পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার একটি প্রাচীন জনপদ চন্দ্রকোণা। ঐতিহাসিক তথ্যানুসারে, একদা চন্দ্রাকোণায় ক্ষমতায় থাকা মল্লদের ক্ষমতাচ্যুত করে চন্দ্রকোণার রাজসিংহাসনে বসেন কেতু বংশের রাজারা। এই কেতু বংশের রাজা চন্দ্রকেতু দীর্ঘ সময় শাসন করেছিলেন এই চন্দ্রকোণায়। রাজা চন্দ্রকেতুর নামেই এই জনপদের নাম চন্দ্রকোণা হয় বলে অনেকে মনে করেন। তবে এই নামকরণের সাপেক্ষে কোনো প্রমাণযোগ্য নথি পাওয়া যায়নি। পুরনো এই ঐতিহাসিক শহরটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে শতাধিক মন্দির। কেতু বংশের রাজাদের আমলেই গড়ে ওঠে এখানে একাধিক মন্দির। বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে মন্দিরগুলি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত অথবা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়। ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দে তদানীন্তন বর্দ্ধমানাধিপতি মহারাজ তেজচাঁদ বাহাদুর ঐ সকল পুরাতন ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরগুলির সংস্কার ও পুননির্মাণ করেন। চন্দ্রকোণা শহর লাগোয়া ‘অযোধ্যা’ নামে যে অঞ্চল রয়েছে সেখানকার রঘুনাথগড়ে তৎকালীন রাজাদের ‘ঠাকুরবাড়ী’ অবস্থিত। বাইকে চেপে হাজির হলাম সেই অযোধ্যায়। গন্তব্য চন্দ্রকোণা... 'রঘুনাথগড় ঠাকুরবাড়ি'। খড়্গপুরের চৌরঙ্গী থেকে ৬০ নম্বর ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে মেদিনীপুরের ধর্মা মোড়ে ডান দিকে টার্ন নিয়ে এগিয়ে চললাম চন্দ্রাকোণার দিকে। চন্দ্রকোণা শহরে প্রবেশের মুখে একটি ভগ্নপ্রায় প্রাচীন মন্দির দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দর্শন না করে কি করে যায়। মাকড়া পাথরের তৈরী এই পঞ্চরত্ন মন্দিরটি মল্লেশ্বর শিব মন্দির।
 |
| মল্লেশ্বর মন্দির |
মল্লেশ্বর শিব মন্দিরের চারদিকে চারটি অলিন্দ রয়েছে। প্রত্যেক অলিন্দে খিলান রীতির তিনটি প্রবেশ পথ। মন্দিরটিতে স্টাকোর অলঙ্করণ রয়েছে। নাটমন্দির, বৃষভ মন্দির, মনসা মন্দির, নহবতখানা, ভোগশালা, অতিথিশালা, পুকুর সমেত মূল মন্দিরের এই জায়গাটি মল্লেশ্বর ঠাকুরবাড়ি নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে তার কয়েকটি ধ্বংসপ্রাপ্ত। তবে মূল মন্দিরটি প্রায় জরাজীর্ণ অবস্থায় এখনো অক্ষত আছে। মন্দিরের পাশে রয়েছে একটা এঁদো পুকুর, নাম 'সিদ্ধ পুষ্করিণী'। রাস্তার ধারে আটচালা বৃষভ মন্দিরটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষভ মন্দিরের দরজার খিলানে পঙ্খসজ্জা এখনো দৃশ্যমান। মল্লেশ্বর মন্দিরের গর্ভগৃহের দরজা বন্ধ থাকায় বিগ্রহ দর্শনের সুযোগ হয়নি। স্থানীয় লোকেদের কাছে জেনেছি এই মন্দিরের গর্ভগৃহের মধ্যিখানে একটি গভীর গর্তে মল্লেশ্বরের অষ্টধাতুর মূর্তি পাথর দিয়ে ঢাকা আছে। যদিও ওই গভীর গর্তের মধ্যে কি আছে তা অনুমান মাত্র। ওই পাথর সরিয়ে কখনও খোঁজ করা হয়নি।
 |
| নহবতখানা পাশে বৃষভ মন্দির |
চন্দ্রকোণার ইতিহাস থেকে জানা যায়, মল্ল বংশের শেষ রাজা খয়ের মল্ল ছিলেন শিবের ভক্ত এবং তিনি চন্দ্রকোণাতে এই মল্লনাথ বা মল্লেশ্বরের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় চন্দ্রকেতুর রাজত্বকালে কালাপাহাড় যখন চারিদিকে ধ্বংসলীলায় মত্ত তখন মন্দিরের পূজারীগণ কালাপাহাড়ের আক্রমনের হাত থেকে মল্লেশ্বরের বিগ্রহ রক্ষা করতে একটি গভীর গর্তের মধ্যে পাথর চাপা দিয়ে ঢেকে রাখেন। কালাপাহাড় তখন দেবমূৰ্ত্তির সন্ধান না পেয়ে মন্দিরটিকেই ধ্বংস করে দিয়ে যান। পরবর্তীকালে রাজা কীর্ত্তিচন্দ্র খ্রীস্টিয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে বর্তমানের সুউচ্চ এই পঞ্চরত্ন মল্লেশ্বর মহাদেবের মন্দিরটি পুনরায় নির্মাণ করে দেন। কিন্তু মল্লেশ্বরের বিগ্রহটি ওই গভীর গর্তের মধ্যেই পাথর দিয়ে ঢাকা অবস্থাতেই রয়ে যায়, সেই পাথর আর সরানো হয়নি। এই মন্দিরে এখনো নিত্য পূজো হয় এবং প্রতি বছর মহা আড়ম্বরের সাথে দুর্গাপূজা হয়ে থাকে।
 |
| মূল মন্দির |
এবারে চলে এলাম চন্দ্রকোণা শহর লাগোয়া অযোধ্যার রঘুনাথগড়ে। এখানে বিশাল এলাকা ঘিরে রয়েছে একটি পরিত্যক্ত ঠাকুরবাড়ি। সমগ্র অঞ্চলটি রঘুনাথগড় ঠাকুরবাড়ি বা রঘুনাথবাড়ি নামে পরিচিত। রক্ষণাবেক্ষণ আর সচেতনতার অভাবে রাজাদের সেই ঠাকুরবাড়ি আজ অবলুপ্তির পথে। কোনও মন্দিরের ভেতরে ডাঁই করে রাখা খড়-বিচালি। যত্রতত্র বাঁধা গরু-ছাগল, দেওয়ালে আধিপত্যে ঢেকে গেছে প্রাচীন অলঙ্করণ। পাঁচিলঘেরা এই ঠাকুরবাড়িতে মূল মন্দির তিনটি। এর মধ্যে অন্যতম রঘুনাথজীউ, যাঁর সুউচ্চ দেউল রয়েছে। এই মন্দিরের পাশেই লালজির মন্দির, রয়েছে রামেশ্বর শিবের মন্দির। এছাড়া এই ভগ্ন রঘুনাথবাড়ির মধ্যে ছিল নাটমন্দির, পাকগৃহ, বাদ্যগৃহ, প্রাচীন কূপ, স্নানগৃহ, সীতাকুণ্ড, বারান্দা, অন্যান্য ঘর প্রভৃতি। এদের কিছু পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে আজও।
 |
| রঘুনাথগড় ঠাকুরবাড়ির ভগ্ন প্রবেশদ্বার |
দূর্গের আদলে তৈরি যে ঠাকুরবাড়িটি আমার নজরে পড়লো, তা ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। ভেঙে পড়েছে বাইরের পাঁচিল, নাটমন্দিরের ছাদ উধাও। ভাঙা পাঁচিলের ঘেরাটোপে পুরো চত্বর জুড়ে কেবল ঝোপঝাড় ও প্রায় বুক সমান উঁচু আগাছার জঙ্গল এবং তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে একের পর এক মন্দিরের কাঠামো, খসে পড়ছে নড়বড়ে ইট। কোনও মন্দিরেই বিগ্রহ নেই। বুনো ঝোপ আর ঘাসের জঙ্গল পেরিয়ে হাঁটাই দায়। কোনোমতে সাহস জোগাড় করে ভেতরে গেলাম।
 |
| ঝোপঝাড় ও আগাছার জঙ্গল |
ঠাকুরবাড়ি এলাকাটি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা এবং দু'ভাগে বিভক্ত। সাবধানে কাঁটা ঝোপ সরিয়ে মূল প্রবেশ পথের কাছে চলে এলাম। গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল উৎকল স্থাপত্য রীতিতে তৈরি রঘুনাথজীউ মন্দির এবং তার পাশে লালজীউর মন্দির। স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন হিসাবে রয়েছে এই চত্বরের সবচেয়ে বড়ো রঘুনাথজীউ মন্দির। মন্দিরের গায়ে ছোট ছোট খোপে রয়েছে কিন্নর-কিন্নরী মূর্ত্তি। শিখর-দেউল রীতির রঘুনাথজীউ মন্দিরটি অনেকটা পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরের আদলে তৈরী। দেউল, জগমোহন, নাটমন্দির রয়েছে সবই। মন্দিরের সামনের অংশ প্রায় ভেঙে পড়েছে তবে দেউলের পিছনের অংশটি এখনও অক্ষত।
 |
| রঘুনাথজীউ মন্দির |
রঘুনাথজীউ মন্দিরের উল্টোদিকে অর্থাৎ উত্তরদিকে রয়েছে খুবই জীর্ণ মাকড়া পাথরের তৈরি আটচালা রীতির লালজীউর মন্দির। লালজীউ হলেন সবচেয়ে প্রাচীন দেবতা। লালজীউ মন্দিরের পাশে রয়েছে ত্রিখিলান প্রবেশপথ বিশিষ্ট দালান-রীতির একটি ভোগমান্ডপ। পূর্বে রঘুনাথজীউ এবং লালজীউ মন্দিরের দুই বিগ্রহ এনে এখানে ভোগ নিবেদন করা হত।
 |
| ভোগমান্ডপ |
লালজীউর মন্দিরের সামনে একটি দালান-রীতির নাটমন্দির আছে। বর্তমানে এই নাটমন্দিরের মাথার ছাউনি বলে কিছুই নেই, কেবল উপরে মরচে ধরা লোহার বিমগুলো যেন অনন্তকাল ধরে এভাবেই পড়ে আছে।
 |
| নাটমন্দির |
রঘুনাথ জীউ এবং লালজীউর স্নানের জন্য দেখা গেলো ছাউনি দেওয়া একটি দৃষ্টিনন্দন স্নান-বেদি। এছাড়া রয়েছে তোষাখানা, অতিথিশালা আরো অনেক স্থাপত্যের ধ্বংসস্তূপ।
 |
| স্নান-বেদি |
ঠাকুরবাড়ির চৌহদ্দিতে বাইরের প্রাঙ্গনে রয়েছে মাকড়া পাথরে তৈরি রামেশ্বর শিবের একটি পঞ্চরত্ন মন্দির এবং তার অনতিদূরে রাসমঞ্চ। চারপাশে আগাছার জঙ্গল ও তার মধ্যে উঁকি দেওয়া পুরানো ভাঙাচোরা মন্দিরের যেটুকু নিদর্শণ দেখতে পাওয়া গেলো সেগুলি থেকে তৎকালীন রাজপরিবারের রুচিশীলতা ও মর্যাদার পরিচয় অনুভব করা যায়।
 |
| রাসমঞ্চ ও পিছনে রামেশ্বর শিবের মন্দির |
বহুদিন ধরেই পরিত্যক্ত এই গড়। কোনও রক্ষণাবেক্ষণ নেই এখানে। দেখভালের অভাবে বর্তমানে ঠাকুরবাড়ির এই চত্বরটি গরু ছাগলের চারণ ভূমি হয়ে উঠেছে। মন্দিরের গায়ে স্থানীয় লোকেরা ঘুঁটে দিয়ে আরো তাড়াতাড়ি নষ্ট করে দিচ্ছে এই শতাব্দী প্রাচীন নিদর্শনগুলিকে। চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে বড়ো রাস্তা ধরে ফিরে চললাম বাড়ির দিকে। অতীতের সাক্ষী হিসেবে পিছনে পড়ে রইল 'রঘুনাথগড় ঠাকুরবাড়ি'।
 |
| ধ্বংসের অপেক্ষায় রঘুনাথগড় ঠাকুরবাড়ি |
» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ- 'মেদিনীপুরের ইতিহাস' - যোগেশচন্দ্র বসু)
Darun bornona..
ReplyDeleteধন্যবাদ।
Delete