শীতের ভ্রমণের আলাদা একটা উন্মাদনা থাকে কারণ শীতকালেই সব চেয়ে স্পষ্ট দেখা যায় ল্যান্ডস্কেপ। যেহেতু ভ্রমণের সাথে ফটোগ্রাফিও আমার একটা শখ তাই শনি-রবি অফিসে দু'দিনের ছুটি পেলেই মন ডানা মেলে উড়তে চায় অচেনা দিগন্তের ক্যানভাসে। হাতে সময় কম তাই লং ট্যুরের কথা না ভেবে কাছে-পিঠে এমন কোনো অফবিট জায়গার হদিস করি যেখানে বেড়াতে গেলে মন হয়ে উঠবে চনমনে। দীঘা, মন্দারমণির কাছেই বগুড়ান জলপাই জায়গাটি পর্যটন মহলে এখনো খুব বেশি পরিচিত নয়। এখানকার সমুদ্র দীঘার তুলনায় অনেকটা শান্ত। সমুদ্র সৈকতের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে ঝাউবন। রয়েছে বিস্তৃত বেলাভূমি। প্রকৃতি এখানে এতটুকুও বদলায়নি, তবে সমুদ্রকে কাছে পাওয়া যায় না সবসময়। কেবল জোয়ার এলে তখনই সমুদ্রকে নিজের মতো কাছে পাওয়া যায়। আবার ভাঁটার টানে সমুদ্র উধাও। অর্থাৎ ভাঁটা হলেই সমুদ্রের জল পিছিয়ে যায় বহুদূরে। এখানে দীঘার মতো দেখা যায় না পর্যটকদের দাপাদাপি, নেই কোনো সমুদ্রে স্নানের উল্লাস। রয়েছে সমগ্র বেলাভূমি জুড়ে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ানো লাল কাঁকড়ার দল, তবে মানুষের পায়ের শব্দ পেলেই ফুরুৎ করে পালাবে।
সমুদ্র সৈকতে আমার কখনো ক্লান্তি আসে না। কিন্তু চেনা সৈকতে কি বারবার যেতে ভাল লাগে! তাই দীঘা মন্দারমণি অনেক হয়েছে, এবারে এক অজানা সমুদ্র সৈকতের হদিস পেয়ে একদিন সকালে উঠে বেরিয়ে পড়লাম গাড়ি নিয়ে। সঙ্গে ছিল সৌমেন আর অরিন্দম। অনেকের কাছে শুনেছি বগুড়ান সৈকতে যাওয়ার আগে গ্রামের ভেতরের রাস্তাটা খুব একটা ভালো নয়। নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে যাব তাই একটা আশঙ্কা থেকে যায়। ভয় ভীতি কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের গন্তব্যে। নির্জন সমুদ্র সৈকত 'বগুড়ান জলপাই' এখনো সেরকম প্রচারের আলোয় আসেনি। কাঁথি সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড পেরিয়ে দীঘা বাইপাস মোড়ের কাছে দেখি দু'দিকে রাস্তা ভাগ হয়ে গেছে। ডানদিকের রাস্তা গিয়েছে দীঘার দিকে, আমরা বাঁ দিকের পথ ধরলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর আলদারপুটে এসে পৌঁছলাম। আলদারপুট খাল পেরিয়ে সোজা রাস্তাটা চলে গেছে জুনপুটের দিকে। সেদিকে না গিয়ে আমরা এবার ডানদিকের পথ ধরলাম। মোড় ঘুরেই খানিকটা এসে সি-ডাইক রোডে ওঠার পর দৃশ্যপট যেন বদলে গেল। রাস্তার দু'ধারে প্রচুর চিংড়ির ভেড়ি। হাওয়ায় ভেসে আসছে শুঁটকি মাছের তীব্র গন্ধ। মাঝে মধ্যে গ্রাম্য ঘরবাড়ির উঁকিঝুঁকি আর দৈনন্দিন গ্রামজীবনের ছবি দেখতে দেখতে এক সময় পৌঁছে গেলাম বাগুড়ান জলপাই গ্রামে। সি-ডাইক রোড থেকে ডাইনে মোড় নিয়ে গ্রামের মধ্যে দিয়ে আরেকটু এগিয়ে গেলাম।
 |
| সাগর নিরালায় |
গাড়ি এসে থামল 'সাগর নিরালায়' গেস্ট হাউসের দোরগোড়ায়। রাস্তাটা এখানে দু'টো ভাগ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সমুদ্র খুব বেশি দূরে নয়। গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, সমুদ্রের ধারে যাব কোনদিকে? তখন তিনি ডানদিকের রাস্তাটা দেখিয়ে বললেন, 'ওদিকে যান, সমুদ্র পেয়ে যাবেন'। ডানদিকে ঘুরে দেখি একটা কাঁচা মাটির রাস্তা চলে গেছে সমুদ্রের দিকে। উঁচু নিচু কাঁচামাটির পথ। পথের দুধারে ঝাউবন। প্রায় আধ কিলোমিটার পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্যে। ঝাউবনের ভেতরে গাছের ছায়ায় গাড়ি রাখলাম। গাড়ি থেকে নেমে ঝাউয়ের দোলায় দোল খেতে খেতে এগিয়ে গেলাম নির্জন সৈকতের দিকে।
 |
| চলে এলাম সৈকতে |
ঝাউবন টপকে একটা রাস্তা চলে গেছে সমুদ্রের দিকে। সেখানে বিশাল এক বালুতট। বালুতটের গায়ে ঝাউগাছের সারি। প্রায় নির্জন পরিবেশ। কোলাহল নেই। সামনে সুবিশাল বেলাভূমি। অনেক দূরে চিকচিক করছে এক চিলতে সমুদ্র। একটা শূন্যতায় ছেয়ে গেলো চারপাশ। সমুদ্র আলিঙ্গন করে বলে 'হে পথিক! এসো মোর কাছে, একান্ত নিভৃতে'।
 |
| পথ এসে মিশে গেল বেলাভূমিতে |
বেলাভূমি লক্ষ্য করে এগিয়ে চললাম। সৈকত যাওয়ার রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে প্রচুর বালি। সৈকতে যা স্বাভাবিক। নরম বালির উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পথ এসে মিশে গেল বেলাভূমিতে। বেলাভূমির শুরুতেই দেখি কয়েকটি অস্থায়ী দোকান। দোকানগুলিতে ডাব ছাড়াও চা-বিস্কুট, চিপস ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলি পার হয়ে চলে এলাম বালুকাময় সমুদ্র সৈকতে।
 |
| সমুদ্রকে কাছে পেতে এগিয়ে চলা |
সমুদ্রে কোনো তোলপাড় নেই। তখন ভাঁটার সময়। ভাঁটার টানে সমুদ্র অনেকটাই পিছিয়ে। জোয়ারের সময় ঢেউগুলি বেলাভূমি ডুবিয়ে দিলেও ভাটার সময়ে দীর্ঘ বেলাভূমি পেরিয়ে সমুদ্রতটে পৌঁছতে হয়। অপরূপ শান্ত এক নির্জনতা। জায়গাটা এখনো জনপ্রিয় হয়নি তাই বেশ নিরিবিলি। নির্জন প্রকৃতিকে উপভোগ করার জন্য উত্তম পরিবেশ। তবে এই সৈকতের নির্জনতা আর কতদিন থাকবে বলা কঠিন। এখনও কংক্রিটের আস্তরণ পড়েনি এই বেলাভূমিতে। তাই এখানে লাল কাঁকড়ার দল নিশ্চিন্তে গর্ত খুঁড়ে বালি দিয়ে বাসা বানিয়ে যেন নিজেদের রাজ্য গড়ে নিয়েছে।
 |
| শান্ত এক নির্জন পরিবেশ |
এখানে আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ফটোগ্রাফি। নির্জন সৈকতের বেলাভূমি ধরে হেঁটে চলেছি। ভাঁটার টানে সমুদ্রের জল তখন বেলাভূমি ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে সরে গিয়েছে। অন্যান্য সৈকতে যেখানে লাল কাঁকড়া সেভাবে দেখা যায় না, সেখানে বগুড়ানজালপাইয়ের সৈকতে লাল কাঁকড়ার আনাগোনা চোখে পড়ার মতো। বেলাভূমি জুড়ে শুধুই কাঁকড়াদের শিল্পকর্ম। ঘুরে বেড়াচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়া। ক্যামেরা হাতে ঘুরতে লাগলাম সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করার জন্য। কিন্তু আমাদের পায়ের শব্দ পেয়ে লাল কাঁকড়াগুলো নিমেষের মধ্যে ছোট ছোট গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
 |
| দুই ফটো শিকারী |
ছবি তোলার জন্য এই কাঁকড়াদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ চললো আমাদের লুকোচুরি খেলা। মাত্র হাত দুয়েক দূরে একটা গর্ত নজরে পড়ল। সেই গর্ত থেকে বেরিয়ে এগিয়ে এল একটা কাঁকড়া, দাঁড়া দুটো শূন্যে তুলে রেখেছে অদ্ভুত দুটো অ্যান্টেনার মত। কিছুটা এগিয়ে হঠাৎ থেমে পড়ল কাঁকড়াটা। দাঁড়ার মাথার ধারাল আঁকশি জোড়া একবার খুলছে, একবার বন্ধ করছে। আমার পায়ের শব্দ পেয়ে কোনরকম বিপদ আছে কিনা আন্দাজ করতে চাইছে। অনেকক্ষণ ধরে এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে। হয়তো সে তার লুকনোর গর্তখানা খুঁজে পায়নি। মাঝে মাঝে নড়াচড়া করলেও, ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে না। ক্যামেরা হাতে প্রায় দৌড়েই এগিয়ে চললাম। এই সুযোগটা আমি ছাড়তে পারলাম না। দেরি না করে চটপট ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করে ফেললাম সেই আশ্রয়হীন জীবন্ত কাঁকড়াটাকে।
 |
| লাল কাঁকড়া |
নির্জন সৈকতের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে আছি। বেলাভূমির গায়ে ঝাউবনের রেখা। দূর থেকে ভেসে আসা ঢেউগুলো একের পর এক আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে। তবে দিঘার মতো বগুড়ান জলপাইতে মাতাল করা ঢেউ নেই। বরং সমুদ্র এখানে বেশ শান্ত। হঠাৎ দেখি কয়েকজন পর্যটক যুবক এসে বাইকে চেপে বেলাভূমিতে চক্কর খেতে লাগল। এরকম পর্যটকদের বাইকের চাকায় না জানি কত লাল কাঁকড়ার প্রাণ যাচ্ছে।
 |
| নির্জন সৈকতে |
সৈকতের গা ঘেঁসেই রয়েছে দীর্ঘ ঝাউবন এবং ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। ঝিরিঝিরি বাতাসে দোল খাচ্ছে সবুজ ঝাউবন। দূর থেকে সেই ঝাউগাছগুলো যেন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এটি দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। বালুময় সৈকত, সমুদ্র আর ঝাউ বনের ভেতরের দৃশ্যগুলো ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করতে চলে নানা ঢঙে ফটোসেশন। প্রায় ঘন্টা খানেক চলল আমাদের এই ফটোসেশন।
 |
| নির্জন বেলাভূমি |
এবার পেটে কিছু দেওয়ার পালা। সকাল থেকে খাওয়া হয়নি। গাড়ির কাছে ফিরে এলাম। সঙ্গে ছিল বাড়ি থেকে আনা লুচি আর আলু ফুলকপির তরকারি। তাই দিয়ে পেট ভরে সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে ফেললাম। ব্রেকফাস্ট সেরে সেই মায়াবী বেলাভূমিকে বিদায় জানিয়ে আবার উঠে পড়ি গাড়িতে। চললাম বাঁকিপুটের দিকে।
 |
| আমার ক্যামেরায় ফ্রেম বন্দি |
গ্রামের কাঁচা রাস্তা ছেড়ে গাড়ি গিয়ে উঠল বাঁধের উপর সি-ডাইক রোডে। ডাইনে মোড় নিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলেছে বাঁকিপুটের পথে। রাস্তার দু'পাশে দেখি নোনাজলের ভেড়ি। বাতাসে নোনা হাওয়া আর মাছের ভেড়ির সোঁদা গন্ধ নাকে আসছে। জুনপুট পেরিয়ে হরিপুরে এসে দেখি রাস্তার একপাশে মাটির বাঁধ তার ওপারে সমুদ্র। বাঁধটা সমুদ্র থেকে খানিক উঁচুতে। হরিপুর পর্যন্ত পুরোটাই প্রাকৃতিক উপকূল। এবারে আর সেটা নেই। বাঘাপুট ছাড়িয়ে বাঁদিকে পড়ল ভোগপুর মৎস্য খটি। আরও কিছুটা এগিয়ে গেলাম। সামনে একটা বাঁক ঘুরতেই দেখি ডানদিকে বাঁধের গা ঘেঁষে অল্প কিছু দোকান। একটা দোকানের কাছে এসে গাড়িটা থামালাম।
 |
| বাঁকিপুটে এসে গাড়ি থামালাম |
বাঁকিপুট
বুঝতে পারছিলাম বাঁকিপুটে এসে পড়েছি। কিন্তু সমুদ্রের ধারে যাওয়ার রাস্তা দেখতে পাচ্ছি না। জায়গাটা খুব নির্জন। দোকানপাট, বাড়ি ঘর তো দূরের কথা আশেপাশে কোন মানুষ পর্যন্ত চোখে পড়ছে না। একটু একটু করে এগোতে থাকলাম। কিছুদূর এভাবে যেতেই সমুদ্রের দিকে একটা রাস্তা দেখতে পেলাম। রাস্তাটা খুব বড় নয়, তবে আমাদের গাড়ি ঢুকে যাবে। ডান পাশে বাঁক নিয়ে ঢুকে পড়লাম ইটের রাস্তায়। মনে হলো লোকজন হয়তো ঐ রাস্তায় সমুদ্র সৈকত থেকে লোকালয়ে যাতায়ত করে। কিন্তু হায়, সমুদ্র কোথায়? এ তো এসে গেছি ছোট্ট একটা গ্রামের মধ্যে।
 |
| ঢুকে পড়লাম গ্রামের মধ্যে ইটের রাস্তায় |
গ্রামটা খুব বড় নয়, অল্প কয়েকঘর লোকের বাস। শুকনো মাছের ঝাঁঝালো গন্ধ চারপাশে। মনে হল জেলেপাড়া। গাড়ি থেকে নেমে এলাম। এক বিশাল ফাঁকা মাঠ যাতে গরু চরছে। দূরে সমুদ্র চোখে পড়ছে এখান থেকেই। যদিও রাস্তা নেই সেদিকে যাওয়ার। কেমন এক মায়ামগ্ন নেশাধরা নির্জনতা। সেই নির্জনতার মধ্যে চোখে পড়ে এক ভাঙা নৌকো। উপুড় হয়ে পড়ে আছে সারার অপেক্ষায়। চোখ তখন ক্যামেরার ভেতর দিয়ে সেই নৌকার দৃশ্য লেন্স বন্দী করতে ব্যাস্ত। এমন সময়, আমাদের দেখে এগিয়ে এল একজন মাঝবয়সি রোগা পাতলা লোক। পরনে ছোটো ধুতি, হাঁটুর উপরে পেঁচিয়ে পরা। গায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। তার কাছ থেকে সমুদ্রের দিকে যাওয়ার একটা শর্টকাট রাস্তা জেনে নিলাম।
 |
| নির্জনতার মধ্যে একাকী |
গ্রামের ভেতর থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে আবার ফিরে এলাম আগের রাস্তায়। একটু একটু করে এগিয়ে চলেছি। কিছুটা যেতেই সামনে দেখি একটা কাঁচা রাস্তা ঢুকে গেছে সমুদ্রের দিকে। মনে হল গাড়ী যাওয়ার রাস্তা। সামনে উঁচু মাটির বাঁধ তার ওপারে বিশাল বটগাছ। ঢুকে পড়লাম সেই কাঁচা রাস্তায়। একেবারে বাঁধের ওপর গাড়িটা দাঁড় করিয়ে চলে এলাম বটগাছের কাছে। এক অজানা নির্জন সমুদ্র সৈকত। আর সে সমুদ্রের কী মনোহর রূপ! অদ্ভুত এক নীরবতা চারিদিকে। নির্জন এই এলাকায় নেই কোনো পর্যটকের হৈ চৈ। রয়েছে শুধু সমুদ্রের শান্ত ঢেউ আর মাছ ধরার নৌকার আনাগোনা। দুরে বাঁধের নীচে কিছু ঘর দেখা যাচ্ছে। হাওয়ায় মাথা নাড়াচ্ছে গাছের সবুজ পাতা। সমুদ্রের গায়ে নুয়ে পড়েছে সেই গাছের ডালপালা।
 |
| বিস্তীর্ণ বালুচর |
বগুড়ান জলপাই-এর মতো এখানে ভাঁটার সময় সমুদ্রর জল বেশি দূরে সরে যায় না। তবে এখানকার সমুদ্রের পাড় কংক্রিট আর বড় বড় পাথরের খণ্ড দিয়ে বাঁধানো। সেই পাড় বেয়ে নেমে গেছে কংক্রিটের সিঁড়ি। দূরে বেলাভূমির গায়ে ঝাউগাছের সারি। দেখে মন ভরে গেল। ছবির মতো সুন্দর দৃশ্যপট। সমুদ্রের বিশাল ঢেউকে ব্যাকগ্রাউন্ড করে সেইসব দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করলাম। ছবির মতো সাজানো হলেও সমুদ্র সৈকত অস্বাস্থ্যকর ও অপরিচ্ছন্ন। সৈকতের আশপাশের অনেক জায়গা নোংরা আবর্জনায় ভরা। নীচে কয়েক পা দূরে সমুদ্রের শান্ত ঢেউ এসে পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ছে। সমুদ্রের জলে পা ভেজাতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম। কিন্তু সেই পাথুরে পাড়ে জলে নামার সাহস হল না আর।
 |
| পাথর দিয়ে বাঁধানো সমুদ্র সৈকত |
ঘড়িতে দেখি দেড়টা পার হয়ে গেছে। খিদেটাও বেশ পাচ্ছে মনে হচ্ছে। এ সময় লাঞ্চটা সেরে ফেললে মন্দ হতো না। বাঁধের ওপর বটগাছের ছায়ায় সতরঞ্জি বিছিয়ে বসে পড়লাম। দুপুরের লাঞ্চটা সেরে ফেললাম সেখানেই। বাড়ি থেকে ক্যাসারােলে করে খাবার নিয়ে এসেছিলাম। স্পেশাল মেন্যু হিসেবে ছিল সৌমেনের হাতে রান্না করা কষা মুরগির মাংস। যেন একটা পিকনিকের পরিবেশ। খেয়ে দেয়ে যখন উঠি তখন বেলা গড়িয়ে প্রায় তিনটে। দেরি না করে চললাম দরিয়াপুরের দিকে। মন না চাইলেও এগোতে হল।
 |
| বাঁধের ধারে জেলেদের ঘর |
বাঁকিপুট ছেড়ে দরিয়াপুরে চলে এসেছি। এই দরিয়াপুরে রয়েছে সেই ঐতিহাসিক কপালকুণ্ডলা মন্দির। কপালকুন্ডলা আর নবকুমারের নামটা মনে পড়তেই গা-টা কেমন ছমছম করে উঠল। চোখের সামনে ভেসে ওঠে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা 'কপালকুণ্ডলা' উপন্যাসের সেই দৃশ্য। সমুদ্রের তীরে ঘন জঙ্গল দিয়ে ঘেরা এক মন্দির আর সেই মন্দিরে খড়্গ হাতে এক কাপালিকের নরবলির ভয়ঙ্কর সব দৃশ্য। আজ এখানে আর সেই ঘন জঙ্গলও নেই। নেই কাপালিক। কেবল ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে পড়ে রয়েছে ছোট্ট কপালকুণ্ডলা মন্দির যাকে ঘিরে রয়েছে পর্যটকদের অনেক আগ্রহ। রাস্তার ধারেই ছোট্ট একটি মন্দির। সেই মন্দিরের ওপরে নাম লেখা কপালকুণ্ডলা মন্দির। এখানেই দেখা পেয়ে গেলাম কপালকুণ্ডলার। তবে ওটা আদি কপালকুণ্ডলা মন্দির নয়, মন্দির গ্রামের ভেতরে। নাম দেখে প্রথমে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়েছিলাম।
 |
| নতুন কপালকুণ্ডলা মন্দির |
গ্রামের লোকেদের কাছে জানতে পারি আদি কপালকুণ্ডলা মন্দিরে মূর্তি না থাকায় এলাকার মানুষ পুজোর জন্য এই নতুন মন্দিরটি তৈরি করেছেন। ইচ্ছে থাকলেও বাড়ি ফেরার তাগিদে সেই ঐতিহাসিক কপালকুণ্ডলা মন্দিরে যাওয়া হয় নি। নতুন কপালকুণ্ডলা মন্দিরের কাছেই তৈরি হয়েছে বঙ্কিম বঙ্কিম স্মৃতিভবন। একটি আবক্ষ মূর্তিও রয়েছে সেখানে। এই কপালকুণ্ডলা মন্দির থেকে সামান্য দূরে রয়েছে একটি শিব মন্দির।
 |
| বঙ্কিম স্মৃতিভবন ও সদাশিব মন্দির |
কপালকুন্ডলা মন্দির থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল ব্রিটিশ আমলের পরিত্যক্ত একটি লাইট হাউস। দেখি লাইট হাউসের গেটে তালা। গাড়ি থেকে নেমে দু-চারটে ফটো তুলে গেটের কাছে গেলাম। প্রতিদিন বিকেল ৩ টে থেকে ৫ টা পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য খোলা থাকে, তবে কোভিডের কারণে এখন বন্ধ রয়েছে।
 |
| দরিয়াপুর লাইটহাউস |
লাইটহাউস ছাড়িয়ে চলে এলাম পেটুয়াঘাটে। এ জায়গাটা এখন দেশপ্রাণ ফিশিং হারবার নামেই পরিচিত। সংরক্ষিত এলাকা। কুড়ি টাকা টোল দিয়ে গেটের ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি পেলাম। গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেলাম একদম জেটি ঘাটে। ওপারে হিজলী শরীফ। লঞ্চে রসুলপুর নদী পেরিয়ে যাওয়া যায়। এই পেটুয়া মৎস্য বন্দরটি মোহনার সামান্য আগে। এখানে রসুলপুর নদী হুগলী নদীতে মিশেছে। আবার সেই হুগলী নদী কিছু পরে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে।
 |
| পেটুয়া মৎস্যবন্দর |
মোহনার কাছাকাছি তাই নদী এখানে বেশ চওড়া। এপার ওপার দেখা যায় না। প্রায় সমুদ্রের মত মনে হল। পেটুয়া মৎস্যবন্দরে অবিরাম কর্মব্যস্ততা। ট্রলারের নিত্য আনাগোনা। জেটি ঘাটে সারি সারি ট্রলার দাঁড়িয়ে। ট্রলার গুলো মাছ ধরার অপেক্ষায় আছে। আমরা এগিয়ে যাই সেদিকে। বাহারী রকমের নৌকা, মা ভবতারিণী, মা গঙ্গা, মা সন্তোষী, মা বিপত্তারিণী আরো কত নাম। মাস্তুলে প্রচুর দড়িদড়া নিয়ে দেশের পতাকা শোভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসে পতপত করে উড়ছে সেই পতাকা। সে এক অদ্ভূত মায়াময় দৃশ্য সৃষ্টি করেছে।
 |
| ট্রলারের সারি |
গভীর সমুদ্র থেকে সারি সারি মাছ ধরা ট্রলার ঘাটে ভিড়েছে। ওইসব ট্রলার থেকে বিভিন্ন প্রকার মাছ নামানো হচ্ছে। এরকমই একটা ট্রলার থেকে বিশাল আকারের দুটো মাছ নামানোর পরেই তা দেখবার জন্য আমাদের আগ্রহ বেড়ে গেল। ছুটে গেলাম মাছ দুটোর কাছে। মাছ তো নয়, যেন মনে হল 'জলদৈত্য'। সচরাচর এরকম মাছ দেখা যায় না।
 |
| বিশালাকৃতির গিটার ফিশ |
মাছটি চিলশঙ্কর বলেই অনুমান করলাম। দেখতে কিছুটা শঙ্কর মাছের মতো। এক মৎসজীবীকে জিজ্ঞেস করলাম এটা কি মাছ? তার উত্তর, এই মাছের নাম জানা নেই। তবে আমরা এটাকে 'ফাল' মাছ বলে থাকি। গুগল সার্চ করে দেখি এটির নাম গিটার ফিশ। গিটারের মত দেখতে, তাই নাম গিটার ফিশ। বাংলাদেশের জেলেরা এটিকে বলেন তিতাম্বুরী মাছ। সাধারণত গভীর সমুদ্রে পাওয়া যায় এগুলি।
 |
| স্থানীয়ভাবে পরিচিত 'চিলশঙ্কর ফাল' মাছ |
রঙিন বিকেলে সূর্যের বাড়ি ফেরা। আকাশের মেঘও রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। তখনও জেলেদের কেউ রাস্তার ধারে জাল শুকোচ্ছে, কেউ কেউ আবার জাল বুনে চলেছে। তাদের সেই নিপুণ হাতে জাল বোনার কাজ কিছুক্ষণ দেখে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম।
 |
| জেলেরা জাল বুনে চলেছ |
» থাকার ব্যবস্থাবগুড়ান জলপাইতে থাকার জন্য আছে 'সাগর নিরালায়' গেস্ট হাউস। এখানে এই একটাই জায়গা ছাড়া থাকার অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। বাঁকিপুটেও থাকার জন্য কেবল রয়েছে 'ঝিনুক রেসিডেন্সি'।
●
বগুড়ান জলপাইসাগর নিরালায়ঃ- +৯১৯৪৩৪০১২২০০, +৯১৮৬৭০৫৪৭৪১১
●
বাঁকিপুটঝিনুক রেসিডেন্সিঃ- +৯১০৯৯৩২৬ ৭৭২৫৮, +৯১৯৪৩৩৮১৩৬৭৮
» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল
BAGURAN JALPAI, BANKIPUT, DARIAPUR, PETUAGHAT FISHING HARBOUR, PURBA MEDINIPUR, WEST BENGAL
No comments:
Post a Comment