Theme Layout

Boxed or Wide or Framed

Theme Translation

Display Featured Slider

Yes

Featured Slider Styles

[Centred][caption]

Display Grid Slider

No

Grid Slider Styles

[style5][caption]

Display Trending Posts

Display Author Bio

Yes

Display Instagram Footer

Yes

Dark or Light Style

অদেখা খোঁজে... মন্দির-নগরী বিষ্ণুপুরে


পূজোর মরশুম পেরিয়ে শীতকাল চলে এলো। ওদিকে করোনার দাপটে বহুদিন বাইরে ঘুরতে যাওয়া হয়নি। ছুটির দিনগুলো ঘরে বসেই কেটে যাচ্ছে। এভাবে অনেক দিন তো হয়ে গেল, বসে-বসে আর ভাল লাগে না। ধীরে ধীরে করোনার ভয়াবহতা কাটিয়ে আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে জনজীবন। এই পরিস্থিতে ভাবলাম কাছেই কোনো জায়গা থেকে ঘুরে আসি। এরকম হঠাৎ করেই যদি মন চায় কোথাও ঘুরে আসি, তাহলেই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ি কাছেপিঠে জানা অজানা কোনো স্থান বা মন্দিরের খোঁজে। ঠিক তেমন করেই একদিন সকালে বাইকে চেপে পৌঁছে গেলাম বিষ্ণুপুরে। মধ্যযুগের প্রায় সমস্ত রীতির মন্দিরই বিষ্ণুপুরে নির্মিত হয়েছিল। ইঁট ও পাথর-এই দুই উপাদানেই নির্মিত মন্দির এখানে আছে। স্থাপত্য ভাস্কর্য-এই দুয়ের মিলনক্ষেত্র বিষ্ণুপুরের সমতুল্য কোথাও নেই। বহুবার বিষ্ণুপুর গিয়েছি কিন্তু এখনো সমস্ত দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে শেষ করতে পারিনি। শহরের অনেক গলিতে বড় গাড়ি ঢুকতে পারে না আবার পুরো শহর পায়ে হেঁটে ঘোরাও সম্ভব নয়। একমাত্র বাইকে ছাড়া ঘুরে দেখা মুশকিল তাই এবার বিষ্ণুপুরটা ভালো করে ঘুরে দেখার জন্য বাইকে চেপে চলে এলাম।

বিষ্ণুপুর শহরের ওয়েলকাম গেট
পর্যটকদের স্বাগত জানাতে বিষ্ণুপুর শহরে ঢোকার মুখে মন্দির নগরীর সঙ্গে তাল রেখে একটি আধুনিক সুদৃশ্য তোরণ বানানো হয়েছে। ওই তোরণ দিয়ে মন্দিরনগরীর মধ্যে প্রবেশ করলাম। শহর আধুনিক হয়েছে। বেড়েছে কলেবর। বাস স্ট্যান্ডের আধুনিকীকরণ হয়েছে। বিগত কয়েক বছরে বিষ্ণুপুর শহরের দ্রষ্টব্যস্থান গুলোর পারিপার্শিক অঞ্চলের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। রাস্তাঘাট আগের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে। উধাও লালমাটির মোরাম বিছানো পথ। যদিও রাস্তার দু’পাশে তা আজও উঁকি দেয়। বিষ্ণুপুর শহরে ঢুকে এবার ভ্রমণ শুরু করলাম লালবাঁধ গ্রুপ-এর মন্দির দিয়ে। চলে এলাম কালাচাঁদ সার্কেলে। কালাচাঁদ বিগ্রহের নামানুসারে এই অঞ্চলটিকে কালাচাঁদ সার্কেল বা পরিমন্ডল বলা হয়ে থাকে। এই কালাচাঁদ সার্কেলে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এবং হর্টিকালচার অফিস ছাড়াও রয়েছে কর্মী আবাসন।

হর্টিকালচার অফিস কম্পাউন্ড
গেটের একপাশে বাইক রেখে অফিস কম্পাউন্ডের ভিতরে প্রবেশ করলাম। কম্পাউন্ডে ঢোকার মুখে বাঁ দিকে অবস্থিত রাধামাধব মন্দির। এই রাধামাধব মন্দিরটি সবচেয়ে আধুনিক এবং সবচেয়ে বেশী অলঙ্কৃত। মন্দিরটি রাজা বীরসিংহের পত্নী রানী শিরোমণি দেবী ১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দে নির্মাণ করেন। মন্দিরের দেওয়ালে, খিলানের মাথায় ও থামের গায়ে নানারূপ ভাস্কর্য রয়েছে। মন্দিরের পশ্চিমে ইঁটের তৈরি বাংলার দোচালা ধাঁচের তিন খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার রয়েছে। এর আগে মাদনমোহন মন্দিরে ঢোকার সময় ঠিক এইরকম প্রবেশদ্বার দেখেছিলাম। মন্দির প্রাঙ্গনে একটি তুলসীমঞ্চও দেখতে পাওয়া গেলো।

রাধামাধব মন্দির
হর্টিকালচার অফিসের কম্পাউন্ডেই রয়েছে কালাচাঁদ মন্দির। বাগানের মধ্যে হেঁটে যাওয়ার সময় রাস্তার দু'পাশে ইঁটের তৈরি ছোট ছোট মঞ্চ দেখা গেলো। সামান্য কিছুটা পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম কালাচাঁদ মন্দিরে। মাকড়া পাথরের তৈরি একরত্ন মন্দিরগুলোর মধ্যে এই কালাচাঁদ মন্দিরটিই বিষ্ণুপুরে সর্বপ্রথম তৈরি। ১৬৫৬ খ্রীষ্টাব্দে রাজা রঘুনাথ সিংহ এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। চূড়ার অনুপাতে মন্দিরের মূল অংশ তুলনামূলকভাবে স্বল্প উচ্চতাবিশিষ্ট। মন্দিরটির গঠন-শৈলী সাদামাটা হলেও সামনের দেওয়ালে নিম্ন রিলিফ বা বাস-রিলিফ পদ্ধতির মূর্তিভাস্কর্যগুলো বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এই মন্দির প্রাঙ্গনেও দেখা গেলো একটি তুলসীমঞ্চ।

কালাচাঁদ মন্দির
হর্টিকালচার অফিস কম্পিউন্ড থেকে বেরিয়ে আবার খানিক পথ যেতেই রাস্তার বাঁ দিকে পড়ল রাধাগোবিন্দ মন্দির। রাধাগোবিন্দ মন্দিরে এসে দেখি মূল গেটের সামনে তালা ঝুলছে। গেটের বাইরে থেকে দেখেতে পেলাম মন্দির চত্বরের চারদিক ঝোপঝাড় আগাছাতে ভরা। একরত্ন এই মন্দিরটি ১৭২৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন রাজা গোপাল সিংহের পুত্র কৃষ্ণ সিংহ। মন্দির প্রাঙ্গনে দেখতে পেলাম মাকড়া পাথরের তৈরি ভিত্তিভূমির উপর অবস্থিত ইঁটের তৈরি একটি একরত্ন বিশিষ্ট ছোট্ট রথ-মন্দির।

রাধাগোবিন্দ মন্দির (পাশে ছোট্ট রথ-মন্দির)
গেটের বাইরে থেকে রাধাগোবিন্দ মন্দির দর্শন করে চলে এলাম নন্দলাল মন্দিরে। নন্দলাল মন্দিরের প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে কিছু জানা যায়নি। একরত্ন এই মন্দিরটি অনেকটাই কালাচাঁদ মন্দিরের অনুকরণে তৈরি। দু'টো মন্দিরের চেহারায় খুব একটা তফাত নেই, তবে এই মন্দিরের চূড়াটি তুলনামূলকভাবে একটু ছোট। মন্দিরের গায়ে পঙ্খের প্রলেপ এখন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত, এখন কিছু জায়গায় সামান্য প্রলেপ দেখে অনুমান করতে হয়। একরত্ন এই মন্দিরটিতে সামনের তিন খিলান দেওয়ালে পাথরের অলঙ্করণ নজরে পড়লো।

নন্দলাল মন্দির
নন্দলাল মন্দির থেকে আরো একটু এগিয়ে ছিন্নমস্তা মন্দিরের কাছে দলমাদল রোডের ঠিক উল্টো দিকের রাস্তায় চলে এলাম 'পোড়া মাটির হাটে'। তখন দুপুর, দেড়টা বাজে। ঘটনাক্রমে ওই দিনটি ছিল শনিবার, চেয়ে দেখি সামান্য কয়েকজন সেখানে কিছু পসরা সাজিয়ে বসেছে। পোড়া মাটির হাটের উল্টোদিকে নাচ-গানের অনুষ্ঠানের জন্য একটি খোলা মঞ্চ সহ গ্যালারি বানানো হয়েছে।

পোড়া মাটির হাট
পোড়া মাটির হাটের ঠিক পাশে প্রাচীর ঘেরা একই চত্বরে রয়েছে তিন তিনটি একরত্ন মন্দির। মন্দির তিনটির আলাদা কোনো নাম নেই। এদের একত্রে 'জোড় শ্রেণি মন্দির' বলা হয়। তিনটি মন্দিরের গড়ন একই। উত্তর ও দক্ষিণের মন্দির দু'টো বড়, তুলনায় মধ্যেরটি ছোট। উত্তরদিকের মন্দিরের ফলক থেকে অনুমান করা হয় ১৭২৬ খ্রীষ্টাব্দে রাজা গোপাল সিংহ এই তিনটি মন্দিরই তৈরি করেছিলেন। চারদিক জঙ্গলে ভরা সবকটি মন্দিরই এখন পরিত্যক্ত। সারা দিনের ঘোরাঘুরিতে খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। এখন পেটে কিছু দানাপানি পড়া দরকার। সোজা ট্যুরিস্ট লজে চলে এলাম।

'জোড় শ্রেণি মন্দির'
ট্যুরিস্ট লজ থেকে বেরিয়ে এলাম ভট্টাচার্য পাড়ায় মল্লেশ্বর মন্দিরে। বিষ্ণুপুরের মন্দিরগুলোর মধ্যে পশ্চিমমুখী এই মল্লেশ্বর মন্দিরটি প্রাচীনত্বের দিক থেকে রাসমঞ্চের পরে হলেও স্থাপত্যের দিক থেকে এখানকার অন্যান্য মন্দিরের তুলনায় একেবারে সাদামাটা। দেউল রীতির মাকড়া পাথরের তৈরি চারকোণা মল্লেশ্বর মন্দিরটি বীর হাম্বীর নির্মাণ শুরু করেন এবং ১৬২২ সালে তাঁর পুত্র রঘুনাথের আমলে শেষ হয়। বর্গাকার আকৃতির মন্দিরের মূল চূঁড়া ভেঙে গেলে তার বদলে এই আট কোণ বিশিষ্ট চূড়াটি স্থাপিত হয়। মন্দিরের সামনে প্রবেশ দরজার উপরে একটি কুলুঙ্গির মধ্যে সবুজ ক্লোরাইট পাথরের তৈরি হাতি ও মাহুতের একটি অপূর্ব মূর্তি রয়েছে।

মল্লেশ্বর শিবের মন্দির
মন্দিরের পাশেই ভট্টাচার্য্য পরিবারের দুর্গা মন্দিরে কয়েকটি কিশোর খেলা করছিলো, আমাকে রিপোর্টার ভেবে তারা ছবি তোলার জন্য ছেঁকে ধরলো। তাদের বললাম আমি খবরের কাগজের রিপোর্টার নই। তবুও তারা আমাকে ছাড়লো না বাধ্য হয়ে কয়েকটা ছবি তুললাম এতেই তারা বেশ খুশি হয়ে গেলো।

ভট্টাচার্য্য পরিবারের দুর্গা মন্দির
মল্লেশ্বর মন্দির থেকে বেরিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজির পর মহাপাত্র পাড়ায় মুরলীমোহন মন্দিরের দেখা পেলাম। আগাগোড়া মাকড়া পাথরের তৈরি পরিত্যক্ত মুরলীমোহন মন্দিরটি নানা দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য। প্রায় বর্গাকার একরত্ন এই মন্দিরটিতে গতানুগতিক তিন খিলানের রীতি দেখা গেলো না। তার পরিবর্তে মন্দিরের প্রতিটি দিকেই চারটি করে সুদৃশ্য থামের ওপর সামান্য খিলান আকৃতি করে তার ওপর ঈষৎ ঢালু ছাদের একটা টানা খোলা বারান্দা গর্ভগৃহকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। যা বিষ্ণুপুরের আর কোনো মন্দিরেই দেখতে পায়নি। আবার বিষ্ণুপুরের এই মন্দিরটি কোনো মল্লরাজা নয়, ১৬৬৫ খ্রীষ্টাব্দে রাধা-কৃষ্ণের প্রীতির জন্য রাজা দুর্জন সিংহের মাতা ও রাজা বীর সিংহের পত্নী চূড়ামণি দেবী এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। মন্দিরের গর্ভগৃহের ছাদের ওপর নির্মিত চূড়াটি আট কোণ বিশিষ্ট একটি বেদির উপর তৈরি। মন্দিরের গায়ে এখনো সামান্য কিছু পঙ্খের আবরণ চোখে পড়লো। এখান থেকে বেরিয়ে রাধাবিনোদ মন্দিরের খোঁজে চললাম।

মুরলীমোহন মন্দির
রাধাবিনোদ মন্দির খুঁজে বার করতে বেশ বেগ পেতে হয়। অনেক লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর শহরের খড়বাংলা পাড়ায় কয়েকটি বাচ্চা ছেলে খেলা করছিলো তারা এই মন্দিরটি আমাকে দেখিয়ে দেয়। ১৬৫৯ খ্রীষ্টাব্দে রাজা প্রথম রঘুনাথ সিংহ এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। ইঁটের তৈরি আটচালা এই মন্দিরটির নীচের চারচালা থেকে উপরের চারচালার মধ্যে উচ্চতা খুব অল্প হওয়ার ফলে মন্দিরটিকে দেখে আপাতদৃষ্টিতে চারচালা অথবা একচূড়া চারচালা মন্দির বলে বিভ্রন্তি হয়। আসলে এটি আটচালা মন্দির। বর্গাকৃতি এই মন্দিরটির গঠন ও টেরাকোটার চিত্তাকর্ষক অলঙ্করণগুলো পর্যটকদের মোহিত করে।

রাধাবিনোদ মন্দির
মন্দিরের সামনে তিন খিলানের নকশা করা প্রবেশপথ রয়েছে। এছাড়াও উত্তরের দেওয়ালে টেরাকোটার ভাস্কর্য সমন্বিত নকল কুলুঙ্গি দরজার আদলে দক্ষিণ দেওয়ালে আরো একটি প্রবেশপথ রয়েছে। দক্ষিণের প্রবেশপথ এবং উত্তরের নকল দরজার তিনদিক ঘিরে যে অলঙ্করণ আছে তা সারা পশ্চিমবঙ্গে বিরল। সংখ্যায় স্বল্প হলেও রাধাবিনোদ মন্দিরের টেরাকোটার কাজ শ্যামরায় বা জোড়বাংলা মন্দিরের থেকে কোনো অংশে কম আকর্ষক নয়। মন্দিরের উত্তর দেওয়ালের তলদেশে লঙ্কাযুদ্ধ, শিকারদৃশ্য, কৃষ্ণলীলার ক্ষুদ্রাকৃতি একাধিক টেরাকোটার দীর্ঘ সারি বেশ নজর কাড়লো। এবার চললাম দুর্গ এলাকায়।

টেরাকোটার ভাস্কর্য
দুর্গ এলাকার মন্দিরগুলো বহুবার দেখেছি তাই এবার এখানের কোনো মন্দিরে না ঢুকে সোজা চললাম পাটপুর। দুর্গ এলাকা দিয়ে যাওয়ার পথে পড়ল মাকড়া পাথরের তৈরি বিশাল তোরণ। এই স্থাপত্যটি বড় পাথর দরজা বা গড় দরজা নামে পরিচিত। আগাগোড়া মাকড়া পাথরের তৈরি এই তোরণ দ্বারটি ছিল প্রাচীন দুর্গের উত্তর দিকে প্রবেশের মূল ফটক। এক সময় দুর্গের চারপাশে পরিখা কাটা থাকতো। পরিখা কে ঘিরে থাকতো বিশাল উঁচু মাটির দেওয়াল। দুর্গ এখন নেই, আগাছার জঙ্গলের মধ্যে দেখা গেল জীর্ণ দুর্গপ্রাচীরের ধ্বাংসাবশেষ। অতীতের সাক্ষী হয়ে আছে শুষ্ক পরিখা, কাঁকড়মাটির উঁচু প্রাচীর ঘেরা সীমানার অংশ। গড় দরজার সরু পথের দুদিকের দেওয়ালে রয়েছে কুলুঙ্গির মতো চোরা খোপ। এই খোপগুলোতে থাকতো সৈন্যদল। সেখান দিয়ে নজর রাখতো কে বা কারা ওই পথে আসছে।

গড় দরজা
গড় দরজার ভিতর দিয়ে যাওয়ার রাস্তা এখন বন্ধ। পাশের কাঁচা মাটির ওপর দিয়ে গাড়ি গিয়ে অস্থায়ী একটা রাস্তা তৈরি হয়ে গিয়েছে। কোনোরকমে ওই কাঁচা রাস্তায় গিয়ে উল্টোদিকের মেন রাস্তায় চলে এলাম। গড় দরজার উল্টোদিকে কৃত্রিম পাহাড়ের মতো একটা জায়গা দেখতে পেলাম। এই পাহাড়টি মূর্চা পাহাড় বা মূর্চার পাড় নাম পরিচিত। গড় দরজা পিছনে রেখে অল্প একটু এগিয়ে যেতেই রাস্তার উপর পড়লো আরও একটি প্রবেশ তোরণ। আকারে ছোট হওয়ার কারণে এই তোরণ দ্বারটির নাম ছোট পাথর দরজা। এই দু'টো পাথরের দরজা নির্মাণ করেন রাজা বীর সিংহ। ছোট পাথরের দরজাটির নীচের অংশ মাকড়া পাথরের তৈরি আর উপরের অংশটি ইঁটের তৈরি। দেখে বোঝা গেলো এই স্থাপত্যটির সারা গায়ে পঙ্খের প্রলেপ ছিল।

ছোট পাথর-দরজা
এই ছোট পাথর-দরজা দিয়ে বেরিয়ে পাটপুরের দিকে যাওয়ার পথে ডানদিকে দেখতে পেলাম একটি ভিত্তিবেদীর উপর অবস্থিত আগাগোড়া মাকড়া পাথরের তৈরি 'রথ'। এই পাথরের রথটি রাজা প্রথম রঘুনাথ মল্লের রাজত্বকালে নির্মিত হয়েছিল। রথের নীচের অংশটির ভিতরে লক্ষ্য করে দেখা গেলো দু'পাশে তিনটে করে এবং মাঝখানে দু'টো করে অর্থাৎ মোট আটটি চাকার অর্ধাংশ রয়েছে। এই চাকাগুলো থাকার জন্য এই স্থাপত্যটিকে 'রথ' বলা হয়। চাকাগুলো না থাকলে এটি মন্দির রূপেই পরিচিত হতো। দ্বিতল এই রথের বাঁকানো কার্ণিশযুক্ত ছাদের উপরে রয়েছে একটি চূড়া। রথ প্রাঙ্গনটিকে স্থানীয় ছেলেরা এখন খেলাধুলার জায়গা বানিয়ে ফেলেছে। পাথর-রথের ঠিক পিছনে দেখা গেলো গড়-দরজার কাছে ফেলে আসা সেই মূর্চা পাহাড়কে।

পাথরের 'রথ', পিছনে মূর্চা পাহাড়
স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞেস করে পৌঁছে গেলাম বিষ্ণুপুর শহরের একপ্রান্তে কৃষ্ণবাঁধের পূর্ব পাড়ে পাটপুরে। চারদিক নিরিবিলি জানমানবহীন স্থান, ঝোপঝাড়ের ভিতরে চলার রাস্তা দিয়ে ভয়ে ভয়ে বহু কষ্টে মন্দিরের কাছে পৌঁছালাম। রাস্তায় গুটিকয় যুবককে দেখি ঝোপের মধ্যে বসে পিকনিক করছে, এরপর বুঝতেই পারছেন কিরকম অনুভব হতে পারে! নামবিহীন ল্যাটেরাইট পাথরের একরত্ন মন্দির। মন্দিরটি এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। অল্প বাঁকানো কার্নিশযুক্ত ছাদের ওপর নির্মিত গর্ভগৃহের মাথায় আট কোণ বিশিষ্ট একটি বেদীর উপরে অবস্থিত মন্দিরের চূড়াটি। ত্রিখিলানযুক্ত তিনদিকে ঢাকা বারান্দা। মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাকাল বা নির্মাণকারীর হাদিস এখনো কোনো বই খুঁজে পাইনি। গর্ভগৃহে প্রবেশ দরজার দু'পাশে দু'টো বিষ্ণুমূর্তি বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

পাটপুর মন্দির
পাটপুর থেকে লালবাঁধের দিকে রওনা দিলাম। বিষ্ণুপুর শহরের মানুষের এখন টেরাকোটা মন্দিরের পাশাপাশি এক অন্যতম পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে লালবাঁধ! এই লালবাঁধে নৌকা করে ঘুরে বেড়ানোর ব্যাবস্থা রয়েছে। 'লালবাঁধ' শব্দটির অর্থ 'লাল জলাশয়', সাধারণত ল্যাটেরাইট মাটির কারণে লালবাঁধের জল লাল বলে মনে হয়। বিষ্ণুপুর শহরের রামানন্দ কলেজের ঠিক পিছনেই রয়েছে এই বিশাল বড় জলাশয়টি। বর্তমানে লালবাঁধ পিকনিক, ফ্যামিলি ট্যুর এবং ফটোগ্রাফির জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। একটি কৃত্রিম জলাশয়, শহরের জলাভাব মেটাতে এবং শহরকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এক সময় এই জলাশয় বিষ্ণুপুরের একমাত্র জলের উৎস ছিল। তৈরি করেছিলেন মল্লরাজ দ্বিতীয় রঘুনাথ সিং। উড়িষ্যার পাঠান সর্দার রহিম খাঁকে হত্যা করে ধনরত্নের সঙ্গে সঙ্গে রূপসী নর্তকী লালবাঈকে ধরে আনেন রঘুনাথ। রাজা রঘুনাথ ও মুসলিম নর্তকী লালবাঈের প্রেম ঘিরে বিখ্যাত এই লালবাঁধ।

লালবাঁধ
সবশেষে এলাম লালগড়ে। অনেকে বলেন লালবাঈের স্মৃতি বহন করছে এই লালগড়। মল্লরাজত্বকালে এখানে ছিল একটি দুর্গ। 'গড়' শব্দটির অর্থ দুর্গ। সুতরাং সহজেই অনুমান করা যায় লালগড় মানে 'লালদুর্গ'। আজ আর তার বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। আগে এই অঞ্চলে গভীর জঙ্গল ছিল। জঙ্গলের লালমাটির উপর তৈরি হওয়ার জন্যই হয়তো এর নাম হয়েছে লালগড়। বর্তমানে এই লালগড়কে কেন্দ্র করে লালবাঁধের পাড়ে গড়ে উঠেছে 'লালগড় প্রকৃতি উদ্যান'। এসে দেখি গেট বন্ধ। সারাটা দিন ঘোরাঘুরি করতে করতে কখন যে বিকেল হয়ে গিয়েছে টেরই পাইনি। মন্দিরনগরীকে বিদায় জানিয়ে ঘরে ফিরলাম। অনেক অদেখা অজানা মন্দির দেখা হলো। এর পরেও রয়ে গেলো দেখার মতো আরও অনেক কিছু, আরো মন্দির। উইক-এন্ড ট্যুরে হাতের কাছে পোড়া মাটির শহর বিষ্ণুপুরে ছোটখাটো ভ্রমণ মোটের উপর মন্দ হ'লো না।

লালগড় প্রকৃতি উদ্যান
» প্রয়োজনীয় তথ্য

বিষ্ণুপুর শহর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অগুনতি প্রাচীন স্থাপত্য। বিষ্ণুপুর বহু প্রাচীন শহর হওয়ার ফলে এখানকার রাস্তাগুলো খুবই সরু। এখানকার রাস্তা এতটাই সরু যে সব জায়গায় গাড়ি ঢুকবে না। ফলে টোটো ভাড়া করে ঘুরে দেখা সবচেয়ে ভালো। ভালো খাওয়ার জন্য রয়েছে মোনালিসা হোটেল, এছাড়া যেতে পারেন সরকারি ট্যুরিস্ট লজে।

» বিষ্ণুপুরের বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান

  • রাসমঞ্চ, গুমগড়, শ্যামরাই মন্দির, ৺মৃন্ময়ী মাতার মন্দির, জোড় বাংলা মন্দির, রাধাশ্যাম মন্দির, লালজীউ মন্দির
  • বড় পাথর দরজা বা গড় দরজা, ছোট পাথর দরজা, পাথর রথ
  • জোড় মন্দির শ্রেণী, দলমাদল কামান, ছিন্নমস্তা মন্দির
  • নন্দলাল মন্দির, রাধাগোবিন্দ মন্দির, রাধামাধব মন্দির, কালাচাঁদ মন্দির
  • মদনমোহন মন্দির, মুরলীমোহন মন্দির, মল্লেশ্বর শিবের মন্দির, মদনগোপাল মন্দির, রাধাবিনোদ মন্দির
  • পাটপুর মন্দির
» বিষ্ণুপুর ভ্রমণ গাইড

© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ- ‘বাঁকুড়া জেলার পুরাকীর্তি’ - অমিয়কুমার বন্দোপাধ্যায়, 'মল্লভূম বিষ্ণুপুর' মনোরঞ্জন চন্দ্র)
BISHNUPUR, BANKURA, WEST BENGAL
Arabinda Pal
0 Comments
Share This Post :

You Might Also Like

No comments:

Post a Comment

[name=Arabinda Pal] [img=https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEia50rmuKEAcbGUbQKvAbzUmdviiIhm-LeVlsEEdFx_xtGfyvx8O02yFVuJemgswzSA8PoMcN-XW0AcinKr9iq28lHK43Z4TFFyL7pJyGGxLNx9LGn0cLvPz0lUJzNrWBo9n_NyxGLjDII/h120/IMG_2788.jpg] [description=পর্যটক হিসাবে নয়, একজন ভ্রমণকারী হিসাবে বেড়ানোটা আমার কাছে একটা নেশা এবং ফটোগ্রাফিতেও আমার ভীষণ শখ। তাই একজন ভ্রমণকারী হিসাবে আমার এই ব্লগে নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে লেখা ও ছবিগুলো যদি আপনাদের ভালো লাগে তাহলে অবশ্যই আপনাদের মতামত কমেন্টসের মাধ্যমে জানাতে ভুলবেন না।] (facebook=https://www.facebook.com/groups/2071066419824586/user/100002484831922) (twitter=Twitter Profile Url) (instagram=https://www.instagram.com/arabindapal2020/) (bloglovin=Blogvin Profile Url) (pinterest=https://www.pinterest.com/arabindapalbrb/) (tumblr=Tumblr Profile Url)

Follow @Arabinda Pal