ডাহি থেকে আরও কিছুটা এগিয়ে এসে পৌঁছলাম নয়াগ্রাম থানার কাছে। সামনে পড়ল এক তিন মাথার মোড়। এবার পড়লাম আসল বিপদে। কিন্তু কোনদিকে তপোবন? এবার কোনদিকে যাব তা ঠিক করে উঠতে পারলাম না। মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক সিভিক ভলেন্টিয়ারকে জিজ্ঞেস করে ডানদিকের রাস্তা ধরে এগোতে থাকি। অপূর্ব সুন্দর! ভয় মিশ্রিত গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তপোবনে পৌঁছোনোর অভিজ্ঞতা বেশ রোমাঞ্চকর। সরু পিচের রাস্তা ধরে একটু এগোতে প্রথমে পড়ল কুড়চিবনি। কিছুক্ষণ পরে আরো একটা ছোট্ট গ্রাম, এলো নিমাইনগর। এই নিমাইনগর গ্রামেই রয়েছে বিখ্যাত কালুয়াষাড় মন্দির। নিমাইনগর থেকে তপোবনের দিকে এগিয়ে চলেছি। রাস্তার ধারে কোথাও ভয়ঙ্কর নির্জনতা, কোথাও আবার রাস্তার ধারে জমজমাট লোকালয়। জঙ্গল, আর একের পর এক আদিবাসী গ্রাম পেরিয়ে চলেছি লোকজনকে জিজ্ঞেস করে তাদের পথনির্দেশ মতো।
 |
| অগ্নিকুণ্ড |
স্থানীয় লোকের বিশ্বাস, এই স্থানেই মহর্ষি বাল্মিকীর তপোবন ছিল। রাম সীতাকে নির্বাসিত করলে সীতা নাকি এখানেই ছিলেন। সেই সময় লব কুশের জন্ম এই স্থানেই হয়েছিল। যদিও রামায়ণে বর্ণিত মহর্ষি বাল্মীকির তপোবনের সহিত এই তপোবনের কোনো সম্বন্ধ নেই। তবে লোকালয় থেকে অনেক দূরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে এখানে এসে যা দেখলাম, সেটি রামায়ণে বর্ণিত যে বনে মুনি ঋষিরা তপস্যার জন্য আশ্রমে থাকতেন সেদিক থেকে এই জায়গাটা তপোবনেরই উপযুক্ত। তার সাথে রামায়ণের যোগসূত্র থাকুক আর না থাকুক। রামায়ণের কাহিনীর সাথে মিল রেখেই এখানে বানানো হয়েছে রামসীতার মন্দির, সীতা কুটির, সীতার রান্নাঘর, আঁতুড়ঘর ইত্যাাদি।
 |
| রামায়ণের কাহিনীর আদতে বিভিন্ন মূর্তি |
এখানে একটি ছোটো গুমটি মতো দোকান আছে। চা, বিস্কুট ছাড়া টুকিটাকি খাবারও পাওয়া যায়। এছাড়া আশ্রম চত্বরে জঙ্গলের মধ্যে একটা নতুন সরকারী গেস্ট হাউস রয়েছে। সেখানে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। এখানে প্রসাদ খেতে হলে সকাল ন'টার মধ্যে এসে সামগ্রী দিয়ে দিলে ওনারা রান্না করে ভোগ খাওয়ান। তবে পুরোটাই নিরামিষ হওয়া চাই।
 |
| মন্দিরের বিগ্রহ |
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে যায়, ঘড়ির কাঁটা জানিয়ে দিলো দুপুর দু'টো। খাওয়াদাওয়া কিছুই হয়নি। সেই কেশিয়াড়িতে সকাল বেলায় ব্রেকফাস্ট করেছি তারপর আর কোনো খাবার পেটে পড়েনি। আশেপাশে কোনো খাবারের দোকানও চোখে পড়লো না, তাই খিদে পেলেও কোনো উপায় ছিল না। এবার ঘরে ফেরার পালা। আবার সেই জঙ্গল? উফ! ভাবলেই শরীরে কাঁটা দিচ্ছে। ওখানে আসা বাইকারদের মধ্যে একজন জানালো কাছেই দেউলবাড় গ্রামে প্রাচীন এক মন্দির আছে, 'রামেশ্বর মন্দির'। আর কি এ সুযোগ মিলবে? এতদূর এসেছি যখন তখন ঘুরে আসাই যাক।
 |
| দেউলবাড়ের দিকে চলেছি |
বেরিয়ে পড়ি রামেশ্বর মন্দির দর্শনে। তপোবন জঙ্গল পেরিয়ে পৌঁছে যায় বাছুরখোয়াড় গ্রামের সেই জায়গায় যেখানে রাস্তা দুভাগে ভাগ হয়েছে। লাল মোরামের পথ ছেড়ে পাকা রাস্তায় উঠলাম। সেই রাস্তা, তবে এবার যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে না গিয়ে ঠিক তার উল্টো দিকের রাস্তাটি ধরে এগিয়ে গেলাম। দেউলবাড়ের দিকে চলেছি। সরু পিচের রাস্তা। বিরিবেড়িয়া গ্রাম পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম রামেশ্বর মন্দিরের কাছে।
 |
| পৌঁছে গেলাম রামেশ্বর মন্দিরে |
রামেশ্বর মন্দিরের ইতিহাস ছুঁয়ে যাওয়া...
রামেশ্বর পঞ্চ শিব মন্দির। মন্দিরটি বহু প্রাচীন। এই মন্দির নির্মাণ কিভাবে হয়েছিল সেই সম্বন্ধে সঠিক তথ্য জানা নেই। খ্রীস্টিয় ষোড়শ শতাব্দীতে এই প্রাচীন রামেশ্বর মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। তবে রামেশ্বর মন্দিরের ইতিহাস নিয়ে রয়েছে নানা জনশ্রুতি। কিংবদন্তি অনুসারে, শ্রীরামচন্দ্র বনবাসে থাকাকালীন বেশ কিছু দিন এই স্থানে কাটিয়েছিলেন। তখন এই অঞ্চলটি গভীর অরণ্যে ঢাকা। সেদিন ছিল শিবচতুর্দ্দশী। সীতা পতির পুণ্যের জন্য শিবের ব্রত রাখেন। সেই ব্রত পালন করতে সুবর্ণরেখা নদীর তীরে বালি দিয়ে দ্বাদশ শিবলিঙ্গ তৈরি করেন। এরপর সীতার অনুরোধে রামচন্দ্র শিবপুজোর জন্য দেবশিল্পী বিশ্বকর্মাকে দিয়ে এই শিব মন্দিরটি তৈরি করিয়েছিলেন। শ্রীরামচন্দ্রের নামানুসারেই মন্দিরটির নাম হয়ে ওঠে রামেশ্বর মন্দির।
 |
| রামেশ্বর মন্দির |
লোকশ্রুতি অনুযায়ী, জঙ্গলমহলের নয়াগ্রামের এই অঞ্চলটি গঙ্গ রাজার আমলে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ময়ূরভঞ্জের রাজারা ছিলেন মরাঠাদের আশ্রিত। সেই সময় মরাঠারা এই অঞ্চলে অনেক ঘাঁটি ও মন্দির তৈরি করেছিল, নিদর্শন হিসাবে গোপীবল্লভপুরের বর্গীডাঙ্গা সেনাঘাঁটি ও রামেশ্বর নাথের এই মন্দিরটি এখনও রয়েছে। মন্দিরটা একটি টিলা পাহাড়ের উপর স্থাপিত। শৈবপন্থী মারাঠারা রামেশ্বর নাথের এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। মরাঠারা এখানে দেবতার আরাধনা ছাড়া শত্রুপক্ষের উপর নজরদারিও করত। আবার ঐতিহাসিক মতে নয়াগ্রামের চতুর্থ রাজা ছিলেন চন্দ্রকেতু সিংহ বা কারও মতে চন্দ্রশেখর সিংহ। স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি এই স্থানে রামেশ্বর নাথের মন্দির নির্মাণ করে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
 |
| মন্দির চত্বর |
একটা গাছের ছায়ায় বাইকটা দাঁড় করিয়ে রেখে মন্দির চত্বরে প্রবেশ করলাম। চারিদিকে ফাঁকা, জনবিরল স্থানে বিশাল এলাকা জুড়ে অবস্থিত এই রামেশ্বর মন্দির। মন্দিরটি মাকড়া পাথরে উৎকল শৈলীতে গঠিত। মন্দিরের গায়েই রয়েছে বহু বছরের পুরানো কাঁঠাল গাছ। এই কাঁঠাল গাছটিও নিত্য পূজিত হয়। দেউলবাড়ের এই মন্দিরে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে পুণ্যলাভের আশায় প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়। এখানের কয়েক শতাব্দী প্রাচীন গাজন উৎসবকে কেন্দ্র করে মেলাও বসে। প্রতিবছর শিব চতুর্দ্দশীর দিন মন্দির প্রতিষ্ঠা দিবস পালিত হয়। সেই সময় মন্দির প্রাঙ্গণে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। শিবরাত্রির দিন থেকে তিন দিন ধরে এই মেলা হয়।
 |
| মন্দিরের পুরানো কাঁঠাল গাছ |
মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে একসঙ্গে বারোটি শিবলিঙ্গ। মূল মন্দিরের সামনে কুণ্ডপুকুর নামে একটি জলাশয় রয়েছে। রোহিণীগড়ের জমিদার অক্ষয়নারায়ণের পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণ ষড়ঙ্গী মন্দিরটি সংস্কার করেন এবং মন্দির থেকে কুণ্ডপুকুরে যাওয়ার জন্য পাথর দিয়ে ঘাট আর সিঁড়ি বাঁধিয়ে দেন। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাবে মন্দিরের দেওয়ালে শ্যাওলা জমে সাদা রঙের প্রলেপ বিবর্ণ হয়ে গেছে।
 |
| মন্দিরের প্রবেশপথ |
মন্দিরটি পূর্বমুখী। সামনের দিক থেকে পর পর রয়েছে ভোগমন্ডপ, নাটমন্দির, জগমোহন, অন্তরাল এবং তারপর মূল মন্দির বা বিমান। জগমোহনের প্রবেশপথের দু'দিকে দুটি দ্বারপাল মূর্তি। মন্দিরের চারপশে সারি দিয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি ঝামাপাথরের তৈরি স্তম্ভ। প্রতিটি স্তম্ভের উপরে অলঙ্করণ হিসাবে একটি করে পাথরের ষাঁড়ের মূর্তি রাখা আছে। ষাঁড়ের মূর্তিগুলি বেশিরভাগই অক্ষত এবং মন্দিরমুখী।
 |
| দ্বারপাল মূর্তি |
মন্দির থেকে সুবর্ণরেখা নদীকে আবছা দেখা যাচ্ছে। অসাধারন সে রূপ তার। মন ভরে গেলো, কিন্তু উপায় নেই দিনের আলো যে ক্রমশ কমে আসছে। সূর্যটা গাছপালার মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছিলো। চারিদিক সূর্যাস্তের আবির মেখে লালে লাল! মন তখন বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়।
 |
| মন্দির থেকে সুবর্ণরেখা |
সম্প্রতি মন্দিরকে ঘিরে সরকারি উদ্যোগে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য মন্দিরের একপাশে সুদৃশ্য বাগান সহ একটি পার্কও গড়ে তুলেছে, কিন্তু অযত্নে পড়ে থেকে সেই বাগানটি আজ হারিয়ে ফেলেছে তার সৌন্দর্য। নয়াগ্রাম উন্নয়ন সমষ্টি কতৃপক্ষের উদ্যোগে রাত্রিবাসের জন্য এখন মন্দিরের কাছেই একটি গেস্ট হাউস তৈরি হয়েছে।
 |
| রামেশ্বর অতিথি নিবাস |
ঘণ্টা খানেক মন্দিরের চারদিক ঘুরে কয়েকটা ছবি তুলে তারপরে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ফেরার কথা ছিল নয়াগ্রাম হয়ে। কিন্তু তপোবনে এক বাইকার আমাকে একটি আনকোরা রাস্তার খোঁজ দিয়েছিল। সেই রাস্তাটি দিয়ে গেলে বেশ শর্টকাটে খড়্গপুর পৌঁছনো যায়। অতএব ফেরার রাস্তা বদলে ফেললাম। সামনে সম্পূর্ণ অজানা পথ, জানিনা কোনদিকে কিভাবে যাব।
 |
| খেয়া নৌকায় নদী পার |
রামেশ্বর মন্দির থেকে একটু পিছিয়ে এসে গ্রামের ভেতরে দিয়ে খেয়ালমত চলেছি। সব পথ একই রকম। রাস্তায় লোককে জিজ্ঞেস করে এ গলি সে গলি হয়ে অবশেষে এসে পৌঁছলাম সুবর্ণরেখার সামনে। বিশাল নদীর চর শুধুই বালুকাময়। দেউলবাড় ঘাট। পাড় থেকে অনেক দূরে ফেরিঘাট। ওপারে যেতে গেলে নদী পেরোতে হবে। ভরসা একমাত্র ভটভটি নৌকা। নদীচরের বালি ঠেলে কোনোরকমে পৌঁছলাম ফেরিঘাটে। ততক্ষনে ওপারে যাওয়ার নৌকা ঘাটে এসে গেছে। বাইকটা নৌকার উপরে চাপিয়ে নদী পেরোতেই ওপারে গড়ধরা। গড়ধরায় এসে নদীর এবড়ো খেবড়ো ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে গ্রামের লাল মোরাম ফেলা রাস্তায় উঠলাম। গড়ধরা থেকে লাল ধুলোর ঘূর্ণি উড়িয়ে এসে পৌঁছলাম একটা বড় রাস্তার মোড়ে। মোড় থেকে ডানদিকে টার্ন নিয়ে হাইওয়ে ধরলাম। রগড়া-কেশিয়াড়ি রোড। রাস্তাটি খুবই সুন্দর। দুপাশে হাল্কা সবুজ জঙ্গলের বুক চিরে এগিয়ে গেছে মিশকালো ঝা চকচকে পিচের রাস্তা, সেই রাস্তা ধরেই অচেনা অজানা রাস্তায় ঘরে ফেরার উৎকণ্ঠা নিয়ে এগোচ্ছি। রোহিনী পার হয়ে গেলাম। জানিনা আরও কতদূরে খড়্গপুর। পশ্চিম আকাশে তাকিয়ে দেখি সূর্য গড়িয়ে পড়ছে অস্তাচলে। একসময় সে টুপ করে অদৃশ্য হয়ে গেল। যদিও এদিকে সেরকম গভীর জঙ্গল নেই, মাঝেমধ্যে জনবসতি আছে তাই সন্ধ্যা নামলেও ভয়ের কোনো কারণ ছিল না।
 |
| গড়ধরার রাস্তা |
রোহিনী থেকে মাত্র পৌনে দু'ঘন্টার মধ্যে খড়্গপুরে পৌঁছে গেলাম। রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এলেও কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। মনে মনে বাইকার ছেলেটিকে অনেক ধন্যবাদ জানালাম। ভাগ্যিস শর্টকাট রাস্তাটা বলেছিল। অতঃপর খবর নিয়ে জেনেছিলাম, যে জঙ্গল দিয়ে আমি গিয়েছি সেখানে দিনের বেলাতেও নাকি হাতি জলাশয়ে স্নান করতে আসে!! তবে আমার যাত্রাপথে কোনো হাতির সাক্ষাৎ পায়নি, যাক এ যাত্রায় তাহলে বেঁচে গেলাম !!
 |
| রগড়া-কেশিয়াড়ি রোড |
» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ- ‘মেদিনীপুরের ইতিহাস’ - যোগেশচন্দ্র বসু )
RAMESWAR TEMPLE, TAPOBAN, JANGALKANYA SETU, JHARGRAM, WEST BENGAL
No comments:
Post a Comment