Theme Layout

Boxed or Wide or Framed

Theme Translation

Display Featured Slider

Yes

Featured Slider Styles

[Centred][caption]

Display Grid Slider

No

Grid Slider Styles

[style5][caption]

Display Trending Posts

Display Author Bio

Yes

Display Instagram Footer

Yes

Dark or Light Style

পাহাড়চূড়ায় সাজানো শহর 'গ্যাংটক'


র্যটকদের স্বর্গরাজ্য সিকিম। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম মাত্র চারটি অঞ্চল নিয়ে ছোট্ট এক রাজ্য। চারপাশে হিমালয় পর্বত। হিমালয়ের মাঝখানে মনোরম পরিবেশে সিকিমের অবস্থান। চারপাশের পাহাড়-পর্বতের দৃশ্য বেশ উপভোগ্য। মনোরম দৃশ্যের জন্য ভ্রমণপিপাসুদের মধ্যে সিকিম আজ খুবই জনপ্রিয়। বাংলার প্রতিবেশী রাজ্যগুলির মধ্যে সিকিম এখন বাঙালির কাছে প্রিয় গন্তব্যস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সিকিম ছোট রাজ্য হলেও দর্শনীয় জায়গার সংখ্যা এতই বেশি যে, এক যাত্রায় সব কিছু দেখা সম্ভবপর হয়ে উঠে না। আর একটা কথা, সমগ্র সিকিম ট্যুর করতে হলে সবচেয়ে সহজ উপায় হলো গ্যাংটকে থেকে সেখান থেকে সর্বত্র ঘোরা। প্রথমবারের জন্য সিকিম ঘুরতে হলে তো কথাই নেই, গ্যাংটকে থাকাটাই ভালো। আমার ভ্রমণ তালিকায় গ্যাংটক থাকলেও সিকিম ট্যুর কিন্তু শুরু পেলিং দিয়েই, কারণ দার্জিলিং থেকে রওনা দিয়ে পেলিং গিয়েছিলাম। গ্যাংটক শহরটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এক কথায় অবর্ণনীয়। ঝকঝকে চকচকে ছবির মত সুন্দর সাজানো পরিপাটি একটি আধুনিক শৈল শহর এবং শপিং প্রেমীদের জন্য এটি আদর্শ।

প্রথমবার সিকিম ঘুরতে আসা তাই প্রথমে রাজধানী শহর গ্যাংটক এর দর্শনীয় স্থানগুলো ভালো করে ঘুরে দেখে নিতে চাই। দার্জিলিং থেকে এসে আমরা পেলিংয়ে রাত কাটিয়েছি। গ্যাংটক যাওয়ার জন্য স্নানটান সেরে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম। গাড়ি আসার অপেক্ষায় আছি, এই ফাঁকে ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম হোটেলের রেস্টুরেন্টে। রিসেপসনে ফাইনাল বিল মেটাতে গিয়ে দেখলাম গাড়ি এসে গেছে। লাগেজপত্র সব গাড়িতে তোলা হলো। একটু পরই গাড়ি চলল গ্যাংটকের দিকে।

গাড়ির জন্য অপেক্ষা
পেলিংয়ে ঠান্ডা লাগার কারণে মেয়ের জ্বর এখনও কমেনি। ড্রাইভারকে বললাম প্রথমে একটা ওষুধের দোকানে নিয়ে যেতে। কিছুক্ষণ পর গেজিং মার্কেটের কাছে একটা জায়গায় ড্রাইভার গাড়ি থামালো। পশ্চিম সিকিমের ছোট্ট জেলা শহর গেজিং (Geyzing বা Gyalshing)। বাজারের একটু উপরে হসপিটাল, পরিচ্ছন্ন সাজানো গোছানো ছিমছাম পরিবেশ, ভিড় বেশী নেই। গাড়ি থেকে নেমে সামনের একটা দোকান থেকে কিছু ওষুধ কিনে আবার এগিয়ে চললাম।

গেজিং পেরিয়ে রাভাংলার দিকে যাচ্ছি
পাহাড়ের গায়ে দেবদারু, ঝাউ, পাইন, বনের জঙ্গলের মাঝে দেখা যাচ্ছে ঘুমন্ত গ্রামের ছোট ছোট ঘরবাড়ি। মাঝে মাঝে ছোট বড়ো ঝর্ণা থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে জলের ধারা বেয়ে আসছে। একের পর এক নাম না জানা পাহাড়ি নদী বেয়ে চলেছে, আমরা তার সেতুর উপর দিয়ে যাচ্ছি। এভাবে চলার পর আমরা বেলা বারোটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম রাভাংলায়। পথের ধারে একটা বাঙালি রেস্টুরেন্ট দেখে ড্রাইভার গাড়িটা থামালো। চা, গরম গরম মোমো খাওয়ার পর আমরা আবার রওনা দিলাম।

রাভাংলায় বাঙালি হোটেল 'ব্যাবিলা'
পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে গাড়ি ক্রমশ এগিয়ে চলেছে। রাস্তা ক্রমশ চড়াই হতে হতে পর্বতের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ধাবিত। নীচে গভীর খাদ। তারই মধ্যে চোখে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি, ধাপ কেটে চাষ, মাঝে মাঝে জঙ্গল, বাঁশঝাড় আর অজস্র ফুলের মেলা। কত রকমের রং সে সব ফুলের। হলুদ, বেগুনি, গোলাপি, ম্যাজেন্টা, পার্পল, আকাশি নীল। আবার কোনও কোনও ফুলে দু'তিনটে রঙের বাহার। পৌনে দু'টো নাগাদ গাড়ি এসে থামলো টেমি তারকুর রাস্তার ধারে খোলা জায়গায় চাসুম রেস্টুরেন্টের সামনে। ড্রাইভার বললো এটা ভালো রেস্টুরেন্ট এখানে খেয়ে নিন। ভারি সুন্দর জায়গায় এই রেস্টুরেন্টটা। রেস্টুরেন্টের চারপাশে সুন্দর চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক দৃশ্য। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার পথ চলা শুরু হল।

টেমি তারকুর কাছে 'চাসুম রেস্টুরেন্ট'
টেমি তারাকু ছাড়িয়ে গাড়ি দুর্বার বেগে এগিয়ে চলেছে। দূরে পাহাড়ি গ্রাম। রাস্তা আস্তে আস্তে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে, এক একটা পাহড়ি বাঁকে গাড়ি মোড় নেওয়ার সময় বুকটা কেঁপে উঠছে সাথে পাহাড় ধ্বস এর কথা খালি মনে হচ্ছে। আর আধঘন্টা চলার পর পাহাড়ী ঢালে উঁচু নিচু ধাপে ধাপে সাজানো ঘরবাড়ি দেখে বুঝতে পারলাম সিংতাম এসে গেছি। তিস্তা নদীর ওপর একটা ব্রীজের মনোরম শোভা দেখে ড্রাইভারকে অনুরোধ করে গাড়ি থামালাম। চললো কিছুক্ষণ ফটোসেশন। খানিকটা পথ তিস্তাকে সঙ্গী করে সিংতামে এলাম।

সিংতামের কাছে তিস্তা নদীর ব্রীজ
ছোট্ট শহর সিংতাম। ডানদিকে শিলিগুড়িতে যাওয়ার রাস্তা ছেড়ে দিয়ে, বাঁহাতের চড়াই রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। এই সিংতাম থেকে তিস্তা নদী ভাগ হয়ে গেছে। গ্যাংটকের দিকে নদীটার নাম রানীখোলা বা ছোট রঙ্গীত। এই রানীখোলা নদীর পাড় ধরেই আমাদের গ্যাংটকে যাওয়ার রাস্তা। সিংতাম থেকে যাত্রা শুরুর করার কিছুক্ষণ পর থেকেই শুরু হলো উত্তর সিকিম এর অসাধারণ পথের শোভা।

সিংতাম ওল্ড ব্রীজ
সিংতাম পেরিয়ে পাহাড়ি পাকদণ্ডি পথ ধরে বিকাল চারটে নাগাদ আমরা গ্যাংটকে পৌঁছলাম। ড্রাইভার আমাদের সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডে মালপত্র সহ নামিয়ে বললো এই সময়ে হোটেলের দিকে নো-এন্ট্রি আছে, এখান থেকে অন্য গাড়িতে যেতে হবে। অগত্যা কি আর করা যায় দুটো আল্টো গাড়ি ভাড়া করে আবার মালপত্র বোঝাই করে হোটেলে পৌঁছালাম। যেহেতু আমাদের ভ্রমণ সূচিতে দার্জিলিং ও গ্যাংটক দুটোই ছিল তাই কোলকাতা থেকেই হোটেলের রুম বুকিং করা ছিল। 'হোটেল মাউন্টেইন রিট্রিট' আমাদের থাকার ঠিকানা। হোটেলের স্টাফরা এসে আমাদের লাগেজপত্র গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে গেল হোটেলের লবিতে।

আমাদের ঠিকানা 'হোটেল মাউন্টেইন রিট্রিট'
হোটেল রিসেপশনে বুকিংয়ের কাগজপত্র দেখিয়ে চাবি নিয়ে সোজা চলে গেলাম দোতালার রুমে। স্টাফরাই আমাদের ব্যাগগুলো বয়ে নিয়ে গেল রুমে। হোটেলের মালিক ও ম্যানেজার দু’জনেই বাঙালি, তাই বেশ একটা স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করছি। ঝটপট ব্যাগপত্র রেখে ঘরে তালা মেরে ডাইনিং হলে চলে এলাম। খিদেয় পেট জ্বলছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে ৩টে বাজে। আমাদের টাউনশিপ ক্যাম্পাসের স্টেটব্যাঙ্কের ম্যানেজার তীর্থদার বন্ধু সেই সময় গ্যাংটকের স্টেট ব্যাঙ্কে কর্মরত ছিলেন। খাওয়াপর্ব মিটে যাওয়ার পর প্রথমে তাঁকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম যে আমরা গ্যাংটকের হোটেলে পৌঁছে গেছি। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই দেখি তিনি সন্তোষ রাই নামে স্থানীয় এক ব্যক্তিকে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। সন্তোষবাবুকে আমাদের আগামী দুদিনের ট্যুর প্রোগ্রাম সম্পর্কে বললাম। সে অনুযায়ী ছাঙ্গু ও লোকাল ট্যুরের জন্য উনি গাড়ীর ঠিক করে দিলেন। ছাঙ্গুতে যেতে হলে অনুমতিপত্র প্রয়োজন। তাই সঙ্গে নিয়ে আসা দু’কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি ও আধারের ফটোকপি সন্তোষবাবুকে দিয়ে দিলাম। উনি সব ব্যবস্থা করে দিলেন। এব্যাপারে আমাদের আর কিছুই ভাবতে হয়নি।

চলেছি এম জি মার্গে
পেলিং থেকে যাত্রা শুরুর সঙ্গেই আমাদের পিছু নিয়েছিল বৃষ্টি। সারা রাস্তাই মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি পেলাম। গ্যাংটকে পৌঁছিয়েও বৃষ্টি যেন আমাদের পিছু ছাড়ছে না কিছুতেই, তখনও টিপ টিপ করে পড়ছে। প্রোগ্রাম সব কাল, আজ কোনো প্রোগ্রাম নেই। মনটা দমে গেল। বিকেলের দিকে বৃষ্টি একটু কমতেই ছাতা মাথায় চলে এলাম এমজি মার্গে। গ্যাংটকের ম্যাল। তিনটি রাস্তা এসে এখানে মিলিত হয়েছে। একটি হলো নামনাং রোড, দ্বিতীয়টি কাজী রোড ও তৃতীয়টি টিবেট রোড। তবে এখানে গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। গ্যাংটকের অন্যতম আকর্ষণ হলো এই এম জি বা মহাত্মা গান্ধী মার্গ।

চলে এলাম এম জি মার্গে
হোটেল থেকে পায়ে হেঁটে মিনিট পাঁচেক লাগলো। বৃষ্টির মধ্যেই রাস্তায় মানুষের ঢল। অধিকাংশই বাঙালি ট্যুরিস্ট। আমরাও সেই দলে মিশে গেলাম। সত্যি, কী চমৎকার জায়গা! পাথরে বাঁধানো রাস্তাঘাট তার মাঝে ম্যাপল গাছ দিয়ে সাজানো বসার জায়গা, সুদৃশ্য ল্যাম্পপোস্টের আলো আর দু'পাশে সুসজ্জিত দোকানপাট সবমিলিয়ে একটা অন্যরকম স্বর্গীয় পরিবেশ। দেখলে মনে হবে ইউরোপের কোনো শহর। কী চমৎকার! কী অপূর্ব! কী দারুণ ফ্যানস্টাস্টিক! এখানে পায়ে হেঁটে ঘোরার মজাই আলাদা।
ভালো আশ মিটিয়ে শপিং করতে হলে এখানের লাল বাজারে যেতে হবে, প্রচুর দোকান, নানারকম জিনিস পাওয়া যায়। সুতরাং শপিং করতে যারা ভালোবাসেন অথচ গ্যাংটকে যান নি তারা অবশ্যই একবার গ্যাংটক ঘুরে আসতে পারেন।
এম.জি. মার্গের একপাশে মহাত্মা গান্ধীর একটা মূর্তি রয়েছে। স্থানীয় মানুষ ও পর্যটকদের ভিড়ে এম জি মার্গ তখন গমগম করছে। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি সাজানো প্রচুর দোকান। দোকানগুলোর ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ের দিক থেকে হু হু করে বয়ে আসছে ঠান্ডা হাওয়া। মাঝে মাঝে ভিড় করে আসছে মেঘকুয়াশার দল। এ-দোকান ও-দোকান ঘুরছি। অল্পবিস্তর কেনাকাটি হয়েছে। শুরু হল বৃষ্টি। বৃষ্টি যে জোরে পড়ছে তা না, কিন্তু চারদিক ভিজে থৈথৈ। বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট, বসার জায়গা সব ভিজে গিয়েছে।

এম জি মার্গ (মহাত্মা গাঁধী মার্গ)
ক্রমশ দিনের আলো কমে আসে। চারদিকে নেমে এলো অন্ধকার। এম.জি. মার্গ তখন আলোয় ঝলমল করছে। পুরো মেঘ কুয়াশায় ডুবে গেছে গ্যাংটকের ম্যাল।  টুপটাপ বৃষ্টিকে সাথে নিয়ে চললো ফোটোসেশন। সন্ধ্যে তখন ৭টা। দোকানপাট রেস্টুরেন্ট আস্তে আস্তে বন্ধ হচ্ছে। লোকজনও কম হতে থাকলো। এখানে রাত ৮টার মধ্যেই সব বন্ধ হয়ে যায়। ভাবলাম একেবারে ডিনার সেরে হোটেলে ফিরবো। সেটা সম্ভব হলো না। কারণ ওখানে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার আগে অর্ডার করলে খাবার পাওয়া যাবে। এই সময় তো আমরা টিফিন করি, রাতের আহার! পারবো না। তাই আমরাও হোটেলের দিকে এগোতে থাকলাম। ঘোরাঘুরি সেদিনের মতো শেষ। রাত নটা নাগাদ হোটেলে ফিরে আসি। চটপট ফ্রেশ হয়ে হোটেলের নিচতলায় ডাইনিং হলে চলে এলাম। গরম ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাত, ডাল, তরকারি একেবারে ষোল আনা বাঙালি খাবার। প্রাণ ভরে খেলাম। বাঙালির আর যাই হোক না কেন! ভাত খাওয়া চাই চাই। অসাধারণ রান্না। এরপর আর বাইরে কোথাও খাবারের কথা ভাবিনি। খাওয়া শেষ করে আমরা রুমে চলে গেলাম।

রাতের এম জি মার্গ
পরদিন সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠে জন্য ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম। আটটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট সেরে হোটেলের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এসে দেখি সবাই হাজির। কিছুক্ষণের মধ্যে হোটেলের সামনে সন্তোষ বাবুর পাঠানো দুটো আল্টো গাড়ি এসে দাঁড়াল। সবাই উঠে পড়ল গাড়িতে। একসাথে দুটো গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সাইটসিয়িং ট্যুরের জন্য। গ্যাংটক শহরের মধ্যে দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। এইসব জায়গায় দেখেছি ড্রাইভাররাই গাইডের কাজটা করে দেয়। আমাদের ক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যাতিক্রম হলো না। গ্যাংটক শহর ও তার আশপাশে দেখার মতো অসংখ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে। শুধুমাত্র গ্যাংটকেই এতকিছু দেখার আছে যে একদিনে ঘুরে দেখা সম্ভব নয়, ভাল ভাবে সাইটসিয়িং ট্যুর করতে গেলে হাতে অন্ততপক্ষে দু'টি দিন রাখতেই হবে। অল্প সময় হাতে নিয়ে যাওয়া, তাই চেষ্টা করলাম একদিনে যতটা ঘুরে ফেলা যায়। কয়েকদিন নাগাড়ে বৃষ্টি হলেও আজ বৃষ্টির দেখা নেই; সকাল থেকে পরিষ্কার ঝলমলে আকাশ। ঠান্ডাটাও এক্কেবারে নেই, হাল্কা গরম লাগছিলো।

বাটার ফ্লাই ওভার ব্রিজ
আমাদের প্রথম গন্তব্য দো দ্রুল চোর্তেন। কিছুক্ষনের মধ্যে আমাদের গাড়ি এসে থামালো বিশাল প্রাচীর দিয়ে ঘেরা সোনালি চূড়ার শ্বেতশুভ্র এক বৌদ্ধ স্তূপের কাছে। এটা গ্যাংটকের বিখ্যাত বৌদ্ধ স্তূপ দো দ্রুল চোর্তেন। চোর্তেনের কাছে পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা হাঁটতে হয়। বড় বড় গাছের শীতল ছায়া পথ ধরে চোর্তেনের কাছে পৌঁছালাম। তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের নিংমা সম্প্রদায়ের একজন বিখ্যাত লামা ত্রুলশিক রিনপোচে (Trulshik Rinpoche) ১৯৪৬ সালে এই স্তূপটি তৈরি করেছিলেন।

চোর্তেনের রাস্তায়
স্থানীয়রা বিশ্বাস করত যে পুরো এলাকাটি একসময় ভূতুড়ে ছিল। তখন এই জায়গাটা অশুভ আত্মাদের দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল এবং কেউ যদি সেখানে যেত, তাহলে তারা তাদের শিকার হয়ে মারা যেত। পরবর্তীতে, ত্রুলশিক রিনপোচে এখানের বৌদ্ধমঠে এসেছিলেন এবং তিনি আত্মাদের তাড়ানোর জন্য এই স্তূপটা নির্মাণ করেছিলেন। চোর্তেনের কেন্দ্রস্থলে একটা সাদা গম্বুজাকৃতির স্তূপ রয়েছে যার উপরে একটি সোনালী চূড়া আছে যা গ্যাংটকের বিভিন্ন জায়গা থেকে দেখা যায়। এর উপরে অবস্থিত দেবতা দর্জে ফুর্বা (Dorje Phurba) বা বজ্রকিলয় (Vajrakilaya) নামে পরিচিত। তাই এই চোর্তেনটা ফুর্বা চোর্তেন নামেও পরিচিত। চোর্তেনকে ঘিরে রয়েছে চোর্তেন লাখাং (বৌদ্ধ মন্দির), যেখানে গুরু রিনপোচে (গুরু পদ্মসম্ভব) এর দুটি বিশাল মূর্তি রয়েছে।

দো দ্রুল চোর্তেন
ডুড-জোম রিনপোচের ইচ্ছানুসারে নির্মিত এই স্তূপের চারপাশে ১০৮টা মণি-লাকোর (Mani-lhakor) বা প্রেয়ার হুইল রয়েছে। যার প্রতিটিতে তিব্বতি ভাষায় মহামন্ত্র লেখা রয়েছে 'ওঁ মণিপদ্মে হুং,' যা করুণার দেবতা চেনরেজিগের মন্ত্র। এটা একটা বিখ্যাত মন্ত্র যা তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। ঘড়ির কাঁটার দিকে প্রার্থনার চাকা ঘোরানো খুবই শুভ বলে বিশ্বাস করা হয়, তাই পর্যটক ও ভক্তরা মন্ত্র উচ্চারণ করার সময় সেই চাকাগুলোকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জপ করছেন যাতে পড়ার সুবিধা হয়। চোর্তেনের ভেতরে অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র রয়েছে, যার মধ্যে বৌদ্ধ শাস্ত্র ‘কাঞ্জুর’ (Kan-gyur) অবশেষ, সম্পূর্ণ মন্ত্র (Zung) সহ বিভিন্ন ধর্মীয় নিদর্শন এবং বৌদ্ধ দেবতাদের কিছু মূর্তি রয়েছে। মূল স্তূপের চারপাশে আরও কয়েকটি ছোট স্তূপ রয়েছে। এর মধ্যে ঝাং চুপ চোর্তেন (Jhang Chup Chorten) ১৯৬২ সালে ত্রুলশিক রিনপোচের মৃত্যুর পরে তাঁর স্মরণে নির্মিত হয়েছিল। ত্রুলশিক রিনপোচের মৃত্যুর পর আরেক বিখ্যাত লামা দোদ্রুবচেন রিনপোচে এখানে এসে একই কমপ্লেক্সে একটা ধর্ম প্রচার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এই নতুন ভবনটি ৭০০ জনেরও বেশি ভিক্ষুকের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা এই পবিত্র স্তূপে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন।

চোর্তেন থেকে বেরিয়ে এলাম। কিছুটা হেঁটেই নামগ্যাল ইনস্টিটিউট অফ টিবেটোলাজি। চোর্তেন যাওয়ার সময় এর পাশ দিয়েই যেতে হয়। আমরা যখন সেখানে পৌঁছায় তখন বন্ধ ছিল, তাই এবারে আর দেখা হয়ে উঠল না। এবারে চললাম গ্যাংটকের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ রুমটেক মনাস্ট্রিতে।

নামগ্যাল ইনস্টিটিউট অফ টিবেটোলাজি
গ্যাংটক শহর ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে রুমটেক মনাস্ট্রি। রুমটেকে যাওয়ার পথে দূর থেকে নজরে পড়লো রোপওয়ে। পাহাড়ি বুনো ফুল, গাছগাছালি দেখতে দেখতে চলছি। প্রায় ঘণ্টা খানেক চলার পরে আমাদের গাড়ি এসে দাঁড়ালো ছোট্ট একটা চায়ের দোকানের কাছে। সেই দোকানের পাশে একটা খুব সুন্দর ভিউ পয়েন্ট বানানো আছে। জিজ্ঞেস করলাম এই জায়গাটার নাম কি? বললো এটা 'শান্তি ভিউ পয়েন্ট'। এখান থেকে গ্যাংটক শহরের সুন্দর প্যানোরামিক ভিউ পাওয়া যায়। চারিদিক মনোরম দৃশ্য...সত্যি যেন এক শান্তির জায়গা। সবুজের মাঝে নৈসর্গিক শোভায় দু'চোখ যেন শান্তি খুঁজে পেল এক অপরূপ শান্তির ঠিকানা।

শান্তি ভিউ পয়েন্ট
গাড়ি আবার এগিয়ে চলল। অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের রুমটেকের মেন গেটের সামনে নামিয়ে দিল। গাড়ি থেকে নেমে গেটে পরিচয়পত্র দেখিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। গ্যাংটকের দিকে মুখ করে একটা পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই রুমটেক মনাস্ট্রি। তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীনতম সম্প্রদায়গুলির মধ্যে একটি ব্ল্যাক হ্যাট। তাদের সদর দফতর এই রুমটেক মনাস্ট্রি। এটা সিকিমের বৃহত্তম বৌদ্ধ মঠ এবং গ্যাংটকের সেরা দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম। রুমটেক মনাস্ট্রির দুটো ভবন রয়েছে। পুরনোটা ১৭৩৪ সালে নবম কারমাপা ওয়াংচুক দোরজে (Wangchuk Dorje) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৭৪০ সালে এটা তৈরি করেছিল সিকিমের চতুর্থ চোগিয়াল গ্যুরমেদ নামগিয়াল (Gyurmed Namgyal)। তারপর ভূমিকম্পে মঠটি প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। ষোড়শ কারমাপা রংজং রিগপে দরজে (Rangjung Rigpe Dorje) খুঁজে পান রুমটেক মনাস্ট্রির ধ্বংসস্তূপ। তিব্বতে থেকে গ্যাংটক আসার পর তিনি পুনরায় এই মঠ পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। সিকিম রাজপরিবার এবং স্থানীয় লোকদের সহায়তায় প্রায় চার বছর ধরে চলে মঠের কাজ। অবশেষে ১৯৬৬ সালে লোসার (তিব্বতিদের নববর্ষ) অনুষ্ঠানে পুনরায় খোলা হয় রুমটেক মনাস্ট্রির নতুন ভবনটি। তখন থেকে এই মঠ 'ধর্মচক্র কেন্দ্র' হিসেবে পরিচিত। পুরনো মনাস্ট্রিটা এই নতুন মনাস্ট্রি থেকে প্রায় ২কিমি দূরে এবং যাওয়ার রাস্তাটা সাদা বৌদ্ধ পতাকা দিয়ে সাজানো।

রুমটেক যাওয়ার গেট
রুমটেকের গেট থেকে বাকি পথটা পাহাড়ের চড়াইয়ে বেশ কিছুটা উপরে হেঁটে মনাস্ট্রিতে পৌঁছাতে হলো। এখানেও প্রেয়ার হুইলের আধিক্য, এগুলি হাত দিয়ে ঘোরানো যায়। 'ওঁ মণিপদ্মে হুং' এই মন্ত্র যেন এই রাজ্যকে রক্ষা করে চলেছে কতকাল ধরে। এই প্রেয়ার হুইল ঘুরিয়ে ওই মন্ত্র পাঠ করলে পুন্যলাভ হয়। পড়ার সুবিধার জন্য এগুলো বাঁদিকে ঘোরাতে হয়। প্রেয়ার হুইল বায়ে রেখে ক্রমশ হেঁটে ওপরে ওঠার সময়ে কয়েকবার সেগুলো ঘোরালাম। আমার স্ত্রী ও আমাদের সঙ্গী কয়েকজন মহিলা অত উঁচুতে আর হেঁটে উঠতে পারলো না, যাবার পথে এক জায়গায় কিছু স্যুভেনিরের দোকান দেখতে পেয়ে সেখানে কেনাকাটা শুরু করে দিলো।

রুমটেকে যাওয়ার চড়াই রাস্তা
মনাস্ট্রিতে প্রবেশের আগেও হ'লো আরেকপ্রস্থ চেকিং। অনেকটা উঁচুতে উঠে একটু বিশ্রামের জন্য সবাই ধপ করে বসে পড়লাম। বিশাল প্রাঙ্গনের চারদিকে নানা ভবন রয়েছে। প্রাঙ্গনের মাঝখানে অবস্থিত একটি স্তম্ভের গায়ে তিব্বতি ভাষায় রুমটেকের ইতিহাস খোদিত আছে। এই মনাস্ট্রি ভিউ পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে। এখান থেকে সিকিমের পাহাড়ি জনপদ, উপত্যকার প্যানোরমিক দৃশ্য উপভোগ করা যায়।

রুমটেক মনাস্ট্রি
রুমটেক মনাস্ট্রির মূল ভবনটা তিনতলা। একতলায় রয়েছে বিশাল একটা প্রার্থনা ঘর। প্রার্থনা ভবনের পিছনে রয়েছে 'নালন্দা ইনস্টিটিউট অফ হায়ার বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ' ও বৌদ্ধ ছাত্রদের থাকার তিনতলা এক বিরাট হোস্টেল। মনাস্ট্রির ভেতরে সব জায়গায় জনসাধারণের যাওয়ার অনুমতি নেই। তবে প্রার্থনা ঘরটি সবার জন্য উন্মুক্ত। চারপাশ ঘুরে দেখে প্রার্থনা ঘরে প্রবেশ করলাম। প্রার্থনা ঘরের ভেতরে ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যে বারান্দা দিয়ে প্রার্থনা ঘরে প্রবেশ করলাম তার দেওয়াল জুড়ে আঁকা আছে তিব্বতের চিরাচরিত রীতিতে আঁকা বিভিন্ন বৌদ্ধ মুরাল ও ফ্রেস্কো। আলো-আধাঁরিতে ঢাকা শান্ত প্রার্থনা ঘরের মধ্যে ঢুকে গেরুয়া বসনে সারি দিয়ে লামাদের প্রার্থনারত অবস্থায় দেখে মনে এক আধ্যাত্মিক ভাব জেগে উঠলো। মনে হলো যেন সারা পৃথীবির সকল শান্তি এখানে বিরাজ করছে। বেশ খানিকটা সময় কাটালাম এখানে। এবার ফিরে আসার পালা। মনে মনে 'বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি' বলতে বলতে বেরিয়ে এলাম। উৎরাই পথে নামতে এবার আর কোনো কষ্ট হ'লো না। গাড়িতে উঠে আবার চলা শুরু।

বৌদ্ধ মুরাল ও ফ্রেস্কো
রুমটেক থেকে পাহাড়ি পথ দিয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে। চলতে চলতে গাড়ি এসে থামলো এবার বনঝাকরির গেটের মুখে। বড় গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেই সামনে বিশাল বড় পার্কিং লট, তাতে ছোট গাড়ি থেকে শুরু করে বড় গাড়ি সব সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে। গাড়ি থেকে নেমে দেখি অসংখ্য পর্যটক। যেতে গিয়েই ডানপাশে দেখলাম একটা ট্যুরিস্ট স্যুভেনির শপ। আরও এগিয়ে চলতে লাগলাম, কানে এল ঝর্ণার আওয়াজ। ওপর থেকে জল পড়ার তীব্র শব্দ। চোখে পড়ল একটা ক্যাফেটেরিয়া। খিদেও লেগেছিল খুব। এখানে আমরা লাঞ্চটা সেরে নিলাম। ক্যাফেটেরিয়াতে বসে চারপাশের অপরূপ দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। গলায় ঝুলিয়ে রাখা ক্যামেরাটা অন করে ঝটপট কিছু ছবি তুলে নিলাম।

ক্যাফেটেরিয়া
বনঝাকরি এক মিথোলজিক্যাল চরিত্র। তারই নামে নামকরণ এ পার্কের। এই বনঝাকরিকে ঘিরে রয়েছে এক লোকগল্প। এটা মিথ নাকি মিথ্যা তা বলা কঠিন। কিন্তু কে এই বনঝাকরি? বনঝাকরিকে বনের দেবতা বলা যেতে পারে। বনঝাকরি চেহারায় ছোট গাট্টাগোট্টা গড়নের এক পুরুষ আর তাঁর সঙ্গিনী লেমলেমে (বনঝাকরিণী) খড়গ হাতে বড়ো চুল এবং নৃশংস চেহারার নারী। ঝাকরি একটা নেপালী শব্দ যার মানে ওঝা বা শামান, অর্থাৎ এক কথায় যারা দুষ্টু আত্মা তাড়িয়ে সমাজের রোগবালাই দূর করে। এই ঝর্ণার আশেপাশেই ছিল তাদের ডেরা। তাই এদের মূর্তিও আছে এখানে। এদের দুপাশে দুই বড় শ্বদন্ত বের করা। উভয়েই শ্যামবর্ণ। তারা এই জঙ্গলেই অনন্তকাল ধরে ঘরসংসার পেতে শক্তির উপাসনা করে অরণ্যকে দুহাত দিয়ে আগলে রেখে এসেছে। এখানে এই বনদেবতা ও তাঁর সঙ্গিনী শুধু অরণ্যই নয়, তারা আবার শিশুরক্ষকও। লোককথা অনুযায়ী বনঝাকরি এমন শিশুদের খুঁজে বের করতেন যাদের মধ্যে শামান (Shaman) হওয়ার লক্ষণ রয়েছে। তাদের অপহরণ করে শামানবাদ (এক ধরনের তান্ত্রিকতা) প্রশিক্ষণের জন্য তাদের গুহায় নিয়ে যেত। প্রশিক্ষণের সময় ছিল একমাস। তিনি নিজের বিদ্যা উজাড় করে শিখিয়ে তাদের ঘরে আবার পাঠিয়ে দিতেন মানবকল্যাণের জন্য। নেপালীদের বিশ্বাস ঘরে ফেরার পরে এইসব শিশু অতিরিক্ত শক্তিশালী আর বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যেত।

বনঝাকরি ও বনঝাকরিনী
প্রাকৃতিক এক ঝর্ণাকে ঘিরে তৈরি করা এই পার্ক। পার্কে ঢোকার জায়গা থেকে ঝর্ণা পর্যন্ত পুরোটাই বাঁধানো রাস্তা। কখনো উঁচু, কখনো নিচু, কখনো আবার সিঁড়ি। একটু পরপর রয়েছে বসার জায়গা। একটু গিয়েই সুন্দর সাজানো এক সাঁকো, চৌচালা নকশাকাটা ছাদসমেত।

ঝর্ণার দিকে এগিয়ে চললাম
সাঁকো পেরিয়ে আর একটু এগিয়ে গিয়েই থ হয়ে গেলাম। বেশ উঁচু থেকে প্রবল বেগে জল নীচে পড়ছে। আর ঝর্ণার সামনে প্রচুর লোকজন সেই জলে পা ভেজাচ্ছে। কেউ বা ভিজতেই নেমেছে। আমরাও ঝর্ণার জলে একটু আধটু পা ভিজিয়ে কিছুটা আনন্দ উপভোগ করলাম। ঝর্ণার ঠিক বাঁ দিকে বেশ কিছু দোকান মত আছে দেখলাম, এখানে ট্রাডিশনাল পোশাক ভাড়া পাওয়া যায়। সঙ্গে ছবি তোলার জন্য ফটোগ্রাফারও রয়েছে। মেয়ের ইচ্ছে হলো ওই পোশাকে একটা ফটো তোলা। পোশাক ভাড়া করে কিছু ছবি তোলা হল।

ঝর্ণার জলে পা ভিজিয়ে আনন্দ উপভোগ করা
চলে এলাম একটু উপরে এখান থেকে দেখি নীচে একপাশে পাথরে বাঁধানো সুইমিং পুলের মত ছোট্ট একটা জলাশয়, তার মাঝখানে ড্রাগনের স্ট্যাচু। প্রচুর ট্যুরিস্ট। সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত। একটু খানি এগিয়ে এসেই রয়েছে বনঝাকরির স্ট্যাচু, রয়েছে একটা হ্যঙ্গিং ব্রীজ।

ড্রাগন লেক
আমরা চলে এলাম উল্টো দিকে। সিমেন্টের রাস্তা দিয়ে বাঁধানো একটি পার্ক মত রয়েছে, পার্ক বলতে আমরা যেরকম বুঝি সেই পার্ক নয়, এত সুন্দর করে বাঁধানো যে মনে হচ্ছে পার্ক। চারপাশে অনেক রকম ফুল দিয়ে সাজানো। এখানে আছে কারুকার্য করা একটি ছোট্ট বসার জায়গা। পুরো জায়গাটাই বেশ সাজানো গোছানো, তবে কৃত্রিমতার ছাপটাই বেশি। টুকটাক কিছু ছবি তুলে আমরা আবার রওনা হলাম। পরবর্তী গন্তব্য তাশি ভিউ পয়েন্টে।

বনঝাকরি ঝর্ণা
পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে বেশ কিছুটা গিয়ে একেবারে তাশি ভিউ পয়েন্টের কাছে এসে গাড়ি দাঁড় করাল ড্রাইভার। এখান থেকে পাহাড়ের উপত্যকার খুব ভালো ভিউ পাওয়া যায়। গ্যাংটকের যে সমস্ত ভিউ পয়েন্ট আছে তার মধ্যে তাশি ভিউ পয়েন্ট অন্যতম। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং মাউন্ট সিনিয়লচুর অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায়। গাড়ি থেকে নেমে অল্প একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি অনেকগুলো ধাপে উপরে উঠে গেছে একটি প্রশস্ত সিঁড়ি। সিঁড়ির ধাপে আস্তে আস্তে পা রেখে ওপরে উঠে এসে একটা চাতালে গিয়ে দাঁড়ালাম। জায়গাটা বেশ ছিমছাম, শান্ত ও স্নিগ্ধ পরিবেশ। সুন্দর দুটো ড্রাগনের মূর্তি দিয়ে সাজানো বসার জায়গা। একটা ক্যাফেটেরিয়াও রয়েছে। মন ভরে যায় জায়গাটার সৌন্দর্যে। খানিক ঘােরাঘুরি আর ফোটোসেশন করে নীচে গাড়ির কাছে চলে এলাম।

তাশি ভিউ পয়েন্ট
তাশি ভিউ পয়েন্ট থেকে ফেরার পথে পড়ল প্লান্ট কনজার্ভেটরি গার্ডেন। ড্রাইভার এখানে গাড়ি দাঁড় করলো। এটাকে একটা বোটানিক্যাল গার্ডেন বলাও যেতে পারে। পাহাড়ের ঢালে তৈরি করা হয়েছে এটা। বিভিন্ন ধরনের গাছ, বিশেষ করে হিমালয়ান প্ল্যান্ট। পর্যটকদের আকর্ষিত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে, ছোট ছোট সাঁকো, জলের পুকুর। হেঁটে হেঁটে ঘোরার জন্যে বাঁধানো রাস্তা, সিঁড়ি ইত্যাদি, ইত্যাদি। একেবারে উপরের প্রান্তের দিকে রয়েছে একটি প্রাকৃতিক ঝর্ণা।

প্লান্ট কনজার্ভেটরি গার্ডেন
ছোট্ট, কিন্তু জায়গাটা বেশ আকর্ষণীয়। দেখতে ভালই লাগে, কিন্তু সমস্যা হলো খাঁড়াই। আমার স্ত্রী কিছুটা গিয়েই, আর উঠতে চাইল না। গেটের সামনে ফিরে এসে টিকিট কাউন্টারের কাছে একটি বেঞ্চে বসে থাকলো। বেশিরভাগ প্রবীণদের দেখলাম একই অবস্থা। আমি মেয়েকে নিয়ে যতটা সম্ভব ওপরে উঠে গিয়ে দেখলাম। সিকিমের বেশিরভাগ প্রাকৃতিক উদ্ভিদই এখানে রয়েছে। বেশিক্ষণ সময় অপচয় করা যাবে না, দিনের আলো কমে আসছে আরও অনেক দেখার বাকি আছে। বেরিয়ে আবার গাড়িতে।

গাছগাছালির ফাঁকে পায়ে চলার পথ
ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা পৌঁছালাম গণেশ টক। দেখলাম সেখানে বেশ কিছু দোকান পাট আছে। গ্যাংটকে স্থানীয় দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে পড়ে এই গণেশ টক। 'টক' মানে মন্দির। তাই গণেশ টক হলো গণেশ মন্দির। পাহাড়ের মাথায় খুব সুন্দর এই ভগবান গণেশের মন্দির। পার্কিং লট থেকে কয়েক পা এগিয়ে মন্দিরের গেট। রাস্তা থেকে মন্দিরে উঠার সময় একটা সিঁড়ি রয়েছে।

পার্কিং লট
গেট পেরিয়ে অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে হল। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে গিয়ে অবস্থা কাহিল। মন্দিরের পাশে একটা খুব সুন্দর বসার ব্যবস্থা করা আছে এবং চারপাশে খোলা বারান্দাও রয়েছে যেখান থেকে দারুণ একটা ভিউ পাওয়া যায়। এটা গণেশ ভগবানের উপাসনালয় হলেও এটা পাহাড় চূড়ার ওপর একটা ভিউ পয়েন্ট। মন্দিরের বারান্দায় গিয়ে যখন দাঁড়ালাম, তখন মনে হলো, কি দেখছি, এখানে না এলে সত্যিই তো দেখা হতো না এমন অপূর্ব সুন্দর জায়গা।

গণেশ টক
এখান থেকে গ্যাংটক শহরের দুর্দান্ত এরিয়াল ভিউ পাওয়া যায়, যাকে বলে একেবারে ৩৬০° ভিউ। চারপাশে সম্পূর্ণ খোলা অবারিত পাহাড়ের মাঝখানে সুউচ্চ একটি টিভি টাওয়ার যেন সেই সৌন্দর্যটাকে আরও কিছুটা বাড়িয়ে তুলেছে। এখানে একটা খুব ভালো স্যুভেনিয়রের দোকান আছে যেখান থেকে কেনাকাটা করা যেতে পারে।

উপর থেকে গ্যাংটক শহর
গণেশ টকে কিছুক্ষণ কাটিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে চলে এলাম গাড়ির কাছে। এই মন্দির থেকে কিছুটা দূরে পাহাড়ের উপর আরেকটা মন্দির আছে আর সেটাই আমাদের পরবর্তী গন্তব্য। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম ওখানে ওটা কিসের মন্দির? ড্রাইভার জানালো, ওটা হনুমান টক। গ্যাংটকে স্থানীয় দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে পড়ে এই গণেশ টক এবং হনুমান টক। তাই হনুমান টক হলো হনুমান মন্দির। দুটো পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত এই দুই মন্দির। দুটো মন্দিরই মোটামুটি একই রকম, রঙের মধ্যে হলুদটাই চোখে পড়ে বেশি। প্রায় সাড়ে সাত হাজার ফুট উঁচুতে এই ভগবান হনুমানের মন্দির। একটু ভাবলাম! অত উঁচুতে। পৌঁছতেও অনেক সময় লাগবে। তাছাড়া সারাদিন ধরে পাহাড়ের বিভিন্ন উচ্চতায় ওঠানামা করার ফলে বেজায় ক্লান্ত ছিলাম। তাই হনুমান টকে কষ্ট করে উঠে আর সময় নষ্ট করতে চাইনি। হনুমানজিকে দূর থেকে প্রণাম জানিয়ে আবার এগিয়ে চললাম।

গণেশ টক ভিউ পয়েন্ট
এবারে আমাদের গাড়ি এসে থামলো রিজ পার্কে ফ্লাওয়ার এক্সিবিশন সেন্টার বা পুষ্প প্রদর্শনী কেন্দ্রে। দিনের আলো প্রায় শেষ। এটাই আমাদের শেষ গন্তব্য। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। বিশাল গ্রীন হাউস। কত রকমের কত ফুল আর অর্কিডের সমারোহ। ভেতরের জায়গাটা গোলাকার, তার মাঝখানে একটা রেলিং ঘেরা জায়গা যার মধ্যে অনেক ফুলের গাছ রয়েছে। আবার গোলাকার ঘরটার দেওয়াল বরাবর একটা রেলিং চলে গেছে আর তার ওদিকেও অনেক ফুলের গাছ। মাঝখানে একটা কৃত্রিম জলাশয় রয়েছে। এর মাঝখানে একটা সাঁকোর ওপর দিয়ে চলে গেছে দর্শকদের জন্য পায়ে চলার রাস্তা। মনে হলো এখানে যেন চির বসন্ত বিরাজ করছে। মন ভরে উপভোগ করার মতো। আমরা যেন এই ফুল বাগিচার মৌমাছি। কোন দিকে কোন ফুলের কাছে যাব তা যেন ঠিক করতে পারছি না। ঘন্টা খানেক ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়িয়ে বেরিয়ে এলাম।

ফ্লাওয়ার এক্সিবিশন সেন্টার
রাস্তার উল্টোদিকে ব্রিটিশ স্থাপত্যের উদাহরণ স্বরূপ রয়েছে 'হোয়াইট মেমোরিয়াল হল' এছাড়া সিকিমের বিভিন্ন সরকারী ভবন। বিকেলের আলো জানিয়ে দিলো এবার ফেরার পালা। এসে দেখি গাড়ি নেই! গাড়ি কোথায়? ড্রাইভারকে ফোন করে জানলাম গাড়ি পার্কিংয়ে রাখা আছে। পার্কিং অনেকটাই দূর। গাড়ি যেখানে আছে সেখানে যেতে আমাদের হাফ কিমি হাঁটতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির কাছে এলাম। জায়গাটা খুব সুন্দর সাজানো গোছানো। চারদিক গাছে ঢাকা, রাস্তাঘাটও বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।

হোয়াইট মেমোরিয়াল হল
ফিরে এলাম হোটেলে। সারাদিন ঘুরে শরীরে ক্লান্তি থাকার দরুন হোটেলে ঢুকে ফ্রেশ হয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম, শরীর যেন আর চলে না। হাল্কা গরম লাগছে, কিন্তু উপায় নেই দেখলাম এখানে কোথাও ফ্যানের ব্যবস্থা নেই। কিছুক্ষণ পরেই মেঘ ঘনিয়ে বৃষ্টি নামলো। এবারে বেশ ঠান্ডা অনুভূতি হতে থাকলো। এরপর হোটেলের ডাইনিংয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুম। আমাদের এর পরের গন্তব্য ছাঙ্গু লেক ও বাবা মন্দির

সরকারী ভবন
» পথ নির্দেশিকা

© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল।
Arabinda Pal
0 Comments
Share This Post :

You Might Also Like

No comments:

Post a Comment

[name=Arabinda Pal] [img=https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEia50rmuKEAcbGUbQKvAbzUmdviiIhm-LeVlsEEdFx_xtGfyvx8O02yFVuJemgswzSA8PoMcN-XW0AcinKr9iq28lHK43Z4TFFyL7pJyGGxLNx9LGn0cLvPz0lUJzNrWBo9n_NyxGLjDII/h120/IMG_2788.jpg] [description=পর্যটক হিসাবে নয়, একজন ভ্রমণকারী হিসাবে বেড়ানোটা আমার কাছে একটা নেশা এবং ফটোগ্রাফিতেও আমার ভীষণ শখ। তাই একজন ভ্রমণকারী হিসাবে আমার এই ব্লগে নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে লেখা ও ছবিগুলো যদি আপনাদের ভালো লাগে তাহলে অবশ্যই আপনাদের মতামত কমেন্টসের মাধ্যমে জানাতে ভুলবেন না।] (facebook=https://www.facebook.com/groups/2071066419824586/user/100002484831922) (twitter=Twitter Profile Url) (instagram=https://www.instagram.com/arabindapal2020/) (bloglovin=Blogvin Profile Url) (pinterest=https://www.pinterest.com/arabindapalbrb/) (tumblr=Tumblr Profile Url)

Follow @Arabinda Pal