হুগলীর প্রাচীনতম গীর্জাগুলির মধ্যে ব্যান্ডেল চার্চ বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এটি একটি রোমান ক্যাথোলিক চার্চ। ব্যান্ডেল শহরে গঙ্গাতীরে এক মনোরম পরিবেশে অবস্থিত এই গীর্জাটি পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের প্রাচীনতম রোমান ক্যাথলিক গীর্জাগুলির মধ্যে অন্যতম। পর্তুগীজ ক্যাপ্টেন পেদ্রো তাভারেস সম্রাট আকবরের কাছে গীর্জা নির্মাণ করার অনুমতি গ্রহণ করে ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে হুগলি নদীর পাশে একটি কাঠের গীর্জা তৈরি করেন, 'নোস সেনহোরা দো রোজারিও' যার ইংরেজি অর্থ ‘আওয়ার লেডি অফ হ্যাপি ভয়েজ’। এর ৪০০ বছর পরে রোমের ভ্যাটিকান এই গীর্জাটিকে 'ব্যাসিলিকা'–র সন্মান দিয়েছিলো। বর্তমনে এটি 'দ্য ব্যাসিলিকা অফ দ্য হোলি-রোসারি' লোকমুখে 'ব্যান্ডেল চার্চ' নামে পরিচিত। স্কুলে পড়াশোনা করার সময় থেকেই এই ব্যান্ডেল চার্চের নাম শুনেছি কিন্তু স্বচক্ষে কখনো দেখা হয়নি। সম্প্রতি আত্মীয়সূত্রে আমার এক কাকু চুঁচুড়াতে ট্রান্সফার হয়ে আসার পরে সেই সুযোগটিকে কাজে লাগলাম। ছুটির দিন দেখে একদিন সপরিবারে বেরিয়ে পড়লাম ব্যান্ডেল চার্চ দর্শন করতে।
 |
| স্বাধীনতা দিবসে পতাকা উত্তোলন |
দিনটি ছিল ১৫ই আগস্ট, স্বাধীনতা দিবসের দিন বলে চার্চে ভালো রকমই জনসমাগম হয়েছে। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ ছাড়াও অনেকে এমনিই এসেছেন এখানে খানিক বেড়ানোর জন্য। গেট পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দেখি পতাকা উত্তোলন চলছে। যেখানে পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে তার পাশে রয়েছে একটি ফোয়ারা ও একটি বিশাল মাঠ। পুরো মাঠ জুড়ে দেখি প্রভু যীশুর জীবনকাহিনী বিভিন্ন ভাষ্কর্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। চারপাশে প্রচুর দর্শনার্থী ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমরাও দর্শনার্থী হিসেবে চার্চের ভেতরে প্রবেশ করলাম।
 |
| চার্চের ভেতরে প্রবেশ করলাম |
১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে এই চার্চটির পত্তন হয়। চার্চে ঢোকার মুখে দেখি একটি ফলকে লেখা আছে চার্চের প্রতিষ্ঠা সাল। ভেতরটি খুবই সুন্দর, পরিষ্কার ও শান্ত। চার্চের অভ্যন্তরীণ শান্ত পরিবেশ মনকে দেয় যেন এক শান্তি যা শহরের কোলাহল থেকে একেবারেই আলাদা। বারান্দা এবং উপাসনাগৃহের ভেতরের দেওয়াল জুড়ে যীশুর জীবনের নানা ঘটনার অজস্র পেন্টিং ও তার সঙ্গে লেখা তথ্য অত্যন্ত পরিষ্কার এবং সুন্দরভাবে সংরক্ষিত রয়েছে। উপাসনাগৃহের মধ্যে ছবি তোলা নিষিদ্ধ।
ব্যান্ডেল চার্চ প্রতিদিন সকাল ৮.০০ থেকে বিকেল ৪.৫০ পর্যন্ত খোলা থাকে। প্রতি বছর ১লা জানুয়ারী ও ২৫শে ডিসেম্বর সর্বসাধারণের জন্য বন্ধ থাকে।
চার্চের ভেতরে একটি সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠলাম, ছাদটি অত্যন্ত সুন্দর। দেখলাম ছাদ থেকে ব্যান্ডেল শহরের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, এছাড়া চার্চের পাশে বয়ে চলা গঙ্গা নদী ও নদীর উপরে জুবিলী ব্রিজকেও দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। ছাদে একটি ছোট ঘরের মতো আছে সেখানে রয়েছে 'আওয়ার লেডি অফ হ্যাপি ভয়েজ’-এর মূর্তি। মূর্তির সামনে রয়েছে বেদির মতো একটি স্থান, সেখানে ভক্তদের অনেকেই মোমবাতি জ্বালাচ্ছেন। তারা যে সকলেই খ্রিস্টান মনে হলো না। পাশে রয়েছে ঘন্টাঘর। ছাদের উপর কিছুক্ষন ঘোরাঘুরি করে চার্চ থেকে বেরিয়ে গাড়ি চালিয়ে সােজা বাড়ি চলে এলাম।
 |
| চার্চের প্রার্থনাস্থলের দিকে এগিয়ে চললাম |
ইতিহাসের আলোয় ব্যান্ডেল চার্চ
পূর্বে ব্যান্ডেল পর্তুগীজদের অধীনে ছিল। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগীজগণ এই চার্চটি নির্মাণ করেন। এই চার্চটি একাধিকবার যুদ্ধ-বিগ্রহে ধ্বংস ও ভস্মীভূত হয়েছে। ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সৈন্য হুগলী আক্রমণ করে। প্রায় সাড়ে তিন মাস ব্যাপী যুদ্ধের পর মুঘলদের হাতে পর্তুগীজরা পরাজিত হয়। মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় এই চার্চটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই যুদ্ধে পরাজিত পর্তুগীজ বন্দীদের মধ্যে ছিলেন পাদ্রী জোয়াও দ্য' ক্রুজ। মুঘলগণ সকল বন্দীদের সাথে তাঁকেও বন্দী করে আগ্রা নিয়ে যায়। কথিত আছে, সেখানে সম্রাট জাহাঙ্গীরের আদেশে দরবার হলে এক উন্মত্ত হাতীর সামনে পাদ্রী জোয়াও দ্য' ক্রুজকে ছুড়ে ফেলা হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে হাতীটি তাঁকে পদদলিত না করে শুঁড় দিয়ে আদর করতে থাকে। এই ঘটনায় সম্রাট জাহাঙ্গীর খুবই আশ্চর্য হয়ে তাঁকে মুক্তি দেন এবং পর্তুগীজদের পুনরায় ফিরিয়ে এনে তাঁর অনুরোধে স্বাধীন ধর্মাচরণের জন্য ব্যান্ডেলের চার্চটি পুননির্মাণ করিবার অনুমতি দেন। ঐ চার্চ নির্মাণের ব্যয়-নির্বাহের জন্য বহু নিষ্কর জমিও তাঁকে দান করেন। এরপর ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে গোমেজ দ্য' সোতো বর্তমান ব্যান্ডেল চার্চটির স্থানে একটি নতুন চার্চ নির্মাণ করেন। নতুন করে এই চার্চটির পুনর্নির্মাণ করার সময় ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দের দুঃস্মৃতি মুছে ফেলার জন্য ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ আসল চার্চটির স্থাপনকাল উল্লেখ করা হয়েছে। এরপরেও একাধিকবার চার্চটি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা ব্যান্ডেলের চার্চ সংলগ্ন পর্তুগীজ নগরীতে লুঠতরাজ চালানোর সময়ে চার্চটি সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও চার্চের যাবতীয় নথিপত্র আগুনে নষ্ট হয়ে যায়। ঠিক তার পরের বছরেই ইংরেজরা নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলে ব্যান্ডেল চার্চ ইংরেজদের সামরিক শিবিরে পরিণত হয়। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহ ভূমিকম্পে চার্চের দক্ষিণদিকের প্রবেশদ্বারের সামনে অবস্থিত চূড়াটি ধ্বসে পড়ে এবং ‘আওয়ার লেডি অফ হ্যাপি ভয়েজ’-এর মূর্তিতে ও চার্চের দেওয়ালে নানা জায়গায় ফাটল ধরে। তৎকালীন ফাদার দ্য' সিলভা দ্রুততার সাথে এই সমস্ত ক্ষয়ক্ষতি মেরামত করিয়ে চূড়াটিকে নতুন করে তৈরি করে দেন।
 |
| চার্চের প্রবেশদ্বার |
'আওয়ার লেডি অফ হ্যাপি ভয়েজ' নিয়ে কিংবদন্তি রয়েছে। মাতা মেরীর এই মূর্তিটি হুগলীর এক পর্তুগীজ সেনাছাউনিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল। পাদ্রী জোয়াও দ্য' ক্রুজ এবং তাঁর এক অন্তরঙ্গ পর্তুগীজ বণিক বন্ধু তিয়োগো এই মূর্তিটিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মুঘল আক্রমণের সময় মূর্তিটি রক্ষা করতে তিয়াগো মূর্তিটিকে নিয়ে হুগলী নদী পেরিয়ে পালিয়ে যাবার জন্য নদীতে ঝাঁপ দেন। এরপর সেই বন্ধু ও মূর্তির কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এতে পাদ্রী জোয়াও দ্য' ক্রুজ ভীষণ দুঃখিত হয়েছিলেন।
 |
| চার্চের ছাদে প্রার্থনাস্থল |
এই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর, ব্যান্ডেল চার্চটি পুননির্মাণ করার শেষলগ্নে এক জ্যোৎস্না রাতে নদীর জলের আলোড়নের শব্দে দৈববাণীর মতো নদী থেকে তাঁর বন্ধু তিয়াগোর ডাক শুনতে পান। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর দেখলেন নদীর তীরে প্রচুর মানুষের ভিড়। তিনি নদীর ধারে গেলেন এবং আশ্চর্য হয়ে দেখলেন যে মেরী মাতার মূর্তিটি নদীর কূলে ফিরে এসেছে। এরপর মূর্তিটিকে সেখান থেকে তুলে এনে চার্চের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে চার্চের সামনে একটি বড় ঝুল বারান্দা তৈরি করে তাতে 'আওয়ার লেডি অফ হ্যাপি ভয়েজ'-এর মূর্তিটিকে দোতলার বারান্দায় স্থানান্তরিত করা হয়।
 |
| চার্চের ছাদে 'আওয়ার লেডি অফ হ্যাপি ভয়েজ’-এর মূর্তি |
চার্চে রাখা জাহাজের মাস্তুলটি নিয়েও একটি কিংবদন্তি রয়েছে। মেরী মাতার মূর্তিটি যে দিন প্রতিষ্ঠিত হয় সেদিন একটি বড় পর্তুগীজ জাহাজ বঙ্গোপসাগরের এক ভয়ঙ্কর ঝড়ের কবলে পড়ে চার্চের সামনে হুগলী নদীর ঘাটে এসে উপস্থিত হয়। জাহাজের ক্যাপ্টেন জাহাজ রক্ষার কোনো উপায় না দেখে ঝড়ের কবল থেকে বাঁচার জন্য মেরী মাতার কাছে প্রার্থনা ও মানত করেন। মেরী মাতার ইচ্ছাতেই হোক বা পর্তুগীজ নৌপ্রযুক্তির গুণেই হোক, জাহাজটি ঝড়ের কবল থেকে সেবার রক্ষা পায়। জাহাজের ক্যাপ্টেন তাঁর মানত রক্ষার জন্য জাহাজ থেকে এই মাস্তুলটি খুলে ব্যান্ডেল চার্চে দান করেন।
 |
| প্রভু যীশুর জীবনকাহিনী |
» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ- 'হুগলি জেলার ইতিহাস' - সুধীর কুমার মিত্র)
BANDEL CHURCH, HOOGHLY, WEST BENGAL
No comments:
Post a Comment