বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?' -'কাজলা দিদি' কবিতাটির এক পঙক্তি শুনলেই অতীতের সেই সুন্দর স্মৃতি হঠাৎ মনের পর্দায় ভেসে ওঠে জীবন্ত হয়ে। ফিরে যেতে ইচ্ছে করে এক পলকে সেই পুরানো দিনটায়। পুরানো স্মৃতিকে ফিরে পাওয়ার এই আকুলতাকেই হয়তো আমরা বলি, নস্টালজিয়া! এক লহমায় মনে পড়ে যায় সেই পল্লীকবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর নাম। 'কাজলাদিদি' এবং 'জন্মভূমি' এই দুটি কবিতা সমস্ত বাঙালির হৃদয়ে অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী যিনি 'কাজলা দিদি' লিখে সকল পাঠকের মন জয় করেছেন। তাঁর অমর সৃষ্টি 'কাজলা দিদি' কবিতাটি পরবর্তীকালে সুধীন দাশগুপ্তের সুরে প্রতিমা বন্ধ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে একটি অতি জনপ্রিয় গান হয়ে বাঙালি শ্রোতার হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছে। নদীয়া জেলার করিমপুরে বাগচী যমশেরপুর গ্রাম। এই গ্রামের মাঝে ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে দাঁড়িয়ে আছে সুবিশাল দু'টি জমিদার বাড়ি। এই জমিদার পরিবারে কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর জন্ম। সামান্য ব্যবধানে দুটি পেল্লাই বাড়ি। একটি পুজোর বাড়ি তথা বাগচীদের পুরাতন বাড়ি। অন্যটি তাঁদের নতুন বাড়ি বলে পরিচিত। কবির সেই জন্মভিটে বাগচী বাড়ি আজ জৌলুস হারিয়ে বড় অবহেলায় পড়ে আছে।
 |
| ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে দাঁড়িয়ে আছে সুবিশাল জমিদারবাড়ি |
করিমপুর অতীতে ছিল বর্ধিষ্ণু গ্রাম! এখন সে এক মফস্বল। নদীপ্রধান এই অঞ্চলে নীল চাষের উপযোগী থাকায় সেই সময় জন এ্যান্ড ওয়াটসন কোম্পানী লাভজনক নীলের কারবার চালু করে। করিমপুরের খুব কাছেই শিকারপুর। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া এই গ্রামে তখন নীলকর সাহেবদের কুঠি ছিল। এখনও সেখানে গেলে নীলকর সাহেবদের সমাধি দেখতে পাওয়া যায়। নীলকর সাহেবরা থাকাকালীন খ্রীস্টান পাদরীরা ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এই গ্রামের শান্তিরাজপুরে গির্জা নির্মাণ করেন। এই শিকারপুরেই ভারতবর্ষের অন্যতম মহাসাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মহারাজের জন্মস্থান রয়েছে। বর্তমানে তাঁর সেই জন্মস্থানে স্মৃতি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া করিমপুরের নিকটে দোগাছি গ্রামে অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত নাটোরের রানী 'ভবানী'র স্মৃতিবিজড়িত দোগাছি রাজবল্লভী মন্দিরটি এখনো কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে।
 |
| বাগচী পরিবারের অপর সদস্যের বাড়ি |
করিমপুর ও শিকারপুরের মধ্যে একটি ছোট গ্রাম আরবপুর। গ্রামটি বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছে। এই গ্রামেই আমার মায়ের মামার বাড়ি। গ্রামের এই বাড়িতে আমার এক মামাতো ভাই থাকে। বয়সে কয়েক বছরের ছোট হলেও আমার বন্ধুর মতো। ঘুরতেও খুব ভালবাসে। কথা হচ্ছিল আমার মামাতো ভাই অনিমেষের সাথে বাগচী বাড়ি প্রসঙ্গে। অনিমেষ বলল, করিমপুরের কাছে যমশেরপুরে কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর বাড়ি এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভ্রমণপ্রিয় মানুষ, তাই বাগচী বাড়ির কথা শুনেই সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। কিন্তু একা যেতে ইচ্ছে করছিল না। অনিমেষকে প্রস্তাবটা দিতেই সে এককথায় রাজি হয়ে গেল। পরদিন সকালে দুজনে মিলে স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাগচী যমশেরপুর আরবপুর থেকে খুব দূরে নয়। আধ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম যমশেরপুরের সেই বিখ্যাত বাগচী বাড়ির সামনে। গ্রামটি বাগচী যমশেরপুর নামেই সকলের কাছে পরিচিত। কেননা বাগচীরা ছিলেন সেখানকার জমিদার। স্কুটি থেকে নেমেই চোখে পড়ল একটি সুবিশাল জমিদারবাড়ি। কাছে এগিয়ে যেতেই দেখি বাড়ির দরজা বন্ধ। কিন্তু দেখলাম এই বাড়িতে মানুষ বসবাস করে। এটা প্রাইভেট প্রপার্টি, হয়তো বাগচী পরিবারের কেউ থাকেন এখানে।
 |
| অতীতের স্বর্গপুরী আজ প্রায় ভগ্নস্তূপ অট্টালিকা |
বাড়ির বাইরের দিকে সুন্দর কারুকার্য করা বড় বড় দুটো পিলার দাঁড়িয়ে। সেগুলোর অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। সেই ভগ্নাবশেষের উপরে গজিয়ে উঠেছে জঙ্গল। সামনে একটা পুকুর রয়েছে দেখছি। তার বাঁধানো ঘাটের অনেকটাই এখনও টিঁকে আছে। আমিও ক্যামেরা বের করে বাড়ির বাইরের ছবি তুলতে শুরু করলাম। অনিমেষকে বললাম এইবার আয় দালানের ভেতরে যাওয়া যাক। দালানের থামগুলো সুন্দর ডিজাইন করা, ভেতরের দেওয়ালে আর খিলানের উপরেও একসময় কি সুন্দর নক্সা করা ছিল। আরও ভাল লাগল কাঠের কারুকার্য করা দরজা দেখে। এত খরচ করে, এত পরিশ্রম করে তৈরি করা এমন সুন্দর বাড়িটি আজ জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে দেখেই খারাপ লাগছে।
 |
| বন্ধ সিংহদুয়ার |
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে ভাবছি একটু যদি ভিতরে যাওয়া যেতো! ঠিক তখনই একজন বয়স্ক লোকের সাথে দেখা হল। এই বাগচী পরিবারের অন্যতম প্রবীণ সদস্য। তিনি বেশ উৎসাহ নিয়ে আমাদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে দাঁড়ালাম দোতলার ছাদে।
 |
| দুর্গা দালান |
তাঁর কাছে জানলাম এই যমশেরপুর গ্রামে বাগচী পরিবারের দু'টো বাড়ি রয়েছে। এটি পুরাতন বাগচী বাড়ি, যতীন্দ্রমোহন এই বাড়িতে জন্মগ্রহণ করলেও পরে তিনি এখানে থাকতেন না। আঙুল তুলে দূরের একটা বাড়ি দেখিয়ে আমাদের বললেন, ওটা আমাদের নতুন বাড়ি। ওই বাড়িতেই কবি থাকতেন। এরপর আমার অনুরোধে তিনি দুর্গাদালান থেকে শুরু করে একে একে পুরো বাড়িটা আমাদের ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন। বাড়িটি বয়সের ভারে জীর্ণ হয়ে গেলেও এখনও যা আছে, তা দেখার মতোই। এই বাড়িতে আজও দুর্গাপুজো হয়। শুনেছি সেই সময় বহু লোকের সমাগম হয় এই বাগচী বাড়িতে।
 |
| বাড়ির অন্দরমহল |
যমশেরপুর গ্রামে অবস্থিত এই রাজপ্রাসাদের ন্যায় বিশাল বাড়িটি পত্তন করেছিলেন যতীন্দ্রমোহন বাগচীর পূর্বপুরুষ সৃষ্টিধর বাগচী যা ‘পুরাতন বাগচী বাড়ি’ নাম পরিচিত। সৃষ্টিধরের পরবর্তী বংশধর যতীন্দ্রমোহনের পিতা হরিমোহন বাগচী পুরাতন বাগচী বাড়ির নিকটে আর একটি সুবিশাল রাজপ্রাসাদের ন্যায় বাড়ি তৈরি করেন, যেটিকে 'নতুন বাগচী বাড়ি' বলা হয়। 'পুরাতন বাগচী বাড়ি'র ছাদের উপর থেকেই দেখা গেলো সেই নতুন বাগচী বাড়ি।
 |
| পুরাতন বাড়ির ছাদে |
পাঁচিল ঘেরা একটা বড় বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাড়ির দেউড়ির সামনে ছোটখাটো একটা ভিড় জমেছে। তাদের বেশিরভাগই মহিলা। নিশ্চয়ই কোনো না কোনো অনুষ্ঠান হবে। ভিড় দেখে আর ভেতরে ঢুকলাম না। এই গ্রামে বাগচীদের বিশাল প্রাসাদোপম দুটি বাড়ি রয়েছে। এটি তাঁদের নতুন বাড়ি বলে পরিচিত। এই নতুন বাড়িতেই কবি যতীন্দ্রমোহন থাকতেন। দোতলা বাড়ি কিন্তু তিনতলার চেয়েও উঁচু। পুরো বাড়ির চারপাশ ইটের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। বাড়ির ছাদে ও দেওয়ালের ফাঁকে আগাছার জঙ্গলে ভরে গিয়েছে। এই বাড়ির সামনেও একটা বড় পুকুর আছে। বেশ পুরনো একটা বাঁধানো ঘাটও আছে। অতি প্রাচীন এই বাড়িটি এখন প্রায় ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে। এই ভগ্নস্তূপেই চাপা পড়ে রয়েছে যতীন্দ্রমোহনের জীবনের স্মৃতি।
 |
| নতুন বাগচী বাড়ি |
প্রায় পরিত্যক্ত বাড়ি। তবে দেখে বোঝা যায়, একটা সময় ছিল যখন এই বাড়ির সৌন্দর্য ছিল দেখার মতো। দোতলায় রয়েছে কবির লাইব্রেরি কক্ষ। সামনে একটি বারান্দা, যেখানে বসে কবি লিখতেন। সেই লাইব্রেরি কক্ষটিরও আজ বেহাল অবস্থা। নোংরা ধুলো আর মাকড়সার জালে ঢেকে আছে। বাড়ির পেছনের দিকটা ঝোপঝাড় ও জঙ্গলে ভর্তি। দিনের বেলাতেও সাপখোপের ভয়ে সেদিকে যাওয়া যায় না। পুরনো বাগচী বাড়ির অবস্থা তুলনামূলক ভাবে ভালো। এদিক ওদিক চক্কর দেওয়ার পর চোখে পড়ল সেই বাঁশ বাগান... সেই পুকুর। যা নিয়ে কবি লিখেছিলেন, 'বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শ্লোক বলা কাজলা দিদি কই'।
 |
| বড় অবহেলায় পড়ে আছে কবির জন্মভিটে |
মহাসাধকের পূণ্যভূমি শিকারপুর
সকালে বাগচী বাড়ি দেখে ঘরে ফিরলাম। দুপুরে লাঞ্চের পর অনিমেষ বললো চলো, আজ শিকারপুরে গিয়ে বাংলাদেশ বর্ডারটা তোমাকে দেখিয়ে নিয়ে আসি। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। বেরিয়ে পড়লাম বর্ডার দেখতে, যেহেতু অনিমেষ স্থানীয় ছেলে তাই সহজেই বর্ডারের রাস্তায় ঘোরার অনুমতি পেয়ে গেলাম। শিকারপুরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মাথাভাঙ্গা নদী যার একদিকে ভারত অপরদিকে বাংলাদেশ। অনিমেষের কাছে জানতে পারলাম মহাসাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর জন্ম হয়েছিল এই গ্রামেই। গেলাম সেই পূণ্যস্থান পরিদর্শন করতে। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম আচার্য এবং তিনি ছিলেন প্রসিদ্ধ অদ্বৈতাচার্য প্রভুর বংশাধীন দশম পুরুষ। শিক্ষার প্রসার ও কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গঠনে তাঁর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ১৮৪১ খ্রীষ্টাব্দের ২রা অগাস্ট সোমবার ঝুলন পূর্ণিমার দিন সন্ধ্যাকালে মহাত্মা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মহারাজ জন্মগ্রহণ করেন। নদীয়া জেলার শিকারপুরের কাছে দহকুল গ্রামে ছিল তাঁর মাতুলালয়। এই মাতুলালয় তাঁহার জন্মস্থান। তিনি যখন মাতৃগর্ভে ছিলেন, সেই সময় তাঁর মাতা স্বর্ণময়ী দেবী আমাশয় রোগে ভুগছিলেন। পরোপকারী বিজয়কৃষ্ণের মাতুল গৌরীপ্রসাদ জোদ্দার একজন বিপন্ন লোকের জামিনদার হয়ে টাকার দায় থেকে রক্ষা করেন। কিন্তু সেই লোকটি সময়কালে টাকা শোধ না করে পালিয়ে যায়। ফলে তাঁর মাতুলের সম্পত্তি নিলামে ক্রোক হয়। ঝুলন পূর্ণিমার সন্ধ্যায় যখন সম্পত্তি ক্রোক হচ্ছিলো ঐ দিন তখন তাঁর মাতা স্বর্ণময়ী দেবীর প্রসব বেদনা শুরু হয়। প্রসব বেদনার সময় স্বর্ণময়ী দেবী বাড়ির কাছেই এক কচুবনে মলত্যাগ করতে গিয়েছিলেন। আর এই কচুবনেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন মহাসাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। এখানে আজ সেই কচুবন আর নেই। এখন সেখানে তাঁর জন্মস্থানটিতে একটি চতুস্কোণ স্মৃতিস্তম্ভ আছে এবং একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। প্রাচীরঘেরা একটি তোরণ দ্বার দিয়ে স্মৃতিমন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করে ধন্য হলাম সেই মহাসাধকের পূণ্যভূমি স্পর্শ করে।
 |
| মহাসাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর জন্মস্থান |
আগেই বলেছি এই শিকারপুর গ্রামে নীলকর সাহেবদের কুঠি ছিল। গ্রামের ভিতরের রাস্তা দিয়ে যেতে তার নমুনা হিসাবে একটা বাড়ির সামনে আগাছার মধ্যে প্রাচীন সমাধি দেখতে পেলাম। অনেক কষ্টে তার খোদাই করা ফলক উদ্ধার করে দেখলাম সেটি কোনো এক নীলকর সাহেবের সমাধি। এরপরে অনিমেষ গাইড হিসেবে নিয়ে গেলো শিকারপুর সংলগ্ন শান্তিরাজপুরের একটি প্রাচীন গির্জায়। ইংল্যান্ডের গ্রাম্য উপাসনা গৃহের ন্যায় অর্ধ গথিক স্থাপত্যে তৈরি এই গির্জাটি 'ক্রাইস্ট চার্চ' নামে পরিচিত। নীলকর সাহেবদের বসবাসকালে খ্রীস্টান মিশনারীগণ গ্রামে গ্রামে ধর্ম্ম প্রচারের জন্য এই গির্জা প্রতিষ্ঠা করেন। গির্জার দরজা বন্ধ থাকায় ভেতরে প্রবেশ করতে পারলাম না। সুন্দর ফুলের বাগানে কিছুক্ষণ ঘুরে ঘরে ফিরতে রাত্রি হয়ে গেলো।
 |
| শান্তিরাজপুর গির্জা |
পরদিন জলঙ্গিতে পদ্মা নদী দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। সেই ছোটবেলায় দেখেছিলাম, তখন পদ্মা জলঙ্গি বাজার থেকে অনেক দূরে ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি, এমন সময় অনিমেষের স্ত্রী ফোন করে জানালো ওদিকে রাজ্য সড়কে অবরোধ চলছে না যাওয়ায় ভালো। চঞ্চল মন, এতদূর এসে ঘরে চুপচাপ বসে থাকবো! না... কিছু একটা ভাবতে হবে। আমাদের পৈতৃক ভিটে ছিল এই করিমপুর সংলগ্ন মুর্শিদাবাদের একটি গ্রামে। বহু বছর কেটে গিয়েছে সেখানে আর কোনো অস্তিত্ব নেই। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অনিমেষ আমাকে বললো চলো সেই গ্রাম থেকে ঘুরে আসি।
 |
| মাঠে-প্রান্তরে শোভা পাচ্ছে হলুদের অপরূপ দৃশ্য |
স্কুটারে চেপে বেরিয়ে পড়লাম দুজনে। করিমপুরের একপাশ দিয়ে বয়ে চলা খড়ে নদী বর্তমানে যার নাম জলঙ্গি। ছোটবেলায় এই নদীতে পাট ভর্তি বহু নৌকার আনাগোনা চোখে পড়তো। এখন গিয়ে দেখি মজে গিয়ে কচুরিপানায় ভরে গিয়েছে। বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে নদীর ধার দিয়ে গ্রামের মেঠোপথে চলেছি। একদিকে নদী অন্যদিকে মাঠে-প্রান্তরে সর্ষে ক্ষেতে শোভা পাচ্ছে হলুদের অপরূপ দৃশ্য। যে দিকে তাকায় চোখ জুড়িয়ে যায়।
 |
| অতীতের খড়ে নদী আজ কচুরিপানায় ভরা |
বর্তমানে আমাদের পৈতৃক ভিটেতে গিয়ে দেখি গ্রামের লোকেদের সহযোগিতায় একটি মন্দির তৈরি হয়েছে। এছাড়া ওই গ্রামে এবারে গিয়ে দেখি খুব সুন্দর একটি নামযজ্ঞের নাটমন্দির তৈরি হয়েছে। মন্দিরের কয়েকটি ছবি তোলার পর ফিরতি পথে আমার গাইড অনিমেষ নিয়ে গেলো দোগাছি গ্রামে।
 |
| নাটমন্দির |
এই দোগাছি গ্রামেই আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগে অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত নাটোরের রানী 'ভবানী'র স্মৃতি বিজড়িত দেবী 'রাজবল্লভী'র পূজা শুরু হয়েছিল। কথিত আছে, রাজবল্লভ নামে এক স্থানীয় মৎস্যজীবী দোগাছির নিকট জলঙ্গি নদীতে মাছ ধরার সময় তার জালে উঠে আসে কষ্টিপাথরে নির্মিত মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি ও বিষ্ণু মূর্তি। স্থানীয় মানুষ সেই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পুজো শুরু করেন। ওই মৎসজীবীর নামানুসারে মূর্তির নামকরণ হয় 'রাজবল্লভী'। পরবর্তী কালে নাটোরের রাণী 'ভবানী' সেখানে টেরাকোটা কাজ করা একটি মন্দির নির্মাণ করে ওই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। মূল মন্দিরটি ভূমিকম্পের ফলে ভেঙে গেলে স্থানীয় মানুষেররা মন্দিরটি পুনরায় নতুন কাঠামো বানিয়ে নির্মাণ করেন এবং স্মরণাচরণের জন্য কয়েকটি টেরাকোটার নিদর্শন মন্দির গাত্রে প্রোথিত করেন। স্থানীয় এক ব্যক্তি দেবীর মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করে বলেন, মূল মন্দির থেকে নতুন মন্দিরে মূর্তি স্থানান্তরের সময়ে দেবীর ছোট আকৃতি দেখে জনৈক ব্যক্তি অবহেলার ছলে বলেছিলেন তিনি একাই স্থানান্তরিত করতে পারবেন, কিন্তু পরে বারো জন ব্যক্তি মিলেও ওই মূর্তিটিকে এতটুকু নড়াতে পারেননি। অবশেষে এক ধার্মিক উপাসক অবলীলায় সেই মূর্তিটিকে তুলে নিয়ে গিয়ে ওই নতুন মন্দিরে স্থানান্তরিত করেন। মন্দিরের বন্ধ দুয়ারের ফাঁক ফোকর দিয়ে দেবী মূর্তির সামান্য কিছু অংশ নজরে পড়লো। পশ্চিমে সূর্য ঢলে পড়েছে, দিনের আলোকে গ্রাস করতে যেন ঘন কালো রঙের পাতলা চাদর নেমে আসছে। গ্রামের পথ অতিক্রম করে ঘরে ফিরতে এখনো অনেক রাস্তা বাকি। তাই তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরার জন্য স্কুটারের গতি বাড়িয়ে দিলাম...
 |
| নাটোরের রানী 'ভবানী'র স্মৃতিবিজড়িত রাজবল্লভী মন্দির |
» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ- 'প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী' - জগদ্বন্ধু মৈত্র)
Khub sundor Dada... Tmi eto sundor vabe likhecho ja bole bojhano jabena
ReplyDeleteAmi anjali
ReplyDeleteঅনিমেষ না থাকলে হয়তো এত সুন্দর বিবরণের তথ্য সংগ্রহ করতে পারতাম না।
DeleteHm Dada
Delete