Theme Layout

Boxed or Wide or Framed

Theme Translation

Display Featured Slider

Yes

Featured Slider Styles

[Centred][caption]

Display Grid Slider

No

Grid Slider Styles

[style5][caption]

Display Trending Posts

Display Author Bio

Yes

Display Instagram Footer

Yes

Dark or Light Style

'দীপুদা'-র দার্জিলিং ভ্রমণ


নেকদিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় নি। ভাবলাম এবার কোথাও একটা ঘুরতে যাওয়া হোক। আর হঠাৎ কোথাও ঘুরতে যাওয়া কথা উঠলেই বাঙালির ভ্রমণের তালিকায় থাকা সেই চিরাচরিত 'দীপুদা!' দীঘা, পুরী, দার্জিলিং। আমার অনেকদিনের সাধ দার্জিলিং দেখবার। খাঁটি বাঙালি হয়েও দার্জিলিং কোনোদিন ঘুরতে যাওয়া হয়নি। দার্জিলিংটা একবার ঘুরে আসতেই হবে। যাওয়াটা হলে কী আনন্দই না হত। অফিসে আড্ডা মারতে মারতে আমার কলিগ কাম বন্ধু অভিজিৎকে হঠাৎ আমি জিজ্ঞেস করলাম, এবার দার্জিলিং যাওয়ার প্ল্যান রয়েছে নাকি। আমার মুখে দার্জিলিংয়ের নাম শুনতেই সে এককথায় রাজি হয়ে গেল। এ যে স্বপ্নেও ভাবা যায় না। এই গরমে দার্জিলিং! ওঃ, ভাবতেই মনটা কীরকম করে উঠল। আমিও ডুবে গেলাম আমার কল্পনার জগতে। উঁচু পাহাড়ের ঢালে অগুনতি চা গাছ। মসৃণ পাইন গাছের সারি। পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট বাড়ি। আহা এমন দৃশ্য! তর সইছে না। ভাগ্যক্রমে দার্জিলিং মেলে টিকিট পেয়েও গেলাম। দার্জিলিং মেলে চেপে দার্জিলিং যাবার একটা আলাদা ইমেজ আছে। হোটেলেও বুক করা হল।

নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামলাম
জীবনের কয়েক দশক পার করে এবারই প্রথম দার্জিলিং যাচ্ছি। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে দার্জিলিং মেলে চেপে রওনা দিলাম। শিয়ালদহ থেকে ছাড়ার পর বর্ধমান বোলপুর মালদহ হয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে চলল। ট্রেন এসে থামল নিউ জলপাইগুড়িতে। তখন সবেমাত্র সূর্যোদয় হচ্ছে। সবারই চোখে মুখে ট্রেন জার্নির ছাপ স্পষ্ট। ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্মের বাইরে যখন এলাম ততক্ষনে খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। স্টেশনের বাইরে দেখি পাইস হোটেলের রমরমা। ঘোরাঘুরি করে ভাল একটা রেস্টুরেন্ট পেলাম না। উপায়ন্তর না দেখে একটা পাইস হোটেলে আমরা ঢুকে পড়লাম। কি খেলাম আর কিরকম খেলাম? না বলায় ভালো। পেটকে ওই মুহূর্তে সামাল দিয়ে প্রিপেইড ট্যাক্সি বুথে গেলাম। এখানে প্রিপেইড ট্যাক্সি বুথে সিজিনের সময় ট্যাক্সি পাওয়া খুব মুশকিল। গাড়ি ঠিক করতে গিয়ে দেখলাম দালালের অত্যাচার। চারপাশে অজস্র ছোট-বড় গাড়ির ভিড়। সবাই যে যার মত প্যাসেঞ্জার নেওয়ার জন্য ডাকাডাকি করছে। সুযোগ বুঝে তারাও ট্যুরিস্টদের কাছে দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া হাঁকছে। হন্যে হয়ে ট্যাক্সি খুঁজছি যেন মাছের বাজারে ঢুকেছি, কোনো লাভ হলো না। অটোয় চেপে শিলিগুড়ির শেয়ার ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে চলে এলাম। যাইহোক এখানে একটা গাড়ির ব্যবস্থা হলো। এক নেপালি ড্রাইভারের সঙ্গে দরদাম ঠিক করে উঠে পড়ি তার সুমো গাড়িতে। ড্রাইভারই গাড়ির মাথায় মালপত্র সব তুলে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল, আমরা চললাম দার্জিলিংয়ের দিকে।

চলার পথে সাময়িক বিরতি
শিলিগুড়ি থেকে মাটিগাড়া হয়ে শিমুলবাড়ি ছাড়ার পর থেকেই শুরু হল রোহিণী রোড। শহরের কোলাহল দূরে চলে গেল। দৃশ্যপট আস্তে আস্তে বদলে গেল। শুরু হয়ে যায় আর্মি ক্যাম্প আর চা বাগানের সঙ্গে পথচলা। দুদিকে বড় বড় শাল গাছের জঙ্গল, তার মাঝখান দিয়ে ছবির মত রাস্তা উঠে গেছে পাহাড়ের ওপর। পথের দুপাশে নাম না জানা অজস্র ফুল, চা বাগান আর পাতার ফাঁকে রোদের লুকোচুরী। পুরো রাস্তার নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করতে করতে মাঝে মধ্যেই থেমে যায় দৃশ্যের হাতছানিতে। কিছু সময় সেই দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করে আবার পথচলা।গাড়িতে মাঝে মাঝে বেজে উঠছে নেপালি গান। তবে যতক্ষণ না গাড়ি রোহিণী ছাড়িয়ে পাহাড়ের দিকে উঠল, ততক্ষন কিন্তু পাহাড়ি আস্বাদটা পাওয়া গেলো না। ভদ্র, নম্র, মিশুকে নেপালি ড্রাইভারকে প্রথমেই ভালো লেগে গেলো আমাদের। নেপালিরা যে জাতি হিসেবে কতটা রসিক এবং ফুরফুরে যাত্রাপথে তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। পুরো ভ্রমণপথ মাতিয়ে রেখেছে আমাদের ড্রাইভার। সাধারণ কথা বলছে, তাতেও যেন রস উপচে পড়ছে।

সিরুবারি হোটেল
প্রায় ঘণ্টা দেড়েক সফরের পর কার্শিয়ঙের কাছে এসে গাড়ি থামালো। সামনে ছোট্ট একটা রেস্টুরেন্ট। বাইরে একটা সাইনবোর্ড। পড়ে দেখি 'সিরুবারি হোটেল'। পাহাড়ে এসছি আর মোমো খাবো না, তা কি হয়! আমরা দোকানের ভিতর ঢুকে মোমোর অর্ডার দিলাম। চা-ও খেতে হবে। কিছুক্ষণ বাদেই আমাদের কাছে পৌঁছে গেল গরম গরম চা, মোমো। সেই মোমোর স্বাদ কিন্তু এখনও ভুলিনি। চা আর ভেজ মোমো খেয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। শুরু হল যাত্রার সেকেন্ড স্পেল।

সিরুবারি হোটেল
গাড়ি চলতে শুরু করল। পথে পড়লো শৈল শহর কার্শিয়াং। কার্শিয়াং শহরটাও মন্দ নয়। পাহাড়ের ওপরে সাজানো গোছানো ছোট্ট শহর। এরপর গাড়ি যতই দার্জিলিঙের দিকে এগিয়ে চলেছে থার্মোমিটারের পারদ ততই কমছে তার সাথে সাথে আমার দার্জিলিং ভ্রমণের উত্তেজনার পারদও ক্রমশ বেড়ে চলেছে। সারি সারি পাইন, রডোডেনড্রন, ফার বিভিন্ন গাছের মধ্যে দিয়ে আঁকা বাঁকা রাস্তা ধরে চলছি। মাঝে মধ্যে ফাঁক ফোকর দিয়ে হালকা কুয়াশার মতো মেঘ ভেসে যাচ্ছে। চলার পথে কখনো দেখা যাচ্ছে সুবিস্তৃত পাহাড়ি উপত্যকায় ছোট ছোট জনপদ। খাড়া পাহাড়ি পথ বেয়ে ওঠা রোমাঞ্চকরই বটে। জনপদ ও দৃশ্যপট এই ভাবে চলতে চলতে শেষে দেখা পেলাম খানিকটা দূরে পাহাড়ের গায়ে, ধাপে ধাপে ছোটো ছোটো অনেক বাড়ি। চারিদিকে হালকা কুয়াশার মতো মেঘের মধ্যে সূর্যের আলোয় যেন বাড়িগুলি জ্বলজ্বল করছে, তাহলে কি এটাই দার্জিলিং!!

দার্জিলিঙের পথে
গাড়ি এবার দার্জিলিং ঢুকল। নির্মল পরিবেশে হঠাৎ করে নাকে উঠে এলো পেট্রোল ডিজেলের গন্ধ আর গাড়ির ধোঁয়া। ছোট্ট ছোট্ট আঁকা বাঁকা রাস্তায় হঠাৎ হঠাৎ জমে উঠেছে গাড়ির জ্যাম। বড্ড ঘিঞ্জি শহর! জ্যাম কাটিয়ে আসতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। যখন হোটেলে পৌঁছালাম তখন সাড়ে ৪ টে বাজে। আমাদের হোটেলটা ছিল লাডেন লা রোডে। আগের নাম ছিল ম্যাকেঞ্জি রোড। আগে এই রাস্তাটা ছিল দার্জিলিঙের প্রধান রাজপথ।

শহরে প্রবেশ
রিঙ্ক মলের সামনে এসে আমাদের গাড়ি দাঁড়ালো। 'শ্রেষ্ঠা লজ'। চমৎকার লোকেশন। একদম পাশেই রিঙ্ক মল। কাছেই দার্জিলিঙের হেড পোস্ট অফিস। এটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। পোস্ট অফিসটি চালু হয়েছিল ১৯২১ সালে। ঠিক উল্টোদিকেই মহাকাল মার্কেট ও ড্রাগন মার্কেট। কোলকাতা থেকে বুক করেছিলাম। ঢুকতেই রেস্টুরেন্ট। পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। ওখানেই সব রুম, মেঝে পুরোটাই কাঠের। একটু পুরোনো। তবে মোটামুটি ভালো ঘর। বাঙালি মালিক ও কর্মচারীদের আন্তরিকতা বেশ ভালো লাগলো আমাদের। চেক ইন ফর্মালিটি কমপ্লিট করে রুমে ঢুকে চটপট ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এদিকে সবার খুব খিদে পেয়েছিল। হোটেলের নীচে রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিলাম সবাই মিলে। মেনুতে ছিল ভাত, ডাল, সবজি, চিকেন একেবারে বাঙালি পদ।

হোটেল পৌঁছালাম
হোটেলের রুমে একটু রেস্ট নিয়ে আমরা ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। যা ঘুরব তা পায়ে হেঁটেই। লাডেন লা রোডের এই রাস্তায় গাড়িঘোড়ার ভিড় নেই। পায়ে পায়ে আমরা যাচ্ছি ম্যালের দিকে। ম্যাল! ম্যাল আবার কী? দার্জিলিং শহরের কেন্দ্রস্থল, ম্যাল। পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে এলাম ম্যালে। এর পুরনো নাম চৌরাস্তা। শহরের উচ্চস্থানে রেলিংঘেরা অনেকখানি প্রশস্ত স্থানের চারটে কোণ দিয়ে চারটা রাস্তা বেরিয়েছে বা মিলেছে। ম্যালের যে চৌরাস্তা তা কিন্তু চারটে রাস্তার একত্র মিলনস্থান নয়। দূরত্ব বেশ কিছুটা। লাডেন লা রোডের বিপরীত দিকের যে রাস্তা দুটো তার বাঁদিকের রাস্তাটা চলে গেছে সেন্ট এন্ড্রুজ চার্চ ও অবজার্ভেটরি হিল এর দিকে। আর ডানদিকের রাস্তাটা চলে গেছে মহাকাল মন্দিরে। অন্য আর একটা রাস্তা চলে গেছে জাকির হোসেন রোডের দিকে।

চৌরাস্তা
দোকানপাট হোটেল রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি নিয়ে পর্যটকদের বিনোদনের সব আয়োজনে ভরা। কী চমৎকার পরিবেশ। বহু পর্যটক। পর্যটকদের বসার জন্য আছে কাঠের বেঞ্চ। বেঞ্চ খালি পাওয়া মুশকিল। মাঝখানে একটা স্টেজ। তার সিঁড়িতেও অনেকে বসে। পা ফেলার জায়গা নেই। যেন মেলা বসেছে। চারদিকে দোকানপাট। ফেরিওয়ালা থেকে শুরু করে ঘোড়াওয়ালা সকলে ঘোরাঘুরি করছে। সারি সারি ঘোড়া ট্যুরিস্টদের নিয়ে ঘুরে বেড়াবার জন্য দাড়িয়ে আছে সেখানে। ম্যাল লাগোয়া চৌরাস্তা জুড়ে রকমারি দোকানপাটের সারি। শুধু ঘুরে ঘুরে দেখলাম, কেনাকাটা কিছু করলাম না। এই সময়ে আমরা যেটা করে ফেললাম সেটা হল 'এডভেঞ্চার দার্জিলিং' নামে একটি ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে গিয়ে পরের দুদিনের সাইট সিইং ট্যুরের জন্য গাড়ি ঠিক করা। ম্যালে তখন সন্ধে হয়ে গেছে। এখানে দোকানপাট তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। হাতে সময় কম, তাই ম্যালে এক পাক হেঁটেই কেভেন্টার্সের পথ ধরলাম। চৌরাস্তা পেরিয়ে একটা শর্টকাট রাস্তা দিয়ে নেমে চলে এলাম চকবাজার। সাজানো গোছানো নয় মোটেই জায়গাটা। আঞ্চলিক মানুষের ভিড় সেখানে। সাংসারিক প্রয়োজনের সবকিছুই পাওয়া যায় এই বাজারে। ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়, রাস্তায় প্রচুর গাড়ি, হৈ চৈ। যেন কোলকাতার বড়বাজারে চলে এসেছি। দরদাম করে সস্তায় শপিং করার উপযুক্ত জায়গা। চকবাজার থেকে আমরা কিছু কেনাকাটা করে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম হোটেলে। পরদিন অনেক ঘোরা, তাই সবাই তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম।

চলে এলাম চকবাজার

সাইট সিইং ট্যুর (প্রথম দিন)

সাইট সিইং ট্যুরের জন্য গাড়ি আগেরদিনই ঠিক করে রেখেছিলাম, প্রথমে পিস প্যাগোডা, জাপানিজ টেম্পল, গঙ্গা মাইয়া পার্ক, রক গার্ডেন ঘুরিয়ে আনবে, তারপর লাঞ্চ, লাঞ্চের পর চিড়িয়াখানা নিয়ে যাবে। সকালে যথারীতি তাড়াতাড়িই ঘুম ভাঙল। মনে পড়ে গেল আজ তাড়াতাড়ি তৈরি হতে হবে। চটপট ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমাদের ড্রাইভার ঠিক সাড়ে আটটার মধ্যে এসে হাজির। একে একে সবাই গাড়িতে উঠে বসলাম।
ভোর ৪:৩০ থেকে সকাল ৬:৩০ এবং বিকাল ৪:৩০ থেকে ৬:৩০ পর্যন্ত এখানে প্রার্থনা চলে। প্রতিদিন সকাল ৪:৩০ টা থেকে সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত মন্দির আর প্যাগোডা খোলা থাকে দর্শনার্থীদের জন্য।
পাহাড়ি উঁচু নিচু রাস্তা বেয়ে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা হাজির হলাম এক শান্তির উপাসনালয়ে। প্রথমেই গেলাম বৌদ্ধ মন্দিরে। এটি নির্মিত হয়েছিল জাপানের বৌদ্ধ সন্ন্যাসী তথা নিপ্পনজান-মিওহোজি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা নিচিদাতসু ফুজির তত্বাবধানে। এটি নিপ্পনজান মিওহোজি বৌদ্ধ মন্দির নামেও পরিচিত। এটি একটি জাপানিজ টেম্পল। দোতলা মন্দির। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে উপরে বিশাল উপাসনাকক্ষ। জুতো খুলে উপরে উঠে দেখি উপাসনাকক্ষে নিচিদাতসু ফুজির ছবি। বুদ্ধের মূর্তিও আছে। সেখানে তখন উপাসনা চলছে গুরুগম্ভীর ড্রাম বাজিয়ে, তাই কোনো ছবি তোলা গেলোনা। ড্রামের তালে তালে নিজের মনে কেমন যেন স্বর্গীয় এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করলাম। এখানে বহু ট্যুরিস্ট এসে উপাসনা করেন। এই উপাসনায় সকলে সামিল হতে পারে। একটা ছোট লাঠি এবং ড্রাম প্যাড দেওয়া হয়, এরপর তালে তালে সেটা বাজিয়ে উপাসনা করতে হবে। চারদিক ভীষণ চুপ চাপ। শান্তি শান্তি ভাব। একজন শ্রমণ এসে আমাদের একটা করে নকুলদানা দিলেন প্রসাদ হিসেবে। প্রাসাদ খেয়ে দোতলা থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম পিস প্যাগোডার দিকে।

বৌদ্ধ মন্দির
পিস প্যাগোডা যাওয়ার পথটা ভারী সুন্দর। সুন্দর কারুকার্য করা দুধের মতো সাদা গম্বুজ আকৃতির প্যাগোডার ডিজাইনটাও বড়ো সুন্দর। সামনে একটি ব্রোঞ্জের বুদ্ধমূর্তি, দুদিক দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে, ওই সাদা গম্বুজটাকে ওপরে উঠে প্রদক্ষিণ করা যায়। সিঁড়ির মুখে দুটো সিংহের মূর্তি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে দাঁড়াতেই নিমেষে জুড়িয়ে গেল মনটা। 'কাঞ্চনজঙ্ঘা!' কি দারুন ভিউ! পাইন গাছের মাথার ওপর দিয়ে আকাশ জুড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার সে এক অপরূপ দৃশ্য। ছবি টবি তোলা হলো। হাতে সময় কম। চারদিকে একটু ঘুরে আবার গাড়িতে গিয়ে বসলাম।

পিস প্যাগোডা
আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে গঙ্গা মাইয়া পার্কের দিকে। রাস্তার দু'পাশ জুড়েই দিগন্তজোড়া পাহাড়। সবুজের পর সবুজ, কোথাও উঁচু কোথাও নিচু। আঁকাবাঁকা সরু পাহাড়ী পথ। একপাশে উঁচু পাহাড় অন্যপাশে শরীর হিম করা গভীর খাদ। অসংখ্য খানাখন্দ ভরা, জায়গায় জায়গায় গভীর গর্ত। এরকম রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলছে গাড়ি। কিছুটা বাদে বাদে এক একটা গাড়ি উল্টো দিক থেকে আমাদের পাশ কাটিয়ে হেলে দুলে চলে যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর সেই রাস্তায় একটু পরপরই বাঁক নিচ্ছে। গা শিউরে ওঠার মতো এক একটা বাঁক। একটু ভুল করলেই গাড়ি পাহাড় থেকে পড়ে যাবে এমন অবস্থা। এরকম খাড়া পাহাড়ি পথ বেয়ে ওঠা নামা জীবনে প্রথম। প্রায় ঘন্টা দেড়েক চলার পরে আমরা পৌঁছে গেলাম গঙ্গা মাইয়া পার্কে।

গঙ্গা মাইয়া পার্কের ভেতরে ঢুকলাম
এন্ট্রি ফি দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। এরপর হেঁটে এ পথ সে পথ করে গোটা পার্ক ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। গঙ্গা মাইয়া পার্কটা বিশাল এলাকা জুড়ে। নানারকম বাহারি গাছপালা দিয়ে সাজানো। একেবারে ছবির মতোই সুন্দর। চারদিকে কেবল সবুজে মোড়া। আহা! কী অপূর্ব সেই দৃশ্য। শান্ত কোলাহলমুক্ত সবুজ মনোরম দৃশ্য যেন আমাদের ঘোরার মাত্রাটা আরও বাড়িয়ে দিলো। গঙ্গা মাইয়া পার্কের মধ্যে ঝির-ঝির করে বয়ে চলেছে নাম না জানা পাহাড়ি এক নদী! পাহাড়ের চড়াই-উতরাই ভেঙে তার চলার পথ। নদীর বুকে নুড়ি পাথর জলের ধাক্কা খেতে খেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। পার্ক জুড়ে ছোট ছোট ব্রীজ পেরিয়ে একটা মাঝারি মাপের সমতল জায়গায় এলাম। এর মাঝে কিছু ফোটোসেশন চলল।

বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী
চোখের সামনে ভেসে উঠল ছোট একটি লেক। যার চারপাশে সবুজ পাহাড়, আর তার মাঝখানে একটা ঝর্ণা। জলে পাহাড়ের ছায়া, যেন প্রকৃতির আয়না। প্রকৃতির সৌন্দর্যকে আরও মোহনীয় ও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এ যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতো এক মনোরম দৃশ্য। প্রকৃতির এই অপরূপ দৃশ্যের মাঝে কিছুক্ষণ মনটা যেন হারিয়ে যায়। এই পার্কের অন্যতম আকর্ষণ হল পার্কের এই লেকে বোটিং করা। সারি দিয়ে বাঁধা প্যাডেল বোট। লেকের মধ্যে প্যাডেল বোটে চড়ে নৌ ভ্রমণের আয়োজন রয়েছে। হাতে বেশি সময় নেই। আমরা এখানে এখন বোটিং করলাম না।

লেকের জলে পাহাড়ের ছায়া
কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর শরীর তখন বেশ ক্লান্ত। মনে হল, সবুজ পাহাড়ের কোলে কোথাও গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকি। দেখলাম কাছেই চমৎকার একটা বিশ্রামের জায়গা। কিছুটা জিরিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা সেখানে বসে পড়লাম। বসে থাকতে থাকতে চোখের সামনে বেলা গড়িয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু এখানকার অসাধারণ সৌন্দর্য ছেড়ে কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে করছিল না। হালকা একটু খিদেও পেয়েছে। সামনে একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম ছোট একটা রেস্টুরেন্ট। দলবল সমেত সেই রেস্টুরেন্টে ঢুকে গরম গরম ম্যাগি আর চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে গাড়িতে চেপে বসলাম। গঙ্গা মাইয়া পার্ককে বিদায় জানিয়ে রওনা দিলাম রক গার্ডেনের উদ্দেশ্যে।

কিছুটা জিরিয়ে নেওয়া
গঙ্গা মাইয়া পার্ক থেকে বের হয়ে গাড়ি আমাদের নিয়ে চললো রক গার্ডেনের দিকে। কিছুদূর গিয়ে ড্রাইভার অনেক নীচের একটা জায়গা দেখিয়ে বললো যে ওটাই রক গার্ডেন। ঢালু ও খাঁড়া পাহাড়ি রাস্তায় যাওয়ার সময় বুকের ভেতরটা ঢিপ ঢিপ করতে লাগলো। রাস্তাগুলো চওড়া না হওয়ার কারণে উল্টো দিক থেকে আসা গাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় মোড়ে মোড়ে ড্রাইভার হঠাৎ করে ব্রেক করছে। এভাবে গাড়ি কখনো বামে কখনো ডানে মোচড় খেয়ে চলার সময় যখন থেমে যাচ্ছে তখন মনে হচ্ছে এই বুঝি গাড়ি ভারসাম্য হারিয়ে নীচের খাদে পড়ে যাবে। দার্জিলিং শহরের মধ্যে এটাই বোধহয় সবচেয়ে বিপজ্জনক রাস্তা। এইভাবে মিনিট দশ পনেরোর মধ্যেই রক গার্ডেনে পৌঁছে গেলাম।

রক গার্ডেন
পাহাড়ের খাঁজ কেটে তৈরি একটি সুন্দর পার্ক 'রকগার্ডেন!' এটি বারবটে রক গার্ডেন নামেও পরিচিত। পার্কিং লটের কাছে দেখলাম রাস্তার পাশে ছোট ছোট কয়েকটি চা কফির দোকান। সবাই গাড়ি থেকে নেমে চিপস, বিস্কুট আর চা খেলাম। ঢুকেই সুদৃশ্য বাগান। দেখে মনেই হয়না এটা মানুষের বানানো। চারপাশে সবুজ বন আর উঁচু পাহাড় দিয়ে ঘেরা। উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে ধাপে ধাপে নেমে এসেছে একটি প্রাকৃতিক ঝর্ণা। যার নাম চুন্নু সামার ফলস। এই ঝর্ণাকে ঘিরেই তৈরি এই রক গার্ডেন।

গাড়ি থেকে নামলাম
চুন্নু ফলসের সামনে অসংখ্য ট্যুরিস্ট। বিশাল বিশাল কালো পাথর খণ্ড পড়ে আছে ঝর্ণার পথ চলার মাঝে। একপাশ থেকে অন্যপাশে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট ব্রীজ। ঝর্ণার সামনে এসে দাঁড়াতেই শোনা গেল চিরচেনা সেই ছলাৎ ছলাৎ স্রোতের শব্দ। ক্যামেরায় বন্দি করার মতো। ছবি তোলার জন্য আদর্শ জায়গা। আমিও ক্যামেরা বের করে কয়েক ডজন ছবি তুলে ফেললাম। রক গার্ডেনে অনেকটা উঁচু পাহাড় চড়তে হয়। রেলিং দেওয়া ঢালু পথ বেয়ে ধাপে ধাপে উপরে উঠতে লাগলাম। ওপরে অনেকগুলো ভিউ পয়েন্ট। বিভিন্ন ধাপে পাথর কেটে তৈরি বসার জায়গা।

চুন্নু ফলস
ছোট্ট একটা কালভার্ট পেরিয়ে ওপরে উঠে দেখলাম একটা গোল রেলিংয়ে ঘেরা বেঞ্চি দেয়া বাঁধানো জায়গা। ঠিক যেন উপত্যকার মাঝখানে, সেখান থেকে চারপাশটা অপূর্ব লাগে। চারদিকে শুধু পাহাড় পাহাড় আর পাহাড়। এখানে কাঠের বেঞ্চিতে এসে কিছুক্ষণ বসলাম। কী চমৎকার জায়গা। এখানেও প্রচুর ছবি, সেলফি তুলে গাড়িতে চেপে বসলাম। এইবারে যাওয়ার পালা। আবার গাড়ি চললো, একের পর এক খাড়া চড়াই আর ওই রকম ভয়াবহ বাঁক পেরিয়ে দুপুর সাড়ে ৩ টে নাগাদ আমরা চিড়িয়াখানার কাছে পৌঁছে গেলাম।

পার্কের মনোরম দৃশ্য
দার্জিলিঙয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র এই চিড়িয়াখানা। এর পোশাকি নাম পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক। গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে যেতে হবে, সামান্য একটু পথ। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে। তার আগে কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। দেখি রাস্তার পাশে গুটিকয়েক খাবারের দোকান। খোঁজাখুঁজি করে সেখানে ভালোমানের খাবারের হোটেল একটাই পাওয়া গেল। সেখানে সবাই হালকা খাওয়া দাওয়া সেরে হাঁটতে হাঁটতে চিড়িয়াখানার গেটে পৌঁছে গেলাম। ততক্ষনে লাইন কমে গেছে। টিকিট কেটে আর ক্যামেরার জন্য টাকা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম।

চিড়িয়াখানার গেটে পৌঁছে গেলাম
এই চিড়িয়াখানার আলাদা একটা গুরুত্ব আছে। উচ্চতার কারণে এমন কিছু পশু এখানে আছে যা সমতলের চিড়িয়াখানায় দেখা যায় না। চিড়িয়াখানা যাওয়ার রাস্তাটা ভারি সুন্দর। চড়াই উৎরাই রাস্তা ঘুরে ঘুরে উঠতে হবে। রাস্তা ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠেছে, পাশে রেলিং দেওয়া, আর জন্তু-জানোয়ার সব রেলিংয়ের বেশ খানিকটা নীচে রয়েছে, ওপর থেকে অনেকটা নীচে ঝুঁকে দেখতে হয়, অনেকটা খোলা একেকটা ঘেরা জায়গায় বিভিন্ন জানোয়ারদের রাখা আছে। এখানে চমরি গাই, রেড পান্ডা, স্নো লেপার্ড, গোরাল (পর্বত ছাগল), ক্লাউডেড লেপার্ড, ভালুক, বার্কিং ডিয়ার, নানা প্রজাতির পাখি, সাপ ইত্যাদি রয়েছে। হাতে সময় খুব কম তাই অল্পের উপরে রাস্তায় যেতে যেতে যে কয়েকটি পশু পাখির দেখা পাওয়া যায় তাই দেখলাম।

পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক
চড়াই পথ, হাঁটতে অনেক কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু যে কষ্টটা হচ্ছিল রাস্তার সৌন্দর্য সেটা অনেকটাই লাঘব করে দিল। আবার বাড়তি পাওনা হিসাবে পেলাম প্রচুর সুন্দর ছবি তোলার সুযোগ। ছবি তুললাম কয়েকটা, মন ভরলো না, একটু হতাশ লাগছে! ওপর নীচ করে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। এতো কাছে এসেও তেনজিং নোরগের ব্যবহার করা জিনিস না দেখে ফিরে যাবো? সামনের বেঞ্চিতে বসে সবাই বিশ্রাম করে মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম।

চলার পথে বিশ্রাম
চিড়িয়াখানার ভেতরেই হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট। বেশ কিছুটা সামনে হেঁটে গিয়ে দেখলাম হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট। সামনে তেনজিং নোরগের স্মৃতিসৌধ এবং তার উল্টোদিকে একটা স্ট্যাচু রয়েছে। ভেতরে মিউজিয়াম। এভারেস্ট জয়ীদের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন সহ আরো অনেক ইতিহাস সংরক্ষিত আছে এই মিউজিয়ামে। এখানে বিখ্যাত পর্বতারোহীদের মডেল, চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, ছবি, পাণ্ডুলিপি, অটোগ্রাফ, বই এবং পর্বতারোহণের বিভিন্ন সরঞ্জাম রয়েছে।

তেনজিং নোরগের স্মৃতিসৌধ
এখন থেকে বেরিয়ে পাশেই খানিকটা পায়ে হেঁটে চলে এলাম বেঙ্গল ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে। টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করলে দুটো জায়গা একসাথে দেখে নেওয়া যায়। এখানে কয়েকশো প্রজাতির পাখি, কীটপতঙ্গ, সরীসৃপ, মাছ এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর সংগ্রহ রয়েছে। এগুলো কেবল হিমালয় অঞ্চল থেকে নয়, রাজ্যের অন্যান্য জায়গা থেকেও সংগ্রহ করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরণের প্রজাপতি রয়েছে! এছাড়াও, মথ, বিটল এবং অন্যান্য কীটপতঙ্গের প্রচুর সংগ্রহ রয়েছে। আর, এই সংগ্রহ গুলো সবই আসল প্রাণীর। নানারকম জানা অজানা পাখি ও কীটপতঙ্গের সাথে পরিচিতি হলো। এদিকে এতক্ষণ ধরে এতো চড়াই উৎরাই রাস্তা ঘুরে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চা কফি খেয়ে ধীরে ধীরে নেমে গাড়ির কাছে পৌঁছলাম।

বেঙ্গল ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম
দার্জিলিং নামটা শুনলেই সবার আগে আসে চা-এর কথা আর তার সাথে অবশ্যই চা বাগানের কথা। দার্জিলিঙে আসার পরেই যেন সেই চা বাগান দেখার ইচ্ছেটা বেড়ে গেল। তখন বিকেল চারটে বেজে গেছে। অযথা সময় নষ্ট না করে গাড়িতে চেপে বসলাম। লেবং কার্ট রোড ধরে নর্থ পয়েন্ট ছাড়িয়ে গাড়ি এসে থামলো একটা ভিউ পয়েন্ট এর কাছে। রাস্তার পাশে সার সার ঝুপড়ি দোকান, সেখানে গাড়ির ভিড়। চারপাশে চোখ ও মন ভালো করা সবুজ চায়ের বাগান, ওপর থেকে ধাপে ধাপে ঢালু হয়ে নেমে গেছে। আর সেই সবুজ চা বাগানের ঢালে সরু সুঁড়িপথ, সেটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে, যতদূর চোখ যায়। পর্যটকদের ভিড় জমেছে। ছবি ছাড়া 'দেখা' হয় না, বেড়ানোও। যথারীতি চললো ফটো সেশন। এখানে ছবি তোলার জন্য ট্রাডিশনাল পাহাড়ি পোশাকও রাখা আছে। ভাড়া পাওয়া যায়। সেই 'পাহাড়ি পোশাক' পাহাড়িরা খুব কমই পরে, কিন্তু তাতে কী আসে যায়? সবুজের মধ্যে লাল, নীল, কমলা, বেগুনি রং ঝলমল করে, ভালো ছবি হয়। অনেকে বাগানের পাকদণ্ডি দিয়ে নীচে নামছে, রঙচঙে 'পাহাড়ি' পোশাক পরে ছবির পর ছবি তুলছে।

রঙচঙে 'পাহাড়ি' পোশাক পরে ছবি তোলা
চোখের সামনে পাহাড়ের ঢালময় বিস্তৃত চা বাগান, যেন সবুজের সাগরে হারিয়ে যাওয়া এক টুকরো স্বর্গ। ঢেউ খেলানো পাহাড়, টিলার কোলে ছড়িয়ে থাকা চা গাছ, মনের সব ক্লান্তি মুছে দেয় এক নিমেষে। এই সময়ে এক কাপ চা হলে মন্দ হয় না। গাড়ির কাছে এসে দেখি রাস্তার ধারে ছোট ছোট ঝুপড়ি দোকানগুলোতে হরেক রকম চা বিক্রি হচ্ছে। আমাদের গাড়ির ড্রাইভারের সাথে একটা দোকানে চা খাওয়ার জন্য গেলাম। দোকান থেকে একটা পাহাড়ি মেয়ে বেরিয়ে এসে বেশ আগ্রহের সাথে বললো এখানে চা খেয়ে যান। একদম ফ্রিতে কোন টাকা পয়সা লাগবে না! আগে খেয়ে দেখুন যদি পছন্দ হয় তাহলে কিনে নিতে পারেন। চা করেও খাওয়ালেন। আহা! কী দারুন স্বাদ সেই চায়ের। এখান থেকে কিছু চা কিনেও নিলাম, কয়েকজনকে গিফট করতে হবে তো! গাড়িতে চেপে বসলাম।

শহরের দিকে এগিয়ে চলেছি
রাস্তায় যেতে যেতে চোখে পড়ল তেনজিং নোরগে ন্যাশানাল মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট। তখন দেখি পাহাড়ের পিছনে সূর্য ডুবে যাচ্ছে একটু একটু করে। তেনজিং রক দেখা হলোনা। কিছুদূর যেতেই সেই বিখ্যাত সেন্ট জোসেফ স্কুল, যেখানে 'ইয়ারিয়া'(Yaariyan) সিনেমার শুটিং হয়েছিল। ভেতরে ঢুকতে মানা। ড্রাইভারকে বললাম গাড়ি থামাতে। অল্পখনের থামা, স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে একটু ফটোসেশন তারপর আবার চলা শুরু। দেখা শেষ। এবার হোটেলে ফেরার পালা।

সেন্ট জোসেফ স্কুল
কাল সূর্যোদয় দেখতে টাইগার হিল যাব। ড্রাইভার বলল, খুব ভোরে উঠে যেতে হবে। খুব ভোরে মানে কখন? খুব ভোরে মানে খু-উ-ব ভোরে। অন্ধকার থাকতে। যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে ততো ভালো পজিশন পাওয়া যাবে। দেরি হলে পার্কিং লটে গাড়ি রাখার জায়গা পাওয়া যাবে না। তখন পায়ে হেঁটে উঠতে হবে অনেকটা। সূর্যোদয় দেখা মিস হয়ে যাবে। খুব ভোরে উঠতে হবে। রাত তিনটের সময় গাড়ি পিক-আপ করতে আসবে। তাই মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সাইট সিইং ট্যুর (দ্বিতীয় দিন)

আজ আমাদের সাইট সিইং ট্যুরের দ্বিতীয় দিন। গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে। খুব ভোরে টাইগার হিল নিয়ে যাবে। তারপর বাতাসিয়া লুপ আর ঘুম মনাস্টারি ঘুরিয়ে আনবে। রাত দুটোর সময় অ্যালার্ম বাজতেই ধড়মড় করে আগে উঠলাম। ডাকলাম সকলকে, ওঠো, ওঠে সব। টাইগার হিল দেখতে যাবে যে? সবাই উঠে পড়ল। এরপর সবাইকে ডেকে বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তখন শেষ রাত, মানে ঘড়িতে তখন তিনটে দশ। শুধু আমরা নয়, দার্জিলিং শহরের সমস্ত ট্যুরিস্টই উঠে পড়েছে তখন। চারদিকে সাজ সাজ রব। রোজই এই সময় দার্জিলিং জেগে ওঠে। অথচ কী প্রচণ্ড ঠান্ডা। সবাই গোছগাছ সেরে নিচ্ছে তখনই গাড়ির হর্ন। বাইরে থেকে কে যেন বলল, গাড়ি রেডি। আনন্দে হইহই করে উঠে বসলাম সকলে।

গাড়ির অপেক্ষায়
টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয়ের বর্ণণা গল্প উপন্যাসে অনেক পড়েছি। এখানে সূর্যোদয় দেখাটা ভাগ্যের ব্যাপার। এমনও ঘটে, এক একজন পর্যটক কতবার এসেও সূর্যোদয় দেখতে পারে না। আবার কেউ একবার গিয়েই চক্ষু সার্থক করে আসে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গাড়ি চলছে সাঁ সাঁ করে। ভীষণ চড়াই। কিছুক্ষণ পরই দেখা গেল রাস্তার দু'ধারে কেবলই জঙ্গল। পর্যটকদের গাড়ি লাইন দিয়ে চলেছে টাইগার হিলের পথে। ভোর চারটের সময় গাড়ি টাইগার হিলের পার্কিং লটে এসে পৌঁছাল। তখনও অন্ধকার কাটেনি। কিন্তু এই রাতেও আমাদেরও আগে আরও কত লোক এসে হাজির হয়েছে। আর কত যে ট্যাক্সি জিপ ও টাটা সুমো জড়ো হয়েছে তার কোনও হিসেব নেই। একদম ওপরে ওঠার অনেকটা নীচে পর্যন্ত গাড়ির লাইন। ড্রাইভার বলল, 'যারা আগে এসেছে তারা গাড়ি নিয়ে ওপরে উঠে গেছে। আপনাদের এখান থেকে পায়ে হেঁটে উঠতে হবে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে কনকনে ঠান্ডায় পায়ে হেঁটে চড়াই ভাঙছি। প্রায় হাফ কিলোমিটার মতো পায়ে হাঁটতে হলো। তখন বুঝলাম ড্রাইভার কেন এত রাতে বেরোতে বলেছিল।

টাইগার হিল অবজার্ভার পয়েন্ট
টাইগার হিলের অবজার্ভার পয়েন্টে যখন পৌঁছায়, তখন দেখি প্রায় হাজারখানেক লোক এসে জড়ো হয়েছে সেখানে। দেশ বিদেশের বহু পর্যটক। টাইগার হিলের মাঝখানে তিনতালা অবজারভেটরি টাওয়ারের কাজ চলছে। অবজারভেটরি টাওয়ারের ভেতরে ও খোলা চত্বরের পূর্বদিকটাতে রেলিং ঘেরা। সত্যি, কী চমৎকার জায়গা। তখনও সূর্যোদয়ের অনেক বাকি। শীতের জামাকাপড় পরে হাতমুখ সব ঢেকে আছি, মাথায় টুপি। তারপরেও কি ঠান্ডা! সূর্যোদয় দেখার আগের মুহূর্ত ভোলার নয়, সবাই তাকিয়ে আছে আর অপেক্ষা করছে সেই দিগন্তরেখার দিকে। রেলিং এর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি, হঠাৎ করেই অন্ধকার ফিকে হতে শুরু করল। সামনে উঁচু এক পর্বত, 'কাঞ্চনজঙ্ঘা!' দূর আকাশের পানে তাকিয়ে অপলক চোখে দেখলাম তার রূপ। কী সুন্দর দেখাচ্ছে।

সামনে উঁচু পর্বত, 'কাঞ্চনজঙ্ঘা!'
পুবের আকাশে একটু একটু করে রঙের খেলা শুরু হচ্ছে তখন। মনে হলো কে যেন আবির ছড়িয়ে দিল। দিগন্তরেখা ধরে সারা আকাশ লাল টুকটুকে হয়ে উঠছে। 'কাঞ্চনজঙ্ঘা!' স্লেট রঙের আকাশে সগর্বে প্রকাশিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। লাল আকাশের রিফ্লেকশন এসে পড়ছে ওর গায়ে। ও দিকে সবাই ডান দিকে পাহাড়ে গায়ে তাকিয়ে আছে। ওখান থেকেই সূর্যদেব প্রকাশিত হবেন। সকলের হাতে ক্যামেরা, সবাই প্রস্তুত। ঠান্ডায় শরীর শিউরে উঠছে কিন্তু কেউ তাকে কেয়ার করছে না। হাওয়ায় জামাকাপড় টুপি উড়ছে, কাঁপিয়ে দিচ্ছে, তাতে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। দমবন্ধ করে তাকিয়ে আছে পাহাড়ের কিনারে। এখন শুধু অপেক্ষা সূর্যোদয় দেখার।

সূর্যোদয় দেখার আগের মুহূর্ত
একটু পরেই সমস্বরে উল্লাস ধ্বনি শোনা গেল। পুরো টাইগার হিল জুড়ে আনন্দের বন্যা। ওই, ওই যে। শুরু হল ছবি তোলার হিড়িক। ক্যামেরার পর ক্যামেরা ঝিলিক মেরে উঠল। প্রথমে একটি সরু লাল রেখা। তার পর একটু একটু করে বাড়ছে সেটা, অন্ধকার পাহাড়ের কোল থেকে লাল টকটকে একটা আগুনের গোলা উঠছে ধীরে ধীরে। এ এক ঐশ্বরিক সৌন্দর্য। মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখছি প্রকৃতির সেই অবিস্মরণীয় রূপ। মাঝে মাঝে বাঁ দিকেও নজর রাখছিলাম। একটু পরেই দেখি চোখ ঝলসানো সোনালী রঙে রঙিন হয়ে বেরিয়ে এল সূর্য। সেই সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ল বাঁ দিকের কাঞ্চনজঙ্ঘায়। কাঞ্চনজঙ্ঘার সোনার চূড়ায় শুরু হল আলোর নাচন। প্রথমে গোলাপী, তার পর ফিকে লাল, তার পর কমলা। একটু পরেই তার সঙ্গে মিশে গেল ডিমের কুসুমের রঙটা। কী ঝকঝকে, কী চমৎকার! সেই অপরূপ দৃশ্যও সত্যি ভোলার নয়। একটু পরেই বুঝতে পারলাম, আর সূর্যর দিকে তাকানো যাবে না। কী তার তেজ! পাহাড়ের কোল ছেড়ে সে উঠে পড়েছে আকাশে। গাড়ির ড্রাইভার জানাল, গত সতের দিন ধরে বৃষ্টি ও মেঘের জন্য সূর্যোদয় দেখা যায়নি। আমরা খুবই ভাগ্যবান, তাই জীবনের প্রথম দিনই সূর্যোদয় দেখতে পেয়েছি। সত্যিই আমরা ভাগ্যবান, টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখা জীবনের এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি, পরম পাওয়া।

অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সূর্যের দেখা
টাইগার হিল থেকে ফেরার পথে গাড়ি গিয়ে থামলো ঘুম মনাস্টারির সামনে। এই মনাস্টারির পোশাকি নাম সামতেন চোলিং মনাস্টারি। এটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়। উনিশ শতাব্দীতে নির্মিত এই বৌদ্ধ মনাস্টারিটি তিব্বতী গেলুগ-পাস সম্প্রদায়ের। ঘুম রেলস্টেশনের নীচুতে বাজার ছাড়িয়ে এই মনাস্টারি। রেললাইনের পাশেই মনাস্টারির গেট। আমাদের স্বাগত জানালো মনাস্টারিতে।

নস্টালজিয়ার ঘুম রেল স্টেশন
গেট পেরিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে এলাম। সামনে একটা খোলা চত্বর। এর একদিকে মূল মনাস্টারি, অন্যদিকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের থাকার জায়গা। পাশে একটা ছোট ক্যাফেটেরিয়া। জুতো খুলে মূল উপাসনা ঘরে ঢুকলাম। বাইরে একটা ছোট স্টল। সেখানে হরেক রকম পসরা সাজানো রয়েছে পর্যটকদের দের জন্য। ডানদিকে একটা মস্ত বড় প্রেয়ার হুইল, তাতে কি সব যেন লেখা।

ঘুম মনাস্টারি
উপাসনাকক্ষের ভেতরটা প্রায় তিনতলা সমান উঁচু। একদিকে সোনার গিলটি করা বুদ্ধের অনিন্দ্যসুন্দর মূর্তি। অপরদিকে লাল কাপড় জড়ানো মহাকালের ভয়ঙ্করদর্শন মূর্তি। এই মনাস্টারির আরাধ্য দেবতা হলেন মৈত্রী বুদ্ধ। তার প্রশান্তি ভরা মুখ, কপালের পাথর থেকে বিচ্ছুরিত নীল রঙের আভা মোহিত করে দিল বেশ কিছুক্ষণের জন্য। উপাসনাকক্ষের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে বৌদ্ধ জাতক কাহিনীর ফ্রেসকো ও ম্যুরাল। সামনে একটা বেঞ্চের মতো আছে, তার ওপর ভক্তদের দান গ্রহণের বাক্স, একটা থালায় প্রদীপ জ্বলছে। চারদিকে নিশ্চুপ নীরবতা। কোথাও কোনো শব্দ নেই। যেন এক গুরুগম্ভীর পরিবেশ। ফোটোসেশন চালাতে চালাতেই সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগলাম।

উপাসনাকক্ষে বুদ্ধ মূর্তি
ফিরে এলাম গাড়ির কাছে। গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম আমাদের পরবর্তী সিডিউল কি? সে বললো এবার যাব বাতাসিয়া লুপ। আমাদের গাড়ি ঘুম স্টেশন ছাড়িয়ে হিলকার্ট রোডের নীচে এসে দাঁড়ালো। রাস্তার উপরে ট্রেন লাইনের সেই বিখ্যাত 'বাতাসিয়া লুপ'। তখন পুরোপুরি সকাল হয়ে গেছে। তবে আকাশ বড় গম্ভীর। মেঘ মেঘ আকাশ। একটুও রোদ নেই। বাতাসিয়া লুপে যাওয়ার জন্য উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতে হলো।

বাতাসিয়া ইকো গার্ডেন
ওপরে দেখি একটি সমতল গোলাকার জায়গায় সুন্দর সাজানো বাগান, আর তাকে ঘিরেই রয়েছে একটি পেঁচালো সর্পিলাকার টয়ট্রেনের লাইন। একই জায়গার দুদিকে রেললাইনটি পরিবেষ্টিত, তফাত শুধু উচ্চতায়। হ্যাঁ, পার্বত্য উচ্চতাকে ঝপ করে এক ধাপে কমানো সমস্যা ছিল, তাই এই সমাধান। সবুজে ছাওয়া ঘাস। বাঁধানো পথ। অনেক বসার বেঞ্চ আর নানান বাহারি ফুলে ছেয়ে রয়েছে চারপাশ। মাঝখানে একটা কালো উঁচু স্তম্ভ। পাশে এক গোর্খা সেনার মূর্তি, রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। 'ওয়ার মেমোরিয়াল'। একটা যুদ্ধ স্মৃতিস্মারক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেসব গোর্খা সৈন্য মারা যান তাঁদের স্মরণে তৈরি। সে এক অপূর্ব দৃশ্য।

ওয়ার মেমোরিয়াল
উত্তরের আকাশ জুড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতমালার সারি! পাহাড়ের দিক থেকে হু হু করে বয়ে আসছে ঠান্ডা হাওয়া। মাঝে মাঝে ভিড় করে আসছে মেঘকুয়াশার দল। বাইনোকুলার দিয়েও দেখা যায় এই কাঞ্চনজঙ্ঘা। তবে খালি চোখে দেখার মজাই আলাদা। আকাশ পরিষ্কার থাকলে সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়। হঠাৎ একরাশ মেঘ এসে সব আবছা করে দিল। মেঘ, কুয়াশা মিলেমিশে ঢেকে দিলো সবকিছু।

বাইনোকুলারে কাঞ্চনজঙ্ঘা
এত সকালেও দেখি রেললাইনের পাশে পর্যটকদের জন্য পসরা সাজিয়ে বসেছে পাহাড়ি মেয়েরা। আছে রঙিন সোয়েটার, শাল, টুপি, হাতের কাজ করা লেডিজ ব্যাগ ইত্যাদি। কেউ আবার ভুটিয়া পোশাকে সেজে ছবি তুলছে। ওদের কাছে টুকটাক কেনাকাটি করছি, এমন সময় দেখি জোর জোর হুইসেল বাজিয়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে তিন কামরার একটি টয়ট্রেন। আর রেললাইনের পাশে সাজিয়ে পসরা নিয়ে বসা ভুটিয়ারা সব জিনিস টেনে সরিয়ে দিচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে দৃশ্যপটের পরিবর্তন। কি অসীম ধৈর্য ওদের। দিনের মধ্যে যতবার ট্রেন যাতায়াত করে প্রতিবার যত্ন করে পসরা তোলা সাজানো নিত্য নৈমিত্তিক কাজ। হুস করে হুইসেল বাজিয়ে চলে গেল। স্টেশনে বুড়ি ছোয়া করল। পাকদণ্ডি পথে কিছুদূর যাওয়ার পর অদৃশ্য হয়ে গেল কিন্তু থেকে গেল রেললাইন। আমরাও দেদার আনন্দে ফোটোসেশন সেরে উঠলাম গাড়িতে। ড্রাইভারকে বললাম সরাসরি হোটেলে যেতে।

ফটোসেশন
টাইগার হিল থেকে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে সবাই ভাবলাম আজ সারা দিনতো পড়ে থাকছে। কি করা যায়? কোথায় যাবো! কিছুতেই ঠিক করতে পারছিলাম না অথচ যেতেই হবে। শেষে ঠিক করলাম টয়ট্রেনে চড়ব। দার্জিলিংয়ে গিয়েছি অথচ টয়ট্রেনে চড়ব না, তা কী করে হয়? হোটেলের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। হঠাৎ আকাশে বেশ কিছু মেঘ জমে গেল। আবহাওয়াটা খুব খারাপ মনে হচ্ছে। মেঘলা আকাশে বৃষ্টি নামবে আর কিছুক্ষণ পরে। ব্রেকফাস্ট সেরে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম দার্জিলিং রেল স্টেশনে। স্টেশনটা রিঙ্ক মলের একদম কাছে। স্টেশনের টিকিট কাউন্টার থেকে দার্জিলিং টু দার্জিলিং জয় রাইডের টিকিট কেটে নিলাম। ছাড়ার সময় দুপুর ১২:৪৫। দার্জিলিং থেকে ঘুম হয়ে আবার দার্জিলিং ফিরে আসবে। মাঝখানে পড়বে বাতাসিয়া লুপ। এই জয় রাইডের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে টয়ট্রেনে চেপে বাতাসিয়া লুপ পার হওয়া।

দার্জিলিং রেল স্টেশন
আকাশের অবস্থা সত্যিই ভাল নয়। ঠান্ডা বাতাস বইছে আর চারদিক অন্ধকার করে ঘন কালো মেঘ যেন সব কিছু ঢেকে দিচ্ছে। ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি নামল। থামার কোনো লক্ষণ নেই। বৃষ্টিতে মাথায় ছাতা নিয়ে টুকটুক করে এগোতে লাগলাম। তারপর এ পথ সে পথ করে বেলা প্রায় পৌনে ১২টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম দার্জিলিং স্টেশনে।

ট্রেনের অপেক্ষায় আছি
ঘন্টা খানেক কেটে গেলো, ট্রেনের দেখা নেই। বসেই আছি। ট্রেন আর আসে না। অপেক্ষা করতে লাগলাম। স্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি সুন্দর একটা মন্দির। 'ধীরধাম মন্দির!' দার্জিলিঙে প্রচুর মন্দির এবং মঠ রয়েছে। এর মধ্যে ধীরধাম মন্দিরটি দার্জিলিং শহরের প্রাচীনতম হিন্দু মন্দিরগুলির মধ্যে একটি। কাঠমান্ডুর পশুপতিনাথ মন্দিরের আদলে তৈরি এই মন্দিরটি ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। নেপালের কাঠমান্ডুর পশুপতিনাথ মন্দিরের স্থাপত্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে রাই সাহেব পূর্ণ বাহাদুর প্রধান ১৯৩৯ সালে মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন। বৌদ্ধ এবং তিব্বতি স্থাপত্য শৈলীর সংমিশ্রণে তৈরি এই মন্দিরটির ডিজাইন করেছেন বেগ রাজ শাক্য নামে একজন গোর্খা স্থপতি।

ধীরধাম মন্দির
ভাগ্যবিধাতা এবার আমাদের প্রতি সদয় হলেন। মেঘের খামখেয়ালিপনা শুরু, বৃষ্টি উধাও হয়ে আস্তে আস্তে রোদের ঝলক, সাথে ডানপাশে ধোঁয়া সরিয়ে পরিষ্কার হল দার্জিলিঙের ঘন জনবসতি। স্টেশন থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা স্পষ্ট হয়ে উঠল। সেই সৌন্দর্য আর বিশালতা নিজের চোখে না দেখলে বর্ণনায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। একজন যাত্রী বলেই ফেললো 'এই রেল ম্যানেজমেন্টের আজ সময়ানুবর্তী ট্রেন না চলার জন্য এতো সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাওয়ার জন্য রেলমন্ত্রককে এই প্রথম বার ধন্যবাদ জানায়। প্রায় একটা নাগাদ কানে ভেসে এলো ট্রেনের হুইসেল আর ঝিকঝিক শব্দ। ঘুরতেই দেখি একটা ডিজেল ইঞ্জিন টয়ট্রেন ন্যারো গেজ এর লাইন ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। পিছনে নীল রঙের তিনটি বগি। কী অপূর্ব সেই দৃশ্য।

দার্জিলিং স্টেশন থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য
যাইহোক ১:১৫ নাগাদ আমাদের ট্রেন ছাড়ল। ইঞ্জিনের পিছনে নীল রঙের তিনটি ফার্স্ট ক্লাস চেয়ারকার। টু বাই টু সিটিং অ্যারাঞ্জমেন্ট। বড় বড় কাচের জানালায় বাহারি পর্দা ঝোলানো। হুইসেল, ঘণ্টি সব বাজিয়ে ট্রেন ছুটতে শুরু করল তার নিজের গতিতে। হালকা দুলুনি সাথে ফোটোসেশন, পাশে দার্জিলিং, বাড়ির পেট চিরে ট্রেন লাইন, হাত বাড়ানো দূরেতে বাজার, দোকানপাট, লোকজনের যাতায়াত। ব্যাপারটা ভারি মজার! এ গাড়ি যত না এগোয় তার চেয়ে বেশি আওয়াজ করে। তেনজিং নোরগে সরণীর (পুরাতন হিলকার্ট রোড) পাশ দিয়ে ট্রেন চলেছে। এই রাস্তার উপরেও অনেক হোটেল। শহর থেকে বেরিয়েই আবার সেই অপূর্ব পথের শোভা। ঘাসের গালিচার ওপর সারি দিয়ে ফার ও রডোডেনড্রন গাছের সৌন্দর্য্য মন্ডিত রাস্তার এক পাশ দিয়ে চলছে আমাদের ট্রেন। বৃষ্টি শেষে সূর্যের আলো গাছের ফাঁক দিয়ে রাস্তায় পড়ছে এবং অসম্ভব সুন্দর এক দৃশ্যের সৃষ্টি করছে।

সারি সারি পাইন রডোডেনড্রন ফার
চলতে চলতে আমাদের ট্রেন একটা পাক খেয়ে বাতাসিয়া লুপে উঠে এল। দশ মিনিটের বিরতি। ট্রেন থেকে নীচে নামলাম। এখানেও মেঘ কুয়াশার দল আমাদের পিছু ছাড়লো না। বাতাসিয়া লুপ এত সুন্দর আশ মেটেনি সকালে। আর তাই কিছু সময় এখানে এসে কাটানোর ইচ্ছেটা ছিল। এমনিতে এখানে ঢুকতে টিকিট কাটতে হয়। তারপর চারদিক নিজের না ক্যামেরার চোখ দিয়ে দেখি ভেবে বের করতে করতেই সময় পার হয়ে গেল। দু একটা ছবি তুলে ট্রেনে উঠে বসলাম। কিছু গ্রুপ ছবিও তুললাম। পুরো জায়গাটা ঘুরে শেষ করতে না করতেই ট্রেনের হুইসেল বাজলো। ক্যামেরা বন্ধ। যে যার মত দৌড়ে উঠতে লাগল। ট্রেন আবার নড়ে উঠল। এরপর শুধু ট্রেনের হুইসেল আর হালকা দুলুনি। পরের গন্তব্য ঘুম।

বাতাসিয়া লুপ
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাদে ট্রেন ঘুম স্টেশনে ঢুকল। দার্জিলিং এর পথে এটাই সর্বোচ্চ রেলস্টেশন। দার্জিলিং এখান থেকে নীচে নেমে গেছে। জানানো হল আধঘন্টা বাদে আবার ট্রেন ছাড়বে। আমরা ট্রেন থেকে নামলাম। সেদিন ঐ সময়টায় আকাশে মেঘ ছিল। স্টেশনে মেঘেদের আনাগোনা লেগেই থাকল। একদিকে রেল মিউজিয়াম। সেখানে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের শতাব্দী প্রাচীন ‘বি’ ক্লাস স্টিম ইঞ্জিন 'বেবি সিভক' সহ প্যাসেঞ্জার বগি, মালগাড়ির বগি, ট্রলি নানা জিনিস রাখা। মিউজিয়ামের দোতালায় ব্রিটিশ আমলে ব্যবহৃত রেলগাড়ির যাবতীয় সরঞ্জাম, পুরনো আমলের টয় ট্রেনের দুষ্প্রাপ্য ছবি এবং সেই সময়ের টয় ট্রেনের মডেল সাজানো রয়েছে।

বেবি সিভক
দেখতে দেখতেই সময় বয়ে গেল। বেজে ওঠে ট্রেনের হুইসেল! ট্রেন আবার দার্জিলিঙের দিকে চলতে শুরু করল। ফেরার পথেও আর একবার দেখলাম দু'চোখ ভরে বাতাসিয়া লুপের অনাবিল সৌন্দর্য। ট্রেন এবার এখানে থামল না। হুইসল বাজাতে বাজাতে বাতাসিয়া লুপ ঘুরে একটি ছোট্ট টানেল পেরিয়ে হিলকার্ট রোডে নেমে গেলো। এরপর পাহাড়ি পাকদণ্ডী পথ বেয়ে দার্জিলিং স্টেশনের দিকে এগোতে থাকে। সময় এগোল, দার্জিলিংও এসে গেল।

বেজে ওঠে ট্রেনের হুইসেল!
ফেরার পথে স্টেশন থেকে চড়াই ভেঙে হেঁটে আসতে আমরা হাঁপিয়ে উঠি। হোটেল ঢুকে একটু রেস্ট নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম কেনাকাটা করতে। পাশেই রিঙ্ক মল, ড্রাগন মার্কেট আর মহাকাল মার্কেট। টুকটাক কেনাকাটা সেরে হোটেলে ফিরলাম। হোটেলে ফিরে রাতের খাবার খেয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলাম। পরদিন সকাল সাড়ে ৭ টা নাগাদ হোটেল থেকে চেকআউট করে বেরিয়ে পড়লাম সিকিমের দিকে। গন্তব্য 'পেলিং'! মোটের উপরে এবারের দার্জিলিং ট্যুরটা ভালোই ছিল। 'দীপুদা'-র ডাকে একবার নয়, দু'বার নয়! বারবার আসবো এই 'দার্জিলিং!' এ।

মহাকাল মার্কেট ও ড্রাগন মার্কেট
» অনেকেই দার্জিলিং গিয়ে টয়ট্রেনে চড়ে জয় রাইডের আনন্দ নিতে চায়। দার্জিলিং-ঘুম-দার্জিলিং এই জয় রাইড কিভাবে বুকিং দেয়া যায় তার বিবরণ এখানে দিলাম
ভারতীয় রেলের বুকিং কাউন্টার থেকে সরাসরি টিকিট বুক করা যায়। অনলাইনে IRCTC-র ওয়েবসাইট থেকেও টিকিট কাটা যায়। দুটো স্টেশন এক হলেও কোড আলাদা তাই প্রথমে From Station দার্জিলিং (DJ) সিলেক্ট করতে হবে এবং পরে Destination Station দার্জিলিং (DJRZ) সিলেক্ট করতে হবে। ডিজেল ইঞ্জিন এবং স্টিম ইঞ্জিন দু’রকমের জয় রাইড আছে। দার্জিলিং থেকে ঘুম পর্যন্ত নিয়ে যাবে এবং আবার দার্জিলিং-এ ফেরত আনবে।
বর্তমানে টয়ট্রেনের জয় রাইডের জন্য ভাড়া
  • ডিজেল ইঞ্জিন ফার্স্ট ক্লাস: ১০০০ টাকা
  • স্টিম ইঞ্জিন ফার্স্ট ক্লাস: ১৫০০ টাকা
» প্রয়োজনীয় তথ্য
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল
Arabinda Pal
2 Comments
Share This Post :

You Might Also Like

2 comments:

  1. দীপুদা, দারুন লিখেছেন। আমি অবশ্যই চক বাজার থেকে কেনাকাটা করবো।

    ReplyDelete
  2. তবে একটু দরদাম করে কেনাকাটা করতে হবে।

    ReplyDelete

[name=Arabinda Pal] [img=https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEia50rmuKEAcbGUbQKvAbzUmdviiIhm-LeVlsEEdFx_xtGfyvx8O02yFVuJemgswzSA8PoMcN-XW0AcinKr9iq28lHK43Z4TFFyL7pJyGGxLNx9LGn0cLvPz0lUJzNrWBo9n_NyxGLjDII/h120/IMG_2788.jpg] [description=পর্যটক হিসাবে নয়, একজন ভ্রমণকারী হিসাবে বেড়ানোটা আমার কাছে একটা নেশা এবং ফটোগ্রাফিতেও আমার ভীষণ শখ। তাই একজন ভ্রমণকারী হিসাবে আমার এই ব্লগে নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে লেখা ও ছবিগুলো যদি আপনাদের ভালো লাগে তাহলে অবশ্যই আপনাদের মতামত কমেন্টসের মাধ্যমে জানাতে ভুলবেন না।] (facebook=https://www.facebook.com/groups/2071066419824586/user/100002484831922) (twitter=Twitter Profile Url) (instagram=https://www.instagram.com/arabindapal2020/) (bloglovin=Blogvin Profile Url) (pinterest=https://www.pinterest.com/arabindapalbrb/) (tumblr=Tumblr Profile Url)

Follow @Arabinda Pal