 |
|
বীরসিংহ! এ গ্রামের সন্তান বিদ্যাসাগর। এ গ্রামের নামেই তার পরিচয়। নামের সঙ্গে জুড়ে ইতিহাস, ঐতিহ্য। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়ার শহরের কাছে এই অনন্য সুন্দর গ্রামটি। এই গ্রামেই বিদ্যাসাগরের জন্ম। উল্লেখ্য, বিদ্যাসাগর যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন বীরসিংহ গ্রাম হুগলি জেলার ক্ষীরপাই মহকুমার অন্তর্গত ছিল। সেই সময় হুগলী জেলায় হলেও, এখন সেই জন্মস্থান পশ্চিম মেদিনীপুরে। বিদ্যাসাগরের পিতৃপুরুষের আদি নিবাস ছিল হুগলী জেলার বনমালীপুরে। পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ তাঁর পিতার মৃত্যুর পর বনমালীপুর থেকে এই বীরসিংহ গ্রামে চলে আসেন। তারপর রামজয় তর্কভূষণ ওই গ্রামে পণ্ডিত উমাপতি তর্কসিদ্ধান্তের তৃতীয়া কন্যা দুর্গামণি দেবীকে বিয়ে করেন। তাদের বিয়ের পর, উমাপতি তর্কসিদ্ধান্ত বীরসিংহের এইস্থানে অল্প কিছু জমি সহ একটা ছোট বাড়িতে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেন। সেখানে পুত্র ঠাকুরদাস ও অন্যান্য সন্তান সহ তাঁরা বাস করতে শুরু করেন। ঐ ভিটেতেই বিদ্যাসাগর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ঠাকুরদাস ও ভগবতী দেবীর প্রথম সন্তান। পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর এই বাড়িটির সংস্কার করে মাটির দোতলা নির্মাণ করেন। ১৮৬৯ সালের মার্চ মাসে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বাড়িটি পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এই ঘটনার কয়েকদিন পরে অর্থাৎ সেই বছরের জুন মাসে পারিবারিক বিবাদের কারণে তিনি চিরতরে বীরসিংহ ছেড়ে চলে যান। বর্তমানে তাঁর গ্রাম ও গ্রামের ভিটে সরকারি উদ্যোগে একটি পর্যটন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
 |
| স্মৃতিমন্দিরে ঢোকার গেট |
খড়্গপুর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার বাইক চালিয়ে চলে এলাম ক্ষীরপাই। ক্ষীরপাই বলতে প্রথমেই যে নামটা মনে আসে তা হলো 'বাবরসা!', গাওয়া ঘি, ময়দা, দুধ এবং মধু দিয়ে তৈরি করা হয় এই বাবরসা মিষ্টি।ক্ষীরপাই হালদার দিঘীর মোড়ে যখন পৌঁছালাম তখন প্রায় দুপুর দুটো বেজে গেছে। রাস্তাঘাটে লোকজন প্রায় নেই বললেই হয়। বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ। মোড়ের কাছে কয়েকটা মিষ্টির দোকানে দেখলাম থরে থরে সাজানো রয়েছে 'বাবরসা'। ক্ষীরপাইয়ের বিখ্যাত এই মিষ্টির সঙ্গে রাজস্থানের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি 'ঘেভারের' অদ্ভুত মিল আছে। পার্থক্য শুধু আকৃতিতে। ঘেভার কড়াই থেকে ভেজে তুলে চিনির রসে ডুবিয়ে শুকনো করে বিক্রি করা হয় আর বাবরসা তেলে অথবা ঘিয়ে ভাজার পর আলাদা করে তুলে রাখা হয় এবং খাবার সময় মধু বা চিনির রস ছড়িয়ে খেতে হয়। এখানে আকার ও গুণমান অনুযায়ী ৬ টাকা ও ১০ টাকা দু'রকম দামের বাবরসা পাওয়া যায়।
 |
| ক্ষীরপাইয়ের বাবরসা |
ক্ষীরপাই থেকে দু তিনটি স্টপেজ পেরিয়ে চলে এলাম সিংহডাঙ্গা মোড়ে। রাস্তার বাঁদিকে চোখে পড়ল বিদ্যাসাগরের নামে একটা বড় তোরণ। তোরণ পেরিয়ে খড়ার শহরের দিকে যে পাকা রাস্তাটা গেছে, সেটা দিয়ে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার যাওয়ার পর এসে পৌঁছলাম বীরসিংহ গ্ৰামে।
 |
| বীরসিংহ |
ছোট গ্রামের ভেতর বিদ্যাসাগরের জন্মভিটে খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধে হলো না। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মভিটে এখন একটা ছোট্ট সংগ্রহালয়ে পরিণত হয়েছে। নাম দেওয়া হয়েছে বিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দির। শুধু তাই নয়, তাঁর সেই সাবেকি বাড়ি আজ আর নেই। সেখানে বানানো হয়েছে একটি রেপ্লিকা বাড়ি।
 |
| গড়ে উঠেছ রেপ্লিকা বাড়ি |
সামনের গেটে দেখি একটা তালা ঝুলছে। ভাবলাম এতদূর এসে না দেখে চলে যাবো। ঠিক তখনই, আমাকে দেখে গ্রাম্য এক ভদ্রলোক সেই বাড়ির সামনে এলেন। তার কাছেই জানতে পারি এখন এই বাড়িটির দেখভাল করেন দিলীপ বাবু। উনি আমাকে পথ দেখিয়ে দিলীপ বাবুর বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে এলেন। দরজায় টোকা মারতেই উনার স্ত্রী বেরিয়ে এলেন। সেই সময় দিলীপ বাবু বাড়িতে ছিলেন না। তার কাছে ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন করলাম দিলীপ বাবুকে। ফোন করার কিছুক্ষণের মধ্যেই দিলীপ বাবু এসে হাজির। সহজ সরল সাদামাটা এক মানুষ। আমাকে দেখে গেটের চাবি খুলে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেলেন।
 |
| কিউরেটর দিলীপ ব্যানার্জী |
বিদ্যাসাগরের জন্মস্থানকে এখানে অন্যরকমভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে বিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দির। বর্তমান প্রজন্মের কাছে বিদ্যাসাগরের সৃষ্টি ও ইতিহাসকে তুলে ধরা হয়েছে নতুনভাবে। সাজিয়ে তোলা হয়েছে জন্মভিটে থেকে বিদ্যাসাগরের ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র। পুরো চত্বর পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সামনে সুন্দর সাজানো বাগান ও তার সাথে রয়েছে বিদ্যাসাগরের একটি আবক্ষ মূর্তি। ভেতরে তখন আমি একা। চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। কী সুন্দর বাড়ি! কী সুন্দর বাগান! যেন শান্তির নীড়। মনে হল পুরো বাড়িটা যেন ধ্যানের মন্দির। জন্মভিটেয় গড়ে উঠেছে মাটির ঘরের আদলে তৈরি একাধিক বাড়ি। সবগুলোই 'রেপ্লিকা'। ইট সিমেন্টের তৈরি। বাঁধানো চাতাল। তার মাঝে মাঝে মরশুমি ফুলের বাহার। যেখানে তিনি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন সেখানে একটা ছোট মঞ্চের মতো মন্দির তৈরি করা হয়েছে।
 |
| স্মৃতিমন্দির চত্বর |
স্মৃতিমন্দিরের সঙ্গেই রয়েছে গ্রন্থাগার ও সংগ্রহশালা। সেখানে তাঁর ব্যবহৃত ধাতুর তৈরি পেপার ওয়েট, বইপত্র, পান্ডুলিপি, মানিব্যাগ, বাঁধানো দাঁত, ভিজিটিং কার্ড ছাপানোর তাম্রফলক ইত্যাদি নানা সামগ্রী রয়েছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে কোলকাতা থেকে পরপর তিনটে পর্যটক ভর্তি গাড়ি এল। দেখতে দেখতে পুরো জায়গা পর্যটকের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠলো।
 |
| সংগ্রহশালায় রাখা সামগ্রী |
বিদ্যাসাগরের এই বাড়িতে রয়েছে তিনটি ঘর, সামনে খোলা বারান্দা। এর মধ্যে দুটো ঘর পর্যটকদের বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করে। একটিতে বিদ্যাসাগরের জীবনের বিভিন্ন পর্যায় ছোট ছোট মডেল আকারে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। শুধু তাই নয়, রয়েছে তাঁর ব্যবহৃত স্টীল ট্রাঙ্ক, ছড়ি, বইপত্র ইত্যাদি বিভিন্ন সামগ্রী যা এখানে দেখার অন্যতম বিষয়। এছাড়াও রয়েছে তাঁর ব্যবহৃত বইপত্র।
 |
| বিদ্যাসাগরের ব্যবহৃত সামগ্রী |
আরেকটিতে আছে তাঁর কর্মকাণ্ডের নিদর্শন। সেখানে মায়ের কোলে ছোট্ট বিদ্যাসাগরের মূর্তিটি দেখে মন ভরে গেল। অন্যটি 'দিনময়ী চতুষ্পাঠী', যেখানে নিয়মিত সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের পঠনপাঠন, গবেষণা ও চর্চা হয়। বর্তমানে এই স্মৃতিমন্দিরটি একটি ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত এবং দিলীপ বাবু অর্থাৎ দিলীপ ব্যানার্জী হলেন এই স্মৃতিমন্দিরের কিউরেটর।
 |
| মায়ের কোলে শিশু ঈশ্বরচন্দ্রের মূর্তি |
বিদ্যাসাগর ছোটবেলায় কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালায় পড়েছিলেন। আট বছর বয়স পৰ্য্যন্ত গ্রামের এই পাঠশালায় তিনি শিক্ষালাভ করেছেন। পাঠশালার সকল ছাত্রের মধ্যে স্নেহধন্য ছিলেন তিনি। হদিশ পেলাম সেই পাঠশালার। স্মৃতিমন্দির থেকে বেরিয়ে একটু পথ যেতেই চোখে পড়ল পাঠশালার দিক নির্দেশ করে একটি বোর্ড দেওয়া রয়েছে। বাঁদিকে একটি মোরামের রাস্তা দেখতে পেলাম।এই রাস্তা ধরে খানিকটা যেতেই পড়লো কালিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালা। পাঠশালা বন্ধ থাকায় ভেতরে প্রবেশ করতে পারলাম না।
 |
| কালিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালা |
আবার ফিরে এলাম বীরসিংহ বাসস্ট্যান্ডের তিন রাস্তার মোড়ে। এই তিন রাস্তার মোড়ে রয়েছে বিদ্যাসাগরের নামে একটা গ্রন্থাগার। রয়েছে তাঁর পিতার স্মৃতির উদ্দেশ্যে ঠাকুরদাস মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। এই বীরসিংহ গ্রামেই রয়েছে তাঁর মা ভগবতী দেবীর নামে গড়ে তোলা একটি হাইস্কুল যা এখানের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। এই গ্রামে বিদ্যাসাগরের বহু স্মৃতি ধরে রাখার চেষ্টা করেছে প্রশাসন। তাই এ গ্রামে যা কিছু চোখে পড়ে সবই বিদ্যাসাগরের নামে নামকরণ করা। ফেরার পথে কয়েকজন টোটোওয়ালা আমাকে দেখে খবরের রিপোর্টার ভেবে কিছু অভিযোগ জানাল। তারা বললো সিংহডাঙ্গা মোড় থেকে খড়ার পর্যন্ত ভাড়াটা খুবই কম, ওটা অন্তত ১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে যেন ১৫ টাকা করা হয়।
 |
| গ্রন্থাগার ও ঠাকুরদাস মঞ্চ |
» প্রয়োজনীয় তথ্যবিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দির প্রত্যহ সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে এবং প্রতি বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে। স্মৃতিমন্দিরের গেট বন্ধ থাকলে কিউরেটর দিলীপ ব্যানার্জীর সাথে যোগাযোগ করুন। স্মৃতিমন্দিরের কাছেই দিলীপ বাবুর বাড়ি।
» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল
VIDYASAGAR SMRITIMANDIR, BIRSINGHA, PASCHIM MEDINIPUR, WEST BENGAL
No comments:
Post a Comment