যপূজো পেতে চান। রাস্তার ধারে একটা শাহাড়া (শ্যাওড়া ) গাছের নীচে ঝোপের মধ্যে যেখানে একটা টাটকা কাটা ডাল পোঁতা আছে, সেখানে মাটির মধ্যে গুপ্ত অবস্থায় তিনি আছেন। সে যেন তাঁর পূজোর ব্যবস্থা করে। দেবীর এই স্বপ্নাদেশের কথা শুনে নন্দ ভক্তা সেই গাছের নীচে ঝোপজঙ্গল পরিষ্কার করে দেখেন যে সত্যিই মাটির মধ্যে দেবী শিলারূপে আছেন। তখন সেখানেই বুনো ফল আর ফুল দিয়ে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করে নিত্যপূজো শুরু করেন। মাটির ভেতরে গুপ্ত অবস্থায় ছিলেন বলে দেবীর নাম হয় 'গুপ্তমণি'। বিষয়টা জানতে পেরে মল্লরাজ জঙ্গল পরিষ্কার করে ঐ জায়গায় মা গুপ্তমণির মন্দির তৈরি করে দেন এবং শুকনিবাসা এলাকার মালিকানা নন্দ ভক্তার নামে দানপত্র করে তাকে মন্দিরের দেহুরি ও সেবাইত হিসেবে নিযুক্ত করেন। সেই থেকে এখানে নন্দ ভক্তার উত্তরাধিকারীরা বংশানুক্রমে সারা বছর ভাগ করে এই মন্দিরের পূজোর দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তবে এখন আর সেই পুরাতন মন্দিরের কোন অস্তিত্ব নেই। ঘটনার কোন ঐতিহাসিক সত্যতাও আছে কিনা জানা নেই।
 |
| গুপ্তমণি মায়ের মন্দির |
আবার রাজা মল্লদেবের হাতিকে ঘিরে অন্যরকম আর একটা গল্প শোনা যায়। ঝাড়গ্রামে তখন মল্লরাজাদের রাজত্ব। রাজা নরসিংহ মল্লদেব তখন সিংহাসনে আসীন। মল্লদেবের রাজপ্রাসাদ ছিল গভীর জঙ্গলে ঘেরা। মল্লরাজা তাঁর রাজস্ব ও রাজ্য রক্ষার জন্য সেই জঙ্গলের ভেতরে একটা গোপন পথ তৈরি করেছিলেন। এই গুপ্তপথের সাহায্যে মল্লরাজ আকস্মিক হামলা থেকে বহু যুদ্ধ জয় করেছেন। তাই অনেকে মনে করতেন দেবী চন্ডী এই গোপন পথ আগলে রাখতেন। হঠাৎ একদিন রাজার প্রিয় হাতি নিখোঁজ হয়ে গেল। রাজার সৈন্যসামন্তরা চারদিকে ছোটাছুটি করে খুঁজে আনার চেষ্টা করল। কিন্তু হাতিটিকে খুঁজে পাওয়া গেল না। শেষে রাজার হারিয়ে যাওয়া হাতিটিকে খুঁজে পাওয়া গেলো রাজার তৈরি গুপ্তপথের সামনে। একটা গাছের গায়ে বুনো লতা দিয়ে বাঁধা রয়েছে। যাদের হারিয়ে মল্লদেবের এত প্রতিপত্তি, সেই শবরপতি নন্দ ভক্তা স্বয়ং দাঁড়িয়ে ঐ হাতির সামনে। রাজা মল্লদেব তখন বুঝতে পারলেন শবরপতি নন্দ ভক্তা জঙ্গলের মধ্যে তাঁর ঐ গুপ্তপথের সন্ধান পেয়ে গেছেন। শবরপতি গুপ্তপথ জেনে ফেলায় রাজা আর তার রাজ্যের নিরাপত্তা সঙ্কটে পড়ে গেলো। নিজেদের অধিকার রক্ষায় শবরেরা তখন রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। শবর দলপতির কাছে পরাজিত হয়ে বুদ্ধিমান রাজা তখন সন্ধির কৌশল করে জঙ্গলের ওই গুপ্তপথ রক্ষার দায়িত্ব শবরপতি নন্দ ভক্তার হাতে তুলে দেন। রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে যে নিজেদের অধিকার ধরে রাখা যাবে না সেটা বুঝতে পেরে ওই শবরেরা রাজার তৈরি জঙ্গলের গুপ্তপথ আগলে রাখার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপর থেকে শবরেরা ঐ গুপ্তপথকে আড়াল করে রাখা পাথরের উপর বুনো ফুল আর ফল দিয়ে বনচন্ডীকে প্রতিষ্ঠা করে। শুরু হয় শবরদের চন্ডী আরাধনা। যেহেতু ঐ জায়গাটা রাজার গুপ্তপথ ছিল তাই শবরদের চন্ডীর পরিচয় হয় 'গুপ্তমণি' হিসেবে।
 |
| দেবী গুপ্তমণি চন্ডী |
মন্দির লাগোয়া একটা টিনের শেডের মধ্যে দেখতে পেলাম পোড়ামাটির তৈরি হাতি ঘোড়ার ছলনস্তূপ। কিছু ছলন আবার লাল সুতোয় বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা। জঙ্গলমহলের প্রায় প্রত্যেকটি গ্রামেই দেখা যায় এই ছলনের উপস্থিতি। 'ছলন' হল পোড়ামাটির তৈরি বিভিন্ন পশু মূর্তি। তবে ছলন হিসাবে হাতি ও ঘোড়ার চলন বেশি। কোনও মনস্কামনা পূর্ণ হলে ভক্তগণ তাদের উৎসর্গ ও মানত করা পোড়ামাটির হাতি ও ঘোড়া মন্দিরের পাশে ঐ ঘরে বেঁধে যায়। মন্দিরের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে বেশ কয়েকটা দোকান। সেখান থেকে দেবীর পুজোর নৈবেদ্য নারকোল, কলা, জবাফুল ইত্যাদি পাওয়া যায়।
 |
| দেবীর কাছে উৎসর্গ করা ছলন |
মন্দির দর্শন করা হলো... কিছুদূর এগিয়ে কালাইকুণ্ডার কাছে গাড়ি থামিয়ে সঙ্গে ফ্লাস্কে করে নিয়ে যাওয়া গরম চায়ে চুমুক দিয়ে ভাবলাম কয়েকটা ল্যান্ডস্কেপ ছবি নেবো। কিন্তু মেঘ যেন আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করছে আজ। কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। সারা শরীরে লাগলো হালকা ঠান্ডা একটা অনুভূতি। গাড়িতে উঠে বসলাম, গাড়ি ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করলো। গাড়ি যতই সামনে এগোয় ততোই মেঘ ধেয়ে আসছে আমাদের দিকেও। বৃষ্টির দানা একফোঁটা-দু'ফোঁটা করতে করতে অঝোর ধারায় ঘিরে ফেললো একসময়। সারাদিনের চমৎকার এক অনুভূতি নিয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরলাম দুজনে।
 |
| বনপথে গহন মেঘের ছায়া ঘনায় |
» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ- আনন্দবাজার পত্রিকা, নিউজ 18 বাংলা)
GUPTOMONI, JHARGRAM, WEST BENGAL
Khub sundor Dada...
ReplyDeleteTmi eto sundor vabe lekho.😊😊👌👌