'দলমা পাহাড়' — গল্প, উপন্যাসে পড়েছি যেখানে দামাল হাতিদের রাজত্ব, এবার ডেস্টিনেশন সেখানে। দলমা পাহাড়ের হিল টপ পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। এই প্রথম গাড়ি চালিয়ে কোনো উঁচু পাহাড়ে ওঠার অভিজ্ঞতাটা মন্দ হল না। সত্যি বলতে, ঘুরতে যাওয়াটা আমার কাছে এখন যেন একটা নেশার মতো হয়ে যাচ্ছে। মাস খানেক আগে স্বরূপ ও সুখেনের সাথে ঘাটশিলা থেকে ঘুরে এসেছি। জীবনের হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও একটুখানি সময় করে উইকএন্ডে বেরিয়ে পড়ার একটা প্রবণতা রয়েছে আমার ও উৎপলের। তাই এবার উইকএন্ড ট্যুরের জন্য উপযুক্ত জায়গা হিসেবে বেছে নিলাম জামশেদপুরকে। এখান থেকে ডিমনা লেক, দলমা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি ও চান্ডিল ড্যাম ঘুরে নেবো। ঘরের কাছে দু' দিনের জন্য এর থেকে ভালো কী হতে পারে। মুম্বাই রোড ধরে সোজা রাস্তায় গেলে সময় একটু কম লাগে। কিন্তু এবারের জার্নিটা একটু অন্যরকম ভাবে চাইছিলাম। গুগল ম্যাপের সাহায্য নিয়ে দেখলাম পুরুলিয়ার বান্দোয়ান হয়ে দলমা পাহাড়ের গা ঘেঁষে ডিমনা লেক এর ধার দিয়ে জামশেদপুর যাওয়া যায়। রাস্তা কম হলেও সময় প্রায় একই লাগবে। ঠিক করলাম এবারের জার্নি হবে ঐ পথেই।
 |
| দামাল হাতির রাজত্ব |
প্ল্যান মাফিক সাত সকালে আমি আর উৎপল দুজনে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। নিজে গাড়ি চালিয়ে রোড ট্রিপ তুলনাহীন, না গেলে সেটা বোঝা যায় না। রানীবাঁধ হয়ে কুটমণিপুর অনেকবার গিয়েছি। এবছরের শুরুতে আরও একবার ঘুরে এসেছি। ফলে রানিবাঁধ যাওয়ার এই রাস্তাটা বেশ পরিচিত। খাতড়া-রানীবাঁধ রোডে আঁকখুটা মোড় পার হয়ে সোজা এগোচ্ছে আমাদের গাড়ি। আঁকখুটা থেকে ডান দিকের রাস্তাটা অম্বিকানগর হয়ে চলে গিয়েছে মুকুটমণিপুর ড্যামে। রানীবাঁধে এসে একটা ছোট্ট ব্রেক নিলাম। বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটা খাবারের দোকান দেখতে পেয়ে দাঁড়ালাম। পেটাই পরোটা, ঘুগনি আর রসগোল্লা দিয়ে সেখানেই ব্রেকফাস্ট সারলাম। স্বাদ! সেটা আর নাই বা বললাম। ফের গাড়ি ছুটল। রানিবাঁধ শহর ছাড়িয়ে ঢুকে পড়লাম সুতানের জঙ্গলে। শুরু হল পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্যে পথ চলা। ঝিলিমিলির 'বারোমাইল' জঙ্গলের একটা অংশ এই সুতানের জঙ্গল। গাড়ি ছুটছে দু’পাশে জঙ্গলমোড়া পথ দিয়ে। মাঝে মধ্যে দু'একটা মোরাম বিছানো সরু পায়ে চলা পথ চলে গিয়েছে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কোনো এক গ্রামে। সুতানের জঙ্গলকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি কুইলাপাল হয়ে বান্দোয়ানের পথে। গত বছর
ঝিলিমিলি বেড়াতে এসে কুইলাপালের যমুনা ব্রীজ দেখে গিয়েছিলাম।
 |
| যমুনা জোড় সেতু |
এবার কুইলাপাল ছাড়িয়ে বান্দোয়ান চলে এলাম। এই অঞ্চলটি মূলত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস। বান্দোয়ান পেরিয়ে এবার আমাদের বাঁদিকের রাস্তা ধরে যেতে হবে। এটাই ডিমনা হয়ে টাটা জামশেদপুরে যাবার রাস্তা। কিছুটা যেতেই আশেপাশে দোকানের বোর্ডগুলোর ভাষা বদলে গেল। বুঝতে পারলাম আমরা ঝাড়খন্ডে ঢুকে পড়েছি। কাটিন এর কাছে টার্ন নিয়ে পটমদার পথ ধরে ছুটছে গাড়ি। দুরের দলমা পাহাড়ের রেঞ্জটা এখন যেন আমাদের দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে। পটমদা মোড় পেরোতেই শুরু হল রাস্তার দুপাশে জঙ্গল। গাড়ি এগিয়ে চলেছে দলমা পাহাড়ের গা ঘেঁষে। ডিমনার ঠিক আগে সিধু কানহু চকে একটা ছোটো গুমটি মতো চায়ের দোকান দেখে দঁড়ালাম। সকাল থেকে চা খাইনি। চায়ের নেশায় মাতোয়ারা বাঙালি মনটা চা চা করছে। চোখের সামনে পাহাড় দেখতে দেখতে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। ছোটনাগপুর মালভূমির এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কোন হিল ষ্টেশনের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। প্রাণ ভরে কিছুটা সময় প্রকৃতির এই অপূর্ব সৌন্দর্যেকে উপভোগ করলাম এবং সঙ্গে থাকা ক্যামেরায় সেই নৈসর্গিক দৃশ্য ফ্রেমে বন্দী করলাম।
 |
| সিধু কানহু চকের মোড় – ডিমনা |
চা পান করে দশ মিনিটের মধ্যে হাজির হলাম ডিমনা লেকের পাড়ে। দেখি কেউ কাপড় কাচছে, কেউ সাঁতার কেটে স্নান করছে, কেউবা লেকের পাড়ের জমিতে গাড়ি ধুচ্ছে। ঘন নীল রঙের জলে পরিপূর্ণ এই লেকটিকে প্রহরীর মতো ঘিরে রেখেছে চার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দলমা পাহাড়ের দল। লেকটি আকারে অনেকটাই বড়। এর একধারে লক্ষ্য করলাম প্রচুর পদ্ম ফুল ফুটে রয়েছে যা লেকের সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
 |
| চলে এলাম ডিমনা লেকের পাড়ে |
শহর থেকে একটু দূরে, তাই জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। পিকনিকের আদর্শ জায়গা। কলেজ লাইফে একবার এখানে পিকনিক করতে এসেছিলাম। সেই ঝাপসা স্মৃতি আজও মনের কোণে রয়েছে গেছে। খানিক যেতেই হাজির হলাম এক্কেবারে ড্যামের সামনে। গাড়ি পার্কিং প্লেসে রেখে এগিয়ে গেলাম লকগেটের দিকে।
 |
| পার্কিং প্লেসে গাড়ি রেখে এগিয়ে গেলাম |
এই লেকের জলকে ব্যবহার করে এখানে গড়ে তোলা হয়েছে একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট যা সমগ্র জামশেদপুর শহরের পানীয় জলের চাহিদা পূরণ করে। ড্যাম থেকে লেকের জল যেখানে ছাড়া হয় সেই জায়গাটা পুরোটাই সিমেন্টের বাঁধানো। স্থানীয় দু'একটা ছেলে ঐ লকগেটের সামনে সামান্য জলে লাফালাফি করছে। দূরে আবছা দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের সারি। চললো ক্যামেরার কারসাজি। ড্যামের উপর ওঠার জন্য লকগেটের পাশ দিয়ে সরু একটা সিমেন্টের সিঁড়ি করা আছে, সেই সিঁড়ি বেয়ে ড্যামের মাথায় উঠতে হবে। বেশ খাড়াই, অনেক কষ্টে সেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম।
 |
| সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম |
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দেখি এক বিশাল লেক। এই লেকই জামশেদপুর শহরের জলের ভান্ডার। মূলত বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে রাখা হয় এই লেকে। এছাড়া সুবর্ণরেখা ও খড়কাই নদীর জল খাল বেয়ে এসে জমা হয় এই ডিমনায়। পর্যটক প্রায় নেই, লেক এর পাশে বাঁধানো রাস্তা। তিনদিকে ধূসর সবুজ পাহাড়ের মাঝে এক কৃত্রিম জলাশয় এই ডিমনা লেক।
 |
| ড্যামের ওপর দাঁড়িয়ে |
ডিমনা লেকের আয়তন বড় হলেও ঘোরার জায়গা শুধু ঐ ড্যামের রাস্তাটুকুই। দূরে সবুজ পাহাড় আর এর নীল জল যেন একসাথে মিলেমিশে গেছে। লেকের জলে পাহাড়ের ছায়া সত্যি অপরূপ। পাহাড়,জল আর আকাশের এই খেলায় জায়গাটি এক মায়াবী রূপে পরিণত হয়েছে। লেক আর পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে চোখ সার্থক। এক অজানা অচেনা আনন্দে মন ভরে উঠল। লেকের অপরূপ দৃশ্যগুলো একের পর এক লেন্সবন্দি করতে লাগলাম।
 |
| লেকের অথৈ জলরাশি |
লেকের আশেপাশে কোন খাবারের হোটেল নেই, এদিকে পেটে প্রচণ্ড খিদে। খানিকক্ষণের মধ্যে দেখি উৎপলের হাতে দুটো ঠোঙা, এক মুড়িওয়ালাকে আবিষ্কার করে ঝালমুড়ি নিয়ে হাজির। প্রায় ঘন্টা খানেক ওখানে কাটিয়ে চলে এলাম জামশেদপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র সাকচি এলাকায়।
 |
| ড্যামের রাস্তা |
জামশেদপুরে এসে রাত কাটাবো কোথায়? হোটেলের ব্যবস্থা আগে করতে হবে। ভ্রমণের সবচেয়ে ঝামেলাপূর্ণ ব্যাপার হলো হোটেল রুম বুক করা। আগে থেকে হোটেল বুকিং না থাকায়, রুম পেতে অনেকখানি বেগ পেতে হয়েছে। বিয়ের অনুষ্ঠান থাকার জন্য বেশিরভাগ হোটেলের রুম আগে থেকেই বুকড হয়ে গেছে। শহরের স্টার ক্যাটাগরি হোটেল থেকে শুরু করে সাধারণ মানের হোটেলগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখলাম কোথাও রুম খালি নেই। এতটা সমস্যা হবে বুঝতে পারিনি, নইলে আগে থেকেই হোটেল বুক করে আসতাম।
 |
| হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম জুবিলি পার্কে |
হোটেলের রুম ফাঁকা আছে কিনা জানার জন্য এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি। অনেকক্ষন খোঁজাখুঁজির পর সাকচিতে আমবাগান ময়দান এর উল্টোদিকে একটা হোটেলে রুম পেলাম। 'হোটেল অল সিজন্স', আমাদের আজকের রাতের আস্তানা। এতটা পথ অতিক্রম করায় বেশ ক্লান্ত লাগছিল। চেক ইন করে ব্যাগপত্র রেখে মার্কেটের কাছে 'হোটেল আহারে' গিয়ে দুপুরের লাঞ্চ সেরে একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম। বিকেলের দিকে হোটেল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম জুবিলি পার্কে।
 |
| জুবিলী পার্কের মুঘল গার্ডেন |
মাইসোরের বৃন্দাবন গার্ডেনের আদলে তৈরি জুবিলী পার্কের এই মুঘল গার্ডেনটি জামশেদপুরের অন্যতম আকর্ষণ। পার্কটি পর্যটকদের জন্য সম্পূর্ণ উন্মুক্ত, কোনো প্রবেশ মূল্য নেই। সুন্দর ফোয়ারায় সাজানো বাগান, ছোট ছোট ঘাসের মধ্যে হেঁটে বেড়ানোর অনুভূতি অন্যরকম। পার্কের একদিকে জামশেদজী টাটার একটি মূর্তি রয়েছে তার চারপাশ রকমারি মরসুমী ফুলের গাছে রঙিন হয়ে উঠেছে।
 |
| পার্কের একদিকে জামশেদজীর মূর্তি |
দেখতে দেখতে বিকেলের শেষ আলোর হাত ধরে সন্ধ্যা নেমে এলো। পার্কের ভিতরে একটা বেঞ্চে বসে আছি। এক চা-ওয়ালা চা নিয়ে উপস্থিত। এই চা-ওয়ালা, এক কাপ চা দাও দেখি। হাল্কা শীতের সন্ধ্যায় চায়ের জুড়ি নেই। শুরু হলো ফাউন্টেইন শো। এটাই পার্কের সেরা আকর্ষণ।
 |
| সুন্দর ফোয়ারায় সাজানো বাগান |
ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে ছ'টা বাজতেই আলো জ্বলে উঠল, রঙিন হয়ে উঠল ফোয়ারার জল। পুরো এলাকা জুড়ে চলছে তখন রঙিন আলোর ঝলকানি। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সেই মনোরম দৃশ্য উপভোগ করছি। চোখ সরাতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু রাত বাড়ছে, এবার ফিরতে হবে। মার্কেটেই একটা রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে ফিরে এলাম হোটেলে। দেরি না করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরিই হল। ঠিক করলাম দলমা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি যাওয়ার আগে চান্ডিল ড্যামটা ঘুরে নেবো। সুবর্ণরেখা নদীর উপরে অনেকগুলি ড্যাম আছে। তার মধ্যে ঝাড়খণ্ডের সরাইকেলা-খারসোয়ান জেলার চান্ডিল অন্যতম। এখানে সারা বছরই পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। শুনেছি জায়গাটা খুব নির্জন, তাই দিনের আলো থাকতে থাকতে চান্ডিলটা ঘুরে নিতে হবে।
 |
| চান্ডিল ড্যাম |
ব্যাগপত্র গুছিয়ে হোটেল থেকে রওনা দিতে প্রায় সাড়ে আটটা বেজে গেলো। হ্যাঁ, একটু দেরি হয়ে গেল। শুরু হলো আজকের সফর। সাকচির জুবিলি পার্কের গেটের সামনে দিয়ে মানগো চক হয়ে জামশেদপুর ছেড়ে আমরা এসে পড়লাম ন্যাশনাল হাইওয়েতে। হাইওয়ে ছেড়ে দোমুহানি ব্রিজ পেরিয়ে রাঁচী রোড ধরে দলমা পাহাড়শ্রেণিকে সঙ্গী করে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি। কিছুটা যাওয়ার পর ওই রাস্তা ছেড়ে বাঁদিকে টার্ন নিয়ে পুরুলিয়া রোড ধরলাম। খানিক পরেই ভালো রাস্তার শেষ, ভাঙাচোরা রাস্তা শুরু। যাই হোক, নির্বিঘ্নে চান্ডিল শহরে চলে এলাম।
 |
| চান্ডিল লেকের সামনে দাঁড়িয়ে |
চান্ডিলের চকবাজার মোড় থেকে বাঁ-দিকের ড্যাম রোডে ঢুকে পড়লাম। ঘনবসতি আর বাজার এলাকা ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই ড্যামের লকগেটগুলো নজরে পড়ল। ড্যামের আগে একটা বড় সাইনবোর্ড দেখে দাঁড়ালাম। ডানদিকের রাস্তাটা চলে গিয়েছে বোটিং কমপ্লেক্সের দিকে। নীচে একপাশে দেখা যাচ্ছে চান্ডিল ড্যামের বিশাল জলরাশি। বোটিং কমপ্লেক্সের রাস্তা ধরে খানিকটা এগোতেই আমরা পৌঁছে গেলাম এক মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক শোভার মাঝে।
 |
| বোটিং কমপ্লেক্সে যাওয়ার রাস্তা |
চান্ডিল লেকে যাওয়ার এই রাস্তাটা শুনশান ফাঁকা। রাস্তায় লোকজন চলাচল করছে বটে, তবে সংখ্যায় অনেক কম। দেখতে দেখতে এক সময়ে আমরা চলে এলাম লেকের ধারে। প্রকৃতপক্ষে এই চান্ডিল লেক হল সুবর্ণরেখা নদীর উপর তৈরি এক বিশাল জলাধার। লেকের ধারে পার্কিং স্পেসে গাড়ি রাখলাম। পাশেই একটা ছোট্ট হোটেল চোখে পড়ল, নাম 'লাকি হোটেল'। খোলা আকাশের নিচে চমৎকার বসার ব্যবস্থা। দু'কাপ চা নিয়ে দিব্যি খোসমেজাজে লেকের পাশে চেয়ার পেতে বসে আছি। বাহ! এখান থেকে ভিউটা তো চমৎকার। চারিদিকে অথৈ জল। আকারে এতটাই বৃহৎ এই লেক যার একূল ওকূল কিছুই দেখা যায়না। আশপাশে উঁকি দিচ্ছে ঘন সবুজ দলমা পাহাড়। হালকা জঙ্গল আর লেকের মাঝে ছোট-বড় টিলায় ঘেরা এক অদ্ভুত নীল জলরাশি।
 |
| চান্ডিল লেক বোটিং কমপ্লেক্স |
সকালের ব্রেকফাস্ট হয়নি, খিদের চোটে মাথা ঘুরছে প্রায়। হোটেলে গরম গরম খাবার তৈরি হচ্ছে দেখে লেকের জ্যান্ত রুই মাছ ভাজা আর রুটি সব্জীর অর্ডার দিলাম। বেলা বাড়ার সঙ্গে কুয়াশার চাদর একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। লেকের জলে দূরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলে দলমা পাহাড়ের চূড়াগুলো আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। হালকা হাওয়ায় জলের উপর সমুদ্রের মতো ছোট ছোট ঢেউ উঠে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। একপাশে ড্যাম আর অন্যদিকে জলের মাঝে ছোট ছোট পাহাড়ের উপস্থিতি এর সৌন্দর্য্যকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। দু'একটা পিকনিক পার্টি ছাড়া এখনো পর্যটকদের আনাগোনা তেমন দেখা যাচ্ছেনা।
 |
| কূলে একা বসে আছি, ছোট্ট এক নৌকায় |
চান্ডিল লেকে বোটিং-এর ব্যবস্থাও রয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম বোটিং পয়েন্টে। এত সুন্দর একটা জায়গায় এসে যদি বোটে রাইড না করি তাহলে প্রকৃতির সৌন্দর্যটাই উপভোগ করা যাবে না। লেকের ধারে তখন যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি স্পিড বোট। চারজনের বসার ব্যবস্থা রয়েছে প্রতিটি বোটে।
 |
| চলে এলাম বোটিং পয়েন্টে |
বোটিং চার্জ জনপ্রতি একশ টাকা। দুটো টিকিট কেটে আমি আর উৎপল উঠে পড়লাম। আমাদের সঙ্গে আরও দু'জন যাত্রী উঠে বসলো। ভেসে পড়লাম লেকের জলে। মনোরম প্রকৃতি আর মন ভোলানো লেকের বুকে স্পীড বোটে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর মজাটাই যেন আলাদা। অল্প কিছুক্ষনের তবে বেশ এনজয় করলাম। হাতে সময় কম তাই আমরাও এক মুহূর্ত দেরি না করে রওনা দিলাম পরের গন্তব্য দলমা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি এর দিকে।
 |
| ভেসে পড়লাম লেকের জলে |
ফেরার সময় চান্ডিল না গিয়ে উল্টো দিকে লকগেটের রাস্তা ধরলাম। লকগেটের সামনে কজওয়ে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে খুব কম সময়েই এসে পড়লাম হাইওয়েতে। হাইওয়ে ধরে চলেছি কোলকাতার দিকে। পথে কিছুটা দূর এগিয়ে যাওয়ার পর শাহরবেড়ার কাছে চোখে পড়লো 'দলমা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি' এর সুন্দর একটা গেট।
 |
| কজওয়ের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেছি |
বেশ কিছু বন্যপ্রাণীর অশ্রয়স্থল এই স্যাংচুয়ারি। হাইওয়ে থেকে বাঁদিকে টার্ন নিয়ে গেটের কাছে গাড়ি দাঁড় করে কয়েকটা ছবি তুলে চললাম হিলটপ এর পথে। ছবির মতো ছোট ছোট পাহাড় আর খেতের মাঝখান দিয়ে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে চলেছি। রাস্তার ধারে হরিণ আর হাতির ছবি দেওয়া বড় বড় বোর্ড দেখা গেল।
 |
| 'দলমা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি'–র গেট |
 |
| চলেছি দামাল হাতির দেশে |
কিছুটা যাওয়ার পর একটা খাল পেরিয়ে ডানদিকে মোড় নিলাম। এরপর সামান্য এগিয়ে যেতেই পৌঁছে গেলাম মাকুলাকোচায়। ঢোকার আগে স্যাংচুয়ারির গেটের মাথায় একটা হাতির মূর্তি শুঁড় তুলে জানালো – "ইউ আর ওয়েলকাম টু আওয়ার এরিয়া"। গাড়ি থেকে নেমে দেখি সামনে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অফিসের কাছে দু'টো কুনকি হাতি শিকল দিয়ে বাঁধা। হিলটপ এখান থেকে আরও তেরো কিলোমিটার। হিলটপ পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য স্পট পারমিট পাওয়া যায়। চেকপয়েন্টের গেটে ঝাড়খণ্ড ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অফিস থেকে পারমিট করে নিলাম।
 |
| মাকুলাকোচা চেকপয়েন্ট |
ঢুকে পড়লাম দামাল হাতির রাজত্বে। চেকপয়েন্ট পেরিয়ে কিছুদূর এগোতেই বাঁয়ে পড়লো ডিয়ার রেসকিউ সেন্টার। গাড়ি চালিয়ে ক্রমশ হিলটপের দিকে এগিয়ে চলেছি, কিছুক্ষনের মধ্যেই জনপদ ছেড়ে পৌঁছে গেলাম জঙ্গলের মধ্যে। গাড়িও সমতল ছেড়ে পাহাড়ি পথ নিল। সরু মোরাম আর নুড়ি পাথর বিছানো খাড়াই পথ উঠেছে ঘুরে ঘুরে। মাঝেমধ্যে কিছুটা কংক্রিটের রাস্তা। যত উপরে উঠছি জঙ্গল তত ঘন হচ্ছে এবং রাস্তাটাও খাড়া হয়ে উপরে উঠছে। পথটা বেহাল হলেও বেশ রোমহর্ষক, বন্যপ্রানী দেখার একরাশ আশা বুকে বেঁধে এগোতে থাকলাম। ধীরে ধীরে জঙ্গলের গা-ছমছমে ভাবটা অনুভূত হতে লাগল। শুনেছি হাতির জন্যই এই অঞ্চল বিখ্যাত। না, যাতায়াতের পথে কোনো হাতির দেখা পাইনি। হয়তো রবিবার ওদের ছুটির দিন তাই বেরোয়নি !!
 |
| দামাল হাতির দেশে অতিথি হাজির |
মাকুলাকোচা থেকে কিছুটা এগোতেই চোখে পড়ল পিন্ডরাবেড়া ফরেস্ট রেস্ট হাউস, এখান থেকে পুরো জামশেদপুর শহরের সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়। হিলটপ আরও পাঁচ কিলোমিটার বাকি, সেখানে দু'টো মন্দির আছে। এর পর পথ আরও খাড়াই। রবিবার থাকায় ভালোই পর্যটক ছিল। বেলা বারোটা নাগাদ আমরা যখন হিলটপে উঠছি তখন উল্টোদিক থেকে পরপর পর্যটকদের গাড়ি নীচে নেমে আসছে। খাড়াই রাস্তার একটা ইউ টার্নের মুখে এরকম একটা গাড়ি হঠাৎ সামনে এসে গেলো, ভয়ে জোরে ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করলাম। একে খাড়াই তার উপর আলগা নুড়িপাথরে ভরা... চাকা পিছলে টাল খেয়ে গেল। যাক কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। হিলটপে পৌঁছানোর কিছুটা আগে রাস্তার ধারে পাহাড়ি গুহায় দলমা মাতার মন্দির দর্শন করলাম।
 |
| দলমা মাতার মন্দির |
দলমা মাতাকে প্রণাম নিবেদন করে খাড়াই পাহাড় আর আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে প্রায় ঘন্টা দেড়েক বাদে পৌঁছে গেলাম হিলটপে। দলমা পাহাড়ের ওপরটাই একটা চাতাল মতো আছে ফলে ওখানে গাড়ি পার্কিং করতে কোনো অসুবিধা হলো না।
 |
| হিল টপে পার্কিং লট |
হিলটপে পর্যটকদের মুগ্ধ করার মতো তেমন কিছু নেই। খুব একটা আকর্ষক মনে হলো না, তবে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ে ওঠার আনন্দই আলাদা। দলমা পাহাড়ের মাথায় ছোট্ট গুহার মধ্যে আছে একটি শিবের মন্দির আর রামসীতার মন্দির। সেখানে যেতে ভাঙতে হবে বেশ কিছু খাড়াই সিঁড়ি।
 |
| মন্দির চত্বরে দোকানপাট |
সাবধানে পা ফেলে সিঁড়ি ভেঙে একটু এগোতেই পাথরের খাঁজে গুহার মাঝে মহাদেবের দর্শন পেলাম। মন্দির ছাড়িয়ে আরো খাড়াই সিঁড়ি ভেঙে হাঁপাতে হাঁপাতে একদম পাহাড়ের চুড়ায় একটা ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। এখানে ট্যুরিস্ট নেই বললেই চলে।
 |
| মহাদেবের দর্শন সেরে আবার ওঠা |
ওয়াচ টাওয়ারের সামনে আরও একটা খাড়াই সিঁড়ি। এবার সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম একেবারে পাহাড়-টঙে হনুমান মন্দিরে। হনুমান মন্দির পর্যন্ত পৌঁছতে প্রায় নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। কে বা কারা এখানে পূজো করতে আসে জানি না।
 |
| পাহাড়-টঙে হনুমান মন্দিরের পথে |
সিঁড়ি গুলো এতটাই খাড়া যে বাচ্চা এবং বয়স্কদের জন্যে হনুমান মন্দিরে যাওয়া বেশ কঠিন। তবে মন খারাপ করার কিছু নেই পাশেই মায়ের মন্দির আছে আর তার ঠিক পেছনেই রয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার। ওয়াচ টাওয়ার থেকে পুরো জামশেদপুর শহরটাকে দেখা যায়।
 |
| হিল টপের ভিউ পয়েন্ট |
শুনেছি দলমা হিল টপ যাওয়ার সময় ভাগ্য ভালো থাকলে অনেক জন্তু জানোয়ারের দেখা মেলে। যদিও এখানে কোনও বন্যপ্রাণী দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। তবে প্রকৃতির যে রূপ দেখেছি তা অনবদ্য। যেদিকে তাকায় শুধু সবুজ আর সবুজ। অনেক নীচে দেখা যাচ্ছে ছোটো ছোটো পাহাড় ঘেরা মালভূমি। এই দৃশ্যপট ক্যামেরা বন্দী করার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। শেষে যেটার কথা বলতে হবে সেটা হল এখানে বাঁদরের বড্ড উৎপাত।
 |
| দাঁড়িয়ে আছি হিল টপে |
ফটোসেশন আর ঘুরে দেখতে বিকেল হয়ে গেলো, ফিরে আসতে মন চাইছিলো না। ফিরতে তো হবেই, তাই 'মন চলো নিজ নিকেতন' বলে চটপট ভোলে বাবার কাছে মাথা ঠেকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেলাম গাড়ির কাছে। উৎপলকে এবার স্টিয়ারিংয়ে বসিয়ে গাড়িতে পাশের সিটে বসলাম। খাড়া পাহাড়ের উতরাই ধরে নেমে এলাম মাকুলাকোচায়। স্যাংচুয়ারি ছেড়ে দলমা পাহাড়কে পিছনে ফেলে ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে রাতের অন্ধকারে আমাদের গাড়ি ছুটে চলল খড়্গপুরের দিকে।
 |
| চলছে ফটোসেশন আর ঘুরে দেখা |
» প্রয়োজনীয় তথ্যদলমার এই স্যাংচুয়ারিতে ঢোকার জন্য পারমিট নিতে হয়। ঢোকার মুখে মাকুলাকোচা চেকপয়েন্টের গেটে ঝাড়খণ্ড ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অফিস থেকে পারমিট পাওয়া যায়। দলমার হিলটপ পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। সঙ্গে আইডেন্টিটি প্রুফ রাখা খুবই দরকার। ভালো ড্রাইভিং না জানলে নিজে চালিয়ে পাহাড়ে ওঠার ঝুঁকি নেওয়া উচিত হবে না। পথে হাতি পড়লে গাড়ি দাঁড় করাবেন, কিন্তু স্টার্ট বন্ধ করবেন না, ওরা সরে গেলে তবেই যাবেন। মনে রাখবেন আপনারা এখানে ওদের অতিথি। এখানে এন্ট্রি ফি ২ টাকা এবং ছোটদের জন্য ১ টাকা, প্রাইভেট কারের জন্য লাগবে ৮০ টাকা। ফটোগ্রাফির জন্য স্টিল ক্যামেরা ৫০ টাকা এবং ভিডিও ক্যামেরা ২০০ টাকা। স্মার্টফোনে ছবি তোলার জন্য কোনো ফি দিতে হয় না।
» 'দলমা ওয়াইন্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি' খোলার সময়সকাল ৬ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত্য স্যাংচুয়ারি খোলা থাকে
» থাকার ব্যবস্থাদলমা ওয়াইন্ডলাইফ স্যাংচুয়ারিতে দুটি রেস্ট হাউস অছে। পাহাড়ের পাদদেশে মাকুলাকোচা ফরেস্ট রেস্ট হাউসে ট্যুরিস্টদের থাকার ব্যবস্থা থাকলেও পাহাড়ের একদম মাথায় পিন্ডরাবেড়ায় থাকার অ্যাডভেঞ্চারই আলাদা। ডাইরেক্ট বুকিং-এর জন্য যোগাযোগের ঠিকানাঃ- 'ফরেস্ট রেঞ্জ অফিস', মানগো (পায়েল টকিজের উল্টোদিকে), জামশেদপুর অথবা ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিস, ডোরান্ডা, রাঁচি।
» 'ঝাড়খন্ড ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট অফিস' এর ফোন নম্বর
➊ জামশেদপুর ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসঃ- +৯১ ৯৩০৪৩২৩১১০❷ রাঁচি ডিভিশনাল ফরেস্ট অফসঃ- +৯১ ৬৫১২৪৮০৯৪৮
» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল
DALMA, CHANDIL LAKE, JUBILEE PARK, DIMNA, TATANAGAR, JAMSHEDPUR, JHARKHAND
You Might Also Like
Weekend getaway
No comments:
Post a Comment