মেদিনীপুর শহর থেকে দশ কিলোমিটার দূরে কংসাবতী নদীর তীরে পাথরা গ্রামটা আজ প্রচারের আলোয় আলোকিত। অখ্যাত এই গ্রামটা এখন আর কারও কাছে অপরিচিত নয়। শ্রদ্ধেয় ইয়াসিন পাঠান মহাশয় এই গ্রামটার জাতীয় পরিচিতি এনে দিয়েছেন। পাথরা মানেই যেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্যের পীঠস্থান। পাথরায় একসময় বহু মন্দির ছিল। গ্রামের পথের দু'ধারে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য মন্দির-দালানের ধ্বংসস্তূপ। তার মধ্যে চৌত্রিশটা মন্দির এখনো কোনোক্রমে টিকে আছে। এই চৌত্রিশটা মন্দিরের মধ্যে বেশ কয়েকটা মন্দির একসাথে রয়েছে কাঁসাই নদীর পাড়ে, এছাড়া রাসমঞ্চ ও অন্যান্য মন্দির গুলো রয়েছে খানিক দূরে গ্রামের মধ্যে। বর্তমানে এই মন্দিরগুলি সব পরিত্যক্ত, কোনোটাতেই বিগ্রহ নেই এবং পুজোপাঠ হয় না। অসংখ্য মন্দিরের সমাবেশের কারণে এই গ্রামটাকে বলা হয় 'মন্দিরময় পাথরা'। আজও সেখানে গেলে দেখা মেলে আড়াইশো বছরেরও বেশি পুরানো স্থাপত্য কীর্তি। এখানকার মন্দিরগুলো মূলতঃ পাতলা ইটের তৈরী, এছাড়া মন্দিরগুলোর বিশেষ আকর্ষণ টেরাকোটার প্যানেল বা ফলক।
 |
| পাথরার মন্দির |
ইতিহাসের পাতায় পাথরা
আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে আনুমানিক ১৭৩২ সালে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার সুবেদার ছিলেন নবাব আলিবর্দি খাঁ। সেই সময়ে কংসাবতী নদীর তীরে অবস্থিত এই পাথরা গ্রামটা ছিল রতনচক পরগণার অন্তর্ভুক্ত। তখন আলিবর্দী খাঁর তত্বাবধানে কয়েক হাজার পরগণা ছিল। এই রতনচক পরগণাটাও ছিল আলিবর্দি খাঁর তত্বাবধানে। এই রতনচক পরগণার নায়েব ছিলেন বিদ্যানন্দ ঘোষাল। ধর্মপ্রাণ বিদ্যানন্দ কর আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গুরুর কথায় খাজনার একটা অংশ দিয়ে তিনি একের পর এক মন্দির বানিয়ে যেতে লাগলেন। শিবমন্দির, রাসমঞ্চ থেকে শুরু করে নানা দেবদেবীর মন্দিরে ভরে উঠলো এই রতনচক গ্রাম। মন্দির প্রতিষ্ঠার কারণে বিদ্যানন্দের সুনাম ছড়ালেও তাঁর কাজে নবাব আলিবর্দী খাঁ মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। বার্ষিক খাজনা দেরিতে পৌঁছানোর কারণ নবাবের কানে গিয়ে পৌঁছাল, নবাব জানতে পেরে অত্যন্ত রুষ্ট হন। বিদ্যানন্দকে বন্দী করে মুর্শিদাবাদে নবাবের দরবারে হাজির করা হয়। সেখানে তাঁকে হাতির পায়ের তলায় পিষ্ট করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। বিদ্যানন্দকে হাত পা বেঁধে মাঠের মধ্যে পাগলা হাতির সামনে ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই পাগলা হাতি বিদ্যানন্দকে পরপর তিনবার পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তাঁকে কিছুতেই আঘাত করেনি। এই আশ্চর্যজনক ঘটনা নবাবের কানে পৌঁছালে নবাব বিদ্যানন্দকে ডেকে পাঠান। বিদ্যানন্দের মুখে তাঁর মন্দির প্রতিষ্ঠার কাহিনী ও গুরুর নির্দেশের কথা শুনে নবাব আলীবর্দী বিস্মিত হয়ে তাঁর আদেশ ফিরিয়ে নেন। এরপর সসম্মানে বিদ্যানন্দকে মুক্তি দিয়ে তাঁকে নায়েব থেকে রতনচক পরগণার জমিদার মনোনয়ন করেন। এর কিছুদিন পর বিদ্যানন্দ মারা যান। এরপর তাঁর পুত্র রত্নেশ্বর এই পরগণার জমিদার হিসেবে নিযুক্ত হন। রত্নেশ্বর তাঁর বাবার স্মৃতিকে চিরদিন অমর করে রাখার জন্য এই পরগণার নাম বদলে নতুন নাম রাখেন পাথরা। কারণ তার পিতা পাগলা হাতির পদতলে পিষ্ট না হয়ে মৃত্যকে উৎরে বেঁচে ফিরেছিলেন। 'পা উৎরা' অর্থাৎ 'পাতরা', অপভ্রংশে পাথরা ! তাই এই নামকরণ।
 |
| নবরত্ন কমপ্লেক্স |
বিদ্যানন্দের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র এবং পরবর্তী জমিদার রত্নেশ্বর ঘোষাল নবাবের দেওয়া মজুমদার উপাধি ব্যাবহার করা শুরু করেন। পরবর্তীকালে মজুমদার বংশের কোন উত্তরসূরি না থাকায় পাথরার জমিদারিত্ব পান এই বংশের দৌহিত্র বন্দ্যোপাধ্যায় বংশ। পরবর্তীকালে তাঁদেরও দৌহিত্র, বংশের সূত্র ধরে এই জমিদারির মালিক হন মুখোপাধ্যায়, ভট্টাচার্য প্রমুখ বংশ। প্রতিটা বংশই এখানে বিভিন্ন সময়ে মন্দির নির্মাণের কাজ চালিয়ে যান। আঠারো শতকের শেষে এই ধনী পরিবার ক্রমশ গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র গমন করা শুরু করলে মন্দির নির্মাণ কার্য্য থেমে যায় এবং প্রায় সব মন্দিরই ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়। মন্দিরগুলিতে যথেচ্ছ লুটপাট শুরু হলো। অনেক মন্দির ধ্বংসস্তুপে পরিণত হল। বর্তমানে কোনোরকমে ৩৪ টা মন্দির সেই ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে। অনেক বাধা বিপত্তি সত্বেও পাথরার পাশের গ্রাম হাতিহলকার বাসিন্দা মহম্মদ ইয়াসিন পাঠান মহাশয় মন্দিরগুলো বাঁচানোর জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৯৯০ সালে তৈরী করেছেন 'পাথরা পুরাতত্ব সংরক্ষণ সমিতি'। তাঁর তত্বাবধানে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া আজ ৩৪ টা মন্দিরের মধ্যে ২৮ টা মন্দির অধিগ্রহণ করেছে। ১৯৯৪ সালে তাঁর এই অসামান্য প্রয়াসের জন্য তাঁকে সরকারের তরফ থেকে কবীর পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়।
 |
| বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের কাছারি বাড়ি |
রবিবার মানেই একটা ছুটি ছুটি মেজাজ! রবিবার মানেই লং ড্রাইভ! তাই একঘেয়েমি কাটাতে, নতুন জায়গা দেখতে খুব সকালে বাইক নিয়ে একাই বেরিয়ে পড়লাম পাথরার উদ্দেশ্যে। খড়গপুরের চৌরঙ্গী থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে সোজা বাঁকুড়ার দিকে এগিয়ে গেলাম। মেদিনীপুর শহরের কাছে কাঁসাই নদীর ওপর বীরেন্দ্র শাসমল ব্রীজ পার হয়ে ডান দিকে একটা ইউ টার্ন নিলাম। হাইরোড থেকে নীচে নেমে মেদিনীপুর শহরে ঢোকার আগে পড়লো ক্ষুদিরাম পার্ক। জায়গাটার নাম আমতলা। ডান দিকের পথটা মেদিনীপুর শহরে আর বাম দিকের পথটা গিয়েছে পাথরা গ্রামে। আমতলা মোড় থেকে চুয়াডাঙ্গা পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম হাতিহলকা গ্রামের কদমতলা বাজারে। বাজার ছাড়ার পর বাম দিকে একটা মোড় নিয়ে ঢুকে পড়লাম পাথরার রাস্তায়। কদমতলা বাজার পর্যন্ত রাস্তা বেশ ভালই ছিল, কিন্তু হাতিহলকা থেকে পাথরা এই দু'কিলোমিটার রাস্তা ভীষণ ভাঙাচোরা। পিচের রাস্তা তৈরির কাজ চলছে, যাক তাহলে পরের বার এলে আর কোনো অসুবিধা হবে না। গ্রামে ঢোকার মুখে কলাইচন্ডী খাল, যা মিশেছে কাঁসাই নদীতে। পাথরার পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছে এই কাঁসাই নদী। কলাইচন্ডী খালের ব্রীজ পেরিয়ে এগিয়ে যেতেই ডানদিকে চোখে পড়লো সেই কাঁসাই নদী। নদীর চরে ধান ক্ষেত, সব্জির ক্ষেত এছাড়া গ্রামের ভেতর পুকুর, বাঁশঝাড় সবকিছু মিলিয়ে শহুরে জীবন থেকে বেরিয়ে এমন অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এই গ্রামটাতে কিছুক্ষণের জন্য হলেও যেন প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম।
 |
| চলে এলাম ঐতিহাসিক পাথরায় |
কাঁসাইয়ের বাঁধের ওপর ভাঙাচোরা লালমাটির মোরামের পথ ধরে চলতে চলতে একসময় পৌঁছে গেলাম মন্দিরময় পাথরায়। পাথরার মন্দিরগুলোকে মূলত পাঁচটা কমপ্লেক্সে ভাগ করা হয়েছে। ধর্মরাজ কমপ্লেক্স, নবরত্ন কমপ্লেক্স, কালাচাঁদ কমপ্লেক্স, শীতলা কমপ্লেক্স আর রাসমঞ্চ কমপ্লেক্স। এছাড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরো বেশ কিছু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে এখানে।
 |
| 'মন্দিরময় পাথরা' |
গ্রামের ভেতর একেবারে শুরুতে দেখি রাস্তার দুপাশে ছোট বড়ো বেশ কিছু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, বাঁ দিকে কালাচাঁদ কমপ্লেক্স আর ডান দিকে নবরত্ন কমপ্লেক্স। রাস্তার একপাশে বাইকটা দাঁড় করে প্রথমে গেলাম নবরত্ন কমপ্লেক্সে। নবরত্ন কমপ্লেক্সের প্রধান আকর্ষণ হল পাথরার সবচেয়ে বড়ো এই নবরত্ন মন্দিরটা। কথিত আছে যে মন্দিরটা অভিশপ্ত তাই এই মন্দিরে কখনও পূজা আর্চা হয়নি। মন্দিরের ভেতরের দেওয়ালে বেশ কিছুটা পঙ্খের কাজের নমুনা দেখা গেল। থামের গায়ে ও উপরে বাইরের দেওয়ালে টেরাকোটা কাজের কিছু নমুনা এখনো রয়েছে। যা দেখে বোঝা গেল একসময়ে এই মন্দিরের গায়ে প্রচুর টেরাকোটার কাজ ছিল। মন্দির সংস্কারের সময়ে এগুলো প্লাস্টারে ঢাকা পড়ে গেছে। এই নবরত্ন মন্দিরের ডান দিকে, রাস্তার ধারে দুই দ্বার বিশিষ্ট, সমতল ছাদের তিনটে শিবালয় আছে, যাদের গায়ে এখনও সামান্য পঙ্খের কাজ রয়ে গেছে। এই কমপ্লেক্সে শিবালয়গুলোর পেছন দিকে, রাস্তার একদম ধারে একটা সুন্দর তুলসীমঞ্চ আছে।
 |
| নবরত্ন মন্দির ও শিবমন্দির |
নবরত্ন মন্দিরের পাশ দিয়ে একটা পায়ে চলা পথ নেমে গেছে নদী পর্যন্ত। আর সেই রাস্তার ডান দিকে ক্ষেতের মধ্যে একেবারে কাঁসাই নদীর ধারে একলা দাঁড়িয়ে রয়েছে এক পঞ্চরত্ন শৈলীর মন্দির। নবরত্ন মন্দির থেকে বেরিয়ে ক্ষেতের আল পথ দিয়ে হেঁটে চলে এলাম সেই ধর্মঠাকুরের মন্দিরে যা ধর্মরাজ মন্দির নামে পরিচিত। এখানে নিয়মিত পুজো অর্চনা হয়। মন্দিরের পাশ দিয়ে বইছে কাঁসাই নদী। এই পঞ্চরত্ন মন্দিরটা সংস্কার করা হয়েছে। দক্ষিণমুখী এই মন্দিরের সামনে তিনটে খিলান প্রবেশপথ রয়েছে। মন্দিরে পঙ্খের কিছু কাজ দেখা গেলেও টেরাকোটার অলঙ্করণগুলো প্লাস্টারে সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে গেছে।
 |
| ধর্মরাজ মন্দির |
নবরত্ন কমপ্লেক্সর ঠিক উল্টো দিকে কালাচাঁদ কমপ্লেক্স। ধর্মরাজ মন্দির থেকে মেন রাস্তায় ফিরে এসে আরো কিছুটা এগিয়ে চলে এলাম কালাচাঁদ কমপ্লেক্সে। এই কালাচাঁদ কমপ্লেক্সের ছোটো মাঠ মতন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেকগুলো মন্দির আছে। এর মধ্যে রাস্তার একদম পাশে রয়েছে একটা সাদামাটা সমতল ছাদবিশিষ্ট দালান রীতির নাটমন্দির। এই মন্দিরটা সম্পূর্ণভাবে সংস্কার করা হয়েছে। পাঁচ খিলানের এই মন্দিরের গায়ে কোনো কারুকার্য নেই। একসময় এই মন্দিরে লক্ষী জনার্দন এবং কালাচাঁদ ঠাকুর পূজিত হতেন। লক্ষী জনার্দন এবং কালাচাঁদের মূর্তিগুলো এখান থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন এখানে পুজোপাঠ হয় না।
 |
| কালাচাঁদ মন্দির |
কালাচাঁদ মন্দিরের পিছনে দেখতে পেলাম একটা পঞ্চরত্ন শৈলীর শিব মন্দির। উঁচু ভিতের উপরে তৈরি এই মন্দিরের গায়ে অনেকটা উপরে কিছু টেরাকোটা মূর্তির ফলক দেখা গেল। মন্দিরের একদিকের দেওয়ালে দেখা গেল এক রমণী এক পাল্লা বন্ধ দরজা দিয়ে উঁকি মারছেন। এই মন্দিরে অলঙ্করণ বলতে এটুকুই। খড়খড়ি দেওয়া আধখোলা দরজার সামনে দাঁড়ানো এই নারীমূর্তি হল ‘দ্বারবর্তিনী’ মূর্তি। এই মূর্তিটা যথেষ্ট বড় এবং মন্দিরের যে পাশের দেওয়ালে এই মূর্তি সেখানে আর অন্য কোন মূর্তি নেই, তাই স্বাভাবিকভাবেই এটা বেশী করে চোখে পড়ে। এ অঞ্চলে ঝাড়েশ্বর মন্দিরে গিয়েও দেখেছিলাম এরকম নারীমূর্তি। মেদিনীপুর জেলা জুড়ে সেই সময়ে তৈরি অনেক মন্দিরেই এই দ্বারবর্তিনী মূর্তি দেখা যায়।
 |
| পঞ্চশিব মন্দির |
কালাচাঁদের দালানের পিছনে একদিকে যেমন পঞ্চরত্ন শিবমন্দির রয়েছে, ঠিক তেমনই অন্যদিকে অর্থাৎ ওই পঞ্চরত্ন মন্দিরের উল্টোদিকে উঁচু ভিতের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে তিনটে আটচালা শিব মন্দির। মন্দিরগুলো গায়ে গায়ে ঠেকানো। একেবারে ডানদিকের মন্দিরে রয়েছে একটা প্রতিষ্ঠাফলক। সেখানে লেখা রয়েছে শকাব্দ ১৭৭১, সন ১২৫৫ সাল। অর্থাৎ এই মন্দিরগুলো তৈরি হয়েছিল ইংরেজি ১৮৫০ সাল নাগাদ। মন্দিরগুলোর গায়ে টেরাকোটা ফলক রয়েছে ঠিকই তবে সেগুলোর বেশিরভাগই ক্ষয়ে এসেছে।
 |
| আটচালা শিব মন্দির |
এখানে এই ডানদিকের আটচালা শিব মন্দিরের একদম পাশেই রয়েছে চুন সুরকি আর পোড়ামাটির ইট দিয়ে তৈরি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত একটা দোতলা বাড়ির কিছু অংশ। এর ভেতরে একটা সিঁড়িও আছে, সেই সিঁড়ি দিয়ে অতি সাবধানে পা ফেলে এখনো দোতলায় ওঠা যায়। এই দোতলা বাড়িটা কিসের সেটা বোঝা গেল না। এই বাড়িটা থেকে একটু দূরেই রয়েছে মাকড়া পাথরে তৈরি একটা ভাঙা দুর্গামন্ডপ। হতে পারে এটা সেই ভেঙে পড়া ঠাকুরদালানের কোনো অংশ। যাকে মন্দির বাড়ি বলা যেতে পারে। এই মন্দির বাড়ি থেকে দুর্গাদালানের মাঝে হয়তো কিছু ছিল। যার চিহ্ন বলতে শুধুই মাটির সঙ্গে মিশে থাকা কয়েকটা ইটের টুকরো। হতে পারে শিবমন্দির থেকে দুর্গামণ্ডপ যাওয়ার জন্য কোনও ঢাকা বারান্দা ছিল! মন্দিরের কোন থামের অস্তিত্ব এখন আর নেই, কিন্তু অনেকগুলো পাথরের থামের তলার অংশ দেখে মনে হল এগুলো সেই বারান্দার থামেরই ধ্বংসাবশেষ।
 |
| মন্দির বাড়ি |
এর পরেই আসি মন্দির বাড়ির পাশেই গায়ে লাগোয়া দুর্গামন্ডপে। এটা একটা সমতল ছাদের দালান মন্দির। দক্ষিণমুখী এই মন্দিরের ছাদ এখন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। এই কমপ্লেক্সের সবচেয়ে চমকপ্রদ মন্দির হল এই দুর্গাদালান। মূল মন্ডপটা বেশ বড় এবং চওড়া, এক খিলানের প্রবেশপথের দু'দিকেই গোলাকার থাম আর তার উপর খোদাই করা ঝালরের মতন নকশা। এছাড়া বাইরের ও ভেতরের দিকে দেওয়ালের গায়ে অনেকগুলো কুলুঙ্গী। এক সময় এই মন্দিরে ধুমধাম করে দুর্গাপূজা পালিত হত। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসতো এখানে। সেই জাঁকজমক আর নেই। এখন মন্দিরের দেওয়ালগুলো কেবল অতীতের স্মৃতি বুকে নিয়ে একলা দাঁড়িয়ে আছে।
 |
| দুর্গামণ্ডপ |
এগুলো ছাড়া আরো দুটো শিবমন্দির আছে এই কালাচাঁদ কমপ্লেক্সে। দুর্গাদালান পেরিয়ে বড় রাস্তা ধরে গ্রামের রাস্তার দিকে কিছুটা যেতেই দেখা গেল মাঠের মধ্যে দুটো অর্ধপ্রোথিত শিব মন্দির। একটা পঞ্চরত্ন শৈলীর ও অন্যটা আটচালা রীতির। মন্দির দুটোর অবস্থা অনেকটাই ভাল। পঞ্চরত্ন মন্দিরটা তিন খিলানের, সেই খিলানের ওপরে অনেক জায়গায় পঙ্খের কাজ এখনো রয়েছে। চুন, বালি, চিটেগুড়, পাকা কলা, জায়ফল, হরিতকী, খয়ের, সুরকিগুড়ো, শাঁখ, ঝিনুকের মিহি গুঁড়ো ইত্যাদি মিশিয়ে তৈরী হতো পঙ্খ। এই মিশ্রণ দিয়ে মন্দির গাত্রে নকশা আঁকা হতো। মন্দিরের দুপাশের প্যানেলে ও কার্ণিশে বেশ কিছু টেরাকোটার ফলক এখনও রয়েছে।
 |
| কালাচাঁদ কমপ্লেক্সে পঞ্চরত্ন শিব মন্দির |
এই মন্দিরের পাশেই রয়েছে সাদামাটা একটা আটচালা শিব মন্দির। এই আটচালা মন্দিরের গায়ে বেশী কাজ না থাকলেও মন্দিরটা কিন্তু আপেক্ষিক ভাবে অনেক মজবুত। মাটি খুঁড়ে মন্দিরগুলোকে বের করা হয়েছে বলে এগুলো এখনো মাটির খানিকটা তলায়। একটা ছোট্ট সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা নীচে নেমে দেখতে পেলাম মন্দিরের প্রবেশপথ। মন্দিরগুলো থেকে একটু দূরে আরো একটা মন্দির চোখে পড়ল। সেটা প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। রত্ন শৈলীর সেই মন্দিরের একটা চূড়ার মাথাটুকুই শুধু দেখা যাচ্ছে, বাকিটা মাটির নীচে প্রোথিত, তাই মন্দিরের ভিতের উচ্চতা বিচার করলে মনে হয় এটাই এই কমপ্লেক্সের সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির।
 |
| আটচালা রীতির শিব মন্দির |
কালাচাঁদ কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়েই বাঁদিকে একটা রাস্তা চলে গেছে গ্রামের ভেতরে। সেই রাস্তা পেরিয়ে আর একটু সোজা গিয়ে বাঁহাতে পড়ল একটা ছোট মন্দির। পাথরা গ্রামের বন্দোপাধ্যায়দের এই শীতলার মন্দিরটা বুড়িমার থান হিসেবেই পরিচিত। এখানে এখন শীতলা দেবীর নিত্য পূজো হয়। উড়িষ্যার দেউল রীতিতে তৈরি এই গোলাপী রঙের মন্দিরটা নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে। এটাও যে এই এলাকার একটা প্রাচীন মন্দির তা দেখে বোঝায় গেল না। মনে হল এটা একেবারে একটা নতুন ও আধুনিক মন্দির। এই মন্দিরের প্রাচীন বৈশিষ্ট্য বলতে শুধু মন্দিরের প্রবেশ পথের চারপাশে প্রাচীন কিছু ফলক ও নকশা এখনো রয়েছে। তবে, সেগুলোর ওপরেও মন্দিরের বাকী অংশের সঙ্গে মিলিয়ে গোলাপী রং করা হয়েছে, ফলে তার প্রাচীনত্ব এখন আর সেভাবে বোঝা যায় না।
 |
| শীতলা মন্দির |
শীতলা মন্দির থেকে একটু পিছনে এসে বড় রাস্তা ছেড়ে গ্রামের ভেতরে যাওয়ার রাস্তা। সেই গ্রামের রাস্তা ধরে একটুখানি এগিয়েই বাঁহাতে চোখে পড়লো একটা পুরোনো মন্দির। বাড়ির উঠোনের মধ্যে দিয়ে গিয়ে পৌঁছালাম সেই মন্দিরের কাছে। বড় বড় গাছগাছালির মধ্যে ঢাকা এই পঞ্চরত্ন মন্দিরটা সর্বমঙ্গলা মন্দির। মন্দিরের সামনের অংশে রয়েছে তিনটে খিলান, যার মধ্যে মাঝের খিলানটা মন্দিরের প্রবেশপথ এবং পাশের খিলান দুটো দেওয়াল দিয়ে বন্ধ করা আছে। এই মন্দিরেও মাঝের খিলানের ওপর পুরোনো পঙ্খের কাজ এবং দুপাশের প্যানেলে আর ওপরদিকে কিছু টেরাকোটার ফলক এখনও রয়েছে। মন্দিরে কোন বিগ্রহ নেই।
 |
| সর্বমঙ্গলা মন্দির |
সর্বমঙ্গলা মন্দিরকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি। গ্রামের পথ, একটু উঁচু নিচু, দুদিকে গাছের সারি। একটুখানি যেতেই দেখি রাস্তাটা দুটো ভাগ নিয়েছে। ঠিক করতে পারলাম না কোন দিকে যাব। রাস্তার মোড়ে একটা ছোট্ট দোকানে গিয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম। উনি হাত তুলে একটা রাস্তা দেখিয়ে বললেন এটা দিয়ে চলে যান। গ্রামের সরু রাস্তা। গাছ গাছালিতে ঘেরা, মাঝে মাঝেই গ্রামের বাড়ী, কোনটা মাটির, কোনটা বা পাকা। বড় গাড়ী চলবেনা এই রাস্তায়। কিছুদূর পর্যন্ত গিয়েই রাস্তা শেষ। বাকিটুকু মেঠো পথ। ব্যস! আর রাস্তা নেই। এই জায়গাটা রাসমঞ্চ কমপ্লেক্স নামে পরিচিত। এখানে ডানদিকে চোখে পড়লো তিনটে মন্দির। পাশাপাশি, কিন্তু আলাদা আলাদা উঁচু ভিতের ওপর স্থাপিত। সবগুলো মন্দিরই একই আকার এবং উচ্চতার।
 |
| রাসমঞ্চ কমপ্লেক্সে পঞ্চরত্ন শিব মন্দির |
পঞ্চরত্ন শৈলীতে তৈরি এই তিনটে শিব মন্দির বন্দোপাধ্যায়রা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠা লিপি থেকে জানা যায় ১৭৩৮ শকাব্দে অর্থাৎ ১২২৪ সনে এই তিনটে মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিটা মন্দিরেই শিবলিঙ্গ আছে। মন্দির তিনটের সামনের অংশে ও দুপাশে বেশ কিছু টেরাকোটা কাজ ও পঙ্খের সূক্ষ্ম নকশা এখনো রয়েছে। প্রতিটা মন্দিরের প্রবেশপথের দুপাশে অলঙ্কৃত মূর্তি রয়েছে যা দ্বারপালক (দ্বাররক্ষক) নামে পরিচিত। এই দ্বাররক্ষীদের তিনযুগের তিনরকম পোশাকে দেখা যায়। উত্তরদিকের প্রথম মন্দিরে যে দ্বারপালক রয়েছে তার হাতে রয়েছে লাঠি, পরের মন্দিরের দ্বারপালকের হাতে বন্দুক আর শেষের মন্দিরের দ্বারপালকের হাতে তলোয়ার। এই তিনটে মন্দিরে এখনো গ্রামের লোক পূজার্চনা করে থাকেন।
 |
| দ্বাররক্ষক |
এই তিনটে মন্দির ছাড়িয়ে আর একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম বাঁহাতে একটা খোলা জমি আর তারই একপাশে একটা দোতলা পরিত্যক্ত বাড়ি। এটা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের কাছারি বাড়ি। একেবারেই ভাঙাচোরা। শুধু কাঠামোটা পড়ে আছে। বাড়ীর বাইরেটা অক্ষত থাকলেও ছাদ এখন আর নেই। ভেতরে পুরো আগাছার জঙ্গলে ভর্তি। জানালা, দরজাও উধাও হয়ে গেছে। এই বাড়ীর পাশেই দেখা গেলো একটা ছোট সমতল ছাদের দালান আকৃতির শিবমন্দির। ভেতরের শিবলিঙ্গ এখনও রয়েছে। শিবলিঙ্গের মাথায় একটা টগর ফুল রাখা। মনে হলো এখনো পূজা আর্চা হয়ে থাকে এই মন্দিরে।
 |
| বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের কাছারি বাড়ি |
কাছারি বাড়ির সামনে উঁচু বেদীর ওপর একটা আট কোণা রাসমঞ্চ আছে। এই রাসমঞ্চে মোট নটা চূড়া রয়েছে। পুরো চূড়াটা দেখতে ওল্টানো পদ্মের মতো। এরকম বেহারি রসুন চূড়া শৈলির রাসমঞ্চ খুবই কম দেখা যায়। এর প্রতিটা স্তম্ভের গায়ে টেরাকোটা ও পঙ্খের সূক্ষ্ম নকশা রয়েছে। আট কোণা বিশিষ্ট এই রাসমঞ্চের আটটা কোণেই রয়েছে পেখম তোলা ময়ূরের মূর্তি। প্রতিটা দরজার দুপাশে দ্বারপালিকা দিয়ে সুশোভিত। রাধিকার সখিরা এখানে দ্বারপালিকার ভূমিকায় রয়েছে। বেশিরভাগ মূর্তিই এখন দেখা যায় না কেবল অনুমান করতে হয়। ঘোরা শেষ, বাইকে স্টার্ট দিলাম। পাথরার ঐতিহাসিক স্থাপত্যকে পিছনে ফেলে সুন্দর একটা স্মৃতি নিয়ে ক্রমশ বাড়ির দিকে এগিয়ে চললাম। ভবিষ্যতে হয়ত এগুলো নিয়েই স্মৃতিচারন করতে হবে।
 |
| রাসমঞ্চ |
» প্রয়োজনীয় তথ্যপাথরায় খাবারের কোনো দোকান নেই। তাই খাবার ও জল সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ভালো। হাতিহলকা বাজার ছাড়া কাছাকাছি সেরকম দোকানপাট নেই। শীতকাল এখানে ঘোরার জন্য আদর্শ।
» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ- ‘মন্দিরময় পাথরার ইতিবৃত্ত’ - ইয়াসিন পাঠান)
PATHRA, PASCHIM MEDINIPUR, WEST BENGAL
খুব ভালো ফটোগ্রাফি ও কাহিনীর জন্য প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। আপনার এই পোস্ট উৎসাহী ভ্রমনকারিদের খুবই উপকারে আসবে।
ReplyDelete