পরপর দুটো ট্যুর প্ল্যান বাতিল করতে হয়েছে। এবারে দেখছি দিনক্ষণ ঠিক করে আর যাওয়া যাবে না। হঠাৎ করে কোথাও ঘুরতে যাওয়া আমার একটা বাতিক আছে। সপ্তাহের মধ্যে আমরা তিন অফিস কলিগ মিলে ঠিক করলাম সামনের শনি ও রবি ছুটির দুটো দিন ফ্যামিলি নিয়ে ধারে কাছে কোথাও ঘুরে আসি। তীব্র দাবদাহের মধ্যে স্বস্তির খোঁজ পেতে পাহাড়ে যাওয়া একদিনের পরিকল্পনায় সম্ভব নয়। অনেক ভেবে কেউ যখন কোথাও যাবার প্ল্যান ঠিক করে উঠতে পারলো না। সবার মুখে শোনা গেল তাহলে না হয় দীঘা থেকেই ঘুরে আসি। ঘরের কাছে উইকএন্ড ডেস্টিনেশনে কম সময়ে, কম খরচে বেড়ানোর কথা ভেবে চোখ বন্ধ করলেই সবার আগে ভেসে ওঠে যে নাম সেটা বাঙালির একান্তই নিজস্ব সমুদ্র সৈকত 'দীঘা'! সমুদ্রের নীল জলরাশি, ঝাউবনের সারি, বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি আর জেলেদের মাছ ধরার নৌকা। এসবের টানে আপামর বাঙালি বারবার ছুটে আসে এই সৈকত শহরে। বাংলা সাহিত্য থেকে শুরু করে বহু সিনেমার পর্দাতেও ধারা দিয়েছে এই সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য। অনেক আলোচনার পর আমরা তিনটে ফ্যামিলি মিলে দুটো গাড়িতে চেপে রওনা দিলাম দীঘার উদ্দেশ্যে।
 |
| ইতিহাসের পাতায় দীঘা |
ইতিহাসের পাতা যদি উল্টে দেখা যায় তাহলে অতীতে দীঘার পরিচিতি ছিল 'বীরকুল' নামে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এই উপকূল অঞ্চলটি বহুপূর্বে ছিল ওড়িশার জলেশ্বর চাকলার অধীনে বীরকুল পরগনার অন্তর্গত। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৎকালীন বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস ওড়িশা সীমান্ত সংলগ্ন উপকূল অঞ্চলে ঘনঘন যাতায়াতের ফলে কোনো একসময় বীরকুল গ্রামটি তাঁর নজরে আসে। শীতের দেশ ইংল্যান্ড থেকে আসার ফলে এখানের গরমে তখন হেস্টিংসের হাঁসফাঁস অবস্থা। ইউরোপীয়দের কাছে দার্জিলিং ছিল তখনও অজানা। বীরকুলের সমুদ্র সৈকতটি দেখে ওয়ারেন হেস্টিংসের ভীষণ পছন্দ হয়। গ্রীষ্মাবাস তৈরির উপযুক্ত জায়গা পেয়ে ১৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দে এখানে একটি বাংলো তৈরি করেন। বীরকুলের সমুদ্র সৈকত ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে স্ত্রীকে ওয়ারেন হেস্টিংস চিঠিতে লিখেছিলেন 'বীরকুল ওয়াজ দ্য স্যানাটোরিয়াম-দ্য ব্রাইটন-অফ ক্যালকাটা'। তিনি এখানের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে ইউরোপীয়দের জন্য হরিণ শিকার, মাছ ধরা, সমুদ্রস্নান-সহ বিনোদনের জায়গা হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বীরকুলকে জনপ্রিয় করার চেষ্টায় যে ওয়ারেন হেস্টিংস কিছুটা সফল হয়েছিলেন তা ১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দের ১৯ মে প্রকাশিত হিকি'জ বেঙ্গল গেজেট পত্রিকায় উল্লেখ করা একটি চিঠি থেকে জানা যায়। যদিও পরবর্তীকালে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। হেস্টিংস চলে যাওয়ার পর তাঁর বাংলোটিও সমুদ্রের জলে মিশে যায়। বীরকুলের এই অঞ্চলটির যোগাযোগ ব্যবস্থা সুগম না হওয়ার ফলে ইউরোপীয়দের আনাগোনা ক্রমশ কমে আসে। এরপর বহু বছর দীঘা রয়ে গেল আড়ালে। ১৮৫২ খ্রীষ্টাব্দে বীরকুল অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার কাঁথি মহকুমার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হয়। বীরকুল তখন 'দীঘা' নামের সঙ্গে মিশে গেলেও দীঘা ছিল তখনও অখ্যাত পরিচয়হীন একটি দুর্গম গ্রাম। তবে বীরকুলের নাম দীঘা কিভাবে হলো তা সঠিক ভাবে জানা যায়নি। অনেকের মতে, বীরকুল গ্রামের মধ্যে দিয়ে বয়ে বয়ে যাওয়া চম্পা নদী বঙ্গোপসাগরের মোহনার কাছে অনেকটা বিস্তৃত হয়ে সরোবরের আকার নিয়েছে। মোহনার ওই জায়গাটিকে স্থানীয় বাসিন্দারা দীঘি বলতেন। আর সেই দীঘি থেকেই ওই জায়গাটি পরে দীঘা নামে পরিচিতি লাভ করে। বীরকুল গ্রামের চম্পা নদীর মোহনায় আজকের দীঘা মোহনা।
 |
| অতীতের দীঘা |
মাঝে কেটে গেলো আরও অনেকগুলো বছর। অভিজাত ভারতীয়দের ঘরে হ্যামিলটন তখন বিশিষ্ট নাম। ব্রিটিশ ব্যবসায়ী জন ফ্র্যাঙ্ক স্নেইথ ছিলেন কোলকাতার জুয়েলারী ও ঘড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা হ্যামিলটন অ্যান্ড কোম্পানির (Hamilton & Co.) মালিক। কাঁথির বালিশাহীর এক জমিদার ছিলেন হ্যামিলটনের অন্যতম ক্রেতা। তাঁর কাছেই স্নেইথ সাহেব দীঘার সমুদ্র সৈকত সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেন। প্রকৃতি-প্রেমী স্নেইথ সাহেব পুরাতন বইপত্র ঘেঁটে বীরকুল সম্বন্ধে তথ্য জোগাড় করে ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে নেহাতই কৌতুহলবশে বেলদা পৌঁছান। সেখান থেকে তিনি হাতির পিঠে চড়ে কাঁথির ডাক-বাংলোতে গেলেন। তারপর পিছাবনি নদী ও ঘন জঙ্গল পেরিয়ে বীরকুলের সমুদ্র সৈকতে পৌঁছালেন। বীরকুলে এসে তিনিও সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যান। এরপর সরকারের কাছে আবেদন করে সমুদ্রের পাড়ে জমি লিজ নিয়ে তৈরি করেন তাঁর মনের মতো বাড়ি 'রানসিক হাউস' (Runswick House)। কোলকাতার হ্যামিলটন কোম্পানির সামনে যে দুটো সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি হাতি ছিল সে দুটো নিয়ে এসে বসালেন রানসিক হাউসের সামনে। অতঃপর অবিবাহিত স্নেইথ সাহেব তাঁর ভাইপো চার্লস ফ্লেনিগানকে কোম্পানির দায়িত্ব বুঝিয়ে ব্যবসা থেকে অবসর নেন। তারপর থেকে তিনি বছরের ছ'মাস দীঘার রানসিক হাউসে ও বাকি ছ'মাস শিলং-এ কাটাতেন। দীঘার প্রথম আবাসিক স্নেইথের প্রচেষ্টায় এই দুর্গম বীরকুল আবার প্রচারের আলোয় আসে। স্বাধীনতা লাভের পর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বাংলার রূপকার বিধানচন্দ্র রায়ের হাত ধরে গড়ে উঠে পর্যটন শিল্প। তারই ফলশ্রুতি আজকের রূপসী দীঘা।
 |
| হারিয়ে গেছে সেই ঝাউবন |
সেই স্কুল জীবন থেকে শুরু। বাবার হাত ধরে জীবনের প্রথম সমুদ্র দর্শন। কোলকাতা থেকে দীঘা তখন খড়গপুর হয়ে আসতে হতো। নরঘাটের হলদি নদীর উপর মাতঙ্গিনী সেতু তখন তৈরি হয়নি। রাত্রি সাড়ে বারোটা নাগাদ বাস ছাড়ত খড়গপুর থেকে, ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগেই পৌঁছে যেত দীঘায়। ওল্ডে তখন বাসস্ট্যান্ড ছিল নেহেরু মার্কেটের কাছে। সত্যি বলতে তখন দীঘায় ট্যুরিস্ট-এর এত ভিড় ছিলনা। বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বাজার অঞ্চল ও ইতিউতি গুটিকয়েক হোটেল সবে গজিয়ে উঠছে। বাজার এলাকা ছাড়িয়ে গেলেই শুধুই ঝাউবন, ভালও লাগতো সেই ঝাউবনে ঘুরে বেড়াতে। নিউ দীঘা বলে কিছুই ছিল না, সন্ধ্যের পর ওই পথে যেতে রীতিমতো গা ছমছম করত। ওল্ড দীঘায় সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়ালে চোখের সামনে ভাসত একদিকে বালিয়াড়ি আর এক দিকে বিশাল সমুদ্র সৈকত। সেই বালিয়াড়ি ভরে থাকত ঝাউয়ের ঘন জঙ্গলে। ধীরে ধীরে ওল্ড দীঘা জমজমাট হয়ে ক্রমশ বিস্তার লাভ করতে লাগল। শুরু হলো ওল্ড দীঘায় ভাঙন।
 |
| তৈরি হল নিউ দীঘা |
তৈরি হল নিউ দীঘা। পরবর্তীকালে নির্জনতার খোঁজে চলে যেতাম নিউ দীঘায়। তখন নিউ দীঘা আর ওল্ড দীঘার মাঝখানে দু' কিলোমিটার রাস্তাটা কী অদ্ভুত সুন্দর ছিল। ওল্ড দীঘার বাসস্ট্যান্ড পেরিয়ে গেলেই সমুদ্রের দিকে পুরোটাই ঝাউবন! চারদিকে শুধুই নিস্তব্ধতা! একদিন নিউ দীঘাও ওল্ড হয়ে গেল। ঝাউবনের জঙ্গল একেবারে সাফ হয়ে গেল। যেখানে সেখানে গড়ে উঠল হোটেল, চারদিকে দোকানপাটে ঘিঞ্জি হয়ে উঠল। নির্জনতা হারিয়ে নিউ দীঘা এক কংক্রিটের জঞ্জালে পরিণত হয়ে উঠলো। এপর্যন্ত কত বার যে দীঘা গিয়েছি তা হিসেবের বাইরে চলে গেছে। এখন এত ভিড় হয় যে দীঘা ভ্রমণ যেন ক্রমশ বিরক্তিতে পরিণত হচ্ছে। 'চলোনা দীঘার সৈকত ছেড়ে ঝাউ বনের ছায়ায়!' ছোটবেলায় শোনা পিন্টু ভট্টাচার্য্যের সেই নস্টালজিক গানের কলির সাথে আজকের দীঘার কোনো মিল খুঁজে পায় না।
 |
| আজকের দীঘা |
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে তৈরি। ব্যাগপত্তর সব গোছানো হয়ে গেছে। সকাল সাড়ে ছটায় গাড়ি স্টার্ট করলাম। ভেবেছিলাম আর একটু সকাল সকাল বেরোবো। কিন্তু তা সম্ভব হল না! আমাদের প্রথম দিনের গন্তব্য দীঘা। সকালে ব্রেকফাস্ট করে বেরোনো হয়নি। খড়্গপুর শহরের ভেতরে রাস্তার ধারে একটা দোকানে গরম গরম লুচি সব্জি তৈরি করতে দেখে গাড়ি দাঁড় করলাম। গাড়ি থেকে নেমে সবাই খাবারের দোকানে গেলাম। চটজলদি টিফিনটা সেরে গাড়ী আর কোথাও না দাঁড়িয়ে ছুটলো দীঘার দিকে। চারিদিকে চোখ জুড়ানো সবুজে ভরা মাঠ, তার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চললো আমাদের গাড়ি। খড়্গপুর শহর থেকে বেরিয়ে নারায়ণগড় বেলদা এগরা হয়ে কাঁথি শহরকে পিছনে ফেলে আমরা দেড়টার মধ্যে ঢুকে পড়লাম ওল্ড দীঘায়। আগে থেকে কোনও হোটেল বুক করে যায়নি। তাই পৌঁছেই হোটেল খুঁজতে শুরু করলাম।
 |
| হোটেলের খোঁজে |
দুপুর ছুঁইছুঁই, হোটেল বুকিং করা নেই। ভিড়ের কথা মাথায় রেখে ভাবলাম নিউ দীঘায় প্রচুর হোটেল ওখানে গিয়ে খোঁজ করি। দীঘার এই সমস্যা, উইকএন্ডে ছুটির দিনে হোটেল পাওয়া ভারী মুশকিল। তিন জনের প্রচেষ্টায় আধ ঘন্টার ওপরে খোজাখুঁজির পর প্রায় দ্বিগুন ভাড়ায় 'হোটেলে সাগরির' দোতালায় তিনটে এসি রুম পাওয়া গেল। চেক ইন করে আমরা যখন হোটেলের রুমে ঢুকলাম তখন বেলা প্রায় দেড়টা।
 |
| হোটেলে সাগরির সামনে |
ততক্ষণে পেটে সবার ছুঁচো ডন বৈঠক দিচ্ছে। আমি এত ক্লান্ত ছিলাম যে তাড়াতাড়ি স্নান করে হোটেলের রেস্টুরেন্ট থেকে লাঞ্চ সেরে খানিক বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে ভাবলাম বিকেলে সমুদ্র দর্শনে যাব। একটু ঘুমাবো বলে যেই শুয়েছি! ঠিক সেই সময় আমার কলিগ কাম বন্ধু স্বাধীন ও বড়ুয়াদা ফ্যামিলি নিয়ে আমার রুমে এসে হাজির। তারা এখুনি সমুদ্রে স্নান করতে যেতে চায়। আজই সুযোগ, কাল চন্দনেশ্বরে পূজো দিতে যাবার প্ল্যান রয়েছে তাই সমুদ্রে স্নান করার সময় পাওয়া যাবে না। কাজেই আর কোনো বাধা নেই। সময় নষ্ট না করে আমিও ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। দল বেঁধে সমুদ্রে স্নান ও হৈ হৈ চলতে থাকে। প্রায় ঘণ্টা খানেকের উপর সমুদ্রে লাফালাফি দাপাদাপি করে কাটলো। এরপর ঢেউয়ের সাথে খেলা শেষ। আধা স্নান করে ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
 |
| সমুদ্র স্নান ও হৈ-হৈ |
হোটেলের রুমে ফিরে খানিক বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে আবার সবাই তৈরী সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার জন্য। হোটেল থেকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গোলাম সমুদ্রের দিকে। উইকেন্ডে কিংবা ছুটির দিনে ভিড় উপচে পড়ে দীঘাতে। আজও দেখি ওল্ড দিঘা থেকে নিউ দিঘা সমুদ্র সৈকতে শুধুই মানুষের ভিড়। রাস্তায় যেন লোকের মেলা বসে গেছে। রাস্তার ধারে হাজারো দোকান! থরে থরে সাজানো কাজু বাদাম, কিসমিস, আছে ঝিনুক দিয়ে তৈরী নানা রকমের ঘর সাজানোর জিনিস। এছাড়াও রয়েছে নানান সামুদ্রিক মাছ, কাঁকড়া, গলদা চিংড়ি, পমফ্রেট। মন চাইলে চেখে দেখার জন্য পাওয়া যাবে একদম হাতে গরম ভাজা। হরেক রকম স্ট্রিট ফুডের দোকান। রয়েছে এগরোল, চাউমিন, মোমো কিম্বা ফিশফ্রাই। সবাই নিজের পছন্দের খাবার খেলাম। খেয়েদেয়ে পেট ঠাণ্ডা করে এবার আমরা সমুদ্রের দিকে চললাম। সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এখানে প্রচুর বসার জায়গা আছে দেখলাম। ওখানে জাঁকিয়ে বসলাম।
 |
| গল্প আড্ডায় মেতে উঠলাম |
আমরা যখন সমুদ্রের কাছে এসে পৌঁছায় তখন আলো অনেকটাই কমে এসেছে। সূর্য ততক্ষনে ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। সামনে সমুদ্রের দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। পাড়ে বোল্ডারের মত বেশ কিছু পাথর ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে সেই সব পাথরের তৈরি ব্লকগুলোর ওপর। এরকম মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে দেখতে এবং নিজেদের মধ্যে গল্প আড্ডায় কখন যে রাত নটা বেজে গেছে টেরই পাইনি। সমুদ্রের হু হু হাওয়ায় মন ঠান্ডা করে এবারে পা বাড়ালাম হোটেলের দিকে। হোটেলে ফেরার পথে সব দোকান ঘুরে ঘুরে দেখতে অনেকটা সময় কেটে গেল, টুকটাক এটা-সেটা কিনে ব্যাগও ভারী হয়ে উঠল। রাতের খাবার খেয়ে সবাই একসাথে গল্প আড্ডায় মেতে উঠলাম। সেই ফাঁকে আমরা ঠিক করলাম যে কাল সকালে সমুদ্রে স্নান আর বিকালে বিজ্ঞান কেন্দ্রে যাব। শেষদিন সকাল সকাল বেরিয়ে চন্দনেশ্বরে পুজো দিয়ে বাড়ি ফিরবো।
 |
| হোটেলে ফিরলাম |
সকালে ঘুম থেকে উঠে ঠিক করলাম সবার আগে খাওয়া, তারপর যাব সমুদ্র দর্শনে। এই কাছাকাছির মধ্যে, নিউ দীঘার বীচেই। হোটেলে থেকে বেরিয়ে রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট দোকানে বসে গরম গরম লুচি আর আলুর তরকারি তার সাথে এক কাপ চা খেলাম। ব্রেকফাস্ট সেরে সমুদ্র স্নানের লোভ আর সামলাতে পারলাম না। পায়ে পায়ে এগিয়ে চললাম সমুদ্রের দিকে। সমুদ্রের পাড়ে একটু ঘোরাঘুরি করে নেমে পড়লাম জলে। ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে লাফালাফি ও হৈ-হুল্লোড় করে কাটালাম দুঘন্টা মতো। আবার পা বাড়ালাম হোটেলের দিকে। হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে চলে এলাম বিজ্ঞান কেন্দ্রে।
 |
| বিজ্ঞান কেন্দ্রে |
দীঘায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে সমুদ্রে বেড়ানোর পাশাপাশি অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এই বিজ্ঞান কেন্দ্র ও জাতীয় বিজ্ঞান শিবির। তিনটি গ্যালারি, কয়েকটি প্রদর্শনী ও একটি বিজ্ঞান পার্ক নিয়ে গড়ে উঠেছে এই দীঘা বিজ্ঞান কেন্দ্র। আলোর প্রতিফলন ও তার বিভিন্ন ঘটনা তথা সূত্রকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে রিফ্লেকশন গ্যালারি। জীবন বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় যেমন জৈব প্রযুক্তি, জৈব বিবিধতা, ভারতীয় জৈব বৈচিত্র্য, জীবন্ত জীব জন্তুদের ক্রিয়াকলাপকে সরাসরি পর্যবেক্ষণের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য গড়ে তোলা হয়েছে জীবন বিজ্ঞান বা লাইফ সায়েন্স গ্যালারি। মজাদার বিজ্ঞান বা ফান সায়েন্স গ্যালারিতে আছে দ্রুতগতিতে জ্বলতে নিভতে থাকা আলোর মাধ্যমে টেবিল ফ্যানের ঘুরন্ত ব্লেডকে স্থির দেখানো বা আলোর প্রতিপ্রভাকে ব্যবহার করে নিজের ছায়াকে ফ্রেমে আটকে রাখা এমনি অনেক মজার প্রদর্শনী।
 |
| রিফ্লেকশন গ্যালারি |
কোলকাতার মতো বড়ো না হলেও এখানের সায়েন্স মিউজিয়ামে বিজ্ঞানের চমকপ্রদ প্রদর্শনী সম্ভার নিরাশ করলো না। গাছগাছালি আর ফুলের সমারোহের মধ্যে কিছুক্ষণ আনন্দ উপভোগ করে তারপর পায়ে হেঁটে এগিয়ে যাই প্ল্যানেটারিয়ামের দিকে। ঝলমলে রোদ আর গরমের দীর্ঘশ্বাসে তখন ওষ্ঠাগত প্রাণ। প্ল্যানেটোরিয়ামের এসি ঘরে স্পেস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনমি শো দেখার সময় ক্লান্তিতে চোখ যেন বুজে আসে, হাই উঠতে থাকে।
 |
| সায়েন্স মিউজিয়াম |
প্ল্যানেটারিয়াম থেকে বেরিয়ে এলাম। এবার একটু ঘোরাঘুরির পালা। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলল লম্ফঝম্ফ, ঘোরাঘুরি আর ফটোসেশন। বিজ্ঞান-কেন্দ্রিক এমিউজমেন্ট পার্কে নানারকম বিজ্ঞান প্রযুক্তির প্রদর্শনী দেখতে দেখতে কিভাবে সময় কেটে গেলো বোঝা গেলো না। সন্ধ্যায় এখানে জুরাসিক পার্ক থিমের উপর ভিত্তি করে লাইট এন্ড সাউন্ডের মাধ্যমে একটি বিশেষ শো অনুষ্ঠিত হয়। টিকিট কেটে অপেক্ষা করছি সেই মুহুর্তের জন্য। কিন্তু লাইট এন্ড সাউন্ড শো দেখার পরে আশাহত হলাম। ভাবলাম এই শো দেখার জন্য এতক্ষণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম! ঐ প্রদর্শনী দেখে হোটেলে ফিরলাম।
 |
| এমিউজমেন্ট পার্ক |
কথায় বলে না, 'ওল্ড ইজ গোল্ড'! সমুদ্রের পাড়ে বসে সমুদ্রকে উপভোগ করার জন্য ওল্ড দীঘার জুড়ি মেলা ভার। আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্ধ্যেবেলা সায়েন্স সিটি থেকে গাড়ি চালিয়ে চলে এলাম সেই ওল্ডে। ঠিক ছিল এখানেই অনেক রাত্রি পর্যন্ত কাটাবো। কিন্তু বাদ সাধে গাড়ি পার্ক করতে গিয়ে। কোনোরকমে একটি গাড়ি পার্ক করা গেলো। সবাইকে নামিয়ে দিয়ে আমি আর বড়ুয়াদা চলে এলাম নিউ দীঘার হোটেলে। ঠিক করলাম হোটেলের সামনে গাড়ি রেখে একটা টোটো ভাড়া করে সেখানে যাব। কিন্তু লাগাম ছাড়া ভাড়া শুনে দুজনে ঠিক করলাম রাত আটটা যখন বেজেই গিয়েছে তখন আর গিয়ে লাভ নেই। শেষমেশ দুজনে সৈকতের পাড়ে কংক্রিটের সিঁড়িতে বসে কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। ততক্ষণে আমাদের বাকি লোকজন হোটেলের রুমে চলে এসেছে। পরেরদিন আমাদের ফেরার পালা। রাতের খাবার খেয়ে গল্পগুজব করে ব্যাগপত্র গুছিয়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।
 |
| রাতের নিউ দীঘা |
এবারের মত ঘোরা শেষ। কিন্তু শেষ হয়েও কি শেষ হয়? হয় না। আগেই ঠিক করেছিলাম চন্দনেশ্বরে পুজো দিয়ে বাড়ি ফিরবো। সেই মতো সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে স্নানটান সেরে তৈরি হয়ে নিলাম। ব্যাগপত্র সব গাড়ির ডিকিতে তুলে হোটেলের বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সামনে মোড়ের কাছে একটা দোকান থেকে চা জলখাবার খেয়ে রওনা দিলাম ওড়িশার দিকে। দীঘা ছেড়ে চলে এলাম কিয়াগেড়িয়া। পশ্চিমবঙ্গের শেষ গ্রাম। ওড়িশা বর্ডার পেরিয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে পৌঁছালাম চন্দনেশ্বর মন্দিরে। নিউ দীঘার বেশ কাছে অবস্থিত এই মন্দিরটি। গেটের একটু আগে বাঁ-দিকে পার্কিং লটে গাড়ি রেখে ভেতরে ঢুকলাম।
 |
| মন্দিরের গেট |
স্ত্রীর ইচ্ছে, পূজা দিতেই হবে। ফুল বেলপাতা পূজা সামগ্রী নিয়ে আমরা মন্দির চত্বরে প্রবেশ করলাম। দেখা মন্দির, তবু অনেকদিন পরে আবার দেখলাম। বেশ বড় মন্দির। ওড়িশার অন্যান্য প্রাচীন মন্দিরগুলোর মতো সাধারণ উৎকল স্থাপত্য শৈলীতে তৈরি। এটা উত্তর ওড়িশার প্রাচীনতম মন্দিরগুলোর মধ্যে অন্যতম। চন্দনেশ্বর আসলে শিবের রূপান্তরিত নাম। এই মন্দিরে একটি প্রাচীন শিবলিঙ্গ রয়েছে। মন্দিরের সামনে নন্দীর একটি কালো মূর্তি বেশ আকর্ষক। মন্দিরের পাশে একটি পুকুর রয়েছে। সেখানেও স্নান করেন ভক্তেরা। দেখা মন্দির, তবু বছর খানেক পর আবার এখানে আসা। আমার স্ত্রীর ইচ্ছে পূজো দিতে হবে। মন্দিরের গেট পেরোতেই পান্ডার দল ছেঁকে ধরল। ফুল বেলপাতা পূজো সামগ্রী কিনে নিয়ে আমরা মন্দির চত্বরে প্রবেশ করলাম।
 |
| চন্দনেশ্বর মন্দির |
চন্দনেশ্বর কাহিনীচন্দনেশ্বর একটা গল্প একটা মিথ! কত মিথ, ইতিহাস, ধর্মীয় কাহিনি জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। এই মন্দিরকে ঘিরে একটি লোককথা প্রচলিত আছে। আজ যেখানে এই চন্দনেশ্বর শিবের মন্দির, সেখানে বহু বছর আগে ছিল ঘন জঙ্গল ও হোগলার বন। ওই বনের ভেতরে ছিল প্রচুর চন্দন গাছ। তার মধ্যে ছিল বড় এক ঝর্ণা। সেই ঝর্নার জল গড়িয়ে যেত সমুদ্রে। চন্দন বনের মধ্যে থাকায় এর নাম চন্দন ঝর্ণা। এই জঙ্গলে নাকি ভূতেরাও বাস করতো, তাই এই জঙ্গলকে অনেকে ভূতবন বলতো। এই দুর্গম হোগলা বনে দেহলি নামে এক তেলেনী থাকতেন। তার একমাত্র মেয়ে লছমী। লছমী ছিল সুন্দরী, ভক্তিমতী ও বুদ্ধিমতী। ছোটবেলা থেকেই লছমী ছিল শিবের ভক্ত। বড় হলে লক্ষণ নামে পাশের গ্রামের এক যুবকের সাথে তার বিয়ে হয়। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সংসারে মন লাগে না লছমীর, সারাদিন সে কোন কাজ করতো না। রাতদিন কেবল শিব পূজোয় ব্যস্ত। লছমীর শ্বশুর বাড়িতে ছিল পাঁচটা দুধওয়ালা গাই। একদিন লছমীর শ্বশুর শাশুড়ি রেগে গিয়ে বললো ঘরের কাজ কর্ম করো না হলে গাভীগুলো বনে চরিয়ে আনো। বাধ্য হয়ে লছমী গাভীগুলো সকালে বনে চরাতে নিয়ে যায় আর সন্ধ্যায় বাড়িতে নিয়ে আসে। এর জন্য শিব পূজোয় যাতে কোনও বিঘ্ন না ঘটে, তাই সে বনের ভেতরে একটা বটগাছের নীচে বসে শিবের ধ্যান জপ করতে লাগলো। যখন সে ধ্যানে মগ্ন থাকতো, তখন তার গাভীরা দূরে কোথাও চলে যেত। ঠিক সন্ধ্যে হলেই চলে আসতো এবং লছমী তাদের ঘরে নিয়ে আসতো। এদিকে তার শাশুড়ি গাভীদের দুধ দুইতে গিয়ে দেখে প্রতিদিন দুধের পরিমান ক্রমশ কমতে থাকছে। এমনই একদিন গাভীগুলো একেবারেই দুধ দিলো না। টানা সাতদিন এরকম চললো। গাভীর দুধ নেই। রেগে গিয়ে এবার ননদ ও শাশুড়ি মিলে লছমীকে জিজ্ঞেস করল গাভীর দুধ কোথায় যায়? লছমী বলতে থাকে যে সে চোর নই! শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে বললো দুধ চোরকে ধরে নিয়ে আসতে হবে, না পারলে তাকেই চোরের বদনাম নিতে হবে। ননদ ও শাশুড়ির লাঞ্ছনা সহ্য না করতে পেরে একদিন লছমী গাভীদের পিছু অনুসরণ করতে লাগলো। সে দেখলো তার গাভীরা ভুতবনের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এল। সে এক মনোরম কাননে এসে পৌঁছালো। দুর্গম সেই বনের ভেতর চন্দন ছাড়াও চাঁপা, নাগেশ্বর আরও কত গাছপালা। চন্দন বনের ভেতরে একটা ঝর্ণা। ঝর্ণার জলাশয়ের কুলে কুলে হোগলা জঙ্গল। জায়গাটা ফুলের গন্ধে ম ম করছে। এমন সময় দুন্দুভি বেজে উঠল। সে হঠাৎ দেখতে পেল, একটা জায়গায় ধীরে ধীরে মাটি দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল। তখনই আকাশ থেকে ধুতুরা, চাঁপা, নাগেশ্বর ও নানারকম ফুল এবং গাছ থেকে বেলপাতা ঝরে পড়তে লাগলো। চারদিকে শঙ্খ, ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠল, ধূপধুনা গন্ধে ভরপুর হয়ে গেল চারদিক। লছমী দেখল, সেই দ্বিখন্ডিত মাটির কুণ্ডে তার গাভীগুলোর বাট থেকে দুধ ঝরে পড়তে লাগলো। আর সেই দুধ গিয়ে পড়ছে শিবলিঙ্গের উপর। এরপর এক সময় তার গাভীগুলো ফিরে গেল আর ধীরে ধীরে গর্তের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। গাছের আড়াল থেকে সব কিছুই দেখে লছমী স্তম্ভিত হয়ে গেলো। এ কোন দৈব ঘটনা? বুঝতে পারল সে। লছমী সেখানে বসে এক মনে শিবের ধ্যান শুরু করে দিলো। ভক্তের আকুল ডাকে সাড়া দিয়ে এক সময় শিব ঠাকুর তাকে দেখা দিয়ে বললো, কি চাস তুই? লছমী বলল যে সে কিছুই চাই না, সারাজীবন কেবল যেন তাঁরই আরাধনা করে যেতে পারে। শিব তুষ্ট হয়ে লছমীকে বরদান করলেন আর বললেন এখন থেকে শুধু আমি তোর জন্য এই কুণ্ডে বাস করব। এখানে শুধু এই কুণ্ডটা থাকবে। আর চাঁপা, নাগেশ্বর, ধুতুরা ফুল ও বেলপাতা দিয়ে এই কুণ্ডে যে দুধ জল পঞ্চামৃত দিয়ে আমার স্তুতি করবে তার মনোবাঞ্ছা পূরণ হবে এবং তাদের সবার জন্য আমি চন্দনেশ্বরে বিরাজ করব। এই কথা বলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এদিকে লছমীর শ্বশুরবাড়ির লোক সারা জঙ্গল খুঁজে কোথাও লছমীকে খুঁজে পেলো না। এরপর লছমীর শাশুড়িকে শিব ঠাকুর স্বপ্নে দেখা দিয়ে সব ঘটনা জানিয়ে বললেন যে লছমী তাঁর পরম ভক্ত। ওকে তোমরা ঘরে নিয়ে যাও। আর এটাও বললেন 'লছমী দুধ চুরি করেনি, আসল দুধ চোর তো ছিলাম আমি।' এরপর তারা সমাদরে লছমীকে ঘরে নিয়ে এল। তারপর ধীরে ধীরে জঙ্গল লুপ্ত হয়ে অচিরে এখানে বাবা চন্দনেশ্বরের নামে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠিত হল। সেই সঙ্গে পড়শী রাজ্য থেকেও প্রচুর ভক্তের সমাগম হতে লাগলো।
 |
| চলছে পূজা পর্ব |
পুজোপাঠ শেষ হলে সবাই মিলে ঠিক করলাম কাছেই তালসারি থেকে একটু ঘুরে আসি। কিন্তু তার আগে ব্রেকফাস্টটা সেরে নিতে হবে। মন্দিরের সামনে একটা দোকানে হালকা কিছু ব্রেকফাস্ট করে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলাম। পার্কিং লট থেকে ডানে মোড় নিয়ে তালসারির পথ ধরলাম। গাড়ি এগিয়ে চলল সঙ্কীর্ণ পিচ রাস্তা ধরে। দু'দিকে অগোছালো গাছ। মাঝেমধ্যে ডালপালা ঝুঁকে এসেছে রাস্তায়। গ্রামের ভেতরে কখনও কখনও আবার রাস্তাই হয়ে উঠেছে বাড়ির উঠোন। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎই গাছগাছালির মাঝে উঁকি দিল ওড়িশা ট্যুরিজমের পান্থনিবাস।
 |
| ওড়িশা ট্যুরিজমের পান্থনিবাস |
তালসারিতে পৌঁছে দেখি, একটা রাস্তা নেমে গেছে সৈকতের দিকে। পান্থনিবাসের গেট পেরিয়ে খানিকটা যেতেই পিচ রাস্তা শেষ। মাটির ঢালু পথ। সামনে একটা ফাঁকা মাঠে গাড়ি রেখে পাড়ি দিলাম সৈকতের পথে। পাড়ের এপার থেকে সামনে তাকালে যত দূর নজর যায় দেখি বিস্তীর্ণ ঝাউবন আর তার পেছনে সমুদ্র। হ্যাঁ! এটাও একটা সমুদ্র। তবে জল অনেকটা দূরে, পাড় থেকে দেখাই যাচ্ছে না। ঢেউ এর শব্দ হালকা শোনা যাচ্ছে। সামনে শুধু বালি আর বালি। মাঝে মাঝে একটু একটু পুকুরের মতো জমা জল। সেই জল পেরিয়ে যেতে হবে সমুদ্র সৈকতে। দু-একটা নৌকা দাঁড়িয়ে আছে সেই পুকুরের মতো জমা জলের মধ্যে। আর সেই বালির ভেতর জমে থাকা জলে নৌকাগুলো প্রহর গুনছে সমুদ্রে পাড়ি দেওয়ার জন্য। মোটের উপর ভালই লাগছে।
 |
| প্রহর গুনছে সমুদ্রে পাড়ি দেওয়ার জন্য |
সমুদ্রে নামার মুখে একটা ছোট্ট মাছের আড়ৎ। জেলেরা সমুদ্র থেকে জ্যান্ত মাছ, কাঁকড়া এসব ধরে এনে, এখানে বিক্রি করে। আমরা একধার দিয়ে বালির মধ্যে নেমে পড়লাম। এখানে নাকি প্রচুর লাল কাঁকড়া দেখা যায়? কিন্তু কাঁকড়া তো দেখলাম না একটাও। দু-একটা যাও আছে দূরে দূরে, শুধুই ওদের ঘর দেখতে পেলাম। কিন্তু কাছে যাওয়ার আগেই টুক করে তারা বালির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে!
 |
| জেলে নৌকা |
সুবর্ণরেখা এখান থেকে বারো কিলোমিটার আগে সমুদ্রে মিশেছে। আর তারই একটা শাখা বিছিন্ন হয়ে এই তালসারিতে এসে সমুদ্রে মিশেছে। তাই এখানে সমুদ্রকে ছুঁতে হলে জোয়ারের সময় ছোটো নদীটা নৌকায় পেরোতে হয়। এখন ভাটা, তার জন্য নদীতে জল কম। এ সময় সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার একমাত্র উপায় বাইকে চেপে যাওয়া। স্থানীয় যুবকেরা দেখি দুজন করে বাইকে চাপিয়ে মোহনা পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনছে। লাল কাঁকড়া দেখার জন্য অনেকেই দেখি দু'শো টাকা দিয়ে বাইক ভাড়া করে ঘুরতে যাচ্ছে। যাতায়াত ব্যবস্থা দেখে আমাদের কারো যাওয়ার আগ্রহ হলো না।
 |
| তালসারীর পথে |
দুপুর তখন একটা কি দেড়টা! এদিকে সেরকম ভালো খাওয়ার হোটেল দেখতে পেলাম না। তাই ঠিক করলাম দীঘায় কোনো ভালো হোটেলে গিয়ে লাঞ্চ করে বাড়ি ফিরবো। অতএব আবার ফিরে চললাম দীঘার দিকে। ওড়িশার সীমান্ত পেরিয়ে দেখি ডানদিকে একটা রাস্তা সমুদ্রের দিকে গেছে। সেখানে একটা বোর্ডে লেখা 'উদয়পুর সৈকতে যাবার রাস্তা'। উদয়পুর যে নিউ দীঘার এত কাছে সেই ধারণা আমার ছিল না। জায়গাটা খুবই শান্ত ও নির্জন! এখানে দীঘার মতো পর্যটকের ভিড় নেই। তাই দোকানের সংখ্যাও অনেক কম।
 |
| সৈকতে যাবার রাস্তা |
মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ যেন সমুদ্র সৈকত আর ঝাউবনের মাঝে প্রকৃতির কোলে এক মনের শান্তি। বিস্তীর্ণ বেলাভূমি, সারি সারি ঝাউবন আর সৈকতে আছড়ে পড়া বিশাল ঢেউ। চোখের সামনে উন্মুক্ত অঞ্চল তার সাথে ফুরফুরে হাওয়া। সমুদ্র সৈকতে ইতিউতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে টাঙানো রয়েছে রঙিন সামিয়ানার ছাউনি আর তার নীচে লাল নীল প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিল সাজানো সব দোকান। সেই সঙ্গে এই সৈকতের উপরি পাওনা স্থানীয় জেলেদের ধরা টাটকা মাছ ও কাঁকড়া ভাজা। ঐ মাছভাজার আড়ালে চলছে প্রকাশ্যে মদ্যপান। দীঘায় এই ছবিটা এখন দেখা না গেলেও উদয়পুরে দেখে মনে হলো এটা এখানের পরিচিত ছবি। এই সৈকতে প্যারাগ্লাইডিং, বাইক রাইডিং, ঘোড়ায় চড়া, ছোটদের জন্য রিমোট গাড়ি চড়ারও ব্যবস্থা আছে। চওড়া সৈকত ধরে ডান দিকে ঝাউবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার বাঁ দিকে বঙ্গোপসাগরের বিরামহীন ঢেউ আর ডান দিকে সমুদ্রের পাড়ে বালিয়াড়ি আর ঝাউবন। এই প্রাকৃতিক শোভার মায়াজালে কিছুক্ষণ আটকে থেকে সমুদ্রের রূপ উপভোগ করে উদয়পুর থেকে বেরিয়ে আবার এগিয়ে চললাম দীঘার দিকে।
 |
| উদয়পুর সমুদ্র সৈকত |
গত রাতে ওল্ডে ঘোরা হয়নি তাই প্রথমে ঢুঁ মারলাম সেখানে। বাসস্ট্যান্ডের কাছে নেহেরু মার্কেট ছাড়িয়ে চলে এলাম ওল্ড দীঘার সমুদ্র সৈকতে। ঢোকার মুখেই রয়েছে গাড়ি পার্কিংয়ের সুন্দর ব্যবস্থা। সেখানে এক জায়গায় গাড়ি পার্ক করে সকলে গাড়ি থেকে নেমে সারি সারি খাবারের দোকান পেরিয়ে চলে এলাম সুন্দর সাজানো বিশ্ব বাংলা পার্কে। কংক্রিটের চওড়া গার্ডওয়াল দেওয়া সমুদ্র পাড়ে উঁচু সিমেন্ট বাঁধানো বসার জায়গা। তারপরেই দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রের জলরাশি। সবাই মিলে দীর্ঘক্ষণ বসে রইলাম সেখানে।
 |
| বিশ্ব বাংলা পার্ক |
সমুদ্র থেকে বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়তে লাগল সিমেন্ট ও পাথরের তৈরি ব্লকগুলোর ওপর। মনের আনন্দে কাটিয়ে দিলাম বেশ কিছুটা সময়। ওদিকে সূর্যও ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। শেষ বিকেলের মিষ্টি রোদের আলো মেখে সমুদ্র উপভোগ ছিল অসাধারণ। এবার ফেরার পথ ধরতে হবে। সাগরপাড় থেকে উঠে মেরিন ড্রাইভের রাস্তায় এসে একটু ঘোরাঘুরি করে ছবিটবি তুলে চলে এলাম পার্কিংয়ের জায়গায় এক চা-স্ন্যাক্স এর দোকানে।
 |
| সমুদ্র উপভোগ |
ঘোরা শেষ! এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। পুরো দিনটাই ঘোরের মধ্যে আর ঘোরাঘুরির মধ্যে হৈ হৈ করে কেটে গেল। সারাটা দিনে একবারও মনে হয়নি কখন বাড়ি পৌঁছাবো। একরাশ ভালোলাগা নিয়ে ফিরে এলাম আবার সেই একঘেয়ে কর্মব্যস্ত জীবনে।
 |
| ওল্ড দীঘা |
» প্রয়োজনীয় তথ্যনিউ দীঘার খুবই কাছাকাছি অমরাবতী লেক, দ্য মেরিন অ্যাকুরিয়াম অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, সায়েন্স সেন্টার, এগুলো দেখে নেওয়া যেতে পারে। দীঘা থেকে ওড়িশার দিকে ঘুরে আসা যায় উদয়পুর সমুদ্র সৈকত, চন্দনেশ্বর শিব মন্দির, তালসারি সমুদ্র সৈকত, বিচিত্রপুর এবং দীঘা যাওয়ার সময় ঘুরে নেওয়া যেতে পারে বাঁকিপুট, মন্দারমণি, তাজপুর, চাঁদপুর (জায়গাটি শঙ্করপুর ও তাজপুরের মাঝামাঝি), শঙ্করপুর, দীঘা মোহনা এছাড়া বাংলার সৈকত মানচিত্রে নবতম সংযোজন বগুড়ান জলপাই।
দীঘা বিজ্ঞান কেন্দ্র এবং জাতীয় বিজ্ঞান শিবিরদীঘা বিজ্ঞান কেন্দ্র সকাল ৯ টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এর প্রবেশ মূল্য ২৫ টাকা। জুরাসিক পার্কের প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ১৫ টাকা। বিকেল ৪ টের পরে থেকে টিকিট দেওয়া হয়। এটা কেবলমাত্র সান্ধ্যকালীন শো এবং টিকিট ঘর খোলা থাকে সকাল ৯ টা থেকে সন্ধ্যে সাড়ে ৬ টা পর্যন্ত। তারামণ্ডল, 3D শো, স্পেস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনমি শো দেখার জন্য আলাদা প্রবেশ মূল্য লাগে। তারামণ্ডলের প্রদর্শন মূল্য ১০ টাকা। সায়েন্স শো দেখতে গেলে খরচ হবে ১০ টাকা। ২০ টাকার টিকিট কাটলে দেখা যাবে 3D শো। স্পেস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনমি শো দেখার জন্য খরচ পড়বে জনপ্রতি ২৫ টাকা।
» থাকার ব্যবস্থা
ওল্ড দীঘাসমুদ্রের দিকে মুখ করা হোটেলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো 'হোটেল সী হক' যার ব্যালকনি থেকে সমুদ্র দেখা যায় এর ঠিক পাশে রয়েছে 'সৈকতাবাস' রয়েছে 'হোটেল ব্লু ভিউ', 'হোটেল সিগাল' এছাড়া ওল্ড দীঘা ঢোকার মুখে সমুদ্র সৈকত থেকে কিছুটা দূরে রয়েছে 'পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের ট্যুরিস্ট লজ' ও 'বেনফিশের হোটেল মীনাক্ষি'।
- হোটেল সী হকঃ- ০৩২২০২৬৬২৩৫, ৯৮৩০১০৮৬৮৩, ৯৮৩৬৩৪৪৪৮৭, ৯৮৩০১৭৭৭০০
- হোটেল ব্লু ভিউঃ- ০৩২২০২৬৬৩২৪, ৭৮৭২০০৩৯২৯, ০৩৩২২৪১২৩৩০, ০৩৩২২১৯৭৯২০
- হোটেল সীগালঃ- ৯৮৩৬৪৬৮৬৮২, ৯৩৩১৯৬৯০০, ৮৩৩৬৯১৬৮৬১
- দীঘা সৈকতাবাসঃ- ০৩২২০২৬৬২৩৪, ৮৯৪২০০৭৭৮৮, ৯৪৩৪২৩৪২২২
নিউ দীঘাসমুদ্রের দিকে প্রথম সারিতে থাকা হোটেল
- হোটেল শঙ্খচিলঃ- ০৩২২০২৬৭০৮২, ৯৭৩৪৫০১৯০৭, ৯৭৩২৫১৮৬৮৫, ৯৭৩৪৫০১৯০৪
- হোটেল রাজ প্যালেসঃ- ৯৭৩২৬৫৫২১, ৭০৬৩২২৪১১১
- হোটেল নিউ সাগরপ্রিয়াঃ- ০৩২২০২৬৬২৭৫, ০৩২২০২৬৬৫২৬, ৯৩৩১৭০২৯৬৩
- নিউ হোটেল গীতাঞ্জলি ইনঃ- ০৩২২০২৬৭১৫৮, ৯৭৩৪৩৯৩৪৫০, ০৩৩২৩৯৬৫৬৭৩, ৯৮৩১২৫৮১৪৮
- হোটেল সাগরপ্রিয়াঃ- ০৩২২০২৬৬৩১৫, ০৩২২০২৬৬৩২৬, ০৩৩২২৩১১৮২১, ৯৪৩৪০৩৪৪৭৬
- হোটেল সী বার্ডঃ- ০৩২২০২৬৬১২৭, ০৩২২০২৬৬০২২, ৭৬০২৮০৩১৩১
- বসুমতি হলিডে হোমঃ- ৮৩৩৬৮০১৪৪৫, ০৩৩২৩৫০৯৪৬২, ০৩৩২৩৫০৭৫৪০
- হোটেল সী বার্ড ২ঃ- ৯৮০০৭০৪৩০৪
- হোটেল গোল্ডেন বীচঃ- ০৩২২০২৬৬৮৮৯, ৬২৯১৭৪৯৯৩৩, ৯৭৩২৭৬১৫১৭
- হোটেল কামলা রেসিডেন্সিঃ- ০৩২২০২৬৬১৫৪, ০৩২২০২৬৬১৫৭, ৮১০১২৬০২৫৯, ০৩৩২২৩১১৭৭৫
- হোটেল সূর্যদীপঃ- ৮১৬৭৪৭০৪৪৬, ৯৪৭৪৭১৫১৬৮, ০৩৩২২৩৫৩৭০২
- হোটেল মাহেকঃ- ৮৭৬৮৮৯২৪৪১, ৯৯৩২২২৭২৬৮, ৮৯০০২৫৭৫০৬
- হোটেল জয়রাম হাই-টাইডঃ- ০৩২২০ ২৬৬০০১, ৯৮০০০৬৯৩৬৯
- হোটেল বসন্তপ্রিয়াঃ- ৭৯৮০২৪৭৩০৩, ৮৫৮২৯৫৯৫০০
- হোটেল রানীকুঠিঃ- ৭০৬৩২১৩৬৪৯
- হোটেল জেপিঃ- ৯৭৩৪৪৮০৯৬৭, ৯০৫১৯৮৭৩৯০
- হোটেল আশা ইন্টারন্যাশনালঃ ৮১১৬০৬৩২৬৬
- হোটেল সাগর নীড়ঃ- ৯০৯১৩৩৪২৪৩, ৬২৯৫৬২৫৩৪২
- হোটেল মেঘ বালিকাঃ- ৯৮৩০৪৮৭০৩৫, ৯৮৭৪৫২১০৮৪
- হোটেল বীচ ভিউঃ- ৯৮৩৬২২১৪১৪, ৯৮৩১৮৭৩১৩১
- হোটেল মোনালিসা ইনঃ- ৮৪৪৭৭৯৪৯৩৪, ৯২০৫৯৩৭৯৪৯, ৯৫৯৯৮৯৭৮৫৯
- হোটেল কোজি ইনঃ- ৯৮৩৬৩৬০১২৮, ৯২৩১৬৩২৩৭৮, ৯৮৮৩৪৫৬১৯১
- হোটেল প্রিয়দর্শিনীঃ- ৯৮০০২৩৯৮৪৪
» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার্স মেদিনীপুর, 'অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট' হিন্দুস্তান টাইমস - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়)
DIGHA, UDAIPUR, CHANDANESWAR, TALSARI, PURBA MEDINIPUR, WEST BENGAL
No comments:
Post a Comment