Theme Layout

Boxed or Wide or Framed

Theme Translation

Display Featured Slider

Yes

Featured Slider Styles

[Centred][caption]

Display Grid Slider

No

Grid Slider Styles

[style5][caption]

Display Trending Posts

Display Author Bio

Yes

Display Instagram Footer

Yes

Dark or Light Style

লালবাগ যার পথে ছড়ানো ইতিহাস ...



লালবাগ, মুর্শিদাবাদ জেলার এক ঐতিহাসিক শহর। মুর্শিদাবাদে আমাদের আদি বাসস্থান হওয়ার সুবাদে গত পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে বহুবার বহরমপুরে যাতায়াত করেছি। কিন্তু ওই যে ঘরের কাছে তাই কোনো একদিন দেখলেই হবে এমন ভাব নিয়ে চক্ষু মেলিয়া আজও দেখা হয় নাই মুর্শিদাবাদকে। মুর্শিদাবাদের এলোমেলো রাস্তাঘাটে ও ঘিঞ্জি গলির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ব্রিটিশ আমল ও স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ভারতের ঐতিহাসিক নিদর্শন। হাজারদুয়ারী প্রাসাদ, নিজামত ইমামবাড়া, কাটরা মসজিদ, জাহানকোষা কামান, ফুটি মসজিদ, বাচ্চাওয়ালি তোপ, জাফরগঞ্জ, খোশবাগ, কাঠগোলা বাগান, জগৎ শেঠের বাড়ি, নশিপুর রাজবাড়ী, নমকহারাম দেউড়ি, চারবাংলার মন্দিরের মতো জায়গাগুলো ছাড়াও এখানের দর্শনীয় স্থানের তালিকা এতটাই লম্বা যে লিখে শেষ করা কঠিন। হাজারদুয়ারী সহ মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর বেশিরভাগই লালবাগে অবস্থিত। ভাবলাম এমন ঐতিহাসিক স্থান চাক্ষুস না করলেই নয়।

কাটরা মসজিদ
ডোমকলের কাছে একসময় আমার পূর্ব-পুরুষেরা বসবাস করতেন। যদিও বর্তমানে সেই বাসস্থানের কোনো চিহ্ন নেই। বাপ-ঠাকুর্দার সেই আদি বসতভূমির টানে এখনো মাঝে মধ্যে ঢুঁ মেরে আসি। আদি বসতভূমি থাকার দৌলতে ডোমকল নিবাসী অমলের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে। দিনটি ছিল জানুয়ারির মাঝামাঝি। অমলের বাড়িতে আমরা সপরিবারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ঠিক করলাম একদিনের জন্য হলেও এবার লালবাগ থেকে ঘুরে আসবো। প্রবল শৈত্যপ্রবাহ আর কনকনে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে স্নানটান সেরে ব্রেকফাস্ট খেয়ে রেডি হতেই প্রায় ন'টা বেজে গেলো। ডোমকল থেকে আমরা দুটো ফ্যামিলি একসাথে গাড়িতে চেপে বেরিয়ে পড়লাম লালবাগ এর দিকে। অমল স্থানীয় বাসিন্দা হওয়ায় সমস্ত রাস্তা তার জানা তাই আমার গাড়ি চালিয়ে যেতে কোনো অসুবিধা হয়নি। ডোমকলের দিক থেকে লালবাগ যাওয়ার পথে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল কাটরা মসজিদ।

কাটরা মসজিদ
কাটরা মসজিদ

চলে এলাম কাটরা মসজিদে। স্থাপত্যশিল্পের অনন্য নিদর্শন কাটরা মসজিদ। মুর্শিদকুলি জাফর খাঁ তাঁর বার্ধক্যকালে নিজের সমাধি-ভবন নির্মাণের আদেশ দেন। তাঁর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে তিনি চেয়েছিলেন এমন ভাবে তাঁর সমাধি নির্মিত হবে যেখানে তিনি মসজিদে প্রবেশকারী পূণ্যবান বহু মানুষের পদস্পর্শ পাবেন। তাঁর আদেশ অনুসারে মুর্শিদাবাদের এই জায়গাতে একটি মসজিদ ও বাজার তৈরি করা হয়। কাটরা শব্দটির অর্থ হলো গঞ্জ বা বাজার। ঐ বাজার অর্থাৎ কাটরা থেকেই জায়গার নাম হয় 'কাটরা'। মোরাদ ফরাস নামে সামান্য একজন বিশ্বস্ত কর্মচারীর অধীনে এক বছরের মধ্যে ১১৩৭ হিজরি সনে অর্থাৎ ১৭২৪ খ্রীষ্টাব্দে এই সমাধি-ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। কথিত আছে, মক্কার কাবা মসজিদের অনুকরণে এই মসজিদটি তৈরি করা হয়েছিল। মসজিদটি পূর্বমুখী হলেও মসজিদের পেছনে পশ্চিম দিকে মূল প্রবেশপথ। গেট দিয়ে ঢুকে দেখি চারদিকে ফুলের সাজানো বাগান। কাটরা মসজিদের এখন ভগ্নদশা হলিও ছোট ছোট লাল ইঁটের তৈরি চতুর্ভূজাকৃতির এই মসজিদটির স্থাপত্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।

ভূমিকম্পের ফলে হারিয়ে গিয়েছে বাকি মিনার দুটি
গেট থেকে মসজিদের ডানদিকের পথ ধরে পৌঁছিয়ে গেলাম মূল প্রবেশদ্বারে। মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি এই কাটরা মসজিদেই অবস্থিত। মসজিদের প্রবেশদ্বারে ওঠার জন্য একটি বড় সিঁড়ি রয়েছে। এই সিঁড়ির নীচে একটি ছোট্ট অন্ধকার ঘরে রয়েছে মুর্শিদকুলি খাঁ-এর সমাধি। মসজিদ নির্মাণ শেষ হওয়ার বছর খানেকের মধ্যেই মুর্শিদকুলি খাঁ মারা যান। তাঁর ইচ্ছানুসারে মৃত্যুর পরে কাটরা মসজিদের এই জায়গাতে তাঁকে সমাধি দেওয়া হয়েছিল। সিঁড়ি দিয়ে উঠে দেখি একটি পাঁচটি খিলান দেওয়া বড় তোরণ দ্বার, তোরণ দ্বারের উপরে দ্বিতল নহবতখানা। তোরণ দ্বার থেকে মসজিদ পর্যন্ত দেখি বিশাল চারকোণা এক চত্বর। খোলা ও বিস্তৃত ছাদের এই বিশাল চত্বরে বহু মানুষ একসাথে নামাজ পড়তে পারেন। পুরো চত্বরটি পোড়ামাটির ফলক দিয়ে বাঁধানো হলেও, সিঁড়ি থেকে মসজিদের দরজা পর্যন্ত মাঝখানের একটি অংশ কালো পাথর দিয়ে বাঁধানো। পোড়ামাটির বাঁধানো অংশের মধ্যে নামাজপড়ার জন্য চৌকো চৌকো খোপ করে জায়গা নির্ধারণ করা আছে। এই চত্বরের পশ্চিমদিকে পাঁচটি গম্বুজ বিশিষ্ট ছোট ছোট লাল ইঁটের তৈরি এক বিশাল মসজিদ কালের আঘাত সহ্য করে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদের মাঝখানের দরজার ওপরে রয়েছে একটি কালো পাথরের ফলক।

মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি
মসজিদের পাঁচটি গম্বুজ ছাড়াও চারকোণে আটকোণাকৃতি উঁচু মিনার ছিল বর্তমানে কেবল মসজিদের পশ্চিমে পেছন দিকের দুই কোণে দুটো মিনার এখনো রয়েছে। বাকি দুটি হারিয়ে গিয়েছে ভূমিকম্পের আঘাতে। এইভাবে হারিয়ে গিয়েছে মসজিদের পাচঁটির মধ্যে তিনটে গম্বুজ। কোন প্রযুক্তিতে আর্চের উপরে দাঁড়িয়ে এই গোটা স্থাপত্যটা ভাবলে অবাক লাগে। মসজিদের চারপাশ ঘিরে রয়েছে একাধিক ছোট ছোট ঘর। ঘরগুলির একটিতেও কড়ি-বরগা নেই সবগুলোই খিলানের তৈরি। নীচে নেমে এলাম। তখন দুপুর সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। মসজিদ থেকে বেরিয়ে আমরা সামনের হোটেলে দুপুরের লাঞ্চ সেরে নিলাম। খাওয়া শেষ করে আমরা মুর্শিদাবাদের প্রাণকেন্দ্র হাজারদুয়ারীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মসজিদটি আজ প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত

নিজামত কেল্লা

মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের তালিকায় পর্যটকদের সবার প্রথমে থাকে হাজারদুয়ারী প্রাসাদ। হাজারদুয়ারী না দেখলে মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। হাজারদুয়ারীর সামনে বাস পার্কিং-এর জায়গায় এক কোণে গাড়ি পার্কিং করলাম। পরে দেখলাম এটা প্রাইভেট গাড়ি পার্কিং-এর জায়গা নয়, প্রাসাদের পশ্চিমদিকে ভাগীরথীর চরে সারি দিয়ে গাড়ি পার্কিং করা আছে। হাজারদুয়ারী প্রাসাদের পূর্বদিকে টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করে বিনামূল্যে লকার রুমে ক্যামেরা, মোবাইল জমা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম।

টিকিট ঘর
হাজারদুয়ারীর গেটের ভেতরে প্রবেশ করতেই গাইড ছেঁকে ধরলো। জানিয়ে দিলাম আমাদের কোনো গাইডের প্রয়োজন নেই। প্রসঙ্গত বলে রাখি এখানে প্রচুর ভুঁয়ো গাইড ঘোরা ফেরা করে। সরকারি পরিচয়পত্র ঝোলানো দেখে তবেই গাইড নেওয়া ভালো অন্যথায় সর্বস্ব খোয়াতে হতে পারে। মুর্শিদাবাদ ভ্রমণে পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্যস্থান এই হাজারদুয়ারী প্রাসাদটি। শুধুমাত্র ঐতিহ্যে মোড়া এই ঐতিহাসিক হাজারদুয়ারীর টানে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক এই লালবাগে আসেন। ভাগীরথীর পাশেই বিশাল এলাকা জুড়ে এই প্রাসাদ।
শুক্রবার হাজারদুয়ারী প্রাসাদের মিঊজিয়াম বন্ধ থাকে। শুক্রবার ছাড়া প্রত্যহ সকাল দশটা থেকে বিকাল চারটে পর্যন্ত খোলা থাকে। সর্বত্রই ক্যামেরা নিয়ে যাবার অনুমতি আছে, হাজারদুয়ারী, জগৎ শেঠের বাড়ি এবং কাঠগোলা প্রাসাদের ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ।
হাজারদুয়ারী প্রাসাদটি যেখানে অবস্থিত, সেই পুরো চত্বরটাকে বলা হয় 'নিজামত কেল্লা'। আসল-নকল মিলিয়ে হাজারটা দরজা রয়েছে তাই নাম 'হাজারদুয়ারী'। কার্যত হাজারটা দরজা হলেও এই প্রাসাদটিতে রয়েছে নশোটা আসল দরজা, বাকি একশোটা শত্রুর চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য তৈরি করা নকল দরজা। প্রাসাদের দেওয়ালের মধ্যে নকল দরজাগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা যে দেখতে অবিকল আসল দরজা মনে হবে। শত্রুদের বিভ্রান্ত করার জন্যই এই নকল দরজাগুলো বানানো হয়েছিল। ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত এই হাজারদুয়ারী প্রাসাদটি নবাব সিরাজ উদ-দৌলা নির্মাণ করিয়েছিলেন বলে অনেকেই ভুল করেন। সিরাজের প্রাসাদের নাম ছিল 'হীরাঝিল' যা এখন ভাগীরথী নদীতে তলিয়ে গেছে। এই হাজারদুয়ারী প্রাসাদটি তৈরি হয় সিরাজ উদ-দৌলার শাসনকালের পরে। অষ্টম নবাব নাজিম হুমায়ুনজাঁ এটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। প্রায় ১৭ লক্ষ টাকা ব্যয়ে এই পরমসুন্দর প্রাসাদটি নির্মাণ করতে সময় লেগেছিলো ন'বছর। ১৮৩৭ খ্রীষ্টাব্দে এই প্রাসাদটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। তিনতলা এই বিরাট প্রাসাদটি ইতালিও স্থাপত্যরীতিতে তৈরি। প্রাসাদের স্থাপত্যের শিল্পকলা গ্রীসিয়াস ডোরিক। জেনারেল ম্যাকলিওয়েডের নামে এক ইঞ্জিনিয়ারের তত্বাবধানে দেশীয় নির্মাণ শ্রমিকদের দিয়ে এই প্রাসাদটি তৈরি করা হয়। ম্যাকলিওয়েড ছিলেন এই প্রাসাদের স্থাপত্যকলার রূপকার।

হাজারদুয়ারী প্রাসাদ
হাজারদুয়ারী প্রাসাদের মূল প্রবেশপথের সামনে দুটি সিংহের মূর্তি, আর উপরে ওঠার ছত্রিশটি প্রশস্থ সিঁড়ি। এই প্যালেস এখন সম্পূর্ণ রূপে নবাবি ইতিহাসে সমৃদ্ধ একটা মিউজিয়াম। এই ঐতিহাসিক সংগ্রহশালায় নবাবদের ব্যবহার্য বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী সংরক্ষিত রয়েছে। গোটা মিউজিয়ামটি ঘুরে দেখতে বেশ সময় লাগলো। ভেতরে ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশ নিষেধ তাই মনের ক্যামেরায় ধরে রাখলাম।

প্রাসাদের মূল প্রবেশপথ
নিজামাত কেল্লার মধ্যে হাজারদুয়ারীর ঠিক বিপরীতে সাদা ধবধবে বিশাল দ্বিতল ভবনটি হলো মুর্শিদাবাদের প্রসিদ্ধ ইমামবাড়া। হুগলীর বিখ্যাত ইমামবাড়ার চেয়েও এটি বড়। দৈর্ঘ্যে হাজারদুয়ারীর চেয়েও বেশি। এটি ভারতের বৃহৎত্তম শিয়া ইমামবাড়া বলে কথিত। হুমায়ুনজাঁ-এর পুত্র মনসুর আলি বা ফেরুদুনজাঁ-র আমলে মুর্শিদাবাদের এই ইমামবাড়াটি তৈরি হয়েছিল। সিরাজের তৈরি ইমামবাড়াটি আগুনে লেগে পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পর ঐ একই জায়গায় নবাব নাজিম মনসুর আলি খাঁ ১৮৪৭ খ্রীষ্টাব্দে এই নতুন ইমামবাড়াটি তৈরি করেন। কথিত আছে এই নতুন ইমামবাড়াটি মাত্র ৮ থেকে ১০ মাসের মধ্যে তৈরি করা হয়েছিল। প্রতিবছর মহরম মাসের প্রথম দশদিন মহরম উপলক্ষ্যে দর্শনার্থীদের জন্য ইমামবাড়া খুলে দেওয়া হয়। ওই সময় ছাড়া বছরের বাকি সময় বন্ধ থাকায় এর ভেতরে প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। তাই ভেতরে আর ঢােকা হলাে না, কেবল বাইরে থেকেই নয়ন ভরে উপভােগ করলাম এর তিলােত্তমা সৌন্দর্য।

ইমামবাড়া
নিজামত কেল্লার দৃষ্টিনন্দন সবুজ চত্বর ও তার মাঝখানে মাঠের পূর্ব দিকে রয়েছে একটি বিশাল উঁচু ক্লক টাওয়ার। সুউচ্চ এই ক্লক টাওয়ারটিও একটি অনুপম স্থাপত্য নিদর্শন। এটি মুর্শিদাবাদের বিগ বেন এবং স্থানীয়ভাবে এটি ঘড়ি ঘর হিসাবেও পরিচিত। এই সুউচ্চ টাওয়ারের উপরিভাগে একটি বিশাল আকৃতির ঘড়ি আছে যা এখন সচল নেই। এই ঘড়ির ঘন্টা ধ্বনির জোরেলো আওয়াজ শুনে মুর্শিদাবাদের বাসিন্দারা সময় জানতে পারতেন। টাওয়ারের নীচ তলার ছাদের চারকোণে রয়েছে চারটি সিংহ মূর্তি। চমৎকার অলঙ্করণ শোভিত টাওয়ারটির চূড়ায় রয়েছে একটি গম্ভুজ। ভাগীরথী নদীর দিকে মুখ করে ঘড়ির কাটাটি রয়েছে। সম্ভবত নদীতে চলাচল করা নৌযানের নাবিক ও যাত্রীদের সহায়তার উদ্দেশ্য নিয়েই ভাগীরথ নদীর তীরে এটি নির্মিত হয়েছিল। হাজারদুয়ারি প্রাসাদের স্থপতি ডানকান ম্যাকলিওয়েডের একজন ভারতীয় বাঙালি সহকারী সাগর মিস্ত্রি এই ঘড়ির টাওয়ারটির নকশা করেছিলেন।

ঘড়ি ঘর
ইমামবাড়া ও হাজারদুয়ারী প্রাসাদের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে মসজিদের আকৃতির ন্যায় এক গম্ভুজ বিশিষ্ট বিশিষ্ট ছোট্ট ভবন 'মদিনা মসজিদ'। মসজিদের চার কোনায় চারটি মিনার রয়েছে এবং প্রতিটি মিনারের ওপর একটি করে ছোট গম্ভুজ রয়েছে। নবাব সিরাজ উদ-দৌলা এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। সিরাজের তৈরি ইমামবাড়াটি আগুনে লেগে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেলেও ঐ ইমামবাড়ার খুব কাছে থাকা মদিনা মসজিদটি অলৌকিকভাবে আগুনেই হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। এই মসজিদ নির্মাণের সময় সিরাজ উদ-দৌলা তাঁর মায়ের প্রতিজ্ঞা পালনে কারবালা থেকে মাটি এনে মদিনার নীচে এক মানুষ পর্যন্ত মাটি কেটে ভর্তি করেছিলেন। স্থানীয় দরিদ্র মুসলিমদের হজের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। ভাগীরথীর পূর্ব পাড়ে এটি সিরাজের স্থাপত্যশিল্পের একমাত্র নিদর্শন যা এখনো তাঁর স্মৃতি বহন করে।

মদিনা মসজিদ
হাজারদুয়ারী প্রাসাদের উত্তর দিকে মদিনা মসজিদের পাশেই সিমেন্টের তৈরি একটি উঁচু বেদীর ওপর রয়েছে এক বিশালাকার কামান যার নাম 'বাচ্চাওয়ালি তোপ'। চৌদ্দ শতকে গৌড়ের কোনো মুসলিম শাসকের আমলে এটি তৈরি করা হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। এই কামানটি ইছাগঞ্জের ভাগীরথীর তীরে নদীর বালিতে গাঁথা ছিল। নবাব হুমায়ুনজা-র সময় মুর্শিদাবাদের গভর্নর জেনারেল স্যার হেনরি টরেন্সের পরামর্শে সাদেক আলী খানের তত্বাবধানে ভাগীরথী নদী থেকে উদ্ধার করে এই জায়গায় স্থান্তরিত করা হয়। কামানের এই 'বাচ্চাওয়ালি' নামকরণের গল্প লোকমুখে প্রচলিত আছে। কথিত আছে এই কামানটি কেবলমাত্র একবারই দাগা হয়েছিল। কিন্তু তোপ দাগার শব্দ এতটাই তীব্র ছিল যে আশেপাশে তখন বহু গর্ভবতী মহিলার গর্ভপাত ঘটে। সেই থেকেই এর নাম দেওয়া হয় 'বাচ্চাওয়ালি তোপ'। এই ঘটনায় নবাব অত্যন্ত ব্যথিত হন। এর পর থেকে কামানটি আর কোনোদিন ব্যবহার করা হয়নি।

বাচ্চাওয়ালি তোপ
ঘড়ির কাঁটায় সোয়া তিনটে। শীতকালে এমনিতেই বেলা ছোট হয়। দিনের আলো বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না তাই আকর্ষণীয় জায়গাগুলো বন্ধ হয়ে যায় একটু তাড়াতাড়ি। এখনো লালাবাগের বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান দেখতে রয়েছে বাকি। চেষ্টা করলাম তাড়াতাড়ি যতবেশী সম্ভব লালাবাগের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে নেওয়া যায়। গাড়ি রাখা থাকলো হাজারদুয়ারীর সামনে বাস পার্কিং এর জায়গায়। আগের থেকে সময় বদলেছে৷ আগে যেখানে পর্যটকদের কাছে টাঙা গাড়ি ছিল ইতিহাস খ্যাত মুর্শিদাবাদ ঘোরার একমাত্র মাধ্যম৷ সেখানে আজ এসেছে টোটো। ভাগীরথীর পাড় ঘেঁষে রাস্তার ধারে প্রচুর টোটো। সেখান থেকে গাইড ও বাহন হিসাবে দর কষা-কষি করে একটি টোটো ভাড়া করে উঠে বসলাম। এইবারে টোটোতে চেপে শুরু হলো আমাদের লালবাগের পথে পথে টো টো করে ঘোরা। টোটো আমাদের নিয়ে এসে নামালো কাঠগোলা বাগানে ঢোকার মুখে একটা বড়ো নহবতখানার সামনে।

কাঠগোলা বাগানে ঢোকার মুখ
কাঠগোলা বাগান

কাঠগোলা প্রাসাদের এই রাজকীয় নহবতখানা বা মূল প্রবেশদ্বারটি হলো তিনটি তলা বিশিষ্ট। গেট দিয়ে ঢুকে একটু এগোতেই পড়লো টিকিট কাউন্টার। বিশাল আম বাগানের মাঝ বরাবর রাস্তা দিয়ে হেঁটে চললাম। ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দে কাঠগোলা প্রাসাদ ও বাগানের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন জিয়াগঞ্জের সমৃদ্ধ বণিক রায় বাহাদুর লক্ষীপৎ সিং দুগার। এই আমবাগানে রয়েছে লক্ষীপৎ, ধনপৎ, জগপৎ ও মহীপৎ চার ভাইয়ের চারটি ঘোড়ায় চড়া মূর্তি। আম বাগানকে পিছনে ফেলে বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে পড়লো আরেকটি গেট। ওই গেটের ডান দিকে পড়লো নবাব আমলের প্রথম চিড়িয়াখানা ও অ্যাকুয়ারিয়াম আর বাম দিকে একটা উঁচু বেদীর ওপর মাইকেলেঞ্জেলোর সুন্দর শ্বেতপাথরের মূর্তি। তার পাশে রয়েছে একটি গোপন সুড়ঙ্গ পথ। শোনা যায় এই গোপন সুড়ঙ্গ পথটি ভাগীরথী নদীর সঙ্গে সংযুক্ত।

মাইকেলেঞ্জেলোর মূর্তি
গেট থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে পৌঁছিয়ে গেলাম কাঠগোলা বাগানবাড়িতে। এই প্রাসাদটি বর্তমানে মিউজিয়াম। শুটিং চলার জন্য কাঠগোলা প্রাসাদে প্রবেশ করা গেলো না। কাঠগোলা প্রাসাদের সামনে রঙিন মাছে ভর্তি বিশাল পুকুর। পুকুরটির চারদিক সুন্দর ইতালিয়ান মার্বেল দিয়ে সুসজ্জিত, জলে নামার জন্য ছয়টি মার্বেল বাঁধানো ঘাট রয়েছে। পুকুরের চার কোণে চমৎকার গম্বুজাকৃতি প্রহরী পোস্ট রয়েছে।

কাঠগোলা প্রাসাদ
বিশাল বাগান ঘেরা এই কাঠগোলা প্রাসাদ সৌন্দর্য ও আভিজাত্যের দিক দিয়ে মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারীর পরেই পর্যটনের অন্যতম সেরা আকর্ষণ। বিস্তৃত বাগানটি ইতালীয় মার্বেল দিয়ে অলঙ্কৃত ঝর্ণা, চীনামাটির ফুলের টব, ঢালাই লোহার চেয়ার এবং অন্যান্য হাজারো নিদর্শন দিয়ে সাজানো। এই কাঠগোলা প্রাসাদে বেশ কিছু সিনেমা ও টিভি সিরিয়ালের শুটিং হয়েছে।

আভিজাত্যের বাগানবাড়ি
কাঠগোলা বাগানবাড়ি থেকে আর একটু এগিয়ে বামদিকে নজরে পড়লো একটি ভগ্নপ্রায় অতিথিশালা। বর্তমানে এটি একটি পরিত্যক্ত ভবন। তার কিছুদূরে চোখে পড়লো সুন্দর কারুকার্য করা হনুমান এবং গণেশের দালান মন্দির ও ডানদিকে বিস্তৃত বাগান।

দালান মন্দির
বাগানের মাঝখানে রয়েছে চারদিক খোলা একটি স্টেজের মত জায়গা। এটি ছিল নৃত্যমঞ্চ। সেকালের বিখ্যাত নর্তকী হীরাবাঈ এই স্টেজেই নৃত্য পরিবেশন করতেন। স্টেজের চারদিকে মার্বেল পাথরের নক্সা করা রেলিং দিয়ে ঘেরা ও সুন্দর আলোর স্তম্ভ রয়েছে। চারপাশ দিয়েই সিঁড়ি বেয়ে স্টেজটির উপরে ওঠা যায়।

নৃত্যমঞ্চ
কাঠগোলা বাগান এলাকার মধ্যেই একপাশে রয়েছে খুব সুন্দর একটি জৈন মন্দির। এই মন্দিরটি 'আদিনাথ মন্দির' বা নাম 'পরেশনাথ মন্দির' পরিচিত। এই মন্দিরটির নির্মাতা রায় বাহাদুর লক্ষীপৎ সিং দুগার। লক্ষীপৎ ছিলেন একজন জৈন ধর্ম্মাবলম্বী। মায়ের ইচ্ছানুসারে তিনি মন্দিরটি প্রথম জৈন তীর্থঙ্কর, শ্রী শ্রী আদিনাথের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছিলেন। মন্দিরের মূল মূর্তিটি পদ্মাসনে বসা আদিনাথের। মন্দিরের চূড়া পেঁয়াজের ন্যায় গম্বুজাকৃতি। সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি আদিনাথ মন্দিরের স্থাপত্যটি অনন্য, বিভিন্ন শৈলীর মিশ্রণে তৈরি এই মন্দিরটি। এই মন্দিরের গম্বুজগুলিতে মুঘল শৈলী সুস্পষ্ট অনুভব করা যায়, সামনের অংশটি ইউরোপীয় শৈলীতে তৈরি এবং ভেতরের অংশে বাংলা প্লাস্টারের সাথে রাজস্থানী ঘরানার সাধারণ চিরাচরিত জৈন নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। মন্দিরের দেওয়ালে নানারকম ভাস্কর্য্য রয়েছে। মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরী গেট ও তার পাশে সুন্দর মার্বেল পাথরের মূর্তী যেন পুরোটাই সাদা রঙের সমারোহ। মন্দিরের সামনে বিশাল এলাকা জুড়ে গোলাপ ফুলের বাগান। সামনে একটি পুকুর, সেখানে বোটিংয়ের জন্য ছোট ছোট বোট রয়েছে। সাড়ে চারটে বেজে গেলো, জগৎ শেঠের বাড়ি দেখে ফিরতে হবে তাই বেশিক্ষণ এখানে থাকা যাবে না। দিনের আলো যত কমে ততোই পা লম্বা হয় তাই দেরি না করে কাঠগোলা থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

আদিনাথ মন্দির
হাউজ অব জগৎ শেঠ

কাঠগোলা থেকে বেরিয়ে টোটোয় চেপে বসলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই টোটো আমাদের নিয়ে এসে জগৎ শেঠের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিলো। জগৎ শেঠের বাড়ির উপরে লেখা 'হাউজ অব জগৎ শেঠ'। বাড়ির চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর শ্বেত পাথরের মূর্তি, ফোয়ারা। 'জগৎ শেঠ' কোনো ব্যক্তির নাম মনে হলেও আসলে এটি একটি উপাধি। জগৎ শেঠদের পারিবারিক ইতিহাস অনেক আগের। 'হাউজ অব জগৎ শেঠ'-এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মানিকচাঁদ। রাজস্থানের বিশিষ্ট বণিক সম্প্রদায় জৈন পরিবারের মানিকচাঁদ এই বাংলায় প্রথম শেঠ বংশের সূত্রপাত করেন। শেঠ বংশীয়দের মধ্যে ১৭২৪ খ্রীষ্টাব্দে ফতেচাঁদই প্রথম সম্রাট মহম্মদ শাহর কাছে 'জগৎ শেঠ' উপাধি লাভ করেন। জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মহাজন হাওয়ায় বাদশা তাঁহাকে এই উপাধি দান করেন। ফতেচাঁদ মারা যাওয়ার পর তার নাতি মহাতপচাঁদ সম্রাট আহমেদ শাহর নিকট 'জগৎ শেঠ' উপাধি পান। জগৎ শেঠ মহাতপচাঁদ মারা যাওয়ার পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র খোসালচাঁদ ১৭৬৬ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট শাহ আলমের ফরমান অনুযায়ী জগৎ শেঠ উপাধি উপাধি পান। জগৎ শেঠ খোসালচাঁদের একমাত্র ছেলে গোকুলচাঁদ তাঁর জীবদ্দশায় মারা যাওয়ায় তার ভাইপো হরকচাঁদকে দত্তকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। প্রথানুযায়ী তিনি ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস জগৎ শেঠ উপাধি প্রদান করেন। এই হরকচাঁদ প্রথমে অপুত্রক ছিলেন পুত্রকামনায় এক সাধুর পরামর্শে নিজের জৈন্য ধর্ম ছেড়ে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন। পুত্রলাভের পর পুনরায় তিনি জৈন্য ধর্ম গ্রহণ করেন। তৎকালীন মুর্শিদাবাদ তথা সারা বিশ্বের অন্যতম ধনপতি অর্থাৎ 'ব্যাঙ্কার অফ দা ওয়ার্ল্ড' ছিলেন এই জগৎ শেঠেরা।

জগৎ শেঠের বাড়ি
বর্তমানে জগৎ শেঠদের বাড়িটি একটি মিউজিয়াম। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। প্রবেশমুখেই রয়েছে গোপন সুড়ঙ্গে ঢোকার একটি পথ। এই গোপন সুড়ঙ্গ আজ মিউজিয়ামের অংশ। অন্ধকারাছন্ন সরু সিঁড়ি বেয়ে এই সুড়ঙ্গ পথে প্রবেশ করে ভেতরে গিয়ে দেখতে পেলাম একটা আস্ত মিউজিয়াম। জগৎ শেঠদের ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী, বাসনপত্র, ছবি, পিস্তল, তলোয়ার, সোনার তৈরি পোশাক, জগৎ শেঠদের টাঁকশালে তৈরি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা সহ আরও বহু কিছু জিনিস এখানে সংগৃহীত আছে। একটি গোটা মসলিন শাড়ি কখনও একটি আংটির ভেতরে দিয়ে গলে যায় আবার কখনও বড় দেশলাইয়ের বাক্সে এঁটে যায় এরকম কথা অনেকের কাছেই শুনেছি, সেই বাংলার বিখ্যাত ঢাকাই মসলিন কাপড়ের নমুনা এই মিউজিয়ামে দেখতে পেলাম। এছাড়া লর্ড ক্লাইভের ব্যবহার করা একটি পোশাকও এখানে দেখা গেলো। সুড়ঙ্গ থেকে বের হবার পর বাড়ির উঠোনের বাঁ-দিকে দেখতে পেলাম খুব সুন্দর একটি লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির রয়েছে। জগৎ শেঠের বাড়ি দেখে যখন ফিরছি তখন বিকেল পাঁচটা।

লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির
নশিপুর রাজবাড়ী

লালবাগের পথে পথে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস, চলতে গেলে বারবার থেমে যেতে হয়। ঠিক তাই, জগৎ শেঠের বাড়ি দেখে ফেরার পথে নশিপুরে মেন রোডের পাশেই প্রাসাদোপম রাজবাড়ী চোখে পড়তেই থেমে গেলাম। এই নশিপুর প্রাসাদ ছিল দেবী সিংহের দরবার। তিনি পানিপথ থেকে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে মুর্শিদাবাদে এসেছিলেন। দেবী সিংহ নশিপুর রাজ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন। নশিপুর রাজ পরিবারের এই প্রাসাদটির পুরাতন নাম মহিমাপুর রাজবাড়ী। ১৭৭৬ খ্রীষ্টাব্দে রাজা দেবী সিংহ পুরাতন প্রাসাদটি নির্মাণ করেছিলেন। এই এলাকার নাম অনুসারে এই প্রাসাদের নাম হয়ে ওঠে নশিপুর রাজবাড়ী। বর্তমান হাজারদুয়ারী প্রাসাদের অনুকরণে তৈরি এই রাজপ্রাসাদটি ১৮ ৬৫ খ্রীষ্টাব্দে দেবী সিংহের উত্তরপুরুষ রাজা কীর্তি চন্দ্র সিংহ বাহাদুর নির্মিত করেছিলেন। যা আজও শোভা পাচ্ছে ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদ শহরের এই নশিপুর গ্রামে। প্রাসাদে ওঠার বিশালাকার চওড়া সিঁড়ির দুই পাশে দুই সিংহ-মূর্তি যেন পাহারা দিচ্ছে। সিঁড়ির সামনেই রয়েছে একটি ফোয়ারা। এই রাজবাড়ীটি দেখে হাজারদুয়ারীর ছোট সংস্করণ বলে অনুমান করা যেতেই পারে। এখানে এসে ঠান্ডাটা বেশ অনুভূত হচ্ছে, শীতের বস্ত্র সব গাড়িতে রাখা। দুপুরে গরম লাগছিলো বলে গাড়িতে রেখে এসেছি। আমি ও আমার সহযাত্রী অমল দুজনে নেমে ভেতরে গেলাম বাকিরা টোটোতেই বসে থাকলো। রাজবাড়ীর সামনের অংশটি মোটামুট সংরক্ষিত রয়েছে, কিন্তু ভেতরের দিকে পুরোটাই ভগ্নদশা। রাজবাড়ীর ভেতরে মাঝখানে রয়েছে অনেকটা খালি জায়গা ও সেখানে রামচন্দ্রের একটি মন্দিরও রয়েছে, মন্দিরে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি দেখতে পেলাম। বর্তমানে নশিপুর রাজবাড়ীটিকে মিউজিয়ামে রূপান্তর করা হয়েছে। রাজবাড়ীর অন্দরে মিউজিয়ামে প্রবেশ করলাম না। পরের বার এলে দেখা যাবে এই ভেবে তাড়াতাড়ি টোটোয় চেপে বসলাম।

নশিপুর রাজবাড়ী
পথে একটা টার্নের সামনে টোটো দাঁড় করিয়ে আমাদের বললো এটা নশিপুর আখড়া, যান ভিতরটা একবার দেখে আসুন। রামানুজ সম্প্রদায়ের অনুগামী মহান্ত লছমন দাস আচারিয়া ধর্মীয় প্রচারে মুর্শিদাবাদ এসে জাফরগঞ্জ এলাকায় এই আখড়া স্থাপন করেন। এটি রঘুনাথের আশ্রম নামেও পরিচিত।

নশিপুর আখড়া
বর্তমানে এটি মুর্শিদাবাদ পৌরসভা কর্তৃক ঘোষিত একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান। গেটের ভেতরে ঢুকে একটু এগিয়ে দেখি সারি দিয়ে মোহান্তদের ঘর। এক পাশে রয়েছে রঘুনাথদেবজীর মন্দির। শতাধিক বছরের প্রাচীন এই প্রাসাদটি বয়সের ভারে আজ জরাজীর্ণ অবস্থা।

রঘুনাথদেবজীর মন্দির
কালো ত্রিপল ঘেরা অস্থায়ী ছোট একটি গ্যারেজে অযত্নে রাখা আছে প্রাচীন যুগের তৈরি একটি বেবি অস্টিন গাড়ি। শোনা যায়, এই বেবি অস্টিন গাড়িটি আশি টাকা দিয়ে কেনা হয়েছিল। পাশেই আছে সোনার পাতে মোড়া রথ। এছাড়া রয়েছে রূপোর তৈরি আট ফুটের একটি রথ ও তার পাশে আর একটি কাঠের তৈরি রথ।

আশি টাকার বেবি অস্টিন গাড়ি
দিনের সব সময়ই দর্শনার্থীদের জন্য নশিপুর আখড়া খোলা থাকে। এইভাবে ইতিহাসকে দেখতে দেখতে কখন যে দিনের আলো বিদায় নিয়ে বেলা শেষ হলো বুঝতে পারিনি। অন্ধকার বাড়তে বাড়তে এক সময় চারদিকে ভালো করে আর কিচ্ছু দেখা যায় না। পুনরায় হাজারদুয়ারীর সামনে এসে হাজির হলাম। প্রচন্ড ঠান্ডায় কাবু হয়ে গিয়েছি সকলে। আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি গাড়ির কাছে গেলাম। গাড়ির ভেতরে হিটার অন করে এগিয়ে চললাম সন্ধ্যায় মোতিঝিল পার্কে 'লাইট এন্ড সাউন্ড শো' দেখার জন্য ...

সোনার পাতে মোড়া রথ
সন্ধ্যা সাতটার সময় নিউ মোতিঝিল পার্কে পৌঁছিয়ে টিকিট কাটার সময় জানতে পারলাম যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য আজ 'লাইট এন্ড সাউন্ড' শো দেখা যাবে না। আলো আঁধারিতে পার্কের ভেতরটা খুব একটা বোঝা যাচ্ছে না। গেট দিয়ে পার্কে প্রবেশের পর প্রথমেই দেখলাম একটি বেদীর উপরে মুর্শিদকুলি খাঁ-র প্রমাণ সাইজ ব্রোঞ্জের মূর্তি রয়েছে। ওই বেদীর উপরে ছোট করে ইংরেজি-বাংলা আর হিন্দিতে মুর্শিদকুলি খাঁ-র পরিচিতি দেয়া হয়েছে। বেশিদূর যেতে পারলাম না, কিছুক্ষণ পরে পার্কের গেট বন্ধ হবে জানিয়ে দিলো। তাড়াহুড়োর সাথে যতটা পারা যায় একটু ঘুরে নিলাম। এই বিশাল পার্কে ঘুরে দেখার জন্য ব্যাটারি চালিত গাড়ির ব্যবস্থা আছে। বাইরে বেরিয়ে পার্ক সংলগ্ন একটি ক্যাফেটেরিয়াতে চা-কফি ছাড়া আর কিছুই পেলাম না। ভেবেছিলাম ডিনারটা এখানেই সেরে ঘরে ফিরবো। কিন্তু আশেপাশে কোনো ভালো হোটেল পেলাম না। অন্ধকারে গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে গঙ্গা পাড়ের ঝকঝকে রাস্তা ধরে চললাম বহরমপুর শহর পেরিয়ে ডোমকলের দিকে। আবার আসিব ফিরে, রহিল যাহা বাকি দেখিবার তরে...

মুর্শিদকুলি খাঁ-র ব্রোঞ্জের মূর্তি
» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ- 'মুর্শিদাবাদ কাহিনী' - নিখিলনাথ রায়)
Arabinda Pal
1 Comments
Share This Post :

You Might Also Like

1 comment:

[name=Arabinda Pal] [img=https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEia50rmuKEAcbGUbQKvAbzUmdviiIhm-LeVlsEEdFx_xtGfyvx8O02yFVuJemgswzSA8PoMcN-XW0AcinKr9iq28lHK43Z4TFFyL7pJyGGxLNx9LGn0cLvPz0lUJzNrWBo9n_NyxGLjDII/h120/IMG_2788.jpg] [description=পর্যটক হিসাবে নয়, একজন ভ্রমণকারী হিসাবে বেড়ানোটা আমার কাছে একটা নেশা এবং ফটোগ্রাফিতেও আমার ভীষণ শখ। তাই একজন ভ্রমণকারী হিসাবে আমার এই ব্লগে নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে লেখা ও ছবিগুলো যদি আপনাদের ভালো লাগে তাহলে অবশ্যই আপনাদের মতামত কমেন্টসের মাধ্যমে জানাতে ভুলবেন না।] (facebook=https://www.facebook.com/groups/2071066419824586/user/100002484831922) (twitter=Twitter Profile Url) (instagram=https://www.instagram.com/arabindapal2020/) (bloglovin=Blogvin Profile Url) (pinterest=https://www.pinterest.com/arabindapalbrb/) (tumblr=Tumblr Profile Url)

Follow @Arabinda Pal