লকডাউনের ঠিক আগের সপ্তাহে নতুন ডিএসএলআর ক্যামেরা কিনে আনার পরে ছবি তোলার সুযোগ পায়নি। অরিন্দমের সাথে ক্যামেরা কিনতে গিয়েছিলাম। অফিসে আড্ডার সময় একবার জিজ্ঞেস করলো নতুন ক্যামেরায় কেমন ছবি তুলছো? জবাবে আমি জানালাম; সুযোগ পেলাম কোথায়। তখনই দুজনে ঠিক করলাম আজ অফিস শেষে ছবি তুলতে বেরিয়ে পড়বো, কিন্তু যায় কোথায়? শুনেছি কাছেই আনন্দপুরে ঝাড়েশ্বর শিবের মন্দির আছে। সেখানে কোনোদিন যাওয়া হয়নি। অরিন্দমকে আমি বললাম, চলো একটু ঘুরে আসি। বেশ কিছু ছবি তোলা যাবে। সে শুনে বললো হুম! প্ল্যানটা মন্দ নয়। রাজি হয়ে গেলো আমার সাথে যেতে। অফিস শেষে দুজনে ক্যামেরা সঙ্গে নিয়ে বাইকে চেপে বেরিয়ে পড়লাম ঝাড়েশ্বর মন্দিরের উদ্দেশ্যে।
| গ্রামের দোতালা মাটির বাড়ি |
আনন্দপুর আর পাঁচটা গ্রামের মতোই সাধারণ ছোট্ট একটা গ্রাম। এই গ্রামেই অবস্থিত বাবা ঝাড়েশ্বরের মন্দির। মহাদেব এখানে ঝাড়েশ্বর রূপে পূজিত হোন। পঞ্চরত্ন শৈলীতে নির্মিত এই মন্দিরের সাথে জড়িয়ে আছে বাবা ঝাড়েশ্বরের মাহাত্ম্যের কথা। অরিন্দমের সাথে চলে এলাম আনন্দপুর। বাজার পেরিয়ে সখিশোলের দিকে প্রায় দু-কিলোমিটার যাওয়ার পরে বাঁয়ে একটা তোরণ দ্বার দেখা গেলো। তোরণ দ্বার পেরিয়ে চলে এলাম মনোরম গ্রাম্য পরিবেশে ঘেরা ঝাড়েশ্বর শিব মন্দির চত্বরে। পশ্চিম মেদিনীপুরের আনন্দপুর থানার কানাশোলের এই ঝাড়েশ্বর শিব মন্দিরটি সাড়ে তিনশো বছরেরও বেশি প্রাচীন। মন্দিরটি এই এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয়। মন্দিরের সামনে রয়েছে পুণ্যার্থীদের বসার একটি ঘর।
| পুণ্যার্থীদের বসার ঘর |
মন্দিরের ঠিক পিছনেই রয়েছে একটি বিশাল দীঘি। যাকে বলা হয় 'আলাল দীঘি'। এই দীঘিতে ডুব দিয়েই ঘটে জল ভরে শিবের মাথায় ঢালেন ভক্তরা। ভক্তদের বিশ্বাস এই দীঘির জলে স্নান করলে রোগ মুক্ত হওয়া যায়। পূর্বে এই অঞ্চলটি ব্রাক্ষ্মণভূম পরগনার অন্তর্গত ছিল। ঝাড়েশ্বর শিবের আবির্ভাবের পর তৎকালীন ব্রাক্ষ্মণভূমের রাজা আলালনাথ দেব এই দীঘির খননকার্য শুরু করেন। সেই কারণে রাজা আলালনাথ দেবের নাম অনুসারে এই দীঘিটি 'আলাল দীঘি' নামে পরিচিত।
| আলাল দীঘি |
আলাল দীঘির মধ্যে মাকড়া পাথরের একটি 'জলহরি' মন্দির রয়েছে, যেটি এখন লুপ্তপ্রায়। আলালনাথের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই নদীয়াল দেব তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে দীঘির মধ্যে 'জলহরি' মন্দিরটি নির্মান করেন।
| জলহরি |
বট গাছের ছায়ায় ঘেরা শান্ত শীতল পরিবেশে মন্দির চত্বরটি বেশ মনোরম। প্রতিদিন প্রচুর পুণ্যার্থী এখানে ভিড় করেন। মন্দিরের সামনে ফুলের মালা, পসরা সাজিয়ে বসা একটি দোকান রয়েছে। অরিন্দমকে সাথে নিয়ে দারুন আগ্রহ নিয়ে মন্দিরের চারপাশটা দেখতে লাগলাম। মন্দিরের সামনে আর দুই পাশে তিন খিলানের বারান্দা। জুতো খুলে সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে উঠে এলাম মন্দিরের বারান্দায়। মন্দিরের ভেতরে দূরত্ব বজায় রেখে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে এখানে পূজার্চনা চললেও এখন মন্দির বন্ধ। তাই বিগ্রহ দর্শনের সৌভাগ্য এবারে আর হ'লো না। বন্ধ মন্দিরের বাইরে থেকেই ঠাকুরকে নমষ্কার করে বেরিয়ে এলাম।
| পূজাসামগ্রীর দোকান |
রাজ্যের পুরাতাত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। মূল মন্দিরের সঙ্গে বিষ্ণুপুরের মন্দিরের মিল দেখা যায়। যদিও স্থাপত্যের নিদর্শন তেমন উল্লেখযোগ্য নয়, তবে পর্যটকদের কাছে এই মন্দিরটি বেশ আকর্ষণীয়। পাঁচ চূড়া বিশিষ্ট এই পঞ্চরত্ন মন্দিরটি বাঁকানো কার্নিশযুক্ত। সামনের দিকে ও দু'পাশে তিনটি করে অর্ধবৃত্তাকার খিলান বিশিষ্ট প্রবেশপথ রয়েছে। মন্দিরের দেওয়াল জুড়ে পোড়ামাটির কাজে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। খিলানের ওপরও রয়েছে অসংখ্য পোড়ামাটির কাজ। পোড়ামাটির অলঙ্করণগুলির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, রাধাকৃষ্ণের লীলা, রামায়ণের কাহিনী, দশাবতার, রাসমন্ডল চক্র, মিথুনদৃশ্য সহ বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী।
| পোড়ামাটির অলঙ্করণ |
মূল মন্দিরের পাশেই রয়েছে মহাকাল ভৈরবের থান, নাটমন্দির, ভোগঘর ও লেতনালা। মন্দিরের সামনে একটি নাটমন্দির আছে। নাটমন্দিরের কাছেই পশ্চিমদিকে রয়েছে 'মহাকাল ভৈরবের থান', সেখানে মাটির হাতি ঘোড়া দেবতা রূপে পূজিত হয়।
| মহাকাল ভৈরবের থান |
ঝাড়েশ্বর মন্দিরের ইতিহাস
আজ যেখানে এই মন্দির দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেখানেই মাটির নীচে ছিল এই শিবলিঙ্গটি। কোলকাতা আড়িয়াদহের পুরোহিত শীতলানন্দ মিত্র নামে জনৈক ব্যক্তি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এই গ্রামে গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটি বটগাছের নীচে মাটি খুঁড়ে একটি শিবলিঙ্গ পেয়েছিলেন। তারপর ১৬২৯ খ্রীষ্টাব্দে (১০৩৬ বঙ্গাব্দে) ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে ওই বটগাছের নীচে প্রতিষ্ঠিত করা হয় শিবলিঙ্গটিকে। নাম দেওয়া হয় ঝড়েশ্বর শিব। পরে তৎকালীন মেদিনীপুর জেলার গড় আড়রার রাজা আলালনাথ দেব এখানে শিবের নিত্য পূজোর যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেন। প্রতিটি মন্দিরের পিছনে যেমন বহুল প্রচলিত একটি কিংবদন্তি শুনতে পাওয়া যায় এই মন্দিরের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। শোনা যায়, আজ যেখানে এই মন্দির দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেই এলাকাটি আগে ঝোপ জঙ্গল ছিল। ওই জঙ্গলে রাখালরা নিয়মিত গরু চরাতে যেত, সেখানে ছিল একটি বটগাছ। সেই বটগাছের নীচে এক কৃষ্ণগাভী এসে সবার অলক্ষ্যে প্রতিদিন দুধ ঢেলে দিয়ে আসত। শীতলানন্দ স্বপ্নে দেখা এই জায়গাটি নিদর্শন করে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।
| গাভীমূর্তি |
আগে একটি চালাঘরে শিবলিঙ্গটি প্রতিষ্টিত ছিল। কথিত আছে, নাড়াজোলের রাজা অযোধ্যা রাম খাঁনের দেওয়ান রামনারায়ণ জানা ঝাড়েশ্বর শিবের কাছে মানত করে কঠিন শূল রোগ থেকে সেরে ওঠেন। তার পরেই তিনি ১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দে (১২৪১বঙ্গাব্দে) ৯ই জ্যৈষ্ঠ বর্তমান পঞ্চচূড়া বিশিষ্ট এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন।
| বর্তমান মন্দির |
মন্দিরের উত্তরে অষ্টস্তম্ভ বিশিষ্ট 'লেতনালা' এবং পশ্চিমে 'ভোগঘর' আছে। কেশপুর থানার অন্তর্গত বেঁতলা গ্রামের জমিদার সনাতন চৌধুরী মহাশয়ের মনোস্কামনা সিদ্ধ হাওয়ায় ১৮৫১সালে (১২০৮ বঙ্গাব্দে) আটচালা রীতির শিবের 'ভোগঘর' এবং অষ্টস্তম্ভ বিশিষ্ট 'লেতনালা' নির্মাণ করেন।
| ভোগঘর |
ভোগঘরের একটা দেওয়ালে রয়েছে 'দ্বারবর্তিনী' মূর্তি। খড়খড়ি দেওয়া একটা আধখোলা দরজার পাশ থেকে উঁকি মারছে এক নারী। ওই খড়খড়ির আড়ালে দাঁড়ানো নারীমূর্তি সেকালের সমাজব্যবস্থারই পরিচয় দেয়। ওই সময়ের তৈরি অনেক মন্দিরেই এরকম দ্বারবর্তিনী মূর্তি দেখা যায়।
| ‘দ্বারবর্তিনী’ মূর্তি |
ইচ্ছা পূরণ হয় বলে বিশ্বাস করে মেদিনীপুর জেলার নানা স্থান থেকে বহুলোক রোগ-ব্যাধি নিরাময়ের জন্য এখানে নানারূপ মানত করেন এবং শিবঠাকুরের মাথায় জল ঢালতে আসেন। আজও এখানে নিত্য পুজোর পাশাপাশি প্রতি বছরে শ্রাবণী উৎসব, দুর্গাপুজো, শিবরাত্রির ব্রত ও চৈত্র সংক্রান্তির গাজন মেলা ধুমধাম সহকারে হয়ে থাকে। দেখতে দেখতে কেটে যায় কয়েকটা ঘন্টা। এবার ঝাড়েশ্বর মহাদেবকে দু-হাত জুড়ে প্রণাম করে আমরা বাড়ির রাস্তা ধরলাম।
| মন্দিরের সামনে গ্রাম্য পরিবেশ |
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ- পশ্চিমবঙ্গের পূজা-পার্বণ ও মেলা - তৃতীয় খন্ড)
JHARESWAR TEMPLE, ANANDAPUR, PASCHIM MEDINIPUR, WEST BENGAL
ব্যাপক।
ReplyDeleteএকবার ঘুরে আসতে পারো।
Delete