পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার কাছে গনগনিতে শিলাবতী নদীর পাড় বরাবর যে বিচিত্র ভূমিরূপ দেখা যায় তা সত্যিই অবর্ণনীয়। গনগনির এই অঞ্চলকে অনেকে 'পশ্চিমবঙ্গের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন' নামেও উল্লেখ করেছেন। এবার শীতে আমাদের টাউনশিপের কয়েকজন রেসিডেন্ট মিলে গনগনিতে পিকনিক করতে যাওয়ার প্ল্যান করলাম। এর আগে, ভাবলাম বহুদিন পরিবারের সাথে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। অতএব রবিবারের ছুটিতে নিজেই গাড়ি চালিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম গনগনির উদ্দেশ্যে। ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে সোজা গড়বেতা। এরপর হাইওয়ে ছেড়ে বাঁ দিকে বেঁকে গেলাম, একটা বাজার গোছের এলাকা পার হয়ে হুমগড়ের রাস্তা ধরলাম। কিছুটা এগিয়ে কলেজ মোড়। কলেজ মোড় থেকে ডানদিকে টার্ন নিলাম। লালমাটির মোরাম বিছানো রাস্তা। রাস্তার দুপাশে কাজুগাছের ঘন জঙ্গল। সেই জঙ্গল ভেদ করে পৌঁছে গেলাম গনগনির প্রান্তরে।
 |
| শিলাবতী নদী |
হঠাৎ করেই একদম অন্যরকম দৃশ্য। মনে হতে পারে, প্রাচীনকালের কোনো হারিয়ে যাওয়া সভ্যতায় এসে পড়লাম! স্থানীয়রা এই জয়গাটাকে বলে গনগনি ডাঙ্গা বা গনগনি খোলা। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে শিলাবতী নদী সবাই ডাকে তাকে 'শিলাই' বলেই। নদীর একপাশে লাল মাটির গভীর খাদ। সেই লাল মাটির পাড় জুড়ে প্রকৃতির আপন খেয়ালে তৈরি হয়েছে এক অপরূপ শিল্পকর্ম। কি অপূর্ব সৃষ্টি! দেখে মনে হচ্ছে, একটা ছোটখাটো ক্যানিয়ন। মাঠের একপাশে গাড়ি পার্ক করে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলাম একটা বাঁধানো সুন্দর সিঁড়ি। রেলিং ঘেরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এগিয়ে গেলাম, কিছুদূর নামার পর ধাপি শেষ, এরপর এবড়ো খেবড়ো ধাপগুলোতে সাবধানে পা ফেলে একেবারে নদীর ধারে পৌঁছে গেলাম।
 |
| শিলাবতীর পাড়ে এগিয়ে চলেছ |
শিলাবতীর পাড় ধরে এগিয়ে চলেছি। সামনের দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে গেল আমার। নদীর একপাড়ে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে নানা প্রাকৃতিক ভাস্কর্য। প্রকৃতির খেয়ালিপনায় এখানের ল্যাটেরাইট মাটি ক্ষয়ে গড়ে উঠেছে অপরূপ সব ভাস্কর্য। কেমন সেই সব ভাস্কর্য? মেলে দিই কল্পনার ডানা। কোথাও মনে হবে প্রাসাদ, কোথাও গুহা, কোথাও কোনো প্রাণীর মুখ, কোথাও পাহাড় আরো কত কি! এখানেই নাকি মহাভারত খ্যাত বকাসুরের গুহা, যাকে ভীম বধ করেছিলেন। আবার চূয়াড় বিদ্রোহের নীরব ইতিহাস জড়িয়ে আছে এই গনগনির সাথে।
 |
| গনগনির অবর্ণনীয় রূপ |
এই মুহুর্তে যেন একটা প্রাচীন গড়ে এসে ঢুকেছি। মনে হচ্ছে এখানে একটা দুর্গ ছিল। সেই দুর্গ আজ ধ্বংস। এখানে ওখানে প্রচুর গহ্বর। সেই সব গহ্বর কোনও কোনও জায়গায় এমন অভিনব রূপ নিয়েছে যেন মনে হচ্ছে খিলান দেওয়া কোনো মন্দিরের থাম। কোথাও যেন সিংহ দাঁড়িয়ে আছে, কোথাও আবার বুনোমোষ, তো কোথাও আবার হাতির শুঁড়। এইরকম নানা আকৃতির অসংখ্য ভাস্কর্য দেখে মনে হলো যেন কোনো শিল্পী তার নিজের হাতে ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে খোদাই করে তৈরি করেছেন। কিন্তু মানুষের হাতের স্পর্শ ছাড়া প্রকৃতির তৈরি এমন অদ্ভূত সব ভাস্কর্য সত্যিই বিরল।
 |
| প্রাচীন গড়ে এসে ঢুকেছি |
পর্যটক এবং ফটোপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। একদিকে লালমাটি, অন্যদিকে শান্ত শীলাবতী; সব মিলিয়ে গনগনির এক অসাধারণ রূপ। চারিদিক ভীষণ চুপ চাপ। নদী এখানে বিশেষ গভীর নয়। তিন ঋতুতে এর সৌন্দর্য তিনরকম। তবে সবচেয়ে ভাল শীতে। সত্যিই যেন রূপকথার আদর্শ প্রেক্ষাপট। চারদিক ঘুরে দেখতে দেখতে এতটাই তন্ময় হয়ে গেছিলাম যে কখন সূর্য্টা ঝোপজঙ্গলের মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছিলো তা খেয়াল করতে পারিনি। অতএব রূপকথা, পুরাণ, ইতিহাসের অলিগলি ঘুরে বাঁকানো সিঁড়ি পথে আবার বাস্তবে ফিরে আসা।
 |
| বাঁকানো সিঁড়ি পথে ফিরে আসা |
গনগনির অদ্ভুত ভূমিরূপ গঠনের রহস্য
ভূবিজ্ঞানী মতে বহু যুগ ধরে শিলাবতী নদীর জলের স্রোতে ভূমিক্ষয় এবং তার সাথে তীব্র বাতাসের আনাগোনা ও ঘর্ষণের ফলে যে রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়েছে তার ফলে গড়ে উঠেছে এইরূপ নানাধরনের ভাস্কর্যের। গনগনির এই প্রাকৃতিক গড়ন নিয়ে একটি পৌরাণিক গল্পকথা প্রচলিত আছে।
 |
| প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় ভূমিরূপ |
অতীতে বগড়ীর এই অঞ্চল মহাভারতে উল্লেখিত বক রাক্ষসের রাজ্য ছিল বলে অনুমান করা হয়। পান্ডবরা অজ্ঞাতবাসকালে কিছুদিন এই অঞ্চলে অবস্থান করেছিলেন। সেই সময় যুধিষ্ঠির বক রাক্ষসের অত্যাচার থেকে গ্রামের মানুষকে রক্ষা করতে কুন্তীপুত্র ভীমকে পাঠিছিলেন। এখানেই ভীমের হাতে ঐ ভয়ানক বক রাক্ষস নিহত হয়। বক রাক্ষস আর ভীমের মধ্যে যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয়েছিল তার ফলেই এখানকার জমির নানান জায়গা বসে গিয়ে এইরকম আশ্চর্যজনক ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়েছে। শিলাবতীর ক্ষয়কার্যের ফলে ল্যাটেরাইট মাটিতে গড়ে ওঠা এমন অদ্ভূত ভূমিরূপ ও শাল-পিয়ালের জঙ্গলে ভরা গনগনিকে দেখে মহাভারতে উল্লেখিত কাহিনীর মতো মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু মনে হল না।
 |
| যেন এক রূপকথার রাজ্য |
ইতিহাসের পাতায় গনগনি
গনগনি ঐতিহাসিক দিক থেকে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলায় তখন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসন। ইংরেজরা সবে জাঁকিয়ে বসেছে। তখন বগড়ীর এই অঞ্চলের রাজা তথা জমিদার ছিলেন ছত্র সিংহ। কোম্পানি ছত্র সিংহের জমির ওপর চড়া খাজনা ধার্য করে। একসময় তিনি ইংরেজদের নির্ধারিত সেই খাজনা দিতে পারলেন না। তখন ইংরেজরা তার হাত থেকে জমিদারি কেড়ে নতুন জমিদার খুঁজতে লাগলো। এতে বিপাকে পড়লো তাঁর আশ্রিত নায়েকরাও। তারা তাদের জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হল। জমি তাদের কাছে বাঁচা-মরার প্রশ্ন। শুরু হল বিদ্রোহ। সর্দার অচল সিংহের নেতৃত্বে সারা জঙ্গলমহল জুড়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠলো। এই বিদ্রোহ 'বগড়ী'-র লায়েক বিদ্রোহ বা পাইক বিদ্রোহ এবং ইংরেজদের ভাষায় এটা 'চুয়াড় বিদ্রোহ' নামেই পরিচিত।
 |
| গনগনি ডাঙ্গা |
সর্দার অচল সিংহ ছিলেন এই লায়েক বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক। দলবল নিয়ে আস্তানা গড়লেন গনগনির গভীর জঙ্গলে। নায়েকদের এই বিদ্রোহে তখন হুগলী ও মেদিনীপুর জেলার পার্শবর্তী অঞ্চল কেঁপে ওঠে। কোম্পানির গভর্ণর জেনারেলের কানে এই খবর পৌঁছায়। তিনি এই বিদ্রোহ দমন করতে ওকেলী নামে এক ইংরেজ সেনাপতির নেতৃত্বে একদল সৈন্যবাহিনী পাঠালেন। এইসময় গনগনির মাঠের মধ্য থেকে যে বিদ্রোহ শুরু হয়, তার ইতিহাস 'আগুনের মতই গনগনে'। অচল সিংহ দীর্ঘদিন বগড়ী রাজের অধীনে সেনাবাহিনীর উচ্চপদে ছিলেন এবং সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি নায়েকদের সংঘবদ্ধ করে ছোটছোট সৈন্য বাহিনীতে গড়ে তোলেন। বিদ্রোহী নায়কেরা শালের জঙ্গল থেকে সহজেই নির্ভুল লক্ষ্যে ইংরেজ সৈন্যদের তীরবিদ্ধ করে নাজেহাল করে তুললো। শেষে ওকেলী সাহেব একদিন এই গনগনি ডাঙ্গার চারপাশে কামান বসিয়ে রাতের অন্ধকারে সমস্ত জঙ্গল বিধ্বস্ত করে নায়েকদের ঘাঁটিগুলোকে ধ্বংস করে দিলেন, বন্দী হলো অনেকে। তবু দমানো গেলো না অচল সিংহকে। পরেরদিন সেখানে অসংখ্য নায়েক সৈন্যকে নিহত ও আহত অবস্থায় পাওয়া গেলেও অচল সিংহের খোঁজ পাওয়া গেল না। গনগনির মাঠ থেকে পালিয়ে অন্য বনে ঘাঁটি গেড়ে আবার নতুন করে বিদ্রোহ শুরু করলেন। কোম্পানির সৈন্যদল অনেক চেষ্টা করেও অচল সিংহকে ধরতে পারছিল না। এই সুযোগে বগড়ীর রাজচ্যুত রাজা ছত্র সিংহ নিজের রাজ্য উদ্ধারের লোভে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। ইংরেজ সেনাপতিকে অচল সিংহের গােপন আস্তানার তথ্য জানিয়ে তাঁকে ধরিয়ে দেন। বন্দী হলেন অচল সিংহ। ধরা পড়লো তাঁর বাহিনী। বিচার শুরু হল। এরপর গনগনির এই রুক্ষপ্রান্তরে তাঁকে প্রকাশ্য দিবালোকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
 |
| প্রকৃতির তৈরি ভাস্কর্য |
ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও পৌরাণিক গল্পগাথা যাই হোক সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময় গনগনির রূপ সত্যিই অবর্ণনীয়। সূর্যাস্তের রক্তিম আভায় এই গনগনিতে যেন আগুন জ্বলে ওঠে। ইচ্ছা করলে সারা বছরই এখানে আসা যায়। তবে, একটু ঠান্ডার সময়ে অর্থাৎ শরৎকাল থেকে বসন্তকাল এই সময়ে তাপমাত্রা সহনশীল থাকে তাই ইচ্ছে মতো ঘুরতে পারা যায়। গাছপালা না থাকায় অন্যান্য সময় সকালের পরে অত্যন্ত গরম হয়ে যায় তাই ঘুরতে খুব অসুবিধা হয়।
একবারে খাদের ধারে গিয়ে ফটো বা সেলফি তোলা বিপজ্জনক। এখানে ফটো ও সেলফি তুলতে গিয়ে অনেক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে, এমনকি পা হড়কে খাদে পড়ে মৃত্যুও হয়েছে।
এখানে আসার পরে যা বুঝলাম কেবলমাত্র শীতকালে পিকনিকের সময় এবং বিশেষ কিছু দিনে গনগনিতে ঘুরতে যাওয়া ভালো, কারণ ঐ দিনগুলো ছাড়া সারা বছরই জায়গাটা নিরিবিলি থাকে, তাই অন্যসময় এখানে দলবদ্ধ হয়ে আসা উচিত একা নয়, নির্জন এই জায়গায় আশেপাশে একটিও দোকান বা জনবসতির দেখা পেলাম না। তবে বর্তমানে সরকারি প্রচেষ্টায় এই জায়গাটিকে সাজিয়ে তোলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দুটি বাংলো তৈরি করা হয়েছে এবং পিকনিকের জন্য আলাদা স্পটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
 |
| পিকনিকের শেড |
» প্রয়োজনীয় তথ্যপিকনিকের সময়ে বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার ফলে রাজ্য পুলিশের তরফে এখানে একটা ওয়ার্নিং বোর্ড লাগানো হয়েছে। একেবারে খাদের ধারে গিয়ে ফটো ও সেলফি তোলা উচিত নয়। এখানে মদ্যপান বা অশালীন কিছু আচরণ দেখলে সিভিক পুলিশেরা প্রশাসনের নির্দেশ মতো ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে। মনে রাখবেন এখানে থার্মোকল বা প্লাস্টিকের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ, ১০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
» থাকার ব্যবস্থাগনগনিতে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। থাকার পরিকল্পনা থাকলে গড়বেতাতে থাকতে হবে। গড়বেতায় থাকার জন্য সোনাঝুরি গেস্টহাউস, আপ্যায়ণ লজ, শ্যামভবন ধর্মশালা উল্লেখযোগ্য। ভাড়া আনুমানিক ৫০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে।
» গড়বেতায় থাকার লজ ও গেস্ট হাউস- সোনাঝুরি গেস্টহাউসঃ- +৯১ ৯৫৪৭৫১৪০৩০
- আপ্যায়ণ লজঃ- +৯১ ৮৩৪৮৬৯৪৮০১, +৯১ ৯৪৩৪১৩৯১৩৫
- শ্যামভবন ধর্মশালাঃ- +৯১ ৯৮৩২৭৮২২৯৩
» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ- 'মেদিনীপুরের ইতিহাস' - যোগেশচন্দ্র বসু )
GANGANI, GARBETA, PASCHIM MEDINIPUR, WEST BENGAL
No comments:
Post a Comment