গুপ্তিপাড়া একটি প্রাচীন জনপদ। জায়গাটাকে ঠিক গ্রাম বলা যায় না। আবার ঠিক শহরও নয়। ইতিহাসপ্রেমী ও তার সাথে বেড়ানোর নেশা রয়েছে এমন মানুষের কাছে উইকএন্ডে ঘুরতে যাওয়ার একটি আদর্শ জায়গা। এই বাংলার ইতিহাসের নানা ঘটনার সাথে জড়িত রয়েছে এ শহর। বাংলার প্রথম বারোয়ারী পূজোর সূত্রপাত হয়েছিল এই শহরেই। স্বনামধন্য কবিয়াল ভোলা ময়রার শহরও এটি। নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহনলালের জন্মস্থানও এই গুপ্তিপাড়া। এছাড়াও বহু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের জায়গা এ গুপ্তিপাড়া। আছে তন্ত্র সাধনার ক্ষেত্র দেশকালী মাতার প্রাচীন মন্দির।
| চললাম মঠের দিক |
সুখাড়িয়া থেকে অটোয় করে চলে এলাম সোমড়াবাজার স্টেশনে। বেলা তখন সাড়ে এগারোটা। ভাবলাম কাছাকাছি কোথাও একটা যেতে হবে। সোমড়াবাজার থেকে গুপ্তিপাড়া মাত্র কয়েকটি স্টেশন পেরোলেই। গুপ্তিপাড়া নামটা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। আমার অফিসের কলিগ প্ৰভাতদার বাড়ি সেখানে। বেশ কিছু্ দিন ধরেই তার কাছে গুপ্তিপাড়ার কথা শুনে আসছিলাম। গল্প শুনে এবং ইন্টারনেটে ছবি দেখার পর থেকেই যাওয়ার জন্য মন টানছিল। কিন্তু সেখানে যাওয়ার জন্য সময় করে উঠতে পারছিলাম না। অনেকদিনের সেই ইচ্ছে আজ সফল হতে চলেছে। ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি, কাটোয়া লোকাল ধরব। প্লাটফর্মে ট্রেন ঢুকতেই উঠে পড়লাম। ট্রেনে চেপে যখন গুপ্তিপাড়া স্টেশনে এসে পৌঁছায় তখন ঘড়িতে দুপুর পৌনে একটা। এই প্রথম গুপ্তিপাড়া স্টেশনে আসা। স্টেশন থেকে বেরোতেই টোটো অপারেটরদের হাঁকডাক। প্রচুর টোটো দাঁড়িয়ে আছে। এখানে টোটোর রুট নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। রুট অনুযায়ী একটি টোটোয় চেপে চললাম সোজা বৃন্দাবনচন্দ্র মঠের দিকে। বড়বাজারে এসে সহযাত্রী সবাই নেমে গেল; আমি চললাম একা। মঠের মুখে এনে আমাকে নামিয়ে দিল টোটো। টোটোওয়ালা হাত তুলে মঠটি দেখিয়ে বলল, এটাই গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্র মঠ।
| 'বৃন্দাবনচন্দ্র মঠ' |
টোটো থেকে নেমে মন্দির কমপ্লেক্সে ঢোকার আগে দেখি মঠাধ্যক্ষ ও অন্যান্য মঠবাসীদের থাকার জায়গা। বাংলার অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা হয় এই গুপ্তিপাড়াতে। মঠের গেটের সামনে রাখা আছে সেই রথের ঘোড়া। এর পর গেট পেরিয়ে মন্দির চত্বর। লোহার গেট ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। দুপুরের সময়, মন্দির চত্বর একেবারেই শুনশান। হাতে গোনা দু'চারজন লোক ছাড়া কাউকে দেখতে পেলাম না। বিশাল প্রাচীর ঘেরা মন্দির কমপ্লেক্স। ভেতরে মোট চারটি মন্দির। চৈতন্য, বৃন্দাবনচন্দ্র, রামচন্দ্র এবং কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির। বাংলার স্থাপত্য শিল্পের অদ্ভুত নিদর্শন আজও বহন করে চলেছে গুপ্তিপাড়ার এই চার বৈষ্ণব মন্দির। এই চার মন্দিরের সমষ্টিকে বলা হয় 'গুপ্তিপাড়ার মঠ'। একে একে সবকটি মন্দির দর্শন করলাম।
![]() |
| মন্দিরের সাঁকো |
গেট পেরিয়ে প্রথমেই নজর পড়লো 'বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দির'। বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরকে মাঝে রেখে দুই পাশে রয়েছে 'রামচন্দ্র মন্দির' এবং 'কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির'। এছাড়া রয়েছে 'চৈতন্য মন্দির'। এই চার মন্দিরেরই নির্মাণকাল ভিন্ন। মঠের সবকটি মন্দিরই উচুঁ বেদীর ওপর রয়েছে আর একটি মন্দির থেকে আর একটি মন্দিরে যাওয়ার জন্য ইঁটের তৈরি সাঁকো রয়েছে। বেদীতে ওঠার জন্য রামচন্দ্র মন্দিরের পাশে একটি ছোট সিঁড়ি আছে। সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরে।
| বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দির |
মঠের অন্যান্য মন্দিরগুলোর তুলনায় আকারে ও উচ্চতায় এই মন্দিরটিই সবচেয়ে বড়। ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে বাগবাজারের জমিদার গঙ্গানারায়ণ সরকার এটি নির্মাণ করেন। মন্দিরটি আটচালা রীতিতে তৈরি। বাংলার কুটিরের মতো তৈরি মন্দিরের ছাদ তার উপরে আর একটি ছোট চালাঘরের উপরে তিনটি কলসি স্থাপন করা। মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ খুব বেশি নেই। মন্দিরের ভেতরে পুরো দেওয়াল আর ছাদ জুড়ে রয়েছে রঙিন ফ্রেস্কো পেইন্টিং। দেওয়ালের প্যানেলে কত রকম নকশার বাহার। নানা ফুল পাখি, কৃষ্ণের কাহিনী, আরোও অনেক দেবদেবীর ছবি আঁকা। সংরক্ষণের অভাবে এখন অনেক পেইন্টিং নষ্ট হয়ে গেছে।
| দেওয়ালের ফ্রেস্কো পেন্টিং |
মন্দিরের গর্ভগৃহের ভেতরেও পুরো পটভূমি জুড়ে রঙিন ফ্রেস্কো পেইন্টিং, মাঝে রাধা ও কৃষ্ণের মূর্তি আর পাশে করজোড়ে নতজানু গরুড়। এদের ঠিক পেছনেই রয়েছে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি। রথযাত্রার সময় এই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে বের করে এনে কাঠের তৈরি বিরাট রথে বসানো হয়।
| মন্দিরের বিগ্রহ |
বৃন্দাবন মন্দিরের লাগোয়া চৈতন্যর মন্দির। মঠের অন্যান্য মন্দির গুলোর তুলনায় চৈতন্য মন্দিরটা আকারে ছোটো। মন্দিরটি জোড় বাংলা রীতিতে নির্মিত। দুটি খড়ের দোচালা পাশাপাশি সংযুক্ত করলে যেমন দেখতে লাগে মন্দিরটি ঠিক সেইরকম। মঠের সবচেয়ে পুরোনো এই মন্দিরটি। আনুমানিক ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে রাজা বিশ্বেশ্বর রায় এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে মন্দিরটি পশ্চিমমুখী হলেও চোখ দেখে কিছুটা অনুমান করা গেল একসময় এই মন্দিরটি পূর্বমুখী ছিল। মন্দিরের প্রবেশপথ ও থাম দেখে অনুমানিত হলো মন্দিরটির বহু সংস্কার ঘটেছে।
| চৈতন্য মন্দির |
মন্দিরটি অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংস্কার করার ফলে পলেস্তারায় টেরাকোটা ফলক গুলো ঢাকা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। খুব সামান্য কিছু হাতে গোনা ফলক প্রবেশপথের থাম ও খিলানের ওপর দেখা গেল। মন্দিরের বাইরে দেখলাম অনেক পুতুল রাখা। এগুলো সব রথের পুতুল। মন্দিরের ভেতরে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু ও নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর কাঠের বিগ্রহ আছে। বৃন্দাবন মন্দির আর চৈতন্য মন্দিরের মাঝে নেড়া একটা গাছ মন্দির গুলোর প্রাচীনত্বকে আরো গভীর করে তুলেছে।
| রথের পুতুল |
চৈতন্য মন্দির দর্শন সেরে চলে এলাম আবার বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরে। এর ডানদিকে রয়েছে কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির। ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে নবাব আলিবর্দি খাঁ-র সময়কালে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় এই মন্দিরটি স্থাপন করেন। এই মন্দিরটিও আটচালা। মন্দিরে গায়ে টেরাকোটা ফলক গুলো কালের নিয়মে অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তার অধিকাংশই এখন পলেস্তরায় ঢাকা। খিলানের দেওয়াল ও থামের উপর সামান্য কিছু ফুলের নকশা ছাড়া বিশেষ কাজ নেই।
| কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির |
কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরের ঠিক উল্টো দিকে রামচন্দ্র মন্দির। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে শেওড়াফুলির রাজা হরিশচন্দ্র রায় এই একচূড়া মন্দিরটি নির্মাণ করেন। মঠে যতগুলো মন্দির আছে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ টেরাকোটার কাজ রয়েছে এই রামচন্দ্র মন্দিরে। মন্দিরটি বাঁশবেড়িয়ার অনন্ত বাসুদেব মন্দিরের অনুকরণে তৈরি। দুটি মন্দিরের স্তাপত্য প্রায় একই রকমের।
| রামচন্দ্র মন্দির |
এই রামচন্দ্র মন্দিরের সামনের ও ভেতরের দেওয়ালে এবং এর অষ্ট কোণ শিখর জুড়ে দেখা গেল অপূর্ব সব টেরাকোটা কাজ। এইরকম সূক্ষ্ম টেরাকোটার কাজ কালনা ও বিষ্ণুপুরের মন্দিরের গায়ে দেখেছি কিন্তু হুগলি জেলার অন্য কোনো মন্দিরে দেখিনি।
| মন্দিরের গায়ে টেরাকোটা |
মঠের পেছন দিকটায় আমবাগান। সেখানে এক কোণে একটি স্নানমঞ্চ। স্নানযাত্রার দিন মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে বের করে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে স্নান করানো হয় ওখানে। মঞ্চের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলাম। সত্যি! মন ভরে গেল মঠের চারপাশের সেই দৃশ্য দেখে।
| স্নানমঞ্চ |
মন্দির কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে মঠের পাশেই দেখি আম বাগানের ভেতর পেল্লাই টিনের খাঁচায় কিছু একটা ঢেকে রাখা আছে। কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। উৎসুক চোখে তাকিয়ে দেখি ভেতরে এক বিশাল রথ। প্রকৃতির রোষ থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এভাবে ঢেকে রাখা হয়েছে। রথযাত্রার দিন বৃন্দাবন মঠের সামনে থেকে এই রথের যাত্রা শুরু হয়। জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা রথে চড়ে প্রায় এক কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে বড়বাজার গোঁসাইগঞ্জ এলাকায় মাসির বাড়ি যায়। এটি ভারতের দ্বিতীয় দীর্ঘতম রথযাত্রা।
| টিনের আচ্ছাদনে রথ |
গুপ্তিপাড়ার রথের ঐতিহ্য আর জাঁকজমকের কথা সকলেরই জানা। এই রথের বৈশিষ্ট্য হল ভান্ডার লুঠ, যা উল্টো রথের আগের দিন অনুষ্ঠিত হয়। এই অঞ্চলের স্থানীয় উৎসব। ভারতের কোথাও এই ভান্ডার লুঠ হয় না। এটি এক ধরনের খাদ্যোৎসব। উল্টো রথের আগের দিন জগন্নাথদেব তার মাসির বাড়িতে বন্ধ ঘরে সবার অন্তরালে থাকে। এই দিন ঘরের ভেতরে জগন্নাথদেবকে মালসায় করে রকমারি খাবারের পদ সাজিয়ে ভোগ দেওয়া হয়। পুজো শেষে পূজারী একসঙ্গে মাসির বাড়ির তিনটি দরজা খুলে দেন। দরজা খেলার পর এই প্রসাদ নেওয়ার জন্য মানুষের মধ্যে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়। একটা দু'টো মালসা নয়, সংখ্যায় চারশোরও বেশি। মাটির এক একটা মালসায় প্রায় পাঁচ কিলো করে থাকে প্রসাদ। লুঠ করতে হবে সে সব! একেই ‘ভান্ডার লুঠ’ বলে। প্রাচীন সেই রীতি মেনে এখনও প্রতিবছর উল্টোরথের আগের দিন এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে।
| উঁকি মেরে রথ দেখা |
মনে পড়ে কি, পলাশী যুদ্ধের মোহনলালকে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিশ্বস্ত সেনাপতি ছিলেন। রথের উল্টোদিকে সেই বাঙালি বীর মোহনলালের একটি স্মৃতিস্তম্ভ নজরে পড়ল। ঘাসের ওপরে এক অনন্য স্মৃতিফলক, যা পাঠককে আকর্ষণ না করে পারে না। স্মৃতিফলকের লেখা থেকে জানতে পারি এই গুপ্তিপাড়া ছিল তার জন্মস্থান। গুপ্তিপাড়াবাসী তাদের এই বীর সন্তানকে এখনো ভুলেনি তার নমুনা এই স্মৃতিফলক থেকে পাওয়া যায়। শোনা যায় পলাশীর যুদ্ধে হারের পরে তিনি গুপ্তিপাড়ায় পালিয়ে এসেছিলেন। বৃন্দাবনচন্দ্র মঠে নাকি লুকিয়ে ছিলেন। যদিও মোহনলালের সাথে গুপ্তিপাড়ার যোগসূত্রের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই এই তথ্য নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
| মোহনলালের জন্মস্থান |
মঠের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে আবার হাঁটা শুরু করি। হঠাৎ চোখ যায় দূরে এক বড় বট গাছের দিকে। বট গাছের কাছে এসে দেখলাম বেশ জমজমাট ব্যাপার। ভাইফোঁটার বিশেষ দিনে আজ প্রচুর পুণ্যার্থীর সমাগম হয়েছে আর কি! তাদের কাছে জানতে পারি এটা দেশকালী মায়ের মন্দির। এটি গুপ্তিপাড়ার একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মন্দির। প্রাচীন কাল থেকেই এই বাংলায় ডাকাতির সঙ্গে কালীপুজো ও তন্ত্র সাধনার এক সুনিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। সেই আদিকাল থেকেই ডাকাতদল ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে কালীপুজো করতেন। তাঁদের পুজোর ধরণ ছিল যেমন আলাদা, তেমনই রীতিনীতি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। এই বাংলার বুকে বহু কালী মন্দির নির্মানের নেপথ্যে রয়েছেন এককালের ডাকাতেরা। যা ডাকাত কালী মন্দির নামেই পরিচিত। দেশকালী মায়ের মন্দিরটি এরকমই এক অতি প্রাচীন মন্দির। এই মন্দিরেও ডাকাতরা উপাসনা করতো। মন্দির চত্বরে একটি বহু প্রাচীন বট গাছ। তাতে প্রচুর বাদুড়। এই বট গাছের পাশ দিয়ে এক সময় গঙ্গা বয়ে যেত, সে গঙ্গা এখন প্রায় একমাইল দূরে সরে গেছে। তখন এটা ছিল তান্ত্রিকদের সাধন পীঠ। দেবী এখানে শ্মশানকালী রূপে পূজিতা হতেন। দেশকালী মায়ের বর্তমান মন্দির ঘরটি একটি সাধারণ পাকা ঘর, খুব একটা পুরানো নয়। দেবীর বিগ্রহ নেই। আছে কেবল শাড়ি জড়ানো একটি কাঠামো। এখানে প্রতি বছর কালীপুজোর দিন নতুন মাটির মূর্তি এনে পুজো করা হয়। পরের শুক্লা দ্বিতীয়ার দিন মূর্তির কেশ, কাঁকণ, কেউর, কপোল প্রভৃতি কেটে বিকৃত মূর্তি গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। খণ্ডিত অংশগুলিকে একটি আধারে রেখে সারা বছর তান্ত্রিক মতে নিত্যপুজো করা হয়।
| দেশকালী মন্দির |
দেশকালী মায়ের মন্দিরের গা ঘেঁষে একটা রাস্তা চলে গেছে গ্রামের ভেতরে। এই রাস্তায় কিছুটা গিয়ে দেখি প্রাচীর ঘেরা একটা মাঠ আর তারই একপাশে একটা ছোটখাটো পাকা মণ্ডপ। পাকা মণ্ডপ বেশি দিনের নয়। মন্দিরটি দেখলে হয়তো পর্যটকদের মন ভরবে না। তবে মন্দিরটির গুরুত্বও কম নয়, এটি বারোয়ারী পূজোর সৃষ্টিস্থান। এর পেছনে একটা গল্প আছে। কী সেই কাহিনি? দুর্গাপুজো তখন হতো এলাকার জমিদার কীর্তিচন্দ্র সেনের বাড়িতে। আনুমানিক ১৫৮৩ সালে পরিবারের তৎকালীন কর্তা রাম সেন এই পুজোর প্রচলন করেন। কিন্তু সে পূজোয় গ্রামের সর্বসাধারণের প্রবেশের অধিকার ছিল না। সালটা ১৭৫৮, কোনও কারণে সেই বছর দুর্গাপূজোর সময় এলাকার কয়েক জন যুবকের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে জমিদার বাড়ির লোকেরা তাদের বের করে দেন। সেই অপমানে ওই যুবকেরা ঠিক করে যে তারা নিজেরাই এবার পুজো করবেন। যেহেতু ঘটনাটি ঘটে ছিল মহাষ্টমীর দিনে। পুজো তো প্রায় শেষ! তাই ঠিক করলেন তারা জগদ্ধাত্রী পুজো করবেন। তিনিও দুর্গারই আর এক রূপ। ধনী জমিদারের মতো সামর্থ্য না থাকায় তারা বারো জন বন্ধু মিলে চাঁদা তুলে এই জগদ্ধাত্রী পুজো করেন। বারো ইয়ারির আয়োজনে পুজো তাই বারোয়ারি। আর সেই থেকেই বারোয়ারি শব্দের চল। বারো জনের একত্রিত উদ্যোগে পূজিতা এই জগদ্ধাত্রী দেবীই বিন্ধ্যবাসিনী নামে পরিচিতা। আর এই মণ্ডপ যেখানে ঠিক সেখানেই নাকি ১৭৫৯ সালে প্রথম বিন্ধ্যবাসিনী মায়ের পুজো হয়। তখন মায়ের মন্দির বলতে তালপাতার ছাউনি দেওয়া একটি চালাঘর। এখন পাকা দালান। ১৩৪৬ সনে (ইংরেজি ১৯৩৯) সতীশ চন্দ্র সেন মহাশয় এই পাকা মন্দিরটি তৈরি করেন। বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর পুজোর প্রাচীনত্ব থাকলেও আজও সেইভাবে মন্দির সেজে ওঠেনি। পাশেই চাষের ক্ষেত। রাস্তাঘাটও খুব ভালো নয়।
| বিন্ধ্যবাসিনী মাতার মন্দির |
বারোয়ারিতলা থেকে বেরিয়ে গ্রামের সরু ইটের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। এটাকে রাস্তা না বলে গলি বলাই ভাল। সেই গলিটা মেন রোডের সঙ্গে যুক্ত। গলি থেকে বেরিয়ে আরকটু এগিয়ে যেতে চোখে পড়ল এক হলুদ রঙের বড়সড় বাড়ি। বাড়িটা মেন রোডের উপরেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা 'সহজপাঠে' পড়েছি "গুপ্তিপাড়ার বিশ্বম্ভরবাবু পাল্কী চ'ড়ে চলেছেন সপ্তগ্রামে। ফাল্গুন মাস। কিন্তু এখনো খুব ঠাণ্ডা। কিছু আগে প্রায় সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি হয়ে গেছে"... এটাই কি তাহলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সেই বিশ্বম্ভরবাবুর বাড়ি! বাস্তবে আদৌ তার কোন অস্তিত্ব আছে কি? না! এটা সেন বাড়ি। বাড়ির সামনে গেটের উপর লেখা - 'সেনবাটী'। গুপ্তিপাড়ায় সেনেদের আরও চারটে প্রাচীন বাড়ি আছে।
| 'সেনবাটী' |
সেনবাটীর পাশে এক গলি ধরে কিছুটা গিয়ে দেখতে পেলাম কির্ত্তিচন্দ্র সেনের (এরকমই বানান) বাড়ি। এই বাড়িতেই দুর্গোৎসব পালন করা হয়। হাটখোলা পাড়ার এই সেন বাড়ি প্রায় চারশো বছরের পুরোনো। কির্ত্তি সেনের সময়ে প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ে। তিনি ঠাকুর দালানটি নির্মাণ করেন। পুজোর চারদিন গমগম করে এই বনেদি বাড়ি। কির্ত্তি সেনের সময়ে এই সেন বাড়িতে কবিগানের আসর বসত। দলে দলে লোক ভিড় করতেন সেই কবিগান দেখতে।
| কির্ত্তিচন্দ্র সেনের বাড়ি |
সেন বাড়ির সামনে কিছুটা ফাঁকা মাঠ। ফাঁকা মাঠের ওপর দুটি আট চালার শিব মন্দির রয়েছে। এগুলো সেন বাড়ির জোড়া শিব মন্দির। বাড়ির ভেতরে যাবার অনুমতি নেই। কেবল দুর্গাপুজোর সময়ে নাটমন্দিরে ঠাকুর দর্শনের জন্য যাওয়া যায়। এই বাড়িটি বাইরে থেকেই দেখে হাঁটা দিলাম গুপো সন্দেশের খোঁজে বড়বাজারের দিকে।
| জোড়া শিব মন্দির |
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো। রাস্তা প্রায় ফাঁকা, একটাও টোটো নেই। সুতরাং হাঁটা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম বড়বাজার এলাকায়। প্রভাতদার কাছে আগেই জেনেছিলাম এখানকার নাগেদের দোকানের গুপো সন্দেশ খুব বিখ্যাত। গেলাম বলাই চন্দ্র নাগের দোকানে। সাত পুরুষের পুরোনো এই মিষ্টির দোকান। দোকানের সামনে দেখতে পাচ্ছি, বড় সাইনবোর্ডে লেখা 'সীতারাম ওঙ্কারনাথ মিষ্টান্ন ভান্ডার'। প্রথমে এই দোকানের কোনো নাম ছিলনা। দোকানের বর্তমান মালিক তারক নাগের দাদু সীতারামের কাছে দীক্ষা নেওয়ার পর থেকে দোকানের এই নামকরণ হয়। তবে এখনো নাগেদের দোকান নামেই সবাই চেনে। বহু আশা নিয়ে এসেছিলাম এই দোকানের গুপো সন্দেশের স্বাদ নিতে। কিন্তু যেখানে ভাগ্য বিপরীত সেখানে কি করা যায়! ভাইফোঁটার জন্য সেদিন দোকানে গুপো সন্দেশ তৈরি হয়নি। ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়। যাইহোক, এতটা কষ্ট করে এসেছি অথচ কোনো মিষ্টির স্বাদ নেবো না এটা হয় নাকি! অগত্যা মাখা সন্দেশ কিনে বিফল মনে টোটোয় চেপে বসলাম। গুপ্তিপাড়ার দিকে আর গেলাম না, চলে এলাম বেহুলা স্টেশনে। ছোট স্টেশন। টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মের একটি ফাঁকা বেঞ্চে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে রইলাম।
![]() |
| গুপো সন্দেশের সন্ধানে |
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ- ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ - বিনয় ঘোষ, 'হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ' দ্বিতীয় খন্ড - সুধীর কুমার মিত্র)


Khub sundor Dada...
ReplyDeleteTmi lekho khub sundor vabe amr porte khub valo lage.