পোড়ামাটির টেরাকোটার শিল্পকর্ম সমৃদ্ধ মন্দিরগুলোর কাজ দেখতে বাংলা তথা সারা বিশ্বের প্রচুর পর্যটক ছুটে আসেন বিষ্ণুপুরে। স্থাপত্য পর্যটন মানচিত্রে বিষ্ণুপুর আজ এক পরিচিত নাম। ছোট বড়ো বিভিন্ন ধরনের প্রচুর মন্দির থাকার জন্য বিষ্ণুপুরকে মন্দির-নগরী বললে ভুল হবে না। লালমাটির পথের বাঁকে বাঁকে শুধুই ইতিহাস আর টেরাকোটা শিল্পকর্মে সমৃদ্ধ মন্দির ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। রয়েছে চমৎকার সব দর্শনীয় স্থান। মন্দিরগুলোর বেশিরভাগই শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এবং মন্দিরগুলোর অবস্থান বেশ কাছাকাছি হলেও কিন্তু একদিনের জন্য ঘুরতে এসে সবগুলো দেখে ফেলা সম্ভব নয়। শুধু মন্দির কেন? হস্তশিল্পের এত বিপুল সম্ভার বিষ্ণুপুরের মতো এ রাজ্যের আর কোথাও আছে বলে চোখে পড়ে না। টেরাকোটার মূর্তি থেকে বালুচরী শাড়ি, কাঁসার বাসন থেকে শাঁখা শিল্প, চোখ ফেরানো দায় এমন সব সৃষ্টিতে সমৃদ্ধ এই শহর। শুধু কি তাই, সাংস্কৃতিক দিক থেকেও বিষ্ণুপুরের গুরুত্ব কম নয়। বিষ্ণুপুর ঘরানার ধ্রুপদ সঙ্গীত হল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একমাত্র ধারা যার সূত্রপাত হয়েছিল এই শহর থেকেই।
 |
| হোটেল অন্নপূর্ণা |
ভ্রমণপিপাসু বাঙালি মন, ছুটির দিনগুলোতে একেবারেই বাড়িতে মন টেকে না। তাই মাঝে মাঝেই কোথাও একটু বেরিয়ে পড়ি। ঠিক তেমন ভাবেই ঝকঝকে রৌদ্রজ্জ্বল দিন দেখে এক রবিবারে গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেলাম মন্দির-নগরী বিষ্ণুপুরে।শহরে ঢোকার পর বাসস্ট্যান্ড পেরিয়ে মেন রোডের ধারে 'যদুভট্ট মঞ্চ' নামে একটি অডিটোরিয়াম বেশ নজর কাড়লো। অডিটোরিয়ামের একপাশে গাড়ি পার্ক করে গাড়ি থেকে নামলাম। শিল্প সংস্কৃতির এই শহরে যদুভট্ট মঞ্চটিও দেখার মতো। বাংলা ধ্রুপদ গানের চর্চার সঙ্গেই উজ্বল হয়ে আছে যদুভট্টে অর্থাৎ যদুনাথ ভট্টাচার্য্য-এর নাম। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে বিষ্ণুপুরে এই যদুভট্ট মঞ্চটি তৈরী। সামনে শিল্পীর একটি আবক্ষ মূর্তি আছে।
 |
| যদুভট্ট মঞ্চ |
অবস্থান অনুসারে বিষ্ণুপুরের মন্দিরগুলো চারটি গ্রুপে ভাগ করা। লালবাঁধের দক্ষিণে রয়েছে কালাচাঁদ, রাধাগোবিন্দ, নন্দলাল ও রাধামাধব – এগুলো লালবাঁধ গ্রুপ-এর মন্দির আবার এদের কিছু পশ্চিমে যৌথভাবে 'জোড়-মন্দির' নামে পরিচিত তিনটি মন্দির আছে যাদের আলাদা করে কোনো নাম নেই। দুর্গ এলাকায় রয়েছে জোড় বাংলা, শ্যামরায় ছাড়া লালজীউি ও রাধাশ্যাম মন্দির দুটি। আর শহরের মধ্যে রয়েছে চারটি মন্দির মুরলীমোহন, মদনমোহন, মল্লেশ্বর ও রাধাবিনোদ। এছাড়া নামবিহীন আর একটি মন্দির আছে কৃষ্ণবাঁধের পূর্ব পাড়ে পাটপুরে। চলে এলাম মহকুমা শাসকের অফিসের পাশে শিশু উদ্যানের গেটের সামনে। এবার দেখলাম এখানে আরেকটি নতুন আকর্ষণ যোগ হয়েছে। পোড়ামাটির তৈরি এক বিশাল টেরাকোটার দুর্গা প্রতিমা। বিষ্ণুপুরে বেড়াতে আসা পর্যটকদের আকৃষ্ট করতেই এই উদ্যোগ।
 |
| পোড়ামাটির তৈরি বিশাল টেরাকোটার দুর্গা |
কিছুটা এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল বিষ্ণুপুরের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য 'রাসমঞ্চ'। এটি একটি অভিনব স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন। আনুমানিক ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দে রাসমঞ্চটি মহারাজা বীর হাম্বীর নির্মাণ করেন। প্রাচীনত্ব ও স্থাপত্য বৈশিষ্টের জন্য বিষ্ণুপুরের এই রাসমঞ্চ উল্লেখযোগ্য। রাস্তার একপাশে গাড়ি পার্কিং করে চলে এলাম রাসমঞ্চের গেটের কাছে।
এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি, বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত তিনটি স্থাপত্য – রাসমঞ্চ, শ্যামরায় মন্দির ও জোড়বাংলা তথা কৃষ্ণরায় মন্দির দেখার জন্য টিকিট কাটতে হয়। এই মন্দিরগুলোর যেকোনো একটিতে আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার (ASI) কাউন্টার থেকে টিকিট কাটলে বাকি মন্দিরগুলোতে ঢুকতে আর কোনও টিকিট লাগে না।
চারপাশে লোহার রেলিং ঘেরা, কেয়ারি করা সবুজ বাগানের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে রাসমঞ্চ। পুরো চত্বরটা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে। বিষ্ণুপুরের প্রায় সব মন্দির এরাই রক্ষণাবেক্ষণ করেন। ঢোকার মুখে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার টিকিট কাউন্টার। টিকিট কেটে রাসমঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলাম।
 |
| রাসমঞ্চ |
মাকড়া পাথরের বর্গাকার উঁচু বেদীর উপর অবস্থিত পোড়ামাটির ইটের তৈরি বিশাল এক ইমারত। এর গঠনশৈলটি অনেকটা পিরামিডের মতন, ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে চূড়া। মূল মঞ্চের সঙ্গে চারদিক জুড়ে বারান্দা, খিলানের পর খিলান। প্রতিটি খিলানের গঠন তিন রকমের পোড়ামাটির ইঁট দিয়ে বানানো। পাতলা, অপেক্ষাকৃত মোটা এবং আরো মোটা ইঁট। চুন-সুড়কির গাঁথনি ইটের খিলানযুক্ত খোলা প্রবেশপথগুলো গর্ভগৃহকে ঘিরে রেখেছে। গর্ভগৃহে কোন বিগ্রহ নেই। এই ধরণের স্থাপত্য শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, সারা ভারতবর্ষেই বিরল।
 |
| রাসমঞ্চের খিলানযুক্ত প্রদক্ষিণ পথ |
রাসমঞ্চের ঠিক একটু আগেই দেখা গেলো শতাধিক বছরের পুরনো একটি গোশালা। এই গোশালার দেওয়াল জুড়ে ফুটে উঠেছে প্রাচীন বিষ্ণুপুরের সচিত্র ইতিহাস ও প্রাচীন পুরাকীর্তি। এই দেওয়ালচিত্র পর্যটকদের কাছে অন্যতম বাড়তি পাওনা।
 |
| গোশালার দেওয়ালচিত্র |
রাসমঞ্চ দেখে চললাম দুর্গ এলাকার দিকে। যাওয়ার পথে ডানদিকে ঝোপঝাড়ের ভিতরে চোখে পড়ল দরজা, জানলা ও ছাদবিহীন ইটের তৈরি উঁচু চৌকোণা এক ইমারত, এটি 'গুমঘর' বা 'গুমগড়' নামেই পরিচিত। এটি রাজবাড়ীর একটি জলাধার ছিল। আবার ভিন্নমতে শোনা যায় প্রাণদন্ডে দণ্ডিত অপরাধীদের গুম বা খুন করার জন্য নিক্ষেপ করা হতো এই ঘরটির ভিতরে। প্রচলিত এই ধারণা থেকেই 'গুমঘর' কথাটি এসেছে। তবে এই বক্তব্যের পক্ষে কোনো সমর্থনযোগ্য যুক্তি পাওয়া যায়নি।
 |
| গুমগড় |
গুমগড় থেকে সামান্য একটু এগিয়ে বাঁ দিকের লাল মোরামের রাস্তা দিয়ে চলে এলাম শ্যামরায় মন্দিরে। পঞ্চরত্ন রীতিতে তৈরি এই মন্দিরটি ১৬৪৩ খ্রীষ্টাব্দে মহারাজ বীর হাম্বীরের পুত্র প্রথম রঘুনাথ সিংহ প্রতিষ্ঠা করেন। বিষ্ণুপুরের বর্তমান দেবালয়গুলোর মধ্যে প্রাচীনত্বের দিক থেকে এই মন্দিরটি তৃতীয়।
 |
| শ্যামরায় মন্দির |
মন্দিরের বাইরে, ভিতরের দেওয়াল ও চূড়াগুলো ছাড়াও ছাদের নীচের অংশে পোড়ামাটির অজস্র অলঙ্করণ রয়েছে যা পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। টেরাকোটা অলঙ্করণের উৎকর্ষ ও অজস্রতার ক্ষেত্রে শ্যামরায় মন্দির শ্রেষ্ঠ। মন্দিরের মূল পরিকাঠামো বাঁকানো কার্ণিশযুক্ত ঢালু ছাদ দ্বারা আচ্ছাদিত। চারকোণে চারটি প্রকোষ্ঠ এবং প্রকোষ্ঠগুলোর মাঝে তিনটি করে খিলানযুক্ত প্রবেশপথ। চারটি প্রকোষ্ঠর প্রত্যেকটির উপরে রয়েছে চার কোণ বিশিষ্ট একটি করে চূড়া। গর্ভগৃহের উপরে নির্মিত মাঝের চূড়াটি আট কোণ বিশিষ্ট। গর্ভগৃহের চারিদিকে রয়েছে সংকীর্ণ প্রদক্ষিণ পথ।
 |
| রাসচক্র |
শ্যামরায় মন্দির দেখে আবার গুমগড়ের কাছে এসে বাঁ দিকে টার্ন নিয়ে আগের রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে চলে এলাম দুর্গ এলাকায় মৃন্ময়ী মন্দিরে। মৃন্ময়ী মন্দিরের গেটের বাইরে রাস্তার একপাশে গাড়ি পার্ক করেে ভিতরে প্রবেশ করলাম। বিষ্ণুপুরের অতি প্রাচীন মন্দিরগুলোর মধ্যে ৺মৃন্ময়ী মাতার এই দালান মন্দিরটি অন্যতম। মল্লরাজ জগৎ মল্ল এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। ৺মৃন্ময়ী মাতা প্রকৃতপক্ষে দুর্গতিনাশিনী দুর্গা। মল্ল রাজপরিবারের কুলদেবী রূপে পূজিতা হন।
 |
| ৺মৃন্ময়ী মাতার মন্দির |
কথিত আছে, মন্দিরের সামনে অবস্থিত পঞ্চবটী গাছের শিকড়ের নীচে রাজা জগৎ মল্ল এক দৈববাণী অনুসারে মাটি খুঁড়ে পেয়েছিলেন দেবীর একটি আবক্ষ মুখমণ্ডল। তারপর দেবীর ইচ্ছানুসারে গঙ্গামাটি দিয়ে তৈরি হয় দুর্গামূর্তিটি। মাটি দিয়ে তৈরি হওয়ার জন্য দেবীর নাম হল 'মৃন্ময়ী'। অনুমান করা হয় অতীতে এই মন্দিরে দেবীমূর্তির পাশাপাশি রাগ-রাগিণীরও পূজো হতো। সেই কারণে মন্দিরের স্তম্ভে রাগিনীর প্রতীক হিসেবে তিনটি নারীমূর্তি দেখা গেলো। এখানে বিগ্রহের ছবি তোলা গেলো না, মন্দিরের সামনে বড় বড় করে লেখা আছে 'রাজ অনুমতি ব্যতীত শ্রী শ্রী ৺মৃন্ময়ী মাতার ছবি তোলা নিষেধ'। মন্দিরের পাশেই পূজোর সামগ্রী সহ ডোকরা ও টেরাকোটার জিনিসের দুটো দোকান রয়েছে।
 |
| মন্দিরের পাশে দোকান |
মৃন্ময়ী মাতার মন্দির থেকে বেরিয়ে গেটের সামনে চা-এর দোকান দেখে একটু গলাটা ভিজিয়ে নিলাম। এরপর উল্টোদিকে রাধাশ্যাম মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করলাম। উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এই মন্দিরের মন্দিরের মুখে সুন্দর নহবতখানা। নহবতখানা দু'টো ইঁটের তৈরি চারচালা। নহবতখানা দু'টোর প্রত্যেকটিতে রয়েছে পাঁচটি করে খিলানদ্বার। এই নহবতখানায় একসময় নিত্য গানবাজনার আসন বসত। ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এই প্রবেশদ্বারটি নজরকাড়ার মতো।
 |
| রাধাশ্যাম মন্দিরের প্রবেশদ্বার |
চলে এলাম এবার মূল মন্দিরে। আগাগোড়া মাকড়া পাথরের তৈরি এই মন্দিরের শিখর গম্বুজাকৃতি। চতুষ্কোণ ছাদবিশিষ্ট মন্দিরের চুড়োয় গম্বুজআকৃতি বিষ্ণুপুরের বাকি মন্দিরের থেকে অনেকটাই আলাদা। মাকড়া পাথরের তৈরি এই মন্দিরটি মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ ১৭৫৮ সালে নির্মাণ করেছিলেন। মন্দিরের পূর্ব ও পশ্চিমে তিন খিলানযুক্ত খোলা বারান্দা রয়েছে। তবে উত্তরের খিলানযুক্ত বারান্দার দেওয়াল বন্ধ। মন্দির চত্বরে রয়েছে তুলসীমঞ্চ, রান্নাঘর ও নাটমঞ্চ। রয়েছে রাধাশ্যাম, গৌরনিতাই ও জগন্নাথের মূর্তি। এই মন্দিরে এখনও নিত্য পূজা হয়ে থাকে।
 |
| রাধাশ্যাম মন্দির |
মন্দিরের বাইরের দেওয়াল ও কার্নিশ এবং বারান্দার ভিতরের দেওয়ালগুলো নানারকম মূর্তি-ভাস্কর্যে অলঙ্কৃত। ল্যাটেরাইট-ভাস্কর্যের প্রযুর্যের জন্য রাধাশ্যাম মন্দিরটি উল্লেখযোগ্য। রাধাশ্যামের মূর্তি যেদিকে আছে তার সামনে রয়েছে নাটমঞ্চ।
 |
| ল্যাটেরাইট পাথরের উপরে খোদাই করা মূর্তি |
রাধাশ্যাম মন্দিরের পাশে রয়েছে দেউল আকৃতির ইটের তৈরি একটি সুদৃশ্য তুলসী মঞ্চ যা পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষিত করে। এরকম অভিনব তুলসী মঞ্চ অন্য কোনো মন্দির প্রাঙ্গনে দেখা যায় না। তুলসী মঞ্চের গা ঘেঁষে মন্দিরের পূর্ব দিকে গেলে দেখা যাবে একটি ভোগমণ্ডপের ভগ্নাংশ।
 |
| তুলসী মঞ্চ |
রাধাশ্যাম মন্দির থেকে বেরিয়ে চলে এলাম দুর্গ এলাকার লালজীউ মন্দিরে। বছর খানেক পরে এবারে এসে দেখলাম লালজীউ মন্দিরের সামনে সেই রুক্ষ লাল মোরামের চত্বরটি আর নেই। ঐতিহাসিক মন্দির চত্বর এলাকায় সৌন্দর্যায়নের ছোঁয়া পড়েছে। পর্যটকদের আকর্ষণীয় করতে সেখানে সবুজ ঘাসে মোড়া একটি পার্ক তৈরি হয়েছে। পার্কের ভিতরের রাস্তা দিয়ে পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম মন্দির চত্বরে।
 |
| সৌন্দর্যায়নের ছোঁয়া |
উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা আগাগোড়া মাকড়া পাথরে তৈরি এই লালজীউ মন্দির। মন্দিরটি রাধা-লালজীউ এর প্রীতির জন্য মহারাজ রঘুনাথ সিংহের পুত্র দ্বিতীয় বীর সিংহ ১৬৫৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন। চারচালা ছাদ বিশিষ্ট একরত্ন এই মন্দিরটি একটি চৌকো ভিত্তিবেদীর ওপর অবস্থিত এবং মন্দিরের বাইরের দেওয়ালের চারদিকেই রয়েছে তিন খিলানযুক্ত বারান্দা। মন্দির প্রঙ্গনে পূর্ব দিকের প্রাচীর ঘেঁষে রয়েছে ইটের তৈরি একটি ভোগমণ্ডপের ভগ্নাংশ। ভোগমণ্ডপের পাশে রয়েছে একটি কুঁয়ো, এছাড়াও মন্দির প্রাঙ্গনে রয়েছে মাকড়া পাথরের তৈরি একটি সুন্দর তুলসী মঞ্চ। লালজীউ মন্দিরের উল্টোদিকে রাস্তার ধারেই রয়েছে জরাজীর্ণ রাজবাড়ী। ধংসস্তূপ ছাড়া এখন দেখার মতো আর কিছুই নেই।
 |
| লালজীউ মন্দির |
লালজীউ মন্দির দেখে দুর্গ এলাকায় একটু পিছনে এসে চলে এলাম জোড়বাংলা মন্দিরে। এই জোড়বাংলা মন্দির বিষ্ণুপুরের এক ঐতিহ্য বহন করে। জোড়বাংলা মন্দিরের গেটের একপাশে গাড়ি পার্ক করেে ভিতরে প্রবেশ করলাম। যেহেতু রাসমঞ্চে টিকিট কাটা ছিল তাই এখানে প্রবেশের জন্য আলাদা করে টিকিটের প্রয়োজন হলো না। দুচালার এক জায়গায় মিলন। গায়ে পোড়ামাটির কাজ, নজর কাড়বেই। মন্দিরটি বীর হাম্বীরের পুত্র প্রথম রঘুনাথ সিংহ ১৬৫৫ খ্রীষ্টাব্দে কৃষ্ণরায়ের জন্য নির্মাণ করেন। সেইজন্য মন্দিরটি 'কৃষ্ণরায় মন্দির' নামেও পরিচিত।
 |
| জোড়বাংলা মন্দির |
শুধু স্থাপত্যরীতির অভিনবত্ব নয়, পোড়ামাটির অলঙ্করণ-প্রাচুর্যের জন্যও জোড়বাংলা মন্দির অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। শ্যামরায় মন্দির ছাড়া অজস্র টেরাকোটার অলঙ্করণ সারা পশ্চিমবঙ্গের আর কোনো মন্দিরে নেই। পরষ্পর সংযুক্ত দু'টো দোচালা ঘরের মধ্যে চার কোণ বিশিষ্ট বেদীর উপর চারচালা বিশিষ্ট একটি চূড়া নিয়ে তৈরি এই মন্দিরটি। দু'টো দোচালা বাংলাঘরকে জুড়ে মন্দিরটি তৈরি হওয়ার জন্য 'জোড়বাংলা মন্দির' নামে পরিচিত। প্রথম দোচালার নীচে তিন খিলানের প্রবেশ পথ বিশিষ্ট বারান্দা আর দ্বিতীয় দোচালার নীচে গর্ভগৃহের অবস্থান। পিছনের দোচালার গর্ভগৃহে প্রবেশের জন্য অতিরিক্ত একটি দরজা আছে। মন্দিরটির সারা দেওয়াল জুড়ে অসংখ্য সূক্ষ্ম এবং সুসজ্জিত টেরাকোটার কাজ যা রীতিমতো পর্যটকদের নজর কাড়ে।
 |
| পরস্পর সংযুক্ত দু'টো দোচালা বাংলাঘর |
জোড়বাংলা মন্দিরের সামনে রাস্তার পাশে দেখি কয়েকজন মাটিতে প্লাস্টিক বিছিয়ে পসরা নিয়ে বসে আছেন। পোড়ামাটির ঘোড়া, কাপডিশ, জলের বোতল, ঘর সাজানোর সামগ্রী, বাঁকুড়ার গামছা থরে থরে সাজানো। এছাড়া ডোকরার তৈরি দেবদেবীর মূর্তি থেকে গয়না, ঘর সাজানোর রকমারি জিনিস রয়েছে। পোড়ামাটির গহনা এবং তার উপর রং তুলির কাজ চোখে পড়ার মতো। এক বাউল একতারা নিয়ে তাঁর সুমধুর কণ্ঠে অবিরাম গান গেয়ে চলেছে। একটা সুন্দর স্মৃতি নিয়ে এবারে চললাম শহরের অন্য প্রান্তে মদনমোহন মন্দিরে।
 |
| পসরা সাজিয়ে বসা এক দোকানি |
বিষ্ণুপুরের সঙ্কীর্ণ আঁকাবাঁকা গলি রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে চলে এলাম মদনমোহন মন্দিরে। মন্দিরটি শহরের বৃহত্তম পুরাতন মন্দিরগুলির মধ্যে একটি। বিষ্ণুপুরের বেশিরভাগ মন্দিরেই এখন আর বিগ্রহ নেই তবে মদনমোহন মন্দিরে প্রতিদিন পূজা হয়। ভগবান মদনমোহন অর্থাৎ কৃষ্ণ হলেন এই মন্দিরের অধিষ্ঠিত দেবতা। এই মন্দিরের সামনে এসেও দেখতে পেলাম ডোকরা ও পোড়ামাটির তৈরি জিনিসের বেশ কিছু দোকান। বাংলার দোচালা ধাঁচের ইটের তৈরি নকশা করা তিনটি খিলানযুক্ত সুদৃশ্য প্রবেশপথটি রীতিমতো নজর কাড়ে।
 |
| দোচালার প্রবেশদ্বার |
মন্দির চত্বর পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। মূল মন্দিরটি বর্গাকার এবং মাকড়া পাথর দিয়ে তৈরি উঁচু ভিত্তির উপর অবস্থিত। মূল মন্দিরে প্রবেশের জন্য ভূমি থেকে ৬টি উঁচু সিঁড়ি রয়েছে। মল্লরাজদের রক্ষক ও নগরদেবতা মদনমোহনের উদ্দেশ্যে নির্মিত এই মন্দিরটি। বিশ্বাস করা হয় যে মারাঠা আক্রমণের সময় তিনি এই বিষ্ণুপুর শহরকে রক্ষা করেছিলেন। ১৬৯৪ খ্রীষ্টাব্দে মল্লরাজ দুর্জন সিংহ প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটি 'একরত্ন' শৈলীতে নির্মিত। বর্গাকার ঢালু ছাদের উপর উপরে একটি চূড়া রয়েছে। ইটের তৈরি 'একরত্ন' মন্দিরগুলোর মধ্যে মদনমোহন মন্দিরটি অতুলনীয়। চূড়াটি রাধাশ্যাম মন্দিরের মতো গম্বুজাকৃতি। মন্দিরের ছাদ বিভিন্ন নকশায় খোদাই করা।
 |
| মদনমোহন মন্দির |
মন্দিরটির বাইরের দেয়াল এবং স্তম্ভগুলি সুন্দর পোড়ামাটির ভাস্কর্যে পরিপূর্ণ। যেখানে 'পুরাণ', 'রামায়ণ' এবং 'মহাভারত'-এর বিভিন্ন দৃশ্য চিত্রিত করা হয়েছে। এর বেশিরভাগই কৃষ্ণের সাথে সম্পর্কিত। মূর্তি-ফলকগুলো ছাড়াও ফুল-লতাপাতার অপরূপ নকশা খুব কম মন্দিরেই লক্ষ্য করা যায়।
 |
| সুন্দর কারুকার্য করা টেরাকোটার ফলক |
মদনমোহন মন্দিরের দক্ষিণ দিকে পোড়ামাটির কারুকার্য করা একটি বাংলার চারচালা আকৃতির 'চণ্ডী মণ্ডপ' রয়েছে। যার কার্নিশগুলি বাঁকা এবং ঢালু চালা ধরণের ছাদ। মন্দিরের বিপরীতে অবস্থিত দোচালা ভোগমণ্ডপটিও বিষ্ণুপুর স্থাপত্যশৈলীর একটি উদাহরণ, যার তিন খিলানযুক্ত খোলা বারান্দা রয়েছে। এই মন্দিরে এখনও প্রতিদিন দুবেলা পুজো হয়।
 |
| নাটমন্দির |
মদনমোহন মন্দির দর্শন করে চলে এলাম আবার রাসমঞ্চের কাছে। হাইস্কুল মোড় থেকে ট্যুরিস্ট লজের পাশের রাস্তায় দলমাদল রোড ধরে একটু এগিয়ে যেতেই ডানদিকে নজরে পড়লো সেই বিখ্যাত সুবিশাল কামানটি যার নাম 'দলমাদল'। এই দলমাদল কামানটি হল মল্লভূমের মল্লরাজাদের সবচেয়ে বড় কামান। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এটি রাজমহল থেকে আনা কুমার জগৎসিংহের দেওয়া উপহার। দলমাদলের চেহারা ও ধাতুবৈশিষ্ট্য বিষ্ণুপুরের অন্য কামানগুলোর সঙ্গে মেলে না। এর পিছনদিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় ফারসি ভাষায় একটি লিপি খোদিত রয়েছে। তবে অনেকেই মনে করেন এই কামানটি বিষ্ণুপুর শাঁখারিবাজারের জনৈক জগন্নাথ কর্মকারকে দিয়ে মল্লরাজ রঘুনাথ তৈরি করিয়েছিলেন। এই কামানটি যে কর্মকার তৈরি করেছিলেন তিনি ছিলেন ধর্মঠাকুরের পূজারী। শাঁখারিবাজার মহল্লা ছিল ধর্মঠাকুরের অঞ্চল। সেখানে ধর্মঠাকুরের একটি ধর্মশিলার নাম 'দলমাদল' থেকেই কামানটির নাম দেওয়া হয়েছে বলে আনুমান করা হয়। কামানের নামকরণ নিয়ে একটি কিংবদন্তী চালু রয়েছে, রাজা গোপাল সিংহের রাজত্বকালে বর্গী হামলা আটকাতে নগরদেবতা মদনমোহন তাঁর মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে তিনি নিজেই এই কামান চালিয়ে বিষ্ণুপুরকে রক্ষা করেছিলেন। সেই থেকে এই কামানটির নাম 'দল-মর্দন। দল মানে শত্রুদল অর্থাৎ বর্গীর দলকে মর্দন বা বিনাশ করেছে যে কামান। লোকমুখে অপভ্রংশ হয়ে দলমর্দন আজ দলমাদল নামে পরিচিতি।
 |
| দলমাদল কামান |
দলমাদলের পাশেই রয়েছে 'ছিন্নমস্তা মন্দির'। তবে এই মন্দিরটি টেরাকোটার নয়, আধুনিক মন্দিরের মতোই। ১৩৪৯ বঙ্গাব্দে বিষ্ণুপুরের 'তুড়কি হরি তপোবন আশ্রমে' ছিন্নমস্তা দেবীকে প্রথম স্থাপন করা হয়। পরবর্তীকালে ১৩৮০ বঙ্গাব্দে ঐ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী শ্রী মৌনীবাবার এক গৃহশিষ্য মেদিনীপুর নিবাসী কৃষ্ণচন্দ্র গুঁই মহাশয় দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দিরটি নির্মাণ করে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন। ছিন্নমস্তা মন্দিরের সামনে রাস্তা জুড়ে কেনাকাটার জন্য রয়েছে নানা সম্ভারের দোকান। মাটির ঘোড়া, টেরাকোটা, ডোকরা থেকে শুরু করে শঙ্খ, লণ্ঠন, দশাবতার তাস, চুড়ি-মালা সব কিছুর দোকান রয়েছে এই রাস্তায়। রয়েছে বিখ্যাত বালুচরি, স্বর্ণচরী শাড়ির দোকান 'অনুষ্কা'। এই শাড়ি কীভাবে কারিগররা তৈরি করে তা এখানে নিজের চোখে দেখে নেওয়া গেলো। টুকটাক কিছু কেনাকাটা করে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। ছিন্নমস্তা মন্দির ছাড়িয়ে একটু এগোতেই দেখি পিচের রাস্তা শেষ, এবার লাল মোরামের রাস্তায় এসে মনে হলো যেন শহরের বাইরে চলে এসেছি। এরপর কিছুটা গিয়ে হাইওয়ে ধরে হু হু করে গাড়ি চালিয়ে বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। একদিনের জন্য ঘুরতে এসে মন্দির-নগরীর সব দেখে ফেলা সম্ভব নয়। বিষ্ণুপুরে দেখার মতো রয়ে গেলো আরও অনেক মন্দির, আরও অনেক কিছু। অদেখার খোঁজে... প্রতিবারের মতো আবার আসব ফিরে... এই মন্দির-নগরী বিষ্ণুপুরে।
 |
| ছিন্নমস্তা মন্দির |
» থাকার ব্যবস্থাবিষ্ণুপুরে থাকার জন্য ছোট বড়ো প্রচুর হোটেল আছে। তবে আমার মতে সবচেয়ে ভালো পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন টুরিস্ট লজে থাকা। রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যুব হোস্টেল। এছাড়া উল্লেখযোগ্য হোটেল হলো উদয়ন লজ, হোটেল লক্ষ্মী পার্ক, মোনালিসা লজ। রয়েছে ষ্টার ক্যাটাগরির হোটেল অন্নপূর্ণা।
» বিষ্ণুপুরের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হোটেলের ওয়েবসাইট ও মোবাইল নম্বর
» বিষ্ণুপুরের স্বীকৃত টুরিস্ট গাইডদের নাম ও মোবাইল নম্বর
- দেবাশীষ চ্যাটার্জী - +৯১ ৯৩৩২১৪৬১৯৯
- উত্তম পাল - +৯১ ৯৩৩২৪৬৩১২৭
- কৃষ্ণচন্দ্র গোস্বামী - +৯১ ৯৩৭৮১৩২২১২
- অসিত দাস - +৯১ ৯৪৩৪৪৭৯৫৫৭
- অঞ্জন লাহা - +৯১ ৯৪৩৪৪৭৯৫৭৫
- অচিন্ত ব্যানার্জী - +৯১ ৯৭৩২১২৫৩৬৩
- বিশ্বজিৎ প্রামানিক - +৯১ ৯৪৭৪৬৭০১১০
- নিরঞ্জন অধিকারী - +৯১ ৯৭৩৪২৫৯৬৩৯
- মধুসূদন মুখার্জী - +৯১ ৯৪৩৪৯৯৮৯৪৪
- অলোক অধিকারী - +৯১ ৮৭৬৮৫৭৮১৮০
- মিঠু ভুঁই - +৯১ ৯৪৭৪৪৫২৯৯২
- রাজকুমার গোস্বামী - +৯১ ৯৭৩২২২৩৯৩৯
★★ সৌজন্যে : মল্লভূম ট্যুরিস্ট গাইড ওয়েলফারে এসোসিয়েশন।
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ- 'বাঁকুড়া জেলার পুরাকীর্তি' - অমিয়কুমার বন্দোপাধ্যায়, 'মল্লভূম বিষ্ণুপুর' - মনোরঞ্জন চন্দ্র)
BISHNUPUR, BANKURA, WEST BENGAL
No comments:
Post a Comment