চটপট ক্যামেরা অন করে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম। দূর থেকে নদী ও সাগরের মিলনস্থলটা দেখতে ভীষণ সুন্দর লাগছিলো। কিন্তু সেখানে যাওয়ার কোনো ভালো রাস্তা খুঁজে পেলাম না, ঝাউবনের ভেতরে ধাউড়িয়া নদীর পাড় ঘেঁষে হাঁটার সরু পথ ধরে পৌঁছাতে হবে। ইচ্ছে থাকলেও সাহস করে আর এগোলাম না। ক্রমে সন্ধ্যা হয়ে এল। ঝাউবনে নদীর কিনারে সূর্য হেলে পড়লো। সারা পৃথিবী এক অপূর্ব মায়াবী আলোয় ভরে গেল।
ফিরে এলাম হোটেলে। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার চলে এলাম সমুদ্র সৈকতে। মানুষের ভিড় ফেরিওয়ালাদের চিৎকার আর সমুদ্রের গর্জন। অনেক রাত রাত অবধি চললো সমুদ্র দর্শন। এসবের ফাঁকে সময় করে হোটেলের কাছেই ওড়িশা ট্যুরিজমের কাউন্টার থেকে পরের দিন কন্ডাক্টেড ট্যুরের জন্য টিকিট কেটে নিলাম।
কেয়া ঝোপ আর কাজু বাগানের মধ্যে দিয়ে সংরক্ষিত অরণ্যের গা বেয়ে পুরী-কোণার্ক মেরিন ড্রাইভ পথ ধরে আমাদের বাস ছুটে চললো। ঘন্টা খানেক যাওয়ার পর বাস গিয়ে দাঁড়ালো সুদাম আর্ট মিউজিয়ামের সামনে। বাসের গাইড জানিয়ে দিলেন ইচ্ছুক ব্যক্তিরা ঘুরে দেখে আসতে পারেন। আমাদের তিনজনের প্রত্যেকের ৩০ টাকা করে মোট ৯০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভিতরে স্যান্ড আর্টের নানা ভাস্কর্য দেখলাম। স্যান্ড এনিমেশন স্টুডিওর একটা লাইভশো'তে কাঁচের টেবিলের উপরে বালি দিয়ে মিউজিকের তালে তালে শিল্পী সুদাম প্রধানের হাতে আঁকা ছবি, এককথায় অসাধারণ !!
সুদাম আর্ট মিউজিয়ামে গাইডের দেওয়া কুড়ি মিনিট সময় অতিক্রান্ত হতেই আবার আমরা বাসে উঠে বসলাম। আবার যাত্রা শুরু। পরবর্তী বিরতি রামচন্ডী মন্দিরে। রামচন্ডী মন্দিরটা কুশভদ্রা নদী ও সমুদ্রের মোহনায়। কুশভদ্রা নদীর শান্ত জল পেরিয়ে তারপর চন্দ্রভাগার সৈকতে যেতে হয়, সেখানে সমুদ্র শুরু। জায়গাটা অতি মনোরম।
বাস থেকে নেমে কুশভদ্রা নদীর ধারটা একটু ঘুরে নিয়ে পাশের রামচন্ডী মন্দিরে কোনোওরকমে উঁকি দিয়ে দেখে চলে এলাম। চন্দ্রভাগার সেই নির্জন সমুদ্র সৈকতে আর যাওয়া হলো না। সময় কম, ক্ষিদেয় পেট জ্বলছে। সামনের দোকান থেকে লুচি, সব্জী যা পেলাম চটপট আমরা খেয়ে নিলাম। বাস ছেড়ে দিলো।
রামচন্ডী মন্দির থেকে বেরিয়ে মিনিট কুড়ি চলার পর আমাদের নামিয়ে দিলো কোণার্ক সূর্য মন্দির থেকে কিছুটা দূরে। ওড়িশার মন্দির ভাস্কর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন নিঃসন্দেহে কোণার্কের সূর্য মন্দির। সূর্য দেবকে উৎসর্গ করে তৈরি এই মন্দিরটা দেখতে সারা বছর বহু দেশ বিদেশের পর্যটকের এসে থাকেন। নাম সূর্য মন্দির হলেও বর্তমানে এখানে কোনো বিগ্রহ নেই। ধূসর বেলে পাথরের তৈরি বিশাল আকারের কোণার্কের এই সূর্য মন্দিরটা নির্মিত হয়েছিল চন্দ্রভাগা নদীর তীরে। কিন্তু কালের বিবর্তনে নদীর গতিপথ বেঁকে গিয়ে মন্দির থেকে অনেকদূরে সরে গিয়েছে। এই মন্দিরের মুখ পূর্ব দিকে ঘোরানো। যাতে সূর্যের প্রথম আলোটা মন্দিরের প্রাঙ্গনে সরাসরি এসে পড়ে। দেখে আশ্চর্য লাগে প্রাচীনকালে এত ভারী পাথর কি করে অতো উঁচুতে তোলা হয়েছিল? আর কি করেই বা সাজানো হয়েছিল এভাবে স্তরে স্তরে? সঠিক উত্তর কারোরই জানা নেই।
পায়ে হেঁটে মন্দির চত্বরে প্রবেশ করলাম। লাইন দিয়ে আমাদের টিকিট কাটতে হয়নি। কারণ বাসের মধ্যেই গাইড আমাদের প্রত্যেকের কাছে ১৭৫ টাকা করে সমস্ত জায়গার প্রবেশে মূল্য হিসাবে আগে থেকেই জমা নিয়েছিলেন। মন্দিরের প্রবেশ পথে সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করলো সুবিশাল দু'খন্ড পাথরের তৈরি কুড়ি ফুট উঁচু বিরাট গজসিংহ-মূর্তিদ্বয়। বিশাল দুটো সিংহ, তার পায়ের নিচে চাপা পড়ে আছে একটা করে দুটো হাতি এবং তারও নীচে চাপা পড়ে এক একটা করে মানুষ। অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির হলেও সিংহ যে বিশালাকার হাতিকে বিনাশ করার ক্ষমতা রাখে এটাই তার পশুরাজ আখ্যার বিশেষত্ব। এখানে সিংহ শৌর্যের প্রতীক, হাতি বিত্তর প্রতীক অর্থাৎ যার অন্তর্নিহিত অর্থ হলো শৌর্য ও বিত্তের ভারে মানুষ সর্বদা চাপা পড়ে। মন্দিরের সামনের এই অংশটা ছিল নাটমন্ডপ। নাটমন্দিরের ছাদ নেই কেবল প্রাচীরের কিছু অংশ দাঁড়িয়ে রয়েছে। শোনা যায় এখানে একসময় দেবদাসীরা দেবতার উদ্দেশ্যে পূজা-নৃত্য পরিবেশন করতেন। কেউ কেউ বলেন, এটা ভোগমন্ডপ ছিল।
ঘোড়ায় টানা রথের আদলে পাথরের উপরে নকশা কেটে তৈরি মন্দিরের রথটাকে টানছে সাতটা ঘোড়া। এই সাতটা ঘোড়া সপ্তাহের সাত দিনের প্রতীক। পাথরে খোদাই করে মন্দিরের দেয়ালে দুই দিকে বারোটা করে অর্থাৎ মোট চব্বিশটা চাকা আছে। সূর্য-দেবতাকে উৎসর্গ করে নির্মিত এই মন্দিরে সূর্যোদয়ের প্রথম আলো পড়ে।
রথের প্রতিটা চাকা যেন সময়ের পরিমাপ করার জন্য একেকটা সূর্যঘড়ি, প্রাচীন ভারতের মানুষ শুধুমাত্র এই চাকার উপর সূর্যের আলোর অবস্থান বিচার করে নির্ভুলভাবে প্রতিটা মিনিট পর্যন্ত সময়ের হিসাব রাখতে পারত। এক পাশের বারোটা চাকা বারো মাসের জন্য এবং অন্য পাশের বারোটা চাকা রাশির প্রতীক হিসাবে নির্দেশিত হয়। এছাড়া প্রতিটা চাকায় যে আটটা করে অর বা স্পোক আছে তা দিনের অষ্টপ্রহর কে বোঝায়। যদিও একটা চাকা বাদে অন্য চাকাগুলি এখন আর সম্পূর্ণ অক্ষত নেই। চাকার অসাধারণ কারুকার্য পর্যটকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। সমস্ত পর্যটকের মতো আমিও লোভ সামলাতে পারিনি। চাকার কাছে বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম। মন্দিরের গায়ে পাথরের ওপর খোদাই করা অসংখ্য কারুকার্য দেখা গেলো।
 |
| পাথরের তৈরি চাকা |
মন্দির সম্বন্ধে নানারূপ কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। যেমন এই মন্দির নির্মাণ নিয়ে কপিল-সংহিতায় বর্ণিত কাহিনীতে আছে; শাম্ব সকলের সামনে নারদমুনির চেহারা নিয়ে উপহাস করেছিলেন তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য একদিন রৈবতক পর্ব্বতে শ্রীকৃষ্ণ যখন তাঁহার স্ত্রীদের সাথে স্নান করছিলেন তখন নারদের ছলনায় কৃষ্ণপুত্র শাম্ব সেখানে উপস্থিত হয়। তখন সুন্দর সুঠাম যুবককে দেখে কৃষ্ণের পত্নীগণ শাম্বর অনুরাগিণী হয়ে যায়। কৃষ্ণ অত্যন্ত রেগে গিয়ে শাম্বকে অভিশাপ দেয়। কৃষ্ণের সেই শাপে শাম্বের কুষ্ঠরোগ হয়েছিল। নারদের কাছে রোগমুক্তির উপায় জেনে শাম্ব দ্বারকা থেকে সিন্ধু নদীর তীর ধরে ক্রমশ এই স্থানে এসে উপস্থিত হন। চন্দ্রভাগা যেখানে সমুদ্রে মিলেছে তারই কাছে ছিল মৈত্রেয় বন। সেই বনেই কিছুদিন সূর্য-দেবের কঠোর তপস্যা করে রোগমুক্ত হয়েছিলেন। রোগমুক্তির পর শাম্ব একদিন চন্দ্রভাগাতে স্নান করার সময় নদীর বালির উপরে সূর্য-দেবের সুন্দর একটা মূর্তি দেখতে পেয়েছিলেন। তখন শাম্ব মূর্তিটাকে নদী থেকে তুলে এনে একটা মন্দির তৈরি করে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই মন্দিরটাই আজ কোণার্ক মন্দির নামে খ্যাত। আবার এই মন্দির সম্বন্ধে একটি সুন্দর প্রবাদ আছে; বারোশো কারিগর বারো বছর ধরে এই মন্দিরটা তৈরি করেছে। রাজ্যের বারো বছরের আয় খরচ হয়েছে এই মন্দিরে। যে বারোশো শিল্পী এই মন্দিরটা নির্মাণ করেন তাদের প্রধান ছিল বিশু মহারাণা। ধর্মপদ গর্ভে থাকাকালীন বিশু মহারাণা স্ত্রীকে বাড়িতে রেখে চন্দ্রভাগায় আসেন মন্দির তৈরি করতে। এরপর ধর্মপদ বড় হতে লাগল এবং ধীরে ধীরে তাদের বংশানুক্রমিক স্থাপত্য কাজে বেশ পটু হয়ে গেলো। দেখতে দেখতে বারো বছর কেটে গেল। মন্দিরের চূড়া কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। বিশু মহারাণার বারোশো কারিগরও হাত গুটিয়ে বসে আছে। রাজা এই খবর পেয়ে ভীষণ রেগে গিয়ে আদেশ জারি করলেন, দুই দিনের মধ্যে কাজ শেষ না হলে সমস্ত শিল্পীদের শিরশ্ছেদ করা হবে। এদিকে দেখা গেলো বিশু মহারাণা বছরের পর বছর বাড়ি ফিরে আসেনি। বিশু মহারাণার স্ত্রী একদিন ধর্মপদকে তার বাবার খোঁজে পাঠালেন। এমন সময় দেবী রামচন্ডী বৃদ্ধাবেশে আবির্ভূত হয়ে ধর্মপদকে নিজের কুটিরে নিয়ে গিয়ে গরম ক্ষীর খেতে দিলেন। সে যখন গরম ক্ষীর খাওয়ার চেষ্টা করে তখন তাঁর হাত পুড়ে যায়। তখন তাকে তার বাবার মন্দির তৈরির কাজে ভুল কোথায় হচ্ছে জানালো। চন্দ্রভাগায় এসে দেখে তাঁর বাবার হিসেবের ভুলে মন্দিরের চূড়া কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। ধর্মপদ তখন বাবাকে চিন্তা না করতে বলে হিসেবে সঠিক করে চূড়াটা বসিয়ে দিলো। তারপর তার বাবা ও সেই বারোশো শিল্পীর সম্মানের কথা ভেবে মন্দিরের চূড়ার উপর থেকে চন্দ্রভাগা নদীতে লাফিয়ে পড়ে এবং তারপর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। স্থানীয় লোকেরা অবশ্য অন্য কথা বলে; বিশু মহারাণার ছেলে আত্মহত্যা করে মরে নি। তাকে মন্দিরের উপর থেকে ফেলে হয়েছিল। বিশু মহারাণার কারিগরেরা ভাবলো সে বেঁচে থাকলে তাদের অক্ষমতার কথা সকলে জেনে ফেলবে, সেইজন্যই তারা তাকে হত্যা করেছিল। এই পাপের ফলেই মন্দির ভেঙে পড়েছে।
 |
| কোণার্ক মন্দির |
বর্তমানে মন্দিরের মূল স্থাপত্যের বেশির ভাগই আর অক্ষত নেই। মন্দিরের এই অবস্থা সম্বন্ধে আবার একটা প্রচলিত প্রবাদ; অনেকে সেই গল্পটাকে সত্য বলে মনে করেন। কোণার্ক মন্দিরের চূড়ায় বিশাল একটা চুম্বক লোহা বসানো ছিল। এই চুম্বক সমুদ্রগামী জাহাজের লোহার অংশগুলোকে আকর্ষণ করে নাবিকদের বিপদে ফেলতো। মাদলা পঞ্জী মতে মন্দিরের উপরের এই চুম্বক লৌহদণ্ডটা ছিল একুশ ফুট সাড়ে দশ ইঞ্চির মতো। অতএব কথাটা কতটা যুক্তিসম্মত ভাবার আছে। পূর্বে অবশ্য এরকম 'কুম্ভ-পাথর' মন্দিরের চূড়ায় কলস রূপে ব্যবহৃত হতো। ওড়িশার শিল্পীরা মন্দিরের মাথায় এরকম 'কুম্ভ-পাথর' বসিয়ে আকর্ষণ করিয়ে চূড়ার পাথরগুলো যথাস্থানে রাখতো। ওড়িশায় চলতি কথায় চুম্বককে 'কুম্ভ' বলে। শোনা যায়, পর্তুগীজ নাবিকেরা এই 'কুম্ভ' বা 'কলস-পাথর'টা সরিয়ে নেওয়ায় মন্দিরের চূড়ার সমস্ত পাথর ক্রমশ খুলে পড়ে মন্দিরের এইরূপ অবস্থা হয়েছে।
 |
| উড়-গজসিংহ |
জগমোহনের পেছনে রয়েছে অভিনব স্থাপনাশৈলীর মায়াদেবী বা মহামায়ার মন্দির। মায়া মন্দিরটার মূলত দুটো অংশ জগমোহন ও দেউল। এখানেও কয়েকটা সূর্য-মূর্তি আছে। মন্দিরের চরণামৃত, জল প্রভৃতি নিকাশের জন্য কারুকার্য করা কষ্টিপাথরের সুন্দর দুটো নিকাশি নালা নজর কাড়ে। বিশাল কোণার্ক মন্দিরে মাত্র এক ঘন্টায় ভালো করে কি আর দেখা যায়। আগেই জানিয়েছি আমার ফটোগ্রাফির খুব শখ। এইরকম জায়গা পেয়ে কার মন না চায় ছবি তুলতে। চটজলদি যতটুকু দেখা যায়, দেখা নয় ছবি তোলা যায় সেই কাজটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলার চেষ্টা করলাম। সময়ের ঘন্টা শেষ আর ফিরে দেখা নয়। শর্ত আছে সমস্ত দ্রষ্টব্য স্থানে বরাদ্দ সময়ের মধ্যে কেউ ফিরে আসতে না পারলে নিজের থেকে অটো, ওলা ক্যাব, বা অন্য যেকোনো উপায়ে পরবর্তী গন্তব্য স্থানে গিয়ে বাস ধরতে হবে। তাই সময়ের ব্যাপারে ভীষণ সচেতন। কোণার্ক দেখা শেষ, বাস ভুবনেশ্বরের দিকে রওনা দিল।
 |
| মায়াদেবীর মন্দির |
গাইড জানিয়ে দিলেন এবারে আমাদের গন্তব্য ধবলগিরি। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে ধৌলি পাহাড়ের নীচে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে পার্কিং লটে বাস থেকে নামিয়ে দিলো। শুনলাম রাস্তায় একবার একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ায় ধৌলি পাহাড়ের উপরে বাস যাওয়া এখন বন্ধ করে দিয়েছে। পার্কিং লট থেকে ওড়িশা ট্যুরিজম এর নিজস্ব ট্রাভেলার গাড়িতে করে আমাদের সকলকে নিয়ে গেলো ধৌলি পাহাড়ে। এর জন্য আলাদা কোনো ভাড়া দিতে হয়নি। মিনিট কয়েকের মধ্যে ধবলগিরি পাহাড়ের উপর যখন নামিয়ে দিলো তখন সময় সকাল সাড়ে দশটা। দয়া নদীর ধারে অবস্থিত এই ধৌলি পাহাড় বা ধৌলিগিরি। একে অনেকে ধবলগিরিও বলে। রাজা অশোক এবং কলিঙ্গ রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধে পুরো দয়া নদী লাল হয়ে গিয়েছিল রক্তে। এই কলিঙ্গ যুদ্ধই রাজা অশোককে বৌদ্ধধর্ম পালন করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। এরপর বুদ্ধের কাছ থেকে অহিংসার শিক্ষা গ্রহণ করেন অশোক। সেই স্মৃতিতেই ধৌলি পাহাড়ের উপর নির্মিত হয় শান্তি প্যাগোডা। এই প্যাগোডাটা অনেকটা সাচীর সারোনাথের আদলে তৈরি। এটা নিপ্পনজান মায়োহোজির প্রধান পুরোহিত দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। ১৯৭২ সালে জাপান বুদ্ধ সংঘ ও কলিঙ্গ নিপ্পন বুদ্ধ সংঘ যৌথভাবে এই প্যাগোডাটা তৈরি করে। অনেকে এই স্তুপকে হোয়াইট প্যাগোডা বা ধবলেস্বর মন্দির বলে।
 |
| ধৌলি স্তূপ বা পিস প্যাগোডা |
শান্তি প্যাগোডাতে ঢোকার সময় চোখে পড়ল একজোড়া হলুদ সিংহ। এরকম চারটে প্রবেশপথে মোট চার জোড়া হলুদ সিংহ রয়েছে। প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে শান্তি স্তূপের পাদদেশে পৌঁছে গেলাম। নীচে ইতিহাসের সাক্ষী দয়া নদী আজও বয়ে চলেছে। স্তুপের চার দিকে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় গৌতম বুদ্ধের চারটে শ্বেতপাথরের তৈরি মূর্তি রয়েছে। এর মধ্যে দুটো শ্বেতপাথরের ধ্যানরত মূর্তি, একটা শ্বেতপাথরের ঘুমন্ত বা শয়নরত মূর্তি এবং একটা কষ্ঠিপাথরের দন্ডায়ামান মূর্তি। এছাড়া এই স্তূপের বাইরের দেওয়ালে লাগানো পাথরের স্ল্যাবে গৌতম বুদ্ধের জীবনের অনেক কাহিনি বা ঘটনার চিত্রপট খোদিত আছে।
 |
| বুদ্ধ মূর্ত্তি |
ধৌলি স্তুপের পাশেই একটা শিবমন্দির আছে। মান্দিরের সামনে দুদিকে দু'টো সিংহের মূর্ত্তি। অনেকেই সেখানে পুজো দিচ্ছেন। ধৌলি দর্শন ও লাঞ্চের জন্য বরাদ্দ সময় মাত্র তিরিশ মিনিট। কোনোরকমে কয়েকটা ছবি তুলে এগিয়ে চললাম খাবারের স্থানে। সময় খুবই অল্প তাড়াতাড়ি সারতে হবে! নইলে দুপুরের খাওয়াটাই মাটি হয়ে যাবে। ওড়িশা ট্যুরিজমের নিজস্ব সাদামাটা হোটেল। খাবারের মান খুব একটা ভালো নয়। বছর কয়েক আগে ওড়িশা ট্যুরিজমের বাসে যখন এসেছিলাম তখন ভুবনেশ্বরে তাদের নিজস্ব এসি রেস্টুরেন্টে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। সেখানের খাওয়াটা খুবই ভালো ছিল। খাওয়াদাওয়া সেরে আবার ওই ট্রাভেলার গাড়িতে চেপে বাসের কাছে চলে এলাম। বাস চলতে শুরু করলো! পরবর্তী গন্তব্য ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দির।
 |
| ধবলেশ্বর মন্দির |
চলে এলাম লিঙ্গরাজ মন্দিরে। লিঙ্গরাজ মন্দির ভুবনেশ্বরের সব থেকে বড় মন্দির। ওড়িশার সেরা মন্দিরগুলির মধ্যে এটা অন্যতম। মন্দিরের অনেক দূরে আমাদের বাস থেকে নামিয়ে দিলো। গাইড জানিয়ে দিলো এখানে সময় কুড়ি মিনিট। রাস্তায় ছোট ছোট আরো দু'একটা মন্দির দেখতে পেলাম। অনেকটা পায়ে হেঁটে চলে এলাম মন্দিরের কাছে।
 |
| লিঙ্গরাজ মন্দিরের প্রবেশ পথ |
দূর থেকে ছবি তুললাম কারণ মন্দিরের ভেতরে এখন ক্যামেরা বা মোবাইল ফোন নিয়ে প্রবেশ নিষেধ। বহু বছর আগে আমি যখন এখানে এসেছিলাম তখন ছবি তুলতে কোনো বিধিনিষেধ ছিলো না। তখন ভেতরে বেশ কিছু ছবি তুলেছিলাম, তবে সেগুলো ফিল্ম ক্যামেরায়। জুতো, মোবাইল বাইরে রেখে ঢুকলাম মন্দিরের ভেতরে। অনেকটা পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের মতোই দেখতে। ভেতরে মন্দির চত্বরটা বেশ বড়ো, ছোট বড় মন্দিরে ভরা। যেহেতু ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ তাই কুড়ি মিনিটেই সম্পূর্ণ ঘোরা হয়ে গেলো। মন্দির থেকে বেরিয়ে আবার বাসে উঠে বসলাম।
 |
| লিঙ্গরাজ মন্দির |
উদয়গিরি থেকে শুরু করে আমরা প্রায় ভুবনেশ্বর শহর পেরিয়ে শহরের অন্য প্রান্তে নন্দনকানন জুওলজিক্যাল পার্কে এসে পৌঁছায়। এখানে গাইড আমাদের সকলকে একসাথে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। পার্কে ঢুকতেই চোখে পড়ল বিশাল এক মানচিত্র। পুরো চিড়িয়াখানায় কোথায় কী আছে, সুন্দরভাবে দেখানো। প্রথমেই আমরা গেলাম সাফারি জোনে। চারপাশে উন্মুক্ত বাঘ, সিংহ, জিরাফ, ভালুক, হরিণ হেঁটে বেড়াচ্ছে আর আমরা বাসে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, উফফ!! ভাবতেই যেন কেমন লাগছে।
 |
| নন্দনকাননে প্রবেশ করলাম |
সাফারি বাসের জন্য আমাদের আলাদা টিকিট কাটতে হয়নি। আমরা বাসে উঠে পড়লাম। গাড়ি প্রথম সাফারি জোনের গেটের সামনে এসে দাঁড়াতেই মন চঞ্চল হয়ে উঠল। নিরাপত্তা রক্ষীরা প্রথম সাফারির জন্য গেট খুলে দিল, আমাদের বাস প্রবেশ করার সাথে সাথে তারা পিছন থেকে আরেকটা গেট বন্ধ করে দিল। আমরা কাদামাটি রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলাম।
 |
| সাফারি বাস |
ঢুকেই শুরু হলো বাঘের খোঁজ, দু একটা ময়ূর ছাড়া আর তেমন কিছুই চোখে পড়ছিলো না। একটু হতাশ হতে শুরু করল। একটু এগোতেই গাইড বলে উঠলো 'ও দেখো টাইগার ব্যাইঠা হ্যায়', আমাদের বাস থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে দেখলাম একটা সাদা বাঘ সুন্দর ভাবে বসে রয়েছে। আমাদের দেখে বিন্দু মাত্র ভয় নেই তার। তড়িঘড়ি ক্যামেরা রেডি করে খ্যাচ খ্যাচ করে গোটা কয়েক ছবি তুলে নিলাম। সঙ্গে মেয়েও বেশ কিছু ভিডিও তুললো। বাঘ মামা বিভিন্ন পোজে ছবি তুলতে দিলো আমাদের, যেন আমাদের জন্যই পোজ করছে। তারপর আমরা আর কোন প্রাণী দেখতে পেলাম না।
 |
| ব্ল্যাক টাইগার ভিকি |
এখান থেকে বেরিয়ে এসে আমরা সিংহ সাফারির জন্য নির্ধারিত একটা জোনে গেলাম। আবার আমাদের পিছনের দিকে বন্ধ বড় লোহার দরজা। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের গাড়ির সামনে একটা সিংহ এসে দাঁড়াল। বনের রাজা, তাই তিনি কেবল মাথা ঘুরিয়ে থাকলেন। পরে অবশ্য রাস্তার একপাশে অর্ধঘুমন্ত অবস্থায় আরো দুটো সিংহ দেখতে পেয়েছিলাম। আমরা লোহার দরজার কাছে আবার ফিরে এলাম। এই এলাকা থেকে বেরিয়ে আসার পর আমরা ভাল্লুকের জন্য নির্ধারিত অন্য একটা জোনে গেলাম। সাফারি চলাকালীন প্রচুর হরিণ দেখতে পেলাম।
 |
| হরিণ দেখতে পেলাম |
সাফারির সময় সীমিত হওয়ায় আমরা ধীরে ধীরে গেটের দিকে এগিয়ে গেলাম এবং ড্রপিং পয়েন্টে পৌঁছে গেলাম। এখানে মাত্র দু'ঘন্টা সময়। এর মধ্যে যতটুক পারলাম পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখলাম। দুপুরের পর আমরা এখানে এসে পৌঁছায়, তাই গরমে পায়ে হেঁটে ঘুরতে খুব কষ্টও হচ্ছিলো। সাদা বাঘ, চিতা, ঘড়িয়াল, শিম্পাঞ্জি, হাতি, জিরাফ, সাদা ময়ূর, কুমির ইত্যাদি নানারকম বন্য পশুর মধ্যে কিন্তু আলাদাভাবে আমার নজর কেড়েছে ভিকি (ব্ল্যাক টাইগার)। ভেতরে কৃত্রিম ঝর্ণার পাশে সরীসৃপ ঘর দেখার পর আমরা ধীরে ধীরে পার্ক থেকে বেরিয়ে এলাম।
 |
| সরীসৃপ ঘর |
নন্দনকানন থেকে বেরিয়ে প্রায় আধ ঘন্টা যাওয়ার পরে উদয়গিরি-খন্ডগিরি থেকে সামান্য কিছুটা দূরে আমাদের সকলকে বাস থেকে নামিয়ে দিলো। সেখান থেকে প্রত্যেকে পাঁচ টাকা করে ভাড়া দিয়ে শেয়ার অটোতে উদয়গিরি-খন্ডগিরির কাছে এসে পৌঁছলাম। বামদিকে খণ্ডগিরি আর ডানদিকে উদয়গিরি। দুটো যমজ পাহাড় যা হাতিগুম্ফা শিলালিপিতে কুমারী পর্বত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। উদয়গিরির উচ্চতা একটু কম অপরদিকে খণ্ডগিরি খাড়া হয়ে উঠেছে। অটো থেকে নেমে উদয়গিরির গেটের সামনে চলে এলাম। এখানেও টিকিট কাটতে হয়নি, কারণ আগে থেকেই সমস্ত জায়গার এন্ট্রি ফি গাইডকে দিয়ে রেখেছিলাম। গেট পেরিয়ে আমার স্ত্রী বললো পাহাড়ের সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে পারবে না। অগত্যা গেটের একপাশে স্ত্রীকে বসিয়ে রেখে মেয়েকে সাথে নিয়ে রেলিং ঘেরা পাথরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকলাম।
 |
| সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠা |
উদয়গিরি কিছুটা প্রাকৃতিকভাবে এবং কিছুটা কৃত্রিমভাবে কয়েকটা গুহার সমষ্টি নিয়ে তৈরি। রাজা খারবেল জৈন্য সন্ন্যাসীদের বাসস্থানের ও সাধনার জন্য এই গুহাগুলো নির্মাণ করেছিলেন। অন্ধ্ররাজ শাতকর্ণি গুহা-নির্মাণে সাহায্য করেছিলেন। এই গুহাগুলোর মধ্যে হাতি গুম্ফাটা সবচেয়ে প্রাচীন জৈন গুহা।তাঁহার রাজত্বের ত্রয়োদশ বর্ষ ১৫৫ খ্রীস্টপূর্ব্বাব্দে গুহাটার নির্মাণকাল বলে শিলালিপিতে উল্লেখ করা আছে। খারবেল ছিলেন জৈন রাজা কিন্তু এই গুহাগুলোতে বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরও বাস ছিল। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিত্যক্ত হল এইসব নির্জন গুহাগুলো।
 |
| হাতি গুম্ফা |
সিঁড়ি দিয়ে খানিকটা উঠেই স্বর্গপুরী গুম্ফা। এই গুহায় পাথরের একটা হাতিকে দেখে জীবন্ত মনে হলো। খানিকটা এগিয়ে রাণী গুম্ফা অর্থাৎ রাণীর প্রাসাদ। এটা দোতালা বাড়ির ন্যায় তৈরি এবং এর দেওয়ালে কিছু রাজারাণীর মূর্ত্তি সহ কারুকার্য আছে। এছাড়াও রয়েছে বেশ কয়েকটা গুম্ফা যেমন বৈকুন্ঠ গুম্ফা, হাতি গুম্ফা, বাঘ গুম্ফা ইত্যাদি। সময়াভাবে সবকটা গুহা দেখা হলো না।
 |
| স্বর্গপুরী, মঞ্চপুরী ও রাণী গুম্ফা |
উদয়গিরি পাহাড়ের ওপর থেকে ভুবনেশ্বর শহরকে চমৎকার দেখাচ্ছে। রাস্তার ওপারে দেখতে পেলাম খণ্ডগিরি। দূর থেকে দেখে বোঝা গেলো সেখানেও অনেক গুহা আছে। খণ্ডগিরি পাহাড়ের উপরে দেখা গেলো একটা জৈন মন্দির। দুটো দেখতে গেলে একটা পাহাড়ের উপরে উঠে আবার নিচে এসে পরেরটায় উঠতে হয়। এখানে মাত্র তিরিশ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছে আর এই সময়ের মধ্যে দুটো দেখা সম্ভব নয়।
 |
| খণ্ডগিরি পাহাড়, উপরে পার্শ্বনাথের মন্দির |
নেমে এলাম গেটের কাছে, এবার আগের মতোই অটোতে চড়ে আবার বাসে চেপে বসলাম। আমাদের ট্যুরের এখানেই ইতি। মসৃন রাস্তায় দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে বাস। প্রচন্ড গরম, দুপুরে এখানে বাসের এসি ঠিকমতো কাজ করে না, তাই গাইড সকলকে অনুরোধ করেছিলেন জানালায় পর্দাগুলো সবাই যেন লাগিয়ে রাখে। পথে কোথাও না দাঁড়িয়ে একেবারে পান্থনিবাসের কাছে এসে আমাদের বাস থেকে নামিয়ে দিলো। আমরা সেখান থেকে অটো ধরে হোটেলে ফিরলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে স্বর্গদ্বারের মার্কেটে কেনাকাটা করতে বেরিয়ে পড়লাম। কেনাকাটা শেষ করে হোটেলে জিনিসপত্র রেখে রাস্তার উল্টোদিকে নেমে পড়লাম সমুদ্র সৈকতে। এত রাতেও হাজারো পর্যটকের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে সৈকত। সারা দিন ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত লাগছিল। শোয়া মাত্রই ঘুম!
 |
| স্বর্গদ্বারের মার্কেটে কেনাকাটা |
ভ্রমণের তৃতীয় দিনটা আমাদের ঘরে ফেরার দিন। ভোরে সমুদ্র সৈকতে সূর্যোদয়ের লোভ সামলাতে পারলাম না। সকালে ঘুম ভাঙতেই গেলাম আবার সৈকতে। রাস্তা পেরিয়ে উল্টোদিকের সমুদ্র সৈকতে সোজা হাঁটা লাগলাম। সেই অসাধারণ সূর্যোদয়। মেয়ে তার ফোন নিয়ে সেলফি তুলতে ব্যস্ত। কিন্তু হঠাৎ যেন সেই উচ্ছলতা ও আনন্দের তাল কাটলো। বিরাট ঢেউয়ের ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে মোবাইল ফোন সহ নোনা জলে চিৎপাৎ। বকা খাওয়ার ভয়ে সিটকে গেলো। যা হবার তা হয়ে গিয়েছে বলে ওকে বুঝিয়ে পরে উটের পিঠে চড়ালাম।
 |
| সমুদ্র সৈকতে সূর্যোদয় |
রাতে ট্রেন। জগন্নাথ দেব দর্শন সমুদ্র স্নান সব সারা হল। তার পরেও হাতে অনেক সময় ছিল। একঘেয়ে কাটাবার জন্য হোটেলের সামনে থেকে আমরা একটা অটো বুক করে ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। পুরীর মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে সমুদ্রের ধার বরাবর লাইট পর্যন্ত এসে ডানদিকের রাস্তা ধরে আরো কিছুটা এগিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম লোকনাথ মন্দিরে। জগন্নাথ মন্দির থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে এই লোকনাথ মন্দির। এটা শিবের মন্দির। ভগবান লোকনাথ এখানে লিঙ্গের আকারে পূজিত হন। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে স্বয়ং ভগবান রাম এই মন্দিরের লিঙ্গটা স্থাপন করেছিলেন। এখানে শিবরাত্রির অনুষ্ঠান খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে হয়। লোকনাথ মন্দিরের চারটে অংশ রয়েছে, সেগুলো হল বিমান, জগমোহন, নাটমণ্ডপ এবং ভোগমণ্ডপ। চত্বরের মধ্যে সত্য-নারায়ণ মন্দিরে বিষ্ণু, লক্ষ্মী এবং বেশ কিছু পিতলের মূর্তি সংরক্ষিত আছে।
 |
| লোকনাথ মন্দির |
লোকনাথ মন্দির থেকে মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম গুপ্তবৃন্দাবনের প্রবেশ দ্বারে। আশ্রমে প্রবেশ মূল্য ৫ টাকা। স্থানীয়রা একে গৌড়বিহার আশ্রমও বলে থাকেন। শ্রী চৈতন্যদেব যখন পুরীতে ছিলেন তখন এই গৌড়বিহার আশ্রমে আসতেন সাধনা করতে। বিভিন্ন দেব দেবীর মূর্তি দিয়ে সুসজ্জিত একটা উদ্যান। গাছগাছালিতে ভরা এক গ্রাম্য পরিবেশ। আশ্রমের ভেতরে প্রবেশ করে যে দৃশ্য প্রথমে চোখে পড়ে তা একদম অন্যরকম। বিভিন্ন দেব দেবীর মূর্তি দিয়ে একেবারে সুসজ্জিত। সেই মতো প্রথমেই গণপতির দেখা পেলাম।
 |
| গৌড়বিহার আশ্রম |
এখানে হনুমান, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরামের এবং অন্যান্য দেবদেবীর বিভিন্ন সুন্দর মূর্তি রয়েছে। এই মূর্তি ভাস্কর্যের দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের জীবনবৃত্তান্তকে তুলে ধরা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলাখেলা, গোপীদের বস্ত্রহরণ, বামন অবতার, কালিয়নাগ দমন ইত্যাদি পৌরাণিক কাহিনী মডেল আকারে খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অনেকের মতে বৃন্দাবন ঘোরার অভিজ্ঞতা লাভ করা যায় এখানে, সেকারণেই এর নাম দেওয়া হয়েছে গুপ্তবৃন্দাবন। এই আশ্রমের বর্তমান এই রূপ দিয়েছেন মোহান্ত সুবল চরণ দাস।
 |
| গুপ্তবৃন্দাবন |
গৌড়বিহার আশ্রমে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে এবার চলে এলাম নরেন্দ্র সরোবরে। ওড়িশার সবচেয়ে বিখ্যাত, মনোরম এবং বৃহৎ জলাশয়গুলোর মধ্যে একটা হল এই নরেন্দ্র সরোবর। এখানে প্রভু জগন্নাথকে স্নান করানো হয়। মাদলা পাঁজি মতে, গঙ্গা বংশের রাজা ভানু নরসিংহ দেব নরেন্দ্র সরোবর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর গুরু নখপোষী নরেন্দ্র মহাপাত্রের নামে এর নামকরণ করা হয়েছিল। এই সরোবরে ১৬টা ঘাট রয়েছে। এর মাঝখানে একটা কৃত্রিম দ্বীপ রয়েছে। দ্বীপে চন্দন মণ্ডপ নামে একটা ছোট মন্দির রয়েছে। মন্দিরে যাওয়ার জন্য একটা ব্রীজের মতো রাস্তা রয়েছে। সরোবরের আশেপাশে ছোট-বড় অনেক মন্দির রয়েছে। এই সরোবরে চন্দন উৎসব হয় বলে একে ‘চন্দনপুকুর’ও বলা হয়।
 |
| নরেন্দ্র সরোবর |
নরেন্দ্র সরোবর থেকে আরও ১০মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে চলে এলাম গুন্ডিচা মন্দিরে। এই মন্দিরকে জগন্নাথের মাসির বাড়িও বলা হয়ে থাকে। এখানে রথযাত্রার সময় রথ এসে থাকে। রথযাত্রার দিন জগন্নাথ মন্দির থেকে যাত্রা করে এই গুন্ডিচা মন্দিরেই রথগুলো এসে থামে এবং সাতদিন এই গুণ্ডিচা মন্দিরেই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার আরাধনা করা হয়। সাতদিন পর তাঁদের জগন্নাথ মন্দিরে আবার ফিরিয়ে আনা হয়, যা 'উল্টোরথ' নামে পরিচিত। টিকিট কেটে এই মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। এখানে প্রতিটা বিগ্রহের সামনে পাণ্ডাদের উৎপাত। আগেরবার মন্দিরের ভেতরে ঢুকেছিলাম, তখন আমার খুব খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কেউ হাত ধরে টানছে, কেউ জোর করে টিপ পরিয়ে দিয়ে টাকা চাইছে। সেই জন্য এবার আমি মন্দিরের ভেতরে যায়নি।
 |
| গুন্ডিচা মন্দির (মাসির বাড়ি) |
এরপর সোজা চলে এলাম সুদর্শন ক্রাফট মিউজিয়ামে। পুরী স্টেশন রোডের কাছে এই ক্রাফট মিউজিয়াম। জাপানি ধাঁচের বৌদ্ধ মন্দিরের আদলে তৈরি এই মিউজিয়ামে হরেক রকমের পাথরের মূর্তি, কাঠের খোদাই এবং অন্যান্য হস্তশিল্প প্রদর্শন ও বিক্রয়ের জন্য রাখা আছে। চাইলে এখানে থেকে কেনাকাটা করা যেতে পারে।
 |
| সুদর্শন ক্রাফট মিউজিয়াম |
এবারে আমাদের নিয়ে এলো চক্রতীর্থ রোডে সোনার গৌরাঙ্গ মন্দিরে। মন্দিরের ভেতরে অষ্টধাতু নির্মিত গৌরাঙ্গ মূর্তি রয়েছে। এখানে সুভদ্রা, জগন্নাথ, বলরাম, এবং শ্রীরামের মতো অন্যান্য দেবদেবীরও মূর্তি রয়েছে। মন্দিরের প্রবেশদ্বারে দুটো সিংহের মূর্তি রয়েছে। মন্দিরের ভেতরে মোবাইল ও ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশ নিষেধ। মূল মন্দিরের ভিতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ হলেও, পাশে সুভদ্রা মন্দির এবং গৌরাঙ্গ মন্দিরে ছবি তোলা যায়। এরপর গেলাম বেদী হনুমান মন্দিরে। মন্দির দর্শনের ফি ৫ টাকা। তারপর চক্র নৃসিংহ মন্দির যা জগন্নাথ দেবের শ্বশুরবাড়ি নামে পরিচিত। এছাড়া আরও দু একটা জায়গা ঘুরে দেখলাম।
No comments:
Post a Comment