গড়বেতার এই মন্দিরটি সারা ভারতবর্ষের মধ্যে একমাত্র হিন্দু মন্দির যেটি উত্তরমুখী। মন্দিরটি পীঢ়া দেউল স্থাপত্য রীতিতে তৈরি। এই সর্বমঙ্গলা মন্দির সম্পর্কে নানারকম গল্পগাথা চালু আছে। পূর্বে গড়বেতার এই প্রাচীন জনপদ 'বগড়ী' সংলগ্ন বিস্তীর্ণ অঞ্চল জঙ্গলাকীর্ণ ছিল এবং সেখানে উপজাতিরা বসবাস করতো। শিকারই ছিল তাদের প্রধান উপজীবিকা। তারা শিকারে যাওয়ার আগে জঙ্গলে এক বনদেবীর পূজা করতো। অনেকে মনে করেন তাদের সেই বনদেবীকে বগড়ীর প্রথম রাজা গজপতি সিংহ প্রতিষ্ঠিত করে এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। এই বনদেবীই পরবর্তীকালে বগড়ীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী সর্বমঙ্গলা নামে পরিচিতা হন। সর্বমঙ্গলা দেবী দুর্গার একটি রূপ। মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা ভীষণ সঙ্কীর্ণ। এর আগে একবার ওই রাস্তায় গাড়ি নিয়ে গিয়ে বেকায়দায় পড়েছিলাম, মন্দির দর্শন করতে পারিনি। কিন্তু এবার কোভিডের কারণে রাস্তা ফাঁকা থাকায় সহজেই মন্দির দর্শন করে এলাম।
 |
| গনগনি'র পথে... শিহরণ জাগানো সেই গভীর জঙ্গল !! |
শুনেছি সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময় গনগনির রূপ সবচেয়ে সুন্দর হয়। ফটোগ্রাফির জন্য ওই সময় আদর্শ। তাই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল গনগনির সূর্যাস্তের সময় তার সুন্দর রূপ ক্যামেরায় ধরে রাখা। পরিকল্পনা মতো স্ট্যান্ড সহ ক্যামেরা নিয়ে রওনা দিলাম গনগনির উদ্দেশ্যে। এবারেও আমার সঙ্গী উৎপল। ঘন গভীর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে গড়বেতায় যখন পৌঁছায় তখন বিকেল চারটে, সূর্যাস্তের অনেক দেরি।
 |
| গনগনিতে স্বাগতম |
উৎপলকে বললাম হাতে যখন সময় আছে তাহলে একবার সর্বমঙ্গলা মন্দির দর্শন করে আসি। গড়বেতা বাজার থেকে সহজে পৌঁছানো যাবে এই মন্দিরে। তবে মন্দির পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে যাওয়া গেলেও রাস্তা ভীষণ সঙ্কীর্ণ। এর আগে মন্দির দর্শন করার জন্য ওই রাস্তায় গাড়ি নিয়ে গিয়ে সমস্যায় পড়েছিলাম। তবে এবার কোভিডের কারণে রাস্তা একদম ফাঁকা ছিল, তাই অনায়সে মন্দির পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম। মন্দিরের সামনে ছোট্ট একটা জায়গায় গাড়ি পার্কিং করে পুরোহিতের অনুমতিতে পা রাখলাম মন্দির প্রাঙ্গণে।
 |
| দেবী সর্বমঙ্গলা মন্দির দর্শণ |
সর্বমঙ্গলা মন্দিরের সূচনা:
গড়বেতার অন্যতম প্রাচীন কীর্তি ও সেরা আকর্ষণ এই সর্বমঙ্গলা মন্দির। এখানে দেবী পূজিতা হন দুর্গারূপে। মন্দিরটির বৈশিষ্ট এটি উত্তরমুখী। সচরাচর কোনো হিন্দু মন্দিরে এরকম দেখা যায় না। মন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়ে একাধিক মত রয়েছে। এর সঙ্গে তাল বেতালের গল্প নিয়ে উপকথা জড়িত আছে। গল্পগাথা অনুযায়ী উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্যের সময় এক যোগী সাধক এই অঞ্চলে এসেছিলেন। সেই সময় এই জায়গা ছিল শুধুই জঙ্গল। লোকে বলত বগড়ির জঙ্গল। অলৌকিক প্রতিভাধর সেই সাধক উপেন্দ্র ভট্ট তাঁর অলৌকিক ক্ষমতাবলে বগড়ীর বনপ্রদেশে এই দেবী মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এই মন্দিরের মাহাত্ম্যের কথা ধীরে ধীরে বিক্রমাদিত্যের কানে পৌঁছল। রাজা বিক্রমাদিত্য এই অলৌকিক শক্তির কথা শুনে গড়বেতায় দেবীর মন্দিরে এসে পঞ্চমুন্ডি আসনে বসে শব সাধনা শুরু করলেন। সর্বমঙ্গলা মন্দিরে গেলে আজও দেখতে পাওয়া যায় সেই পঞ্চমুণ্ডির আসন। রাজা বিক্রমাদিত্যের সাধনায় দেবী পরিতুষ্ট হয়ে তাঁকে তাল বেতাল নামে অলৌকিক তেজ সম্পন্ন দুই অনুচরের উপর আধিপত্যলাভের অধিকার প্রদান করেন। অর্থাৎ তাল বেতাল সেই মুহুর্ত থেকে রাজা বিক্রমাদিত্যের হুকুম মেনে চলবে। সত্যিই কী বিক্রমাদিত্য সেই ক্ষমতা লাভ করতে পেরেছেন! রাজা তখন নিজের আধ্যাত্মিক শক্তি প্রত্যক্ষ করতে দেবী প্রদত্ত তাল বেতালকে ঐ মন্দির-দ্বার পূর্ব দিক থেকে ঘুরিয়ে উত্তর দিকে পরিবর্তন করতে নির্দেশ দিলেন। আদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাল বেতাল মন্দিরের মুখ পরিবর্তন করে উত্তর দিকে করে দেয়। সেই কারণেই সর্বমঙ্গলা দেবীর মন্দিরের দ্বার উত্তর দিকে অবস্থিত বলে প্রচলিত আছে। তবে উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্যের এখানে এসে শব সাধনার কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আবার অনেকের মতে বগড়ীর প্রথম রাজা গজপতি সিংহ এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন।
 |
| সর্বমঙ্গলা মন্দির |
কোভিডের কারণে মন্দিরে কোনো লোকজন নেই। আমরা দু'জন ছাড়া মাত্র গুটি চারেক ছোটো বাচ্চা খেলা করছিলো মন্দির প্রাঙ্গনে। মন্দিরের প্রাঙ্গনের ডানদিকে রয়েছে এক বিশাল হাঁড়িকাঠ। কাঠ নয়, সেটি ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা বা লাল মাটির। কথিত আছে আগে এখানে নাকি নরবলি হত। তবে এখন শুধু ছাগল ও মোষ বলি হয়। একসময় মল্লরাজ দুর্জন মল্ল বলি দেওয়া বন্ধ করে দেন। শুরু হয় বৈষ্ণব মতে পূজো। বাংলায় বর্গি আক্রমণের হাত থেকে এই মন্দিরও বাদ যায়নি। বর্গিদের বারেবারে আক্রমণের ফলে নষ্ট হয়েছে মন্দিরের কষ্টিপাথরের আসল মূর্তিটি। পরবর্তীকালে রাজা গজপতি সিংহ মন্দির সংস্কার করে নতুন করে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত করেন।
 |
| ছোট্ট বাচ্চাদের সাথে |
মন্দিরটি মাকড়া পাথরের তৈরি হলেও বর্তমানে সংস্কার করার ফলে পুরোটাই সিমেন্টের পলেস্তারে ঢাকা। মন্দিরের দেওয়ালের ওপর সম্প্রতি গোলাপি রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। ওড়িশার পীঢ়া দেউল স্থাপত্য রীতিতে তৈরি মন্দিরটির মোট চারটি অংশ - নাটমন্দির, ভোগমন্দির, জগমোহন এবং দেউল (গর্ভগৃহ)। মূল মন্দিরের বিমান শিখর রীতির। এর সাথে যোগ হয়েছে জগমোহন। গর্ভগৃহের সঙ্গে জগমোহন যুক্ত থাকলে সেটিকে "পীঢ়া রীতি" বলা হয়। জগমোহনের সামনে ছোট্ট যোগমন্ডপ। গর্ভগৃহ থেকে যোগমণ্ডপের ছাদ লহরাযুক্ত, তার উপর বেঁকি। এর পরে নাটমন্দির অংশটি চারচালা। এই অংশটি পরে নির্মিত হয়েছে। মন্দিরের মূল কপাট বন্ধ ছিল তাই দেবীর দর্শন হলো না। মন্দির চত্বরটা ভালো করে ঘুরে দেখে বাইরে থেকে কয়েকটি ছবি তুলে চললাম গনগনির দিকে।
 |
| পীঢ়া দেউল স্থাপত্য রীতিতে তৈরি মন্দির |
সর্বমঙ্গলা মন্দির থেকে বেরিয়ে হুমগড়ের রাস্তা ধরে কিছুটা যেতেই কলেজ মোড়ের কাছে চোখে পড়ল একটা সাইনবোর্ড। গাড়ি ডান দিকে ঘুরিয়ে লাল মোরাম রাস্তা ধরে একটু এগুতেই ঘন কাজুর বন। কাজু জঙ্গলের মধ্যে লাল ধুলোর ঘূর্ণি উড়িয়ে আমাদের গাড়ি ছুটতে থাকল গনগনির গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের দিকে। দুপাশে কাজুবাদাম গাছের সারি পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম নদীর ধারে। সামনে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে নদী পর্যন্ত। নিচে প্রবল স্রোতে বয়ে যাচ্ছে শিলাবতী নদী। সারাবছর শিলাবতী গা এলিয়ে থাকলেও, ভরা বর্ষায় সে কিন্তু রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে।
 |
| সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামা |
আমরা সিঁড়ি বেয়ে খাদে নেমে গেলাম। পিছনে জঙ্গলে লাল মাটির সমতল ভূমি আর সামনে খাদ, সেখানে লাল ও গেরুয়া মাটির নানান ভাস্কর্যের অপূর্ব দৃশ্য। খাদের পরে শিলাবতী নদী আর নদীর ওপারে উর্বর চাষ জমি। একদিকে শিলাবতী নদী যেমন ক্ষয় করেছে এই অঞ্চলের ল্যাটেরাইট মৃত্তিকাকে, তেমনই প্রাকৃতিক জলবায়ুও এই ভূমিকে যেন এক দক্ষ শিল্পীর ন্যায় ইচ্ছামতো আকার দিয়েছে এই ভূমিভাগকে।
 |
| বর্ষায় গনগনির রূপ |
আজ যেন সকাল থেকেই আকাশের মুখভার। মাথার উপরে তাকাতেই নজরে এলো একটু একটু করে আকাশে ভিড় জমাচ্ছে ঘন কালো মেঘের দল। ধীরে ধীরে সূর্যকে গ্রাস করে ফেললো। চারিদিকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। দারুন সুন্দর লাগছিল। ছবি তোলার নেশাতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম একসময়। ঘুরে ঘুরে ছবি তুলতে তুলতে দেখলাম অন্ধকার নেমে আসছে। শেষ পর্যন্ত আর দেখা মেলেনি সূর্যের। যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলাম তা সফল হলো না। বর্ষায় ভরা শীলাবতীর রূপ দেখে মনকে সান্ত্বনা দিয়ে ইতিউতি কিছুক্ষণ ঘুরে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া চা-য়ে চুমুক দিয়ে হতাশায় ঘরে ফিরলাম। উপরি পাওনা কেবল দেবী সর্বমঙ্গলা মন্দির দর্শন! সেটাই বা কম কি!
 |
| ভরা শীলাবতী |
» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ- 'মেদিনীপুরের ইতিহাস' - যোগেশচন্দ্র বসু)
SARBAMANGALA MANDIR, GANGANI, GARHBETA, WEST BENGAL
Khub bhalo laglo
ReplyDelete