Theme Layout

Boxed or Wide or Framed

Theme Translation

Display Featured Slider

Yes

Featured Slider Styles

[Centred][caption]

Display Grid Slider

No

Grid Slider Styles

[style5][caption]

Display Trending Posts

Display Author Bio

Yes

Display Instagram Footer

Yes

Dark or Light Style

পুরী-কোণার্ক সেলফ ড্রাইভ লং ট্যুর!


কোণার্ক মন্দির

শৈশবের আনন্দের ছোঁয়া ও ভ্রমণের হাতেখড়ি 'পুরী' দিয়েই শুরু। বাঙালির নস্টালজিয়ার পুরী অবস্থানগত ভাবে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে হলেও আদ্যোপান্ত বাঙালিয়ানায় পরিপূর্ণ। একাধিক বার পুরী গিয়েছি। তবে প্রতিবারই ট্রেনে করে। এবারের পুরী ভ্রমণের পরিকল্পনা অন্যরকম। বছর চারেক হলো আমার গাড়ি কেনা। নিজে ড্রাইভ করে জীবনের প্রথম ট্যুর ছিল দীঘা। তারপর একটু একটু করে দূরে পাড়ি দিতে থাকলাম। মুর্শিদাবাদ থেকে পুরুলিয়া প্রায় দক্ষিণবঙ্গ নিজে গাড়ি চালিয়ে ঘুরেছি। অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল লং ড্রাইভে যাওয়ার। তাই এবার ঠিক করলাম সেলফ ড্রাইভ রোড ট্রিপে পুরী যাবো। হাতের কাছে পুরীর সমুদ্র আমার বেশ লাগে। এতদূর রাস্তা একা যেতে ভীষণ একঘেয়েমি লাগে। আমার অফিস কলিগ অরিন্দম ও সৌমেন দুজনেই নতুন গাড়ি কিনেছে। লং-ড্রাইভের কথাটা শুনেই অরিন্দম লাফিয়ে উঠলো, ওর খুব ইচ্ছে জাগলো যাওয়ার। কত দিনের সাধ এমন একটা লং ড্রাইভের। নিজে ড্রাইভ করে বেশ কয়েকবার ট্যুর করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো লং ড্রাইভ হয়নি অতএব দারুন একটা রোমাঞ্চকর ড্রাইভ হবে এটা! অরিন্দম ড্রাইভিংটা ভালোই জানে আশেপাশে বেশ কয়েকটি জায়গা ঘুরেও এসেছে। কিন্তু সমস্যাটা হলো সৌমেনকে নিয়ে। নতুন ড্রাইভিং শিখেছে তার উপর লাইসেন্সও হয়নি। সৌমেন আগে কোনো দিন পুরী যায়নি তাই নতুন গাড়ি কিনে যাওয়ার ভীষণ শখ। বললো সঙ্গে ড্রাইভার নিয়ে যাবে। তিনজনে মিলে আলোচনা করে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা ও দিনক্ষণ সব পাকা করে ফেললাম। সেইমতো সপ্তাহ তিনেক আগে অরিন্দম কোলকাতার অফিস থেকে 'পুরী হোটেলে'র তিনটে রুম বুকিং করে ফেললো। সৌমেন ড্রাইভারও ঠিক করে ফেললো।

পুরী হোটেল
যাওয়ার দু'দিন আগে কেনাকাটা করে ফিরছি হঠাৎ রাস্তায় অরিন্দমের ফোন এলো। এক্সিডেন্টে অরিন্দমের ডান হাতের আঙুলে চোট লেগেছে, তবে মারাত্মক কিছু নয়। তাহলে কি যাওয়া হবে না! আমাদের মন খুবই ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। রাতে আমি সৌমেনকে নিয়ে অরিন্দমের বাড়িতে গেলাম। আঙুলের অবস্থা দেখে বুঝলাম কিছুটা হলেও আশাব্যঞ্জক। আমাদের ভরসায় অরিন্দমের মনে সাহস হলো। গোছগাছ শুরু করে দিলাম। বৃহস্পাতিবার যাওয়ার দিন সকাল আটটার একটু আগেই আমার ঘরের সামনে অরিন্দম ও সৌমেনের গাড়ি এসে হাজির। আমার গাড়িতে তিনজন আমি, আমার স্ত্রী ও আমার মেয়ে। তুলনায় অরিন্দমের একটু ভারী অরিন্দমের স্ত্রী সঙ্গে এক বছরের মেয়ে এবং শশুরমশাই ও শ্বাশুড়ী মা। সৌমেনের দল আরো একটু ভারী। মানে ড্রাইভারের সঙ্গে সৌমেন, সৌমেনের স্ত্রী এবং মা ও বাবা, সঙ্গে দেড় বছরের মেয়ে। লং ট্যুর! এর জন্য সৌমেনের পক্ষে একটু কষ্টকর। আমাদের যাত্রা শুরু ...।

'হোটেল কনক প্লাজা'
গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করে ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ঠিক আটটা বাজে। এই প্রথম রোড ট্রিপে পুরী যাওয়া। তবে কয়েক বছর আগে আমি একবার আমার এক জুনিয়ার কলিগের বিয়েতে কেন্দ্রপাড়াতে গিয়েছিলাম। তখন ওই রাস্তায় চান্ডীখোল পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। যদিও সেই সময় আমি নিজে ড্রাইভ করিনি আমার দুই কলিগ গাড়ি ড্রাইভ করে নিয়ে গিয়েছিলো। তাই রাস্তা সম্পর্কে আগে থেকে কিছুটা ধারণা ছিল, বাকিটা আমার পরিচিত কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছিলাম। গাড়ি চলতে শুরু করল। মিউজিক সিস্টেম চালিয়ে আমি সামনে এগোতে থাকলাম। আমার গাড়িকে ফলো করে বাকি দুজন এগোতে থাকলো। সুন্দর মসৃন রাস্তায় ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে গাড়ি ছুটে চলেছে। খড়্গপুর, দাঁতন, জলেশ্বর টোল প্লাজা পেরিয়ে যখন বালেশ্বর পৌঁছলাম তখন প্রায় দুপুর এগারোটা। বালেশ্বর শহর থেকে কিছুটা এগিয়ে ব্রেকফাস্ট এর জন্য একটা ভালো রেস্টুরেন্ট দেখে দাঁড়ালাম... নাম 'হোটেল কনক প্লাজা'। তন্দুরি, সাথে মিক্সড ভেজ এই ছিল টিফিনে। বাড়ী থেকে হটপটে আনা খাবারগুলো সৌমেন গাড়ির ভেতরে বসেই খেয়ে নিলো। অতঃপর আমরা এক কাপ চা খেয়ে আবার চলা শুরু করলাম। এরপর দেখি জায়গায় জায়গায় ডাইভার্সন, কোথাও রাস্তা সারানো হচ্ছে তো আবার কোথাও তৈরি হচ্ছে। এই অবস্থা চললো চান্ডিখোল পর্যন্ত। চান্ডিখোলে এসে রাস্তাটা ভাগ হয়ে বামে চলে গেছে পারাদ্বীপের দিকে। ডান হাতের সোজা রাস্তাটা ধরে আমরা এগিয়ে চললাম। সৌমেনের গাড়ি আমার গাড়ির ঠিক পিছনেই দেখা যাচ্ছিলো, অরিন্দমকে দেখতে পাচ্ছি না। আমরা গাড়ি দাঁড় করিয়ে অরিন্দমের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। ফোন করে হোয়াটস অ্যাপ থেকে পাঠানো লাইভ লোকেশন দেখে বুঝতে পারলাম আমাদের পার করে অনেকটা পথ পার হয়ে এগিয়ে গিয়েছে। আবার ফোন করে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে বললাম।

চান্ডিখোলে দাঁড়িয়ে অরিন্দমের জন্য অপেক্ষা
বিকেল চারটে বেজে গেছে, খিদেয় পেট জ্বলছে, রাস্তার ধারে কোনো ভালো হোটেল খুঁজে পাচ্ছি না। কিছু হোটেল, খাবারের দোকান যদিও খোলা ছিল, তাদের অবস্থা দেখে এড়িয়েই চলেছি সবাই। কটক শহরে পৌঁছিয়ে গেলাম। ওদিকে আমার খিদেয় মাথা গরম। কুয়াখাই ব্রীজ পেরিয়ে একটু এগিয়েই দেখলাম বাঁ দিকে কটক-পুরী হাইওয়ে। এই ডাইভার্সনটা সব সময় মাথায় ঘুরছিলো কারণ মিস করলেই ভুবনেশ্বর ঘুরে যেতে হবে। কটক-পুরী হাইওয়ে ধরে সোজা এগিয়ে যাওয়ার সময় ভাবলাম এই রাস্তায় যদি কোনো ভালো খাবার হোটেল পাওয়া যায় সেই আশায় এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। কাছেই বাইপাসের রাস্তায় একটা ভালো রেস্টুরেন্ট চোখে পড়লো। রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করে ঢুকে পড়লাম। নাম আনভি'স কিচেন। খেয়ে দেয়ে আবার চলা শুরু। ফোর লেনের সুন্দর রাস্তা। পিপলি পেরিয়ে গেলাম, আর কিছুক্ষনের মধ্যেই নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছাব। পুরী শহরে ঢোকার মুখে এক বড়ো হোর্ডিং আমাদের সবাইকে স্বাগত জানাল। এরপর জিপিএস অনুসরণ করে চলেছি। সমুদ্রের হদিস তখনও পায়িনি, আর কত দেরি! গ্রান্ড রোড, ভি এই পি রোড, রেল স্টেশন পেরিয়ে একটা মোড় ঘুরতেই চলে এলাম সমুদ্রের কাছে বহু পরিচিত সেই জায়গায়।

মোড় ঘুরতেই পরিচিত সেই জায়গা
মেরিন ড্রাইভ রাস্তা ধরে একটু এগোতেই চলে এলাম 'পুরী হোটেলে'। সমস্যাটা হলো এবার গাড়ি পার্কিং নিয়ে। কোথাও গাড়ি রাখার জায়গা খালি নেই। বুকিংয়ের সময় পার্কিং লটে রাখার জন্য একটি মাত্র গাড়ি নথিভুক্ত করা ছিল। যাইহোক অবশেষে হোটেলের ফার্ম হাউসে বাকি দু'টো গাড়ির পার্কিং-এর ব্যবস্থা হয়ে গেলো। পুরী হোটেলের বিশেষত্ব হোটেলের রুম নম্বর আগে থেকে দেওয়া থাকে না। চেক-ইন এর সময় আমাদের বলা হলো একসাথে তিনটে সী-ফেসিং রুম খালি আছে। রিসেপশনে কাজ মিটিয়ে রুমের চাবি নিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে সকলে মিলে ওই রাতেই বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে। এতটা পথ চলার ক্লান্তি যেন দূর হয়ে গেল এক নিমেষে। রাতের খাবার ব্যবস্থা হ'লো হোটেলেই। খাবারের কোয়ালিটি খুবই মাঝারি মানের, কিন্তু তুলনায় দাম অনেকই বেশি। তিনজনে বসে রাতেই ঠিক করে ফেললাম পরদিন সকালে নিজেদের গাড়িতেই কোণার্ক ঘুরতে যাবো। এরপর রুমের ব্যালকনিতে চেয়ারে বসে অন্ধকারের কালো ক্যানভাসে সমুদ্রের সাদা ঢেউ-এর নানা কারুকার্য দেখতে দেখতে কাটিয়ে দিলাম বেশ কিছুটা সময়। প্রতিবারের ন্যায় এবারেও ইচ্ছে ছিলো ভোরে সূর্যোদয় দেখবো। সেই মতো মোবাইলে এলার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

চলে এলাম হোটেল
পরদিন, ভোর সাড়ে চারটেতে মোবাইলে দেওয়া এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙলো। শুনতে পাচ্ছি সমুদ্রের গর্জন। ব্যালকনির দরজা খুলেই দেখি চোখের সামনে সমুদ্র তার বিশালতা আর অপরূপ বালুময় তটভূমি নিয়ে হাজির, নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত আমাদের ক'জনেরই বা এমন ভোর দেখার সুযোগ হয়? প্রতিবারের ন্যায় এবারেও কোনভাবেই সূর্যোদয় দেখার অভিজ্ঞতাটা হাতছাড়া করবো না। তাই ঝটপট ফ্রেশ হয়ে আকাশ আর সূর্যের রংমিলান্তি দেখতে স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্র সৈকতে। তখন সূর্য ওঠার অনেক বাকি। ভোরের আলো উদ্ভাসিত হয়ে একটু একটু করে ক্রমশ স্ফুরিত হচ্ছে। পুব আকাশে সমুদ্রের মধ্য থেকে উঠে এলো লাল সূর্য, হালকা ছটায় আবীর লালে ছেয়ে গেলো গোটা আকাশ।

উঠে এলো লাল সূর্য
সমুদ্রের ঢেউ থামার নাম নেই। দেখি কত লোকের আনাগোনা, কত মানুষ সমুদ্রের বিচে এসে ঘোরাঘুরি করছে। প্রায় সবার হাতেই ক্যামেরা। সময় বাড়তে থাকলো। সূর্য তার রূপ পাল্টাতে লাগলো। জল আর আকাশ মিশে গিয়ে তৈরি করেছে এক বিস্তীর্ণ রঙিন ক্যানভাস, যেখানে সোনালি আর রক্তিম আভা খেলা করছে একসঙ্গে। জলে তার অদ্ভুত প্রতিবিম্ব। এই অবস্থায়ই চলল কয়েক দফায় ক্লিকবাজি।

ভোরের প্রথম সূর্য দেখতে মানুষের ঢল
কোণার্কে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম। পাশের গলিতে 'পারিজাত রেস্টুরেন্টে' দোসা, আলুর পরোটা আর মিষ্টি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম কোণার্কের সূর্য মন্দির দেখতে। পুরী থেকে বাইরে আসতেই চোখজুড়ানো দৃশ্য। দুপাশে ঘন সবুজ জঙ্গলের বুক চিরে চলে গিয়েছে কালো পিচের রাস্তা। বালুখণ্ড-কোণার্ক বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ভেতরর এই রাস্তাটা খুবই সুন্দর। ড্রাইভিংটা ভীষণভাবে এনজয় করা গেল। ডানপাশে পেলাম সমুদ্রকে। সমুদ্রকে ডান হাতে রেখে মেরিন ড্রাইভ ধরে এগিয়ে চলেছি। পথে দেখা গেলো ছোট্ট একটা ব্রিজ, তার নীচ দিয়ে বয়ে গেছে নুয়ানাই নদী। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে অনেকেই ছবি তুলছে। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম চন্দ্রভাগা। এখান থেকে আর মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরেই কোণার্ক। চন্দ্রভাগাকে পেছনে ফেলে এগোতে থাকলাম কোণার্কের দিকে। গাড়ি চালাতে চালাতে এই মন্দিরের বিষয়ে বইয়ে পড়া নানা পৌরাণিক কাহিনীর কথা মনে পড়ে গেল।

কোণার্ক মন্দিরের ইতিহাস

কোণার্কের প্রাচীন নাম 'অর্কক্ষেত্র' বা 'মৈত্রেয় বন'। রাজা দ্বিতীয় নরসিংহ দেবের তাম্রলিপিতে উল্লেখিত আছে যে; "প্রথম নরসিংহ দেব 'কোণাকোণ' নামের প্রসিদ্ধ স্থানে অন্যান্য দেবতাদের সাথে একসাথে বাস করার জন্য সূর্যদেবের জন্য একটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।" সূর্যের কোণা বা দেশের যে কোণটি সূর্য-দেবের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। 'অর্ক' কথাটির অর্থ 'সূর্য' অর্থাৎ 'কোণা'র অর্ক এই কথাটি থেকেই কোণার্ক নামটি এসেছে বলে অনুমান করা হয়। মন্দিরটি সঠিক কত সালে তৈরি হয়েছে সেটা নিয়ে নানা মতবাদ আছে। তবে এই মন্দিরটি রাজা প্রথম নরসিংহ দেব বা লাঙ্গুলিয়া নরসিংহ দেবের রাজত্বকালে ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা নিয়ে দ্বিমত নেই। ওড়িশার এনসাইক্লোপিডিয়া বলে খ্যাত মাদলা-পঞ্জী মতে রাজা প্রথম নরসিংহ দেবের রাজত্বের (১২৩৮-১২৬৪ খ্রীস্টাব্দ) অষ্টাদশ বর্ষে অর্থাৎ ১২৫৬ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল।

মন্দির কমপ্লেক্সে ঢোকার আগে
মন্দিরের শিলালিপিতে উল্লেখ করা ১৯৫০ খ্রীষ্টাব্দ। ভিন্সেন্ট স্মিথের তথ্য অনুযায়ী মন্দিরটি ১২৪০ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১২৮০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। আবার ব্রজকিশোর ঘোষের 'পুরীর ইতিহাস' এবং নগেন্দ্রনাথ মিত্রর 'পুরী তীর্থ' গ্রন্থে উল্লেখ করা আছে মন্দিরটি ১২৭৬ খ্রীষ্টাব্দে কেশরীবংশীয় রাজা সিধ কিশোর বা সিদ্ধ শেখরের রাজত্বকালে শিবাই সৈতুরার (সান্তরা) তত্বাবধানে নির্মিত হয়েছিল। একই মতে স্টার্লিং সাহেবের হিসেবে মন্দিরটি ১২৪১ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরটি কৃষ্ণদেউল বা ব্ল্যাক প্যাগোডা নামে পরিচিত হলেও কালো পাথরে তৈরি নয়। বেলে পাথরই এই মন্দিরের প্রধান উপকরণ। তবে মন্দিরের গায়ে বেশ কিছু জায়গায় ক্লোরাইট এবং কালো গ্রানাইটের উপর খোদাই করা রয়েছে। দূর থেকে মন্দির সামনের অংশটি কালো দেখায় বলে অথবা খোদাই করা কালো পাথরের নক্সার সমাবেশ থাকায় মন্দিরটির ব্ল্যাক প্যাগোডা নামকরণ হয়ে থাকতে পারে।

ফলকে ঐতিহাসিক ঘটনাবলী
এসব কাহিনীর কথা ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গেলাম কোণার্কে। মন্দির থেকে বেশ খানিকটা দূরে ওড়িশা ট্যুরিজম-এর পার্কিং জোন। দূর থেকেই চোখে পড়লো সেই বিখ্যাত সূর্য-মন্দির। পার্কিং লটে গাড়ি রেখে মন্দিরের দিকে হাঁটতে থাকি। দুদিকে রকমারি দোকানপাট আর অজস্র মানুষকে পিছনে ফেলে আমরা পৌঁছালাম সূর্য-মন্দিরের কাছে।

ওড়িশা ট্যুরিজমের পার্কিং জোন
অনেকদিনের ইচ্ছা ছিলো কোণার্কের সূর্য-মন্দিরটা ভালো করে দেখবো। বাঙালি মাত্রই তার অন্য আকর্ষণ। চিরকালই পুরী বেড়াতে গেলে দেখা চাই-ই৷ তাই এবার ঠিক করেছিলাম একটা দিন কোণার্কে কাটাবো। প্রতিবারই প্যাকেজ ট্যুরে এখানে আসি কিন্তু তাড়াহুড়ো করে কোনোবারই ভালো করে দেখা হয়নি।

চোখে পড়লো সূর্য-মন্দির
পার্কিং জোন থেকে মন্দিরে পৌঁছতে ভালোই সময় লাগলো। এখানে টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। ঢোকার আগে বাঁদিকে টিকিট কাটার কাউন্টার আছে। এখানে এখন টিকিটের বদলে কোলকাতা মেট্রোর মতো টোকেন সিস্টেম। টোকেন মূল্য চল্লিশ টাকা। কাউন্টার থেকে একসাথে সকলের টোকেন সংগ্রহ করে আমরা একে একে টোকেন কন্ট্রোল টার্নস্টাইল গেট দিয়ে মন্দির কমপ্লেক্সে ঢুকলাম।

দোকানপাট আর অজস্র মানুষকে পিছনে ফেলে পৌঁছালাম মন্দিরে
এই প্রথমবার লোহার খাঁচা মুক্ত মন্দির দেখতে পেলাম। মাদলা-পঞ্জী অনুসারে ১৬২৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত মন্দিরটি প্রায় অক্ষুন্ন ছিল। এরপর মন্দিরটি পরিত্যক্ত হয়েছিল বলে কথিত আছে। বর্তমান মন্দিরের মূল স্থাপত্যের বেশির ভাগই আর অক্ষত নেই। একের পর এক আঘাত এসেছে এই মন্দিরটিতে। সুলাইমান খান কররানির কুখ্যাত সেনাপতি কালাপাহাড়ের আক্রমণ, খোর্দ্ধার রাজার আমলে সূর্য-দেবের বিগ্রহ সহ অনেক ভাস্কর্য ও প্রস্তরখন্ড পুরীর জগন্নাথের মন্দিরে স্থানান্তর করা এমনকি মারাঠা শাসনকালেও রক্ষা পায়নি এই মন্দির।

খাঁচা মুক্ত মন্দির
মন্দিরের বড়-দেউলটি এখন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখা গেলো। এ সম্বন্ধে নানারকম মতবাদ আছে। কারো মতে বজ্রপাত বা ভূমিকম্পের ফলে মন্দিরের এইরূপ অবস্থা হয়েছে। ব্রজকিশোর ঘোষের লেখা অনুযায়ী কোণার্ক মন্দিরের প্রধান স্থপতি ও শিল্পী ছিলেন শিবাই সইতুরা (সান্তরা)। শিবাই সইতুরার অকাল মৃত্যুতে এই মন্দির অসমাপ্ত অবস্থাতেই রয়ে যায়। ভিন্সেন্ট স্মিথও লিখেছেন মন্দিরটি অসমাপ্ত ছিল। অবশ্য আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে প্রথম নরসিংহ দেবের অকাল মৃত্যুর ফলে এই মন্দিরের নির্মাণ কাজ অসমাপ্ত রয়ে যায়। মন্দিরের দেউলটি ভেঙে পড়ার একটি প্রচলিত প্রবাদ; মন্দিরের চূড়ার বসানো একুশ ফুট সাড়ে দশ ইঞ্চির মতো 'কুম্ভ-পাথর' বা চুম্বকদণ্ডটি সরিয়ে নেওয়ায় ধীরে ধীরে মন্দিরের চূড়ার সমস্ত পাথর খুলে পড়েছে। এবিষয়ে এর আগের পুরী ভ্রমণে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। মন্দিরের মূল রেখ-দেউলটি কেন ভেঙে পড়েছিল এ বিষয়ে শ্রীযুক্তা দেবলা মিত্রের আরও একটি তথ্য পাওয়া যায়। কোণার্ক মন্দিরের বিগ্রহ স্থানান্তরিত করার পরে বিগ্রহহীন মন্দিরটি মূল্যহীন হয়ে পড়ে। ওদিকে মন্দিরের কলসটি সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ফলে উপর থেকে বর্ষার জলধারা মন্দিরে প্রবেশ করতে থাকে। বিগ্রহহীন অবহেলিত মন্দিরের দেউলে বট-অশ্বত্থ গাছ জন্মে ক্রমে বড় হয়ে একসময় দেউলের গণ্ডি অংশ ভেঙে পড়ে। দেউলের উপর ঝুঁকে থাকা প্রকাণ্ড উড়-গজসিংহটি দেউলের কিছুটা ক্ষতি করে জগমোহনের উপর তিন টুকরো হয়ে পড়ে। এখনো সেটি জগমোহনের উত্তর প্রান্তে পড়ে আছে।

বড়দেউল, জগমোহন ও রন্ধনশালার ভগ্নাবশেষ
মন্দির অসম্পূর্ণ থাকা সম্বন্ধে বিশু মাহারাণা ও তার ছেলে ধর্মপদর কাহিনীর মতো প্রচলিত আরও এক কিংবদন্তী আছে। রাজা প্রথম নরসিংহ দেবের মন্ত্রী তথা মন্দিরের প্রধান স্থপতি শিবাই সইতুরা (সান্তরা) মন্দির নির্মাণের ভার গ্রহণ করার পর তাঁর অন্তঃসত্বা স্ত্রীকে পুরীর বাড়িতে রেখে চন্দ্রভাগায় আসেন। সেই সময় তাঁর একটি ছেলে হয়। শিবাই-এর ছেলে ছোট থেকেই বংশানুক্রমিক স্থাপত্য কাজে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছিল। ছেলের বয়স এগারো বছর হলে শিবাই-এর স্ত্রী বাড়ির গাছের বিশেষ একটি ফল দিয়ে তার বাবার খবর নিতে পাঠায়। স্ত্রীর পাঠানো হাতের ফল দেখে শিবাই যাতে তাঁর ছেলেকে চিনতে পারেন তাই ব্যবস্থা। ওদিকে শিবাই বারোশো শিল্পী নিয়ে বারো বছর ধরে পরিশ্রম করেও মন্দিরটি সম্পূর্ণ করতে পারেননি। পদ্মতোলা গণ্ডে মন্দির উঠবে। তার জন্য দিনের পর দিন পাথর ফেলে মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করার চেষ্টা চলছিল। কিন্তু ঐ জায়গার মাটি নরম থাকায় যতবারই পাথর ফেলে মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করছিলো ততবারই ওই জায়গার মাটি নরম থাকায় তা ভেঙে পড়ছিলো। শিবাই-এর ছেলে তার বাবার এই অবস্থা দেখে তখন দেবী রামচন্ডীর শরণাপন্ন হলো। এমন সময় দেবী বৃদ্ধাবেশে আবির্ভূত হয়ে নিজের কুটিরে নিয়ে গিয়ে গরম ক্ষীর খেতে দিলেন। সে যখন গরম ক্ষীরের মাঝের অংশ থেকে খাওয়ার চেষ্টা করে তখন তাঁর হাত পুড়ে যায়। দেবী বললেন 'এ তো শিবাইয়ের রীতি! পাশ থেকে শুরু না করে মাঝখান থেকে শুরু করছো কেন? তখন শিবাই-এর ছেলে তার বাবার মন্দির তৈরির কাজে ভুল কোথায় হচ্ছে বুঝতে পারলো। শেষমেশ শিবাই-এর ছেলের বুদ্ধিতে যখন চড়চড় করে মন্দির তৈরি হতে থাকলো তখন শিল্পীরা রাজার কাছে তাদের সম্মান রক্ষার জন্য সকলে মিলে শিবাইকে বললো যে সে বারোশো শিল্পীর পক্ষ নেবে, না নিজের পুত্রের পক্ষ নেবে। শিবাই তখন ওই বারোশো শিল্পীর পক্ষ নিলে তারা চন্ডিকা অর্থাৎ রামচন্ডী দেবীর কাছে তার ছেলেকে বলি দিলো। শিবাই-এর ছেলের সেই অপূর্ব শিল্প-কৌশলের অভাবে মন্দিরটি অসম্পূর্ণ রইলো। শিল্পীদের পরস্পরের প্রতি যে ঈর্ষা থাকে কিংবদন্তী হলেও অসম্ভব না হওয়ার কোনো কারণ নেই।

জগমোহন
মন্দিরে ঢোকার মুখেই রয়েছে নাটমন্দির। নাটমন্দিরের উপরের অংশ নেই কেবল প্রাচীরের কিছু অংশ দাঁড়িয়ে রয়েছে। কেউ কেউ এটিকে ভোগমন্ডপ বলেও বর্ণনা করেছেন। নাটমন্দিরের সামনে দুপাশে দুটো গজসিংহ-মূর্তি রাখা আছে। আধ শোয়া হাতির উপরে সিংহ আর সেই হাতির নিচে চাপা পড়ে মানুষ। এই মূর্তি দুটি একখন্ড পাথরের তৈরি। মূর্তি দুটো কুড়ি ফুট উঁচু।

প্রবেশ পথে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো এই হস্তিদলনকারী শার্দুল
মন্ডপটির চারদিকেই সিঁড়ি, শুধু পশ্চিমে জগমোহনের দিকের সিঁড়িটি জায়গার অভাবের অন্যান্য দিকের মতো সোজা না নেমে দুপাশে বেঁকে গেছে। মণ্ডপের উপরে ষোলোটি স্তম্ভ রয়েছে। এতগুলো স্তম্ভ এবং এর ঠিক দক্ষিণে রন্ধনশালা থাকায় এটিকে ভোগমন্ডপ হিসেবেই ব্যবহৃত হতো বলে অনেকে অনুমান করেন। নাটমন্দিরের এই অংশে অশ্লীল মূর্তি নেই বললেই চলে। মণ্ডপটি জগমোহন থেকে সামান্য কিছুটা দূরে। সিঁড়িতে পা রেখে উপরে উঠলাম। সিঁড়ির ওপরে দু'চারটে ছবি তুলে নাটমন্দির পেরিয়ে চলে এলাম জগমোহনের সামনে। এখন আমরা মন্দিরের যে অংশটি দেখতে পায় সেটিই জগমোহন। এটি মূল মন্দির বড়-দেউলের প্রবেশ পথ।

নাটমন্দির বা ভোগমন্ডপ
উৎকল ও দ্রাবিড় স্থাপত্যরীতির সংমিশ্রণে তৈরি এই দেবালয়ের নাটমন্দিরের পরেই জগমোহন, জগমোহনের সঙ্গেই জুড়ে রয়েছে মূল বড়-দেউলটি। নাটমন্দিরের সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকালে জগমোহনের মূল প্রবেশদ্বারটি দেখতে পাওয়া যায়। জগমোহনের তিন দিকে তিনটি দরজা ছিল, কোনো জানালা নেই। পূর্বদিকে প্রধান দরজা। পশ্চিম দিকে রয়েছে বড়-দেউলের গম্ভীরা অর্থাৎ গর্ভগৃহে যাওয়ার রাস্তা। মন্দিরটি যেন সূর্যদেবের রথের আকারে পরিকল্পিত। রথের দুটো অংশ; মন্দিরের মূল অংশ বড়-দেউল, যেখানে বসেন রথী। আর রথের সামনে সারথির বসার আসনটি হলো জগমোহন। দেউল-জগমোহন মিলিয়ে যে রথ তাতে সাতটি ঘোড়া। সপ্তাহের সাত বার; তাই রথের সামনে সাতটি ঘোড়া, আবার সূর্যেরও সাতটি রশ্মি। জগমোহনের সামনে পূর্বদিকের সিঁড়ির প্রত্যেক দিকে দুটো করে মোট চারটি চাকা আছে। এইভাবে রথটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুরো মন্দিরের ভিত্তিগাত্রে এক এক দিকে বারোটি করে চাকা রয়েছে; সব মিলিয়ে মোট চব্বিশটি চাকা।

কোণার্ক মন্দিরের ল্যান্ডস্কেপ
মন্দিরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য নিদর্শন চাকা। এক একটি চাকা এক এক পক্ষকাল, প্রতি জোড়া চাকায় এক মাস। রথের চাকাগুলো বাইরের দিক থেকে দেখতে একই কিন্তু কারুকার্যের তফাৎ আছে। প্রত্যেকটি চাকায় আটটি বড় অর বা স্পোক এবং আটটি ছোট অর বা স্পোক আছে। বড় স্পোকগুলো সরু থেকে মোটা আবার মোটা সরু হয়ে নেমি বা রিম অংশে গিয়ে মিশেছে। সরু অর বা স্পোকগুলোতে গোলাকার মুক্তোর বলের সারির মতো কারুকার্য করা। প্রতিটি চাকা দিনের অষ্টপ্রহর। চাকা গুলোর ভেতরেও বহু খোদাই করা আছে। বিখ্যাত এই চাকার সামনে দাঁড়িয়ে স্মার্টফোন, ক্যামেরা হাতে বিভিন্ন পোজে ছবি তোলার জন্য অজস্র লোকের ভিড়। সুযোগ পেয়ে আমরাও ক্যামেরার জন্য পোজ দিতে শুরু করলাম। কত রকম পোজে কত ছবি ক্যামেরা বন্দি করা হলো।

ক্যামেরা বন্দি রথের চাকা
মন্দিরের বেদী থেকে শুরু করে চূড়া পর্যন্ত প্রতি ইঞ্চি জায়গায় পাথরের ভাস্কর্য ও কারুকার্য রয়েছে। মন্দিরের দেওয়ালজুড়ে যেমন নির্মিত হয়েছে দেবদেবীর স্বর্গীয় মূর্তি, তেমনি লাস্য ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে রয়েছে মানব-মানবীর মিথুন প্রতিচ্ছবিও। একই সঙ্গে রয়েছে রাজদরবারের বিভিন্ন দৃশ্য, শিকারের দৃশ্য, জীবজন্তু প্রভৃতি। এই মন্দির শুধু ধর্মীয় উদ্দেশ্য নিয়েই নির্মিত হয়নি। মানবসভ্যতা, সমাজ, দর্শন, ধর্ম, বিজ্ঞান, রাজনীতি এবং সংস্কৃতির সার্বিক চেতনার বিরল সম্মিলন ঘটেছে এই মন্দিরটিতে। চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্দিরের শিল্পকলা দেখার পর তাঁর "পথে-বিপথে' গ্রন্থাটিতে লিখেছেন - 'চিরযৌবনের হাট বসিয়াছে! চিরপুরাতন অথচ চিরনূতন কেলিকদন্তলে নিখিলের রাসলীল! চলিয়াছে - কিবা! রাত্রি, কিবা দিন - বিচিত্র বর্ণের প্রদীপ জ্বালাইয়া, মৃত্তিহীন অনঙগদেবতার রত্ববেদীটি ঘিরিয়া। এখানে কিছুই নীরব নাই, নিশ্চল নাই, অনুর্বর নাই! পাথর বাজিতেছে মুদঙ্গের মন্দ্রস্বনে, পাথর চলিয়াছে তেজীয়ান অশ্বের মতো বেগে রথ টানিয়া, উর্বর পাথর ফুটিয়া উঠিয়াছে নিরন্তর-পুষ্পিত কুঞ্জলতার মতো শ্যাম-সুন্দর আলিঙ্গনের সহস্র বন্ধে চারি দিক বেড়িয়া! ইহারই শিখরে, এই শব্দীয়মান, চলায়মান উর্বরতার চিত্রবিচিত্র শৃঙ্গারবেশের চুড়ায়, শোভা পাঁইতেছে কোণার্কের দ্বাদশ- শত শিল্পীর মানসশতদল - সকল গোপনতার সীম হইতে বিচ্ছিন্ন, নিভীঁক, সতেজ, আলোকের দিকে উন্মুখ।' ১৯৮৪ খ্রীষ্টাব্দে ইউনেস্কো থেকে এই মন্দিরটিকে 'ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট'-এর মর্যাদা দিয়েছে। চিত্তাকর্ষক ছবি তোলার জন্য ফোটোগ্রাফারদের কাছে এক চমৎকার জায়গা। ছবি তোলার সেরা জায়গা খুঁজে পেয়ে আমার সাথে অরিন্দম ও সৌমেন ক্যামেরায় পটাপট ছবি তুলতে লাগল।

মন্দিরগাত্রে পাথরের ভাস্কর্য ও কারুকার্য
অতীতে মন্দিরের প্রাচীরের ভেতরে জগমোহনের তিনটি দ্বার ছিল। উত্তর দিকের দ্বারে ছিল রাজহস্তী অর্থাৎ দুটো হাতি তাদের শুঁড়ে করে জড়িয়ে ধরেছে মানুষকে, দক্ষিণ দ্বারে অশ্ব ও মুণ্ডহীন পদাতিক অর্থাৎ যোদ্ধার সাজে সজ্জিত দুটো ঘোড়ার মূর্তির পায়ের নীচে কোনো হতভাগ্য মানুষ ও তার সঙ্গে একজন করে অনুচর এবং পূর্ব দ্বারে হস্তিদলনকারী শার্দুল অর্থাৎ দুটো সিংহ এক একটি পরাজিত হাতির উপর আক্রমণের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। সেই হিসেবে জগমোহনের এই তিনটি দ্বারকে যথাক্রমে হস্তিদ্বার, অশ্বদ্বার এবং সিংহদ্বার নামেও অভিহিত করা যেতে পারে। মন্দিরটি বহুদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। মন্দিরের বহু অংশ জঙ্গল ও বালির স্তুপে ঢাকা ছিল। ব্রিটিশ সরকারের তত্বাবধানে জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করা হলো। মন্দির দ্বারের এই তিন জোড়া প্রকাণ্ড মূর্তিকে মন্দির প্রাঙ্গনে এক একটি বেদী তৈরি করে রাখা হয়েছে।

দক্ষিণ দ্বারে অশ্ব ও মুণ্ডহীন পদাতিক
হাতি ও ঘোড়ার মূর্তিদুটো মন্দিরের দিকে পিছন করে রাখার বদলে ভুলবশত বসানো হল মন্দিরের দিকে মুখ করে এবং সিংহের মূর্তিটিকে পূর্ব-দিকে একটি বালির ঢিবির উপরে বসানো হলো। পরবর্তীকালে বালির স্তুপ সরিয়ে ভোগমণ্ডপটি আবিষ্কৃত হলে আবার সেটা সরিয়ে ভোমণ্ডপের সামনে বসানো হয়েছে। তবে মূর্তিটিকে বসানোর সময় একটা ভুল রয়ে গেছে; এখনও ওই সিংহের নীচের বেদীর খোদাই করা পাথরটি লক্ষ্য করলে দেখা যায় সারি দেওয়া হাতিগুলো আকাশের দিকে পা করে হাঁটছে। শোনা যায় এই মূর্তি দুটো আগে উত্তর দ্বারে অবস্থিত ছিল। ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দে লর্ড কার্জনের সময় জন হান্টারের তত্বাবধানে মন্দিরটির প্রকৃত সংস্করণ শুরু হয়। চারদিকের বালির স্তুপ সরিয়ে আবিষ্কৃত হলো রথের অনুকৃতি। সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে জগমোহনের উপর থেকে বালি ঢেলে ভিতরের অংশ চিরকালের জন্য নিরেট করে ভরাট করে দেওয়া হলো। এই সময়ে মায়াদেবীর মন্দিরটিও আবিষ্কার হয়েছিল।

উত্তর দ্বারে রাজহস্তী
মন্দির চত্বরে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত মায়াদেবীর মন্দিরটি সত্যি দারুণ এবং এক অভিনব স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি। এই মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষ এখনও টিকে আছে। আমরা এখন সূর্য-দেবের মন্দির হিসেবে যে বড়-দেউলটি দেখি সেটি নতুন মন্দির। মায়াদেবীর মন্দিরটি আগেই নির্মিত হয়েছিল এবং এই মন্দিরটি নিয়েও বিতর্ক কম নয়। ওড়িয়া ভাষায় লেখা কোণার্ক সূর্য মন্দির সম্পর্কে প্রথম এবং আজ অবধি একমাত্র প্রমাণিক বই 'কোণার্ক' এর বিখ্যাত লেখক পণ্ডিত কৃপসিন্ধু মিশ্রর মতে এটি রামচণ্ডী মন্দির। উৎকল গৌরব মধুসূদন দাস লিখেছিলেন, 'এটি রামচণ্ডী মন্দির নয়, এটি সূর্যপত্নী ছায়াদেবীর মন্দির।' বালিস্তুপ থেকে মন্দিরটি পুনরুদ্ধার হওয়ার পর আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ডেপুটি জেনারেল দেবলা মিত্র এটিকে সূর্যপত্নীর মন্দির হিসাবে ধরে নিয়েই মায়াদেবী মন্দির নামে অভিহিত করেন। মূল দেবতার মন্দিরটি নির্মিত হওয়ার অনেক আগে তাঁর স্ত্রীর মন্দির নির্মিত হয়েছিল - এটাও অবিশ্বাস্য। মাদলা-পঞ্জির মতে, কেশরী রাজবংশের পুরেন্দ্র কেশরী এই মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন এবং সেই মন্দিরের সামনে নরসিংহ দেব একটি বড়-দেউল তৈরি করে পুরাতন মন্দিরের বিগ্রহটি নতুন মন্দিরে স্থানান্তরিত করেন। প্রত্নতাত্বিক মতে জানা যায় যে একসময় এটি সূর্য মন্দির ছিল। এর সামনে রাজা লাঙ্গুলিয়া নরসিংহ দেব আরও একটি বিশাল মন্দির নির্মাণ করেছিলেন এবং নির্মাণ শৈলীতে বোঝা যায় যে তথাকথিত ছায়াদেবী মন্দিরটি নতুন মন্দিরের চেয়েও পুরানো। এবার গিয়ে দেখি মন্দির সংস্কারের কাজ চলছে তাই ওদিকে লোকজনের প্রবেশ নিষেধ। কোণার্ক মন্দির প্রাঙ্গনে অনেক ভাঙা মূর্তি ছাড়াও একজায়গায় দেখি বড় বড় লোহার বিম সযত্নে রাখা আছে। এই বিমগুলো মন্দির তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

মায়াদেবীর মন্দির (পুরাতন সূর্য মন্দির)
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়েও প্রখর তেজে খাড়া হয়ে সূর্য জ্বলছে মাথার ওপরে। রোদ উঠেছে চড়চড়িয়ে। সকলেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এক জায়গায় ছায়াঘেরা গাছের তলায় বিশ্রামের জন্য বসে পড়লো। এই সুযোগে আমি আর সৌমেন ক্যামেরা নিয়ে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে শট নিয়ে যতটা সম্ভব সম্পূর্ণ মন্দিরের একটা সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফি পাওয়া যায় তার চেষ্টা করতে থাকলাম।

ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফি
ঘুরতে ঘুরতে সকলে ক্লান্ত হয়ে গেলে। দুপুর আড়াইটা বেজে গেছে, খিদেও পাচ্ছে। মন্দির থেকে বেরিয়ে চলে এলাম গাড়ির কাছে। রাস্তার উল্টো দিকে পরপর বেশ কিছু হোটেল, ছোট ছোট খাবারের দোকান, রেস্টুরেন্ট আছে। ঠিক করতে পারলাম না কোনটা ভালো হবে! বেশ লোকজন দেখে আমরা ঢুকে পড়লাম একটায়। কেমন খেলাম? যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন তাদের উদ্দেশ্যে বলি এর চেয়ে খারাপ খাবার এই সফরে কোথাও খায়নি। হোটেলের খাবারের বিল মিটিয়ে কোণার্ককে বিদায় জানিয়ে পুরীর দিকে রওনা দিলাম। যাওয়ার পথে উপরি পাওনা চন্দ্রভাগা।

চলে এলাম চন্দ্রভাগা সমুদ্র সৈকতে
হাতে যথেষ্ট সময় থাকায় আমরা চলে এলাম চন্দ্রভাগা সমুদ্র সৈকতে। একটু সময় দিলাম এখানে। চন্দ্রভাগা নদী এখানে সাগরে এসে মিশেছে। মূল স্পটে মানুষের ভিড় উপচে পড়ছে। হুজুগে ভীড় দেখে আস্তে আস্তে বাঁ দিকে এগিয়ে গাড়িটা একটা নিরিবিলি জায়গা দেখে দাঁড় করলাম। সেখানে দেখি দু'একজন নানান পোজে ফটোসেশনে ব্যস্ত।

ফটোসেশনে ব্যস্ত
গাড়ি থেকে নেমে বালুময় পথে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম সমুদ্র সৈকতে। চারপাশে বিশাল বালুময় প্রান্তর। ডানে বামে চোখের সীমানা পর্যন্ত দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। পর্যটকদের ভিড় এখানে হামলে পড়েনি তাই বেশ দারুন লাগছিল। পুরীর সৈকতের চেয়ে চন্দ্রভাগা সৈকতের সৌন্দর্য আরো বেশি মনোহর।

চন্দ্রভাগার বালুময় সমুদ্র সৈকত যেন মরুভূমি
নিরিবিলি চন্দ্রভাগাতে নীল সমুদ্রের ঢেউয়ের অনবরত আছড়ে পড়া জলোচ্ছ্বাসের মনোরম সেই সব দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করে রাখলাম। তার সাথে চলল একে অপরের ছবি তোলা। ক্যামেরা নিয়ে আমরা এতটাই মগ্ন ছিলাম যে ফেরার কথা খেয়াল ছিলনা। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ সমুদ্রের সাথে কাটিয়ে আমরা রওনা হলাম।

মৎস্যজীবীদের সমুদ্রে পাড়ি
বিকেল পাঁচটা, আবার ফিরে এলাম গাড়ির কাছে। গাড়ি গড়িয়ে চলল পুরীর দিকে। রামচণ্ডীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ইচ্ছে হলো একবার ঘুরে আসি। পথের বাঁদিকে ঘুরে চলে গেলাম রামচণ্ডী মন্দিরে। গাড়ি পার্কিং করে ঘোরাঘুরি হলো বেশ কিছুক্ষণ। মন্দিরের একটা ঘাট চলে গিয়েছে কুশভদ্রা নদীতে। এখান থেকে এক অসাধারণ দৃশ্য দেখার সুযোগ হলো, নদী আর সমুদ্র পাশাপাশি বয়ে চলেছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে সমুদ্র আর নদীর মাঝে বিস্তৃত বালুকাভূমি। কুশভদ্রা নদী পেরিয়ে পৌঁছানো যায় সেই বালুকাভূমিতে। নদীর একটি ধারা সেই বালুকাভূমিকে কেটে সাগরে গিয়ে মিশেছে। সেই সব দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করে ফেললাম। সন্ধ্যে ছুঁই-ছুঁই, তাই আবার আমরা রওনা হলাম। চলে এলাম হোটেলে।

কুশভদ্রা নদী আর সমুদ্র পাশাপাশি বয়ে চলেছে
সারাদিন ঘুরে ঘুরে ভীষণ ক্লান্ত। ফিরতে একটু রাত হয়ে গেলো। হোটেলের রুমে ঢুকে ব্যালকনির দরজা খুলে দিলাম। সামনে সমুদ্র সৈকত আর হোটেলের আশপাশে কয়েকশ ফুট পর্যন্ত অসংখ্য পর্যটকের পদভারে মুখরিত। অসংখ্য আলোর ঝিলিমিলি চোখে পড়ছে। জমজমাট দোকানপাট। রঙবেরঙের মানুষের সমাগমে মুখর। হোটেলের আশেপাশে মেরিনড্রাইভের রাস্তায় দেখি মাছভাজার দোকানগুলোতে নানা রকমের তাজা সামুদ্রিক মাছের পসরা থরে থরে সাজানো। পমফ্রেট, চিংড়ি, পারশে, গুরজালি, শঙ্কর, রূপচাঁদা আরও কত কি মাছ। কাঁকড়াও আছে দেখলাম। পাশে গ্যাস ওভেন জ্বলছে। ক্রেতা কোনো একটি মাছ দরদাম করে দেওয়া মাত্রই তৎক্ষণাৎ ওরাই কেটেকুটে মশলা দিয়ে ফ্রাই করে পরিবেশন করছে। অনেকেই দেখি খুব আগ্রহ নিয়ে ফ্রাই করে খাচ্ছে। আমি পুরীতে এসে কোনোবার খাইনি। সৌমেন একবার খাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো। আমাদের জন্য পমফ্রেটের অর্ডার হল। আমার স্ত্রী সামুদ্রিক মাছের গন্ধ সহ্য করতে পারেনা। স্ত্রীকে বললাম একবার চিংড়িটা খেয়ে দেখতে পারো। একটু নাক সিটকে বললো সামুদ্রিক চিংড়ি, দেখা যাক! বলে অর্ডার দেওয়া হলো। অল্প সময়ের মধ্যেই ফ্রাই হয়ে হাতে এলো সেই সামুদ্রিক মাছ ভাজা। স্বর্গদ্বারের মোড়ের কাছে 'কোলকাতা রোলস' আমার খুব প্রিয়। এখনো স্বাদ লেগে আছে জিভে। ওই দোকানের রোলের স্বাদ না নিয়ে ফিরতে মন চায় না। এবারেও বাদ গেলো না। বাইরের খোলা আকাশের নিচে দোকানের সামনে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে রোলের স্বাদ নিতে নিতে আমরা তাকিয়ে আছি সমুদ্রের দিকে। সমুদ্রের গর্জন ভেসে ভেসে আসছে। কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম সকলে মিলে। এরপর টুকটাক কিছুটা শপিং করে রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে আসলাম এবং ঘুমিয়ে পড়লাম।

রাতের আলোয় মায়াবী সৈকত
সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখার স্বাদ আমাকে বরাবরই রোমাঞ্চিত করে। ভোর পাঁচটা বাজতে না বাজতেই ঘুম থেকে উঠে, চললাম সূর্যোদয় দেখতে। ক্যামেরার ব্যাগ আর ট্রাইপড কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্র সৈকতে। কিছুক্ষণ পরে দেখি অরিন্দম ও সৌমেন সপরিবারে এসে হাজির। সবাই নিজের ক্যামেরা বের করে একের পর এক লেন্সবন্দি করতে লাগলাম দৃশ্য গুলো।

সূর্যস্নাত সৈকতের বুকে সূর্যোদয়ের প্রথম আলো
প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে চললো আজকের ফটোসেশন। তারপর সবাই হোটেলে ফিরে গেলো, আমার রুমে বন্দী থাকার ইচ্ছে ছিল না তাই একাই আশপাশটা ঘুরে দেখতে ক্যামেরাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

অলস সময়-ধারা বেয়ে, মন চলে শূন্য-পানে চেয়ে
পুরীতে আসবো আর জগন্নাথ দর্শন হবে না তা কি হয়! আমাদের তরফ থেকে তাই আজকের দিনটা মন্দিরে পুজো দেওয়ার জন্য ধার্য করা হয়েছে। তাড়াতাড়ি সবাই রেডি হয়ে হোটেলের গেটের সামনে থেকেই অটো ভাড়া করে চললাম মন্দিরে পুজো দিতে। মন্দিরের সামনে পৌঁছিয়ে দেখি জগন্নাথ দেবের মন্দির সংলগ্ন এলাকা সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেছে। পূর্ব পরিচিত জগন্নাথ মন্দিরের সেবায়েত সন্তোষ কুমারকে ফোনে (+৯১ ৯৮৬ ১১১২ ১৮৩) ডেকে নিলাম। মন্দিরের বাইরে অজস্র পূণ্যার্থীর ভিড়। লম্বা লাইন পূজো দেওয়া এবং বিগ্রহ দর্শনের জন্য। তবে ব্যবস্থাপনা বেশ ভালো। জুতো, ক্যামেরা, মোবাইল লকারে জমা রেখে লাইন ধরে এগিয়ে প্রবেশ করলাম বিশাল মন্দির চত্বরে। মন্দিরে পুজো দিয়ে জগন্নাথ দর্শনের পর সকলের ইচ্ছে দুপুরের মহাপ্রসাদ খেয়ে ঘরে ফেরা। মন্দির প্রাঙ্গনেই আছে আনন্দ বাজার। সেখানে ইচ্ছে হলে বিভিন্ন দামের মহাপ্রসাদ কিনে খাওয়া যায়। ওখানে মাটিতে বসে খাওয়ার জন্য ভালো জায়গাও আছে। সন্তোষবাবু একটা দোকান থেকে প্রায় হাফ দামে আমাদের মহাপ্রসাদ কিনে দিলেন। মহাপ্রসাদ খেয়ে সবাই হোটেলে ফিরে গেলো। আমি আর সৌমেন দুজনে মন্দিরের চারপাশটা একটু ঘুরে খাজা কেনার জন্য 'আদি নৃসিংহ সুইটস' এর ফ্যাক্টরিতে গেলাম। এরপর একটা অটো ধরে হোটেলে যখন ফিরলাম তখন দুপুর পার হয়ে গেছে।

পূজো দেওয়া এবং বিগ্রহ দর্শন
সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেশ ক্লান্ত হয়ে গেলাম। ফ্যান চালিয়ে দিয়ে ক্লান্ত শরীরটাকে হোটেলের বিছানায় এলিয়ে দিলাম। বিকেল চারটে নাগাদ অরিন্দম লাইট হাউসে যাওয়ার জন্য তৈরি। আমাকে ফোন করে যাওয়ার জন্য বললো। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে যাওয়ার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। ভাবলাম, এই ক্লান্তির মধ্যেও জড়িয়ে থাকে বেড়ানোর আলাদা একটা সুখের অনুভূতি। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় লাইটহাউস বন্ধ হয়ে যাবে। চটপট রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম ক্যামেরাটা নিয়ে। হোটেলের সামনে থেকে টোটো ধরে চলে গেলাম লাইটহাউসে। গিয়ে দেখি কোভিড অতিমারির কারণে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য দর্শকদের জন্য বন্ধ লাইটহাউস। অরিন্দম আশাহত হয়ে ফিরলো, আমি অবশ্য এর আগে ঘুরে এসেছি।

লাইট হাউস
কিছু কেনা কাটা ছিল, সেসব সেরে হোটেলে ফিরলাম। তখন বাজে সাড়ে ন'টা। সকলে মিলে পাশের গলিতে 'পারিজাত রেস্টুরেন্টে'র দোতালায় রাতের ডিনার সেরে হোটেলে ফিরে এলাম। পরদিন বাড়ি ফিরবো। অরিন্দম আমাকে জিজ্ঞেস করলো, "পাল'দা কাল কখন বেরোবে?" আমি অরিন্দমকে বললাম তোমার দেওয়া সময়েই আমরা বেরোবো। অরিন্দমের তৎক্ষণাৎ উত্তর, "তাহলে দুপুর বারোটায় বেরোনো যাক"। সৌমেনকে জানানো হলো, অবশেষে ওদের দুজনের মধ্যে কথাবার্তা হওয়ার পর ঠিক হলো সকাল ন'টায় বেরোনো হবে। দেরী করাটা ঠিক নয় বলেই মনে হলো। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম।

টুকটাক শপিং
আজ বাড়ি ফেরার দিন। একটু দেরি করেই বিছানা থেকে উঠলাম। ফ্রেশ হয়ে সামনের খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আনমনে চেয়ে থাকি সাগরের দিকে। উত্তাল জলতরঙ্গ আছড়ে পড়ছে সমুদ্র সৈকতে। স্নানটান করে সকালের খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা সকাল ন'টার মধ্যে রেডি। অরিন্দম এসে বললো সামান্য একটু কেনাকাটা বাকি। অবশেষে পূর্বের দেওয়া সময় অনুযায়ী দুপুর পৌনে বারোটায় হোটেলের চেক আউট করে বেরোলাম আমরা। যাক তাহলে কথা রেখেছে অরিন্দম! পুরী ভ্রমণের অনেক সুখস্মৃতি নিয়ে জয় জগন্নাথ!! বলে যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের বাড়ি পৌঁছানোটা অবশ্য অতটা সুখকর ছিল না। রাস্তায় প্রচুর জ্যাম ঠেলে, পনেরো ঘণ্টার দীর্ঘ ভ্রমণের ধকল সয়ে রাত্রি তিনটের সময় বাড়ি ফিরি।

চেয়ে আছি সাগরের দিকে
» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ 'অর্কক্ষেত্র কোণার্ক' - অনিল দে, 'মন্দিরের কথা' - গুরুদাস সরকার, 'কলিঙ্গের দেব দেউল' - নারায়ণ সান্যাল)
Arabinda Pal
0 Comments
Share This Post :

You Might Also Like

No comments:

Post a Comment

[name=Arabinda Pal] [img=https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEia50rmuKEAcbGUbQKvAbzUmdviiIhm-LeVlsEEdFx_xtGfyvx8O02yFVuJemgswzSA8PoMcN-XW0AcinKr9iq28lHK43Z4TFFyL7pJyGGxLNx9LGn0cLvPz0lUJzNrWBo9n_NyxGLjDII/h120/IMG_2788.jpg] [description=পর্যটক হিসাবে নয়, একজন ভ্রমণকারী হিসাবে বেড়ানোটা আমার কাছে একটা নেশা এবং ফটোগ্রাফিতেও আমার ভীষণ শখ। তাই একজন ভ্রমণকারী হিসাবে আমার এই ব্লগে নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে লেখা ও ছবিগুলো যদি আপনাদের ভালো লাগে তাহলে অবশ্যই আপনাদের মতামত কমেন্টসের মাধ্যমে জানাতে ভুলবেন না।] (facebook=https://www.facebook.com/groups/2071066419824586/user/100002484831922) (twitter=Twitter Profile Url) (instagram=https://www.instagram.com/arabindapal2020/) (bloglovin=Blogvin Profile Url) (pinterest=https://www.pinterest.com/arabindapalbrb/) (tumblr=Tumblr Profile Url)

Follow @Arabinda Pal