Theme Layout

Boxed or Wide or Framed

Theme Translation

Display Featured Slider

Yes

Featured Slider Styles

[Centred][caption]

Display Grid Slider

No

Grid Slider Styles

[style5][caption]

Display Trending Posts

Display Author Bio

Yes

Display Instagram Footer

Yes

Dark or Light Style

কালনার নবকৈলাস মন্দির ও রাজবাড়ী মন্দির কমপ্লেক্স


টেরাকোটার মন্দির মানেই বিষ্ণুপুর এটাই আমার কাছে ছিল ধারণা। বিষ্ণুপুর অনেকবার ঘুরেছি তাই অনেকের কাছে কালনার টেরাকোটার মন্দিরের কথা জানতে পেরে অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে ছিল কালনার মন্দির দেখার কিন্তু সময়াভাবে তা হয়ে ওঠেনি। হঠাৎ কথাপ্রসঙ্গে আমার এক নিকটাত্মীয় রামকৃষ্ণ-দার পরিচিত কালনা নিবাসী সোমনাথ বাবুর সন্ধান পেলাম। সোমনাথবাবু নবকৈলাস মন্দির এলাকার প্রাচীন বাসিন্দা। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম যে এবার সুযোগ যখন পেয়েছি তখন একবার মন্দির নগরীর ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলি নিজের চোখে দেখে আসি। সুযোগের হাতছাড়া না করে রামকৃষ্ণ-দা কে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। অম্বিকা কালনা স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে টোটো করে চলে এলাম শহরের প্রাণকেন্দ্র নবকৈলাস মন্দিরের সামনে। টোটো থেকে নামতেই দেখি সোমনাথ বাবু মন্দিরের সামনেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। পরিচয় হওয়ার পরে উনি আমাদের মন্দির চত্বরে নিয়ে গিয়ে গাইডের মতন একে একে সব বুঝিয়ে দিলেন। উনি আমাদের বললেন রাজবাড়ী মন্দির কমপ্লেক্সের মধ্যে বহু মন্দির আছে তবে নবকৈলাস মন্দিরের শিবলিঙ্গের অবস্থান সম্পর্কে ভালো করে বুঝতে হলে সবার প্রথমে প্রতাপেশ্বর মন্দিরের ব্যাপারে ভালো করে জানতে হবে। তাই তিনি প্রথমেই আমাদের রাজবাড়ী মন্দির কমপ্লেক্সের ভেতরে নিয়ে গেলেন।

রাজবাড়ী মন্দির কমপ্লেক্স
রাজবাড়ী কমপ্লেক্সের মধ্যে সবার প্রথমেই চোখে পড়লো প্রতাপেশ্বর শিব মন্দির। মন্দিরটি 'প্যারীকুমারী মঠ' নামেও পরিচিত। অনেকে আবার মন্দিরটিকে জলেশ্বর মন্দির নামেও উল্লেখ করেছেন। ওড়িশার শিখর দেউলের আদলে তৈরি প্রতাপেশ্বর মন্দিরটি বাঁকুড়ার সোনামুখী নিবাসী শ্রীরামহরি মিস্ত্রির তৈরি। এই মন্দিরটি বর্ধমানের রাজকুমার প্রতাপচাঁদ রায়ের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত হয়েছিল। ১৮৪৯ খৃষ্টাব্দে প্রতাপচাঁদের প্রথমা স্ত্রী প্যারীকুমারী দেবী তাঁর পতিদেবের স্মৃতির উদ্দ্যেশে এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। তবে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপি অনুসরণ করলে মন্দিরটিকে 'প্যারীকুমারীর মঠ' বলতে হয়। পূর্বমুখী এই শিব মন্দিরের শিখরটি খাঁজকাটা ও গম্বুজাকৃতি। মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠিত কালো পাথরের তৈরি শিবলিঙ্গটি উত্তরমুখী। গর্ভগৃহের পূর্বদিকে রয়েছে একটি মাত্র দরজা আর বাকি তিনদিকে রয়েছে টেরাকোটার কাজ করা নকল দরজা। মন্দিরের চারপাশে দেওয়ালের গায়ে অসংখ্য পোড়ামাটির টেরাকোটা কাজের নিদর্শন রয়েছে। কালনায় যতগুলি মন্দির রয়েছে তার মধ্যে স্থাপত্য ও টেরাকোটা অলঙ্করণে শোভিত এই প্রতাপেশ্বরের মন্দিরটি অতুলনীয়।

প্রতাপেশ্বর মন্দির
নবকৈলাস মন্দির

প্রতাপেশ্বর মন্দির দেখার পরে সোমনাথ-দা এবারে আমাদের নিয়ে গেলেন রাজবাড়ীর পশ্চিমে এক বিশাল শিবক্ষেত্রের মধ্যে যেখানে বৃত্তাকারে ১০৯ টি শিবমন্দির আছে। এটি নবকৈলাস বা ১০৮ শিব মন্দির নামে পরিচিত। সাধারণের কাছে ১০৮ শিবমন্দির নামে পরিচিত হলেও প্রকৃতপক্ষে মন্দিরের সংখ্যা হলো ১০৯ টি। কালনা ছাড়াও এরকম শিবক্ষেত্র পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান শহরের নবাবহাটে দেখা যায়। 'নবাধিক শত' মন্দিরটি ১৮০৯ খ্রীস্টাব্দে রাজা তেজচন্দ্র নির্মাণ করেন। মন্দিরগুলো আটচালা। চারচালের উপরে ক্ষুদ্রাকৃতির আরেকটি চারচালা রয়েছে। ১০৮ অর্থাৎ অষ্টোত্তর শত নামের জপমালার ন্যায় একই মালা বড় ও ছোট দুটো বৃত্তে ভাঁজ করলে বড় চক্রের ভেতরে যেমন ছোট চক্রটিকে দেখা যায়, ঠিক সে ভাবেই এই শিবক্ষেত্র নির্মাণের সময়ে এক সারি আটচালার মন্দির দিয়ে তৈরি এক বৃহৎ চক্রের মধ্যে আরও এক সারি আটচালা মন্দিরেরই ছোট্ট চক্র রয়েছে। জপমালায় যেমন ১০৮ টি বীজ গাঁথা থাকে এবং মধ্যস্থলে একটা বড় বীজ গাঁথা থাকে যাতে বোঝা যায় ১০৮ পূর্ণ হলো ঠিক তেমনি আরও একটি মন্দির রয়েছে। এই ১০৯ নম্বর মন্দির হিসেবে চিহ্নিত করা হয় শিবক্ষেত্রের বৃত্তের বাইরে এবং নবকৈলাস শিব মন্দিরের প্রবেশ পথের ডান দিকে মেন রোডের ধারে পঞ্চরত্ন জলেশ্বর শিব মন্দিরটিকে। তাই লোকমুখে ১০৮ মন্দির হলেও আসলে ১০৯ টি মন্দির। মূল মন্দিরের পূর্ব দিকে রোডের ধারে জলেশ্বর মন্দিরের ধাঁচে আরও একটি পঞ্চরত্ন শিবমন্দির রয়েছে যার নাম রত্নেশ্বর। যদিও এই মন্দিরের সাথে নবকৈলাস মন্দিরের কোনো সম্পর্ক নেই।
সকাল ৫ টা থেকে দুপুর ১২ টা এবং বিকাল ৪ টা থেকে রাত্রি ৯ টা পর্যন্ত সপ্তাহের সব দিন খোলা থাকে (এখানে দুপুর ১২ টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত সমস্ত মন্দির বন্ধ থাকে)।
শিবক্ষেত্রের ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম মন্দিরগুলো দুটো সমকেন্দ্রিক জ্যামেতিক বৃত্তে সাজানো। বাইরের বৃত্তে ৭৪টি এবং ভেতরে বৃত্তে ৩৪ টি মন্দির আছে। মন্দিরগুলোর ভেতরে শ্বেতপাথর ও কালো কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ পর্যায়ক্রমে রয়েছে। মন্দিরের সাদা শিবলিঙ্গ গুলো ভগবান সদাশিবের প্রতীক আর কালো শিবলিঙ্গ গুলো হচ্ছে রুদ্রের প্রতীক। অর্থাৎ শ্বেতবর্ণ শিবের অর্থ তিনি চৈতন্য, জ্ঞান আর কৃষ্ণবর্ণ শিবের অর্থ তিনি বোধের অতীত। শিবক্ষেত্রের ভেতরে মন্দিরগুলোতে একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখলাম শিবলিঙ্গের উপরে থাকা গৌরীপট্টগুলো প্রতাপেশ্বর মন্দিরের অভিমুখে রয়েছে। সোমনাথ-দার কথা অনুযায়ী এবারে বোঝা গেলো কেন প্রতাপেশ্বর মন্দির আগে দর্শন করা উচিত। আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখতে পেলাম এখানে আটচালা মন্দিরের মোট চূঁড়া রয়েছে ১১২ টি, অনেকেই হয়তো এটা খেয়াল করেননি। এই আটচালা মন্দিরগুলোর মধ্যে শিবলিঙ্গ আছে এইরকম মন্দিরের চূড়া সংখ্যা ১০৮ টি। বৃত্তাকার সারিবদ্ধ মন্দিরগুলোর কেন্দ্রস্থলে লোহার জাল দ্বারা পরিবেষ্টিত এক কুঁয়ো রয়েছে যেখানে দাঁড়িয়ে ৩৪ টি শিবলিঙ্গ একসাথে দেখা যায়। কুঁয়োটিকে 'শুন্য অর্থ নিরাকার' ব্রহ্মস্বরূপ পরম শিবের প্রতীক বলা যায়। কোনো তত্ব নয় মন্দিরের পুজোপার্বনের উদ্দেশ্যেই এই কুয়াটি তৈরি করা হয়েছিল। সোমনাথ-দা বললেন, শোনা যায় রাজ আমলে এই জলাধার দিয়ে রাজবাড়ী পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গ পথ ছিল, তবে সেই সুড়ঙ্গ পথের কোনো নিদর্শন এখানে দেখতে পেলাম না।

মন্দিরের সারি
রাজবাড়ী মন্দির কমপ্লেক্স

নবকৈলাস মন্দিরের উল্টোদিকেই রয়েছে কালনার অন‍্যতম টেরাকোটার মন্দির সমূহ যা রাজবাড়ীর মন্দির কমপ্লেক্স নাম পরিচিত। বর্ধমান রাজাদের আনুকূল্যে কালনায় প্রচুর মন্দির নির্মাণ হয়েছিল। কালনার রাজবাড়ীটিকে একরকম মন্দিরময় প্রাসাদ চত্বর বলা যেতেই পারে। নব কৈলাস মন্দির থেকে বেরিয়ে পুনরায় রাজবাড়ী মন্দির কমপ্লেক্সে প্রবেশ করলাম। গেট দিয়ে ঢুকেই দেখি সামনে সাজানো বাগান। দু'পা এগিয়েই আবার চলে এলাম প্রতাপেশ্বর মন্দিরের কাছে। রাস্তার বাঁদিকে এই মন্দিরের পাশে রয়েছে রাজবাড়ীর পুরাতন ছোট্ট একটি কামান।

রাজবাড়ীর কামান
প্রতাপেশ্বর মন্দিরের কাছেই দেখা গেলো অতীতের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক ছাদবিহীন রাসমঞ্চ যা রাজবাড়ীর এক অন‍্যতম নিদর্শন। এই রাসমঞ্চটি মূলত লালজী মন্দিরের অংশ ছিল। রাসমঞ্চটি অষ্ট কোণাকৃতি একটি বেদীর ওপর অবস্থিত, মঞ্চটির আটটি খোলা দরজা ও তার উপর গম্বুজাকৃতি শিখর। ইসলামিক স্থাপত্যের প্রভাব রয়েছে এর গম্বুজে। মঞ্চের চারদিকে আর একটি অষ্ট কোণাকৃতি বৃত্তাকার বেষ্টনী রয়েছে যার ইঁটের তৈরি প্রতিটি দেওয়ালে তিনটি করে খিলানাকার খোলা দরজা রয়েছে। এই বৃত্তাকার বেস্টনীকে 'সুগোল প্রাঙ্গণ' বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। একদা এই মঞ্চে রাস উৎসব পালিত হত। রাসমঞ্চের সম্মুখে রয়েছে লালজীউ মন্দির। এই রাজবাড়ী মন্দির কমপ্লেক্সের মধ্যে ছোট বড়ো বহু মন্দিরের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো মন্দির দুটির একটি লালজীউ মন্দির এবং অন্যটি কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির।

রাসমঞ্চ
রাসমঞ্চ থেকে কিছুটা এগিয়ে চলে এলাম লালজীউর মন্দিরে। কালনায় বর্ধমান রাজাদের তৈরী মন্দিরগুলোর মধ্যে লালজীউ মন্দিরটিই হলো সবচেয়ে প্রাচীন। রাজা কীর্তিচন্দ্র ১৭৩৯ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। শোনা যায়, রাজা কীর্তিচন্দ্রের মাতা ব্রজকিশোরী দেবী এক বৈষ্ণব সাধকের কাছে লালজীউ অর্থাৎ একটি কৃষ্ণ-মূর্তি পেয়েছিলেন। পরে ওই বিগ্রহের পাশে রাধিকার বিগ্রহ স্থাপন করা হয়। রাজা কীর্তিচন্দ্র তাঁর মায়ের অনুরোধে এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। স্থাপত্যশৈলীতে লালজীউ মন্দিরটি সারা বাংলায় পঁচিশরত্ন মন্দিরের মধ্যে সবচেয়ে সেরা। মন্দিরটিতে রথের চূড়ার মত তিনটি স্তরে মোট পঁচিশটি চূড়া রয়েছে। এইরকম পঁচিশরত্ন মন্দির সারা পশ্চিমবঙ্গে কেবলমাত্র পাঁচটি রয়েছে যার মধ্যে তিনটিই রয়েছে কালনায় কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির, লালজীউ মন্দির ও গোপালজীউর মন্দির, এছাড়া বাঁকুড়া জেলায় সোনামুখীর শ্রীধর মন্দির, আর একটি হুগলী জেলার সুখড়িয়ায় আনন্দময়ী কালী মন্দির।

লালজীউ মন্দির
লালজীউ মন্দির চত্বরটি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। প্রবেশপথের উপরে আছে নহবতখানা। নহবতখানা দিয়ে ঢোকার সময় মাথার ঠিক উপরে দেখি রয়েছে কাঠের তৈরি ছোট তিনটে ঘোড়ার প্রতিকৃতি। রাজবাড়ি কমপ্লেক্সে ঢোকার মুখে যে কামানটি দেখা গেলো শোনা যায় ওই কামানটি এই নহবতখানার ওপরে রাখা থাকতো। প্রবেশদ্বার পেরিয়ে প্রথমেই নজরে পড়লো এক পালকি, সোমনাথ-দা বললেন অতীতে এই পালকিতে করে লালজীউ মন্দিরের প্রতিষ্ঠিত রাধা-কৃষ্ণের মূর্তিকে বিশেষ দিনে সামনের নবকৈলাস মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হতো।

পালকি
লালজীউ মন্দির প্রাঙ্গনে রয়েছে গিরিগোবর্দ্ধন মন্দির ও আধুনিক বারান্দা যুক্ত নারায়ণ মন্দির। চার চালা বিশিষ্ট এই নারায়ণ মন্দিরে ১০৮ টি নারায়ণ শিলা পূজিত হতো। গিরিগোবর্দ্ধন মন্দিরটি লালজীউর ভোগমন্দির। ১৭৫৮ খ্রীষ্টাব্দে এই গিরিগোবর্দ্ধন মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। মন্দিরটি এক অভিনব নির্মাণ রীতির নিদর্শন। এটি কৃষ্ণের গিরিগোবর্দ্ধন ধারণের সুপরিচিত কাহিনীর অনুসরণে তৈরি বাংলা রীতির একটি দোচালা মন্দির। মন্দিরটি প্রচলিত কোনো পদ্ধতিতে তৈরি না করে বড় বড় শিলাখণ্ডের আকারে বিন্যস্ত। অর্থাৎ কৃষ্ণের গোবর্দ্ধন ধারণের প্রতীক স্বরূপ মন্দিরের ছাদ ও বাইরের অংশ ইঁট চুন বালির তৈরি বড় বড় শিলাখণ্ডের প্রতিরূপে ঢাকা। বারান্দহীন খোলা দরজার এই মন্দিরের বাঁকানো চালাটি তৈরি হয়েছে উত্তর ভারতের গোবর্দ্ধন পাহাড়ের আদলে এবং তার খাঁজে খাঁজে রয়েছে চুন সুরকির তৈরি নানা দেবতা ও বিভিন্ন জীবজন্তুর মূর্তি।

গিরিগোবর্দ্ধন মন্দির
চলে এলাম লালজীউ মন্দিরে। মূল মন্দিরটি একটি উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরের গায়ে অসংখ্য টেরাকোটার অলঙ্করণে শোভিত। লালজীউ মন্দির সংলগ্ন সমতল ভূমিতে রয়েছে একটি সুবিশাল চারচালা বিশিষ্ট নাটমন্দির। নাটমন্দিরের সামনে তিনটি ও দু'পাশে পাঁচটি করে খোলা দরজা রয়েছে। খিলান দরজার পিলারগুলিতে রয়েছে অসংখ্য টেরাকোটার কাজ। নাটমন্দিরের ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেলো লালজীউর বিগ্রহের দিকে মুখ করে একটি ছোট্ট মঞ্চের উপর উপবিষ্ট প্রণাম ভঙ্গিতে এক গড়ুর বিগ্রহ। মূল মন্দিরের গর্ভগৃহের সামনে তিনখিলানযুক্ত বারান্দার পিলারগুলোতেও রয়েছে নানা পৌরাণিক ভাস্কর্য এবং মাঝখানের খিলানের মাথায় ভাস্কর্যগুলোর ওপর ফ্রেসকোর আভাস দেখা গেলো। মন্দিরের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে রয়েছে এক দালানের ঢাকা বারান্দা এবং পিছনে রয়েছে একটি রন্ধনশালা।

লালজি মন্দিরগাত্রে পোড়ামাটির অলঙ্করণ
লালজীউ মন্দিরের পাশেই কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরে যাওয়ার পথে পড়লো তিন খিলানের দালান আকৃতির দক্ষিণমুখী একটি শিব মন্দির। রূপেশ্বর শিব মন্দির নামে পরিচিত এই দেবালয়টি একটি ভিত্তিবেদীর উপরে অবস্থিত। মন্দিরের সামনের দেওয়াল ও খিলানের পিলার গুলোতে অসংখ্য টেরাকোটার কাজ করা। রাজা তিলোকচন্দ্রের প্রথমা স্ত্রী রাণী রূপকুমারী দেবী ১৭৬১ খ্রীষ্টাব্দে ত্রিপুরারি শিবের এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত করেন। রূপেশ্বর শিব মন্দিরের পাশেই রয়েছে ছোট ছোট বিভিন্ন আকৃতির পরপর পাঁচটি আটচালা রীতির পঞ্চশিব মন্দির। এগুলো সমতল ভিত্তিবেদীর উপরে প্রতিষ্ঠিত। এদের দক্ষিণ দিক থেকে পর পর চারটির মুখ পশ্চিম দিকে, শেষেরটি পূর্ব দিকে। মন্দিরগুলোর মধ্যে দক্ষিণ দিক থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয়টি অপেক্ষাকৃত বড়, তৃতীয় মন্দিরটি হলো কাশীনাথ মন্দির। ১৮৪৫ খ্রীষ্টাব্দে রাজা তেজচন্দ্রের পঞ্চম স্ত্রী রাণী কমলকুমারীর প্রিয় সহচরী দেবকী দেবীর প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরটি। এই পঞ্চশিবের মন্দিরের প্রথম মন্দিরটি দেখে মনে হবে কিছুটা বসে গেছে কিন্তু শোনা যায় মন্দিরটি নির্মাণের সময় থেকেই এইরকম ছিল।

রূপেশ্বর শিব মন্দির (বাম দিকে) ও পঞ্চশিবের মন্দির (ডানদিকে)
রূপেশ্বর ও পঞ্চশিব মন্দির থেকে আরও একটু এগিয়ে চলে এলাম কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরে। এই মন্দিরটিও পঁচিশ চূড়ার। রাজবাড়ী কমপ্লেক্সের মধ্যে অবস্থিত এটি দ্বিতীয় পাঁচিশরত্ন মন্দির। লালজীউ মন্দিরের সাথে স্থাপত্যরীতির মিল থাকলেও কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরের টেরাকোটা অলঙ্করণ লালজীউ মন্দিরের তুলনায় অনেক উৎকৃষ্ট।

কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির
১৭৫১ খ্রীষ্টাব্দে বর্ধমানের জমিদার রাজা ত্রিলোকচন্দ্রের মা লক্ষ্মীকুমারী দেবীর নামে এই মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন। দক্ষিণমুখী এই কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরটি একটি উঁচু বেদীর উপরে প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরের দক্ষিণদিকে বাড়ানো চারচালার খিলান অংশটি নাটমন্দির। মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রধান সিংহাসনে রয়েছে দারু কাঠের তৈরি কৃষ্ণচন্দ্র ও রাধার বিগ্রহ। অন্য একটি সিংহাসনে রয়েছে দু'জোড়া রাধাকৃষ্ণ। এই দুজোড়া বিগ্রহকে সামনের রাধাবল্লভজীর মন্দির থেকে এখানে স্থান্তারিত করা হয়েছে। মন্দিরে নিত্য পূজো হয়। গর্ভগৃহের মূল দরজা একটি। মন্দিরের বাইরের দিকে পূর্ব ও উত্তর দেওয়ালের গায়ে রয়েছে কৃত্রিম দরজা। মন্দিরের সামনে রয়েছে তিনখিলানযুক্ত বারান্দা। খিলানের পিলারগুলোতে রয়েছে পোড়ামাটির কাজের নিদর্শন। মন্দিরের গায়ে এবং প্যানেলগুলোতেও অসাধারণ টেরাকোটার অলঙ্করণ দেখতে পাওয়া যায়।

কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরের গায়ে পোড়ামাটির অলঙ্করণ
কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরের সীমানার মধ্যে রয়েছে তিনটি উপমন্দির। কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরের বারান্দায় দক্ষিণমুখী হয়ে দাঁড়ালে বামদিকে পড়বে রাম সীতার মন্দির, ডানদিকে বদ্রীনারায়ণের মন্দির আর সোজাসুজি সামনের দিকে রাধাবল্লভজীর মন্দির। রামসীতা মন্দিরটি পশ্চিমমুখী। এটি পাঁচ খিলানের বারান্দাযুক্ত সমতল ছাদের দালানরীতিতে তৈরি। এই মন্দিরে পরিবার ও পারিষদ সহ রামসীতা রয়েছেন। সবই দারু কাঠের তৈরি মূর্তি।

রামসীতা মন্দিরের বিগ্রহ
রামসীতা মন্দিরের মুখোমুখি একই মাপ ও আকৃতির পূর্বমুখী মন্দিরটি বদ্রীনারায়ণের। এখানে রয়েছে নারায়ণের মূর্তি। মূর্তিটি কালো পাথরের তৈরি। কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরের মুখোমুখি রাধাবল্লভজীর মন্দিরটি খোলা বারান্দার সাধারণ হলঘরের মতো দালানরীতিতে তৈরি। এই মন্দিরের অন‍্যতম আকর্ষণ হলো বহু প্রাচীন পঞ্চবটি গাছটি, যেখানে পাঁচটি ভিন্ন গাছ সম্মিলিত অবস্থায় রয়েছে। রাধাবল্লভজীর মন্দিরের বিগ্রহ সামনের কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরে স্থান্তারিত করা হয়েছে।

রামসীতা মন্দির (বাম দিকে)
কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির প্রাঙ্গনের পূর্বদিকে রয়েছে বিজয় বৈদ্যনাথ শিব মন্দির। রাজবাড়ী কমপ্লেক্সের ভেতরে একটি আলাদা প্রাচীর ঘেরা জায়গায় অবস্থিত হলেও কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরের প্রাচীরের দরজার মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে মন্দির প্রাঙ্গন পেরিয়ে তারপর বিজয় বৈদ্যনাথ শিব মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। মন্দিরটি কুমার মিত্রসেন রায় ও তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীকুমারী দেবীর ইচ্ছেতেই তাঁদের পুত্র রাজা ত্রিলোকচন্দ্র রায় নির্মাণ করেছিলেন। লক্ষ্মীকুমারী দেবী বৈদ্যনাথ শিবকে আরাধনা করে ত্রিলোকচন্দ্রকে পেয়েছিলেন। সেই ত্রিলোকচন্দ্র রাজা হয়ে মানত পূরণের জন্যই এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। পূর্বমুখী আটচালা এই মন্দিরের সামনের দিকে তিন খিলানের খোলা দরজা রয়েছে। দরজার দু'পাশে সারি দিয়ে টেরাকোটার কাজ উপরের কার্নিশ পর্যন্ত উঠে গেছে। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠিত কালো শিবলিঙ্গ রয়েছে এবং এখানে নিত্য পুজো হয়।

বিজয় বৈদ্যনাথ মন্দির
রাতের ঝলমলে আলোয় সেজে ওঠা এই মন্দিরগুলোর সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে হলে অন্তত একটা রাত্রি এখানে থাকতেই হবে। দেখতে দেখতে দুপুর ১২ টা হয়ে গেলো, মন্দির বন্ধ হওয়ার সময় হয়ে যাওয়ায় এবার আমাদের বাড়ি ফেরার পালা অতএব এইটুকু দেখিয়ে সোমনাথ-দা আমাদের বাইকে করে স্টেশনে পৌঁছে দিলেন। পরে কালনার বাকি ঐতিহাসিক স্থানগুলি দেখার জন্য আরও একবার সময় করে আসার জন্য বললেন। কালনার টেরাকোটার মন্দির সমূহ ঘুরে দেখার পরে মনে হলো বিষ্ণুপুরের থেকে এখানের মন্দিরগুলো কোনো অংশে কম নয় কিন্তু প্রচারের অভাবে অনেকের কাছে আজ এগুলো অজানা। বিষ্ণুপুরের মতোই মন্দির ও ইতিহাসের এক অনবদ্য মিলনক্ষেত্র এই কালনা। ছবি তুলতে যারা ভালোবাসেন সেই সব ভ্রমণপিপাসুদের উদ্যেশ্যে জানাই সপ্তাহের একটা দিন কালনার জন্য রাখা যেতেই পারে। এখানে যেকোনো মন্দিরের ছবি তোলা যায়, কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।

বাড়ি ফেরার পালা
» প্রয়োজনীয় তথ্য

মিষ্টি প্রিয় বাঙালিদের জন্য বলি কালনায় ঘুরতে যাবেন আর সেখানের মিষ্টি খাবেন না এটা হতে পারে না। কালনার সুনাম তার মিষ্টিতে। মাখা সন্দেশ তো রয়েছেই, এ ছাড়াও কালনার জোড়া সন্দেশ, নোড়া পান্তুয়া, ছানার মুড়কিও খুব বিখ্যাত। 'মা অম্বিকা সুইটস্' কালনার সেরা মিষ্টির দোকান এদের ছয়টি শাখা দোকান আছে যদিও সবকটি সমান নয়। চকবাজার এলাকার দোকানটি খুব ভালো। যেহেতু কলকাতা থেকে অম্বিকা কালনা ঘুরে দেখে একদিনেই ফিরে আসা যায় তাই রাত্রিবাসের কোনও প্রয়োজন হয় না। তবে রাতের আলোয় মন্দির গুলো দেখে রাত্রিবাস করতে হলে ভালো থাকার জায়গা রাজবাড়ী কমপ্লেক্সের কাছে 'রামকৃষ্ণ লজ'। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে ভরসা করতে হবে ছোটখাটো রেস্টুরেন্টের ওপরে। হোটেল প্রিয়দর্শিনী, হোটেল মা অম্বিকা, মাতৃ হিন্দু হোটেল এবং আহার হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট হল কালনার কিছু জনপ্রিয় হোটেল।

» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ- 'বর্ধমান:ইতিহাস ও সংস্কৃতি' - যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী, 'কালনা মহকুমার প্রত্নতত্ব ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিবৃত্ত' - বিবেকানন্দ দাশ এবং তথ্য সহযোগীতায়ঃ- সোমনাথ)
Arabinda Pal
1 Comments
Share This Post :

You Might Also Like

1 comment:

[name=Arabinda Pal] [img=https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEia50rmuKEAcbGUbQKvAbzUmdviiIhm-LeVlsEEdFx_xtGfyvx8O02yFVuJemgswzSA8PoMcN-XW0AcinKr9iq28lHK43Z4TFFyL7pJyGGxLNx9LGn0cLvPz0lUJzNrWBo9n_NyxGLjDII/h120/IMG_2788.jpg] [description=পর্যটক হিসাবে নয়, একজন ভ্রমণকারী হিসাবে বেড়ানোটা আমার কাছে একটা নেশা এবং ফটোগ্রাফিতেও আমার ভীষণ শখ। তাই একজন ভ্রমণকারী হিসাবে আমার এই ব্লগে নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে লেখা ও ছবিগুলো যদি আপনাদের ভালো লাগে তাহলে অবশ্যই আপনাদের মতামত কমেন্টসের মাধ্যমে জানাতে ভুলবেন না।] (facebook=https://www.facebook.com/groups/2071066419824586/user/100002484831922) (twitter=Twitter Profile Url) (instagram=https://www.instagram.com/arabindapal2020/) (bloglovin=Blogvin Profile Url) (pinterest=https://www.pinterest.com/arabindapalbrb/) (tumblr=Tumblr Profile Url)

Follow @Arabinda Pal