Theme Layout

Boxed or Wide or Framed

Theme Translation

Display Featured Slider

Yes

Featured Slider Styles

[Centred][caption]

Display Grid Slider

No

Grid Slider Styles

[style5][caption]

Display Trending Posts

Display Author Bio

Yes

Display Instagram Footer

Yes

Dark or Light Style

গ্যাংটক থেকে ছাঙ্গুর পথে


গ্যাংটকের দ্বিতীয় দিনটা ছিল বাবা মন্দির আর ছাঙ্গু লেক যাবার জন্য। একই রাস্তায় তিনটে ঘোরার জায়গা 'ছাঙ্গু', 'নাথুলা' আর 'বাবা মন্দির' বা বাবা হরভজন সিংয়ের মন্দির। এখানে যেতে হলে পারমিট নিতে হয়। তাই গ্যাংটকে পৌঁছেই আমরা আমাদের স্থানীয় একজন পরিচিত ব্যক্তি সন্তোষ রাইকে প্রত্যেকের দু'কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি ও ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি দিয়েছিলাম। সন্তোষবাবুই পারমিট তৈরি করে ড্রাইভারের সাথে পাঠিয়েছিলেন, আমাদের কিছুই করতে হয়নি। যাই হোক, আমরা তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে সকাল ন'টার মধ্যে ‘ছাঙ্গু’ যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে হোটেলের রুম থেকে বেরিয়ে বাইরে করিডোরে এসে দাঁড়ালাম।ইতিমধ্যে হোটেলের নীচে দেখি আমাদের জন্য একখানা ঝাঁ-চকচকে ইনোভা গাড়ি এসে হাজির। একটু বাদে সকলে গাড়িতে উঠে বসলাম।

পাহাড়ের ধাপে ছোট্ট গ্রাম
ধীরে ধীরে গাড়ি গড়াল ছাঙ্গুর পথে। আমাদের ড্রাইভার পাহাড়িয়া নয়, পদবি শর্মা, ছোটবেলা থেকেই গ্যাংটকে আছে। ভীষণ মিশুকে ও বিশ্বস্ত। গতকাল রাত থেকে সেই যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে থামার কোনো লক্ষণ দেখছি না। ঝিরঝির করে পড়েই চলেছে। ঠান্ডাটাও বেশ অনুভূত হচ্ছে। এর মধ্যেই আমাদের সঙ্গে নিয়ে গাড়ি চললো ছাঙ্গুর পথে। গ্যাংটক থেকে বেরিয়ে আমরা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে উপরে উঠতে শুরু করলাম। বাঁদিকে মাথা উঁচু করে রয়েছে হিমালয়ের প্রাচীর, ডানদিকে অতল খাদ। পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে যত উপরে উঠছি প্রকৃতির রূপ ততই বদলাচ্ছে। গাছপালা এখানে প্রায় নেই বললেই চলে। রুক্ষ পাহাড়, তাদের গা বেয়ে নেমে এসেছে অজস্র ছোট বড় অসংখ্য ঝোরা। কেউ কেউ আবার রাস্তার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে। সকাল থেকেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়েই চলেছে, তার মধ্যেই আমাদের গাড়ি এগোতে থাকলো। সর্পিল পাহাড়ি রাস্তার প্রতিটি বাঁকে অপেক্ষা করে রয়েছে ভয় ও বিস্ময়। এরকমই একটা বাঁক ঘোরার সময় ভয়ে আমার বুকের ভেতরটা শুকিয়ে গেল।

প্রতিটি বাঁকে অপেক্ষা করে রয়েছে ভয় ও বিস্ময়
প্রায় ঘন্টা খানেক যাওয়ার পর দেখা গেলো দূরে পাহাড়ের ধাপে ছোট্ট একটি গ্রাম। কাছে এসে দেখি এটা একটা মার্কেট মানে কয়েকটা দোকান মাত্র। পরপর সারি দিয়ে কয়েকটি দোকান নিয়ে তৈরি এই 'কিয়াংনোসলা মার্কেট'। ড্রাইভার একটা দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করালো।

কিয়াংনোসলা মার্কেট
এখানে দেখলাম ম্যাগি খাওয়ার বেশ প্রবণতা রয়েছে। ভেজ মোমো আর গরম চা পান করে এই ঠান্ডায় শরীরটা যেন একটু চাঙ্গা হলো মনে হলো। দোকানের মালকিন বেশ স্মার্ট। জানালো ফেরার পথে দুপুরের আহার করতে চাইলে আগে থেকে অর্ডার দিতে হবে। তবে খাবারের মান দেখে সেই ইচ্ছে আর হলো না। খাবার দোকানের সাথেই সুন্দর সুন্দর জ্যাকেট টুপি সহ শীতপোশাকের দারুন পশরা এখানে। এর মধ্যেই আবার আমাদের দু'একজন কিছু কেনাকাটা সেরে নিলো। চা পান করার পর আমরা আবার এগিয়ে চললাম।

আবার এগিয়ে চললাম
উপরে যতই উঠছি ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ততই আমরা কাবু হয়ে যাচ্ছি। তাপমাত্রা তখন ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে, ড্রাইভার গাড়ির হিটার চালু করে দিলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা ছাঙ্গু লেকে এসে গেলাম, ছাঙ্গু’কে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘সোমোগো’ যার অর্থ হল সব হ্রদের উৎস। রাস্তার ধারে পাহাড় ঘেরা ছোট্ট একটা লেক। এমন কিছু আহামরি নয়।
ছাঙ্গু লেক
শুনেছি নীল জলের এই সরোবরটি বছরের অনেকটা সময়ই থাকে সাদা ধবধবে বরফে ঢাকা। আমাদের সেই বরফ মোড়া ছাঙ্গুর দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য আর হয়নি। বৃষ্টি কিন্তু সমানে হয়ে চলেছে। তাই গাড়ি থেকে নামলাম না, ঠিক হল ফেরার পথে যদি বৃষ্টি থামে তাহলে এখানে কিছু সময় কাটানো যাবে। আমরা এগিয়ে চললাম বাবা মন্দিরের দিকে।

ছাঙ্গু পেরিয়ে এগিয়ে চললাম
ছাঙ্গু পেরিয়ে ছোট্ট ছোট্ট সেনাছাউনি ও ন্যাড়া পাহাড়ের পাহাড়ি পথ ধরে শেরাথাংয়ের দিকে আমরা এগিয়ে চলেছি। গ্যাংটক থেকে শেরাথাং এতটা রাস্তা এলাম, কোথাও বরফের চিহ্নমাত্র নেই। মিনিট পনেরো কুড়ির মধ্যেই নাথুলা পাসের গেটের কাছে পৌঁছিয়ে গেলো আমাদের গাড়ি। শুনলাম নাথুলা বন্ধ, আমাদের দুর্ভাগ্য চীনের সীমান্ত দেখা হলো না। নাথুলা পাস পেরিয়ে বরফের আকর্ষণে আমরা এগিয়ে চলেছি। গন্তব্য নতুন বাবা মন্দির। যাওয়ার রাস্তার একেবারেই গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরও একটা লেক। স্থানীয় নাম সুহেলি লেক। এখানেও সেই একই দৃশ্য। বরফ উধাও!

শেরাথাং
বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ নতুন বাবা মন্দিরে পৌঁছলাম। গাড়ি থেকে নামতেই তীব্র ঠান্ডা হাওয়া কাঁপিয়ে দিল। চারপাশ তখনও মেঘের চাদরে ঢাকা। প্রচণ্ড শীতে প্রায় জবুথবু অবস্থা। ঝির ঝিরে বৃষ্টির মধ্যে গাড়ী থেকে নেমে কাঁপতে কাঁপতে মাথায় ছাতা দিয়ে কোনোরকমে দৌড়ে মন্দিরে ঢুকলাম। তবে বাবা মন্দির পৌঁছে চারিদিকের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এককথায় অপূর্ব। ওয়াটার ফলসের ঠিক সামনে একটি সুন্দর শিব মূর্তি স্থাপন করে চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা এক অপূর্ব সুন্দর উপত্যকায় তৈরি করা হয়েছে এই নতুন বাবা মন্দির। কার পার্কিং, ক্যাফেটোরিয়া, স্মৃতি মন্দির এবং ছোট্ট একটা মিউজিয়াম নিয়ে একেবারেই জমজমাট পরিবেশ।

বৃষ্টি মাথায় ‘বাবা মন্দিরে’ প্রবেশ
বাবা মন্দির কোনো দেবতার মন্দির নয়। এই মন্দিরে কোনও দেবতা নেই। এই মন্দিরের সাথে একটা মানুষের দেবতা হয়ে ওঠার কাহিনি জড়িত আছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে আছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক মৃত সৈনিক হরভজন সিং এর ছবি, আর তাঁর জীবিতকালে ব্যবহার করা জামাকাপড় জুতো এবং অন্যান্য ব্যবহৃত জিনিস। হরভজন সিং ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পঞ্জাব রেজিমেন্টের এক জওয়ান। ১৯৬৮ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে নাথুলার কাছে এক দুর্ঘটনায় তাঁর অকালমৃত হয়। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে এই মন্দির।  তিনি মারা যাওয়ার পর থেকে ঘটতে থাকে নানা অলৌকিক ঘটনা। বহু সতীর্থ নাকি আজও স্বপ্নে দেখা পান তাঁর। স্থানীয় মানুষ থেকে ভারতীয় সেনা জওয়ানদের কাছে তিনি এখনো অমর। তাদের কাছে হরভজন সিং একজন দেবতা। প্রত্যেকেই বিশ্বাস করেন এখনও কোনও পর্যটক বা সৈনিক বিপদে পড়লে আজও তাকে বাবা হরভজন সিং পথ দেখান। তাই তাঁকে উপলক্ষ্য করে তৈরি এই মন্দির। তবে নাথুলার কাছে এই মন্দিরটা পরে তৈরি হয়েছে। পুরোনো বাবা মন্দির এই নতুন বাবা মন্দির থেকে প্রায় সাড়ে নয় কিলোমিটার দূরে।

বাবা হরভজন সিং
মন্দিরের একটা ঘরে হরভজন সিংয়ের মূর্তি রাখা আছে। অন্য একটা ঘরে খাটের ওপর পরিষ্কার করে বিছানা পাতা, সেখানে তাঁর ছবি রাখা। ওই ঘরের ভেতর হরভজন সিংয়ের ব্যবহার করা জুতো, চেয়ার, টেবিল, সামরিক পোশাক ইত্যাদি সযত্নে রাখা আছে। এগুলোকে রোজ পুজো করা হয়। নাথুলায় কর্মরত সেনা জওয়ানদের দাবি, এখানে মাঝে মাঝে হরভজন সিং এসে বিশ্রাম নেন এবং বিছানা এলোমেলো হয়ে যায়। একই জিনিস দেখা যায়, তাঁর জুতোর ক্ষেত্রেও। জুতোতেও মাঝে মাঝে কাদা, ধুলো লেগে থাকে। এই বিশ্বাস থেকেই ভারতীয় সেনা জওয়ান থেকে শুরু করে পর্যটকেরা এই বাবা মন্দির দেখতে আসেন।

হরভজন সিং-এর ব্যবহৃত জিনিস
এখানে প্রচুর বাঙালি পর্যটককে দেখা গেলো যাঁরা মূলত বরফের আকর্ষণেই এখানে এসেছেন। কিন্তু বরফ দেখার সৌভাগ্য কারও হয়নি। মন্দিরের পাশেই রয়েছে একটা পাহাড়ি নদীর ঝর্ণা। যার স্থানীয় নাম ভোলেনাথ ফলস। তার ঠিক সামনে রয়েছে একটা প্রকান্ড শিব মূর্তি।
নাথুলা, বাবামন্দির অনেক উঁচুতে তাই এখানে অক্সিজেন কম। শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা থাকলে নিজের স্বাস্থ্য বুঝে যাওয়া উচিত। সাথে কর্পূর রাখা ভালো। শ্বাসকষ্ট অথবা বমি বমি ভাব হলে কর্পূর নাকে শুকলে অনেক কাজে দেয়।
বড় বড় পাথরের চাঁইয়ের নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদীর জল। সেই পাথরের উপর সাবধানে পা রেখে পৌঁছাতে হবে শিব মূর্তিটার কাছে। ছবি তুলতে গেলাম, পরিষ্কার এলো না। ছাতা মাথায় বৃষ্টির মধ্যে একটু একটু করে একা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এই বৃষ্টির মধ্যে যে কোনো মুহূর্তে বিপদ ঘটে যেতে পারে ভেবে অভিযানের নেশা ছেড়ে বাস্তবে ফিরে এলাম।

শিব মূর্তি
খিদেও লেগেছিল খুব। ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে কোনরকমে ছাতা মাথায় আমরা এক প্রকার দৌড়ে গিয়ে বাবা মন্দিরের সামনে একটা ক্যাফেতে ঢুকে পড়লাম। ক্যাফেতে বেশ ভিড়, খাবার টেবিলে বসে সকলের জন্য মোমো আর গরমাগরম কফি অর্ডার দিয়ে দিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই এসেও গেল তারা টেবিলে। পেটপুরে মোমো আর কফি খেয়ে পার্কিং লটে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। বৃষ্টি একটু থেমেছে। কিন্তু আবহাওয়ার পরিস্থিতি দেখে আমরা পুরনো বাবা মন্দিরের দিকে আর গেলাম না। পাহাড়-ঝর্ণা ও তার সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির হাড় কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া, সবমিলিয়ে এখানের এই বিরল পরিবেশের অভিজ্ঞতা নিয়ে আবার গ্যাংটকে ফিরে চললাম।

পাহাড়ি নদী ও ঝর্ণা
ফেরার পথে এক জায়গায় দেখি অনেকগুলো গাড়ি সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে। সামনে যেতেই দেখলাম রাস্তার একধারে বেশ বরফ জমেছে তার ওপর লোকজন লাফালাফি করছে, এককথায় বরফ নিয়ে খেলছে। ড্রাইভারকে বলে রাস্তার পাশে গাড়িটা দাঁড় করলাম। আমার মেয়ে তো ঝলমলে হাসি মুখে প্রায় এভারেস্ট জয়ের আনন্দ নিয়ে মিনিট পনেরো ধরে বরফের ওপর লাফালাফি শুরু করে দিলো। পথের ক্লান্তি ভুলে আমরাও তার সাথে যোগ দিলাম। অবাক কাণ্ড, পুরো সফরে এই প্রথম বরফের দেখা পেলাম। এখানে একটা ছোট্ট ঘটনা ঘটে গেলো। আমার মেয়ে গাড়িতে এসে দেখি এদিক ওদিক খুঁজছে। একটু পরে জানতে পারলাম, ও নাকি তার মোবাইল ফোনটা খুঁজে পাচ্ছে না। ব্যাপারটা আমাদের গাড়ির ড্রাইভার আন্দাজ করতে পেরে তখন একগাল হেসে বললো ফোনটা গাড়ির মধ্যেই রাখা ছিল। দূর থেকে আমাদের বরফ নিয়ে খেলা করার কয়েকটা দৃশ্য সে ওই মোবাইলে কয়েদ করে রেখেছে। ড্রাইভারের সততা দেখে অবাক! যদিও আমার অভিজ্ঞতায় পাহাড়ের সমস্ত ড্রাইভারকেই সৎ দেখেছি।

প্রথম বরফের দেখা
ছাঙ্গুতে গাড়ি থেকে নেমে ঘোরার প্ল্যান ছিল। কিন্তু বাদ সাধল বৃষ্টি। আকাশের মুখ ভার, তখনও ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। আমি ও আমার সহযাত্রী অভিজিৎ দু'জনে কিছু ফটোশট নেওয়ার জন্য গাড়ি থেকে নামলাম। বাকিরা গাড়িতেই বসে থাকলো। যথেষ্ট ভীড়। দোকানপাট নিয়ে একেবারে জমজমাট পরিবেশ। এই ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেও মানুষের কলরবে লেকের চারিদিক সরগরম। লেকের আশেপাশে কোথাও বরফের চিহ্নমাত্র নেই। সত্যি বলতে আহামরি কিছু লাগেনি, এটা মনে অতটা দাগ কাটেনি আমার। তবে টলটলে নীল জল দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে। ছাঙ্গু লেকের ধারে ইয়াক গুলো দেখেও বেশ ভালো লাগলো। অনেকে ইয়কের পিঠে চড়ে ছবিও তুলছে। ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে লেকের পাশে দাঁড়িয়ে ফটাফট কয়েকটি ছবি তুলে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা গাড়িতে উঠে পড়লাম।

ইয়কের পিঠে চড়ে ছবি তোলা
সীমান্ত এলাকা বলে নিরাপত্তার কারণে এখানে BSNL ছাড়া অন্য কোনও মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না ফোনে। আমার মোবাইল ফোনের একটা সিম কার্ড ছিল BSNL এর, তবে এখানে ভালো সিগন্যাল পাওয়ার আশা না করাই ভালো। অনেক কষ্টে হোটেলে ফোন করে আমাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে রাখতে বললাম। গাড়ি যখন আমাদের হোটেলের সামনে এসে পৌঁছালো তখন বেলা তিনটে। খাবার রেডি ছিল, ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে লালবাজারে কেনাকাটা করতে বেরিয়ে পড়লাম। ঘোরাঘুরি এবং টুকটাক কেনাকাটা শেষ করে দেখি এত জিনিস নিয়ে যাবো কিসে! একটা ঢাউস বিগ শপার কেনা হলো। ফিরে এলাম হোটেলের রুমে। পরেরদিন সকালে বেরোতে হবে, তাই একটু রেস্ট নিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে রেখে ডিনার সেরে নিলাম। তারপর সারা দিনের ক্লান্তি জুড়োতে রাতে লম্বা একটা ঘুম দিলাম।

লালবাজারের পথে
এবারে বাড়ি ফেরার পালা। সন্ধ্যে বেলায় নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেন। পাহাড়ি রাস্তা তাই কোনোরকম ঝুঁকি না নিয়ে সন্তোষবাবুকে বলেছিলাম সকালে গাড়ি পাঠিয়ে দিতে। আমরাও যাওয়ার জন্য তৈরি। সকাল দশটা বাজতে না বাজতে দেখি হোটেলের সামনে এসে হাজির হয়েছে দুটো অল্টো গাড়ি। হোটেলের বিল মিটিয়ে চেকআউট করে আমরা দুই ফ্যামিলি দুটো গাড়িতে ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ছিল সন্তোষবাবুর নিজের শ্যালক। হ্যান্ডসাম দেখতে এবং ভীষণ লাজুক ও মিশুকে।

পাহাড়ি পথ ধরে আমরা চলেছি
রানীখোলা নদীর পাড় ঘেঁষে শিলিগুড়ি যাওয়ার পথ। লম্বা সফরে সর্বক্ষণ গল্প করতে করতে শিলিগুড়ির দিকে এগোতে থাকলাম। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে রাণীখোলা নদী। মাঝে রানীপুল এলো। রানীখোলা নদী ও রাস্তার ধারের স্থানীয় সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম সিংতাম বাজারে। পাহাড়ী ঢালে উঁচু নিচু ধাপে ধাপে সাজানো ঘরবাড়ি নিয়ে সুন্দর একটি ‍উপশহর। সামনে রানীখোলা নদীর উপর সিংতাম ব্রীজ। এখন পাকা সেতু হয়েছে। পুরোনো লোহার সেতুটা সিংতাম বাজার থেকে একটু দূরে। সিংতামে রানীখোলা নদী তিস্তার সাথে মিলেছে।

সিংতাম বাজার
ব্রীজ পেরিয়ে সামান্য কয়েক মিটার যাওয়ার পর থেকেই তিস্তা আমাদের সঙ্গী। মামরিং পেরিয়ে রংপোর চেকপোস্টে এসে আমাদের গাড়ি থামলো। আকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ও তিস্তা নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে রাস্তায় একটা চা বিরতি দিয়ে কখন যে রংপো চেকপোস্ট পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারলাম না।

মামরিং
বিশাল এক ঐতিহ্যবাহী গেট। ওপরে সবুজ চৌচালা, দু'পাশে থামের গায়ে রংবেরঙের নকশাকাটা কারুকার্য, যা সিকিমের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। চারপাশে হোটেল আর দোকানপাট। প্রচুর জীপ আর ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। পারমিটের জন্য বেশ কিছুটা সময় লাগবে। এই ফাঁকে আশপাশটা একটু ঘুরে দেখার সুযোগ ছাড়লাম না।

রংপো চেকপোস্ট
মিনিট কুড়ি বাদে চেকপোস্ট থেকে বেরিয়ে আবার শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হই। রংপো ব্রীজ পেরিয়ে আমাদের গাড়ি জাতীয় সড়ক ধরল। আমরা চলেছি পাহাড়ি পথ বেয়ে রংপো থেকে তিস্তা বাজার ব্রীজের দিকে। এবার রঙ্গিত নয়, তিস্তা নদীর পাশ দিয়েই চলেছে আমাদের যাত্রাপথ, কখনও কাছে কখনও দূরে।পাহাড়ি পথে এগোচ্ছি। ডান পাশে তিস্তা, বাম পাশে পাহাড়ের দেওয়াল দুপাশেই জঙ্গলে ভরা সবুজ পাহাড় আর তার উপর উঁচু উঁচু চূড়া। এইসব দেখতে দেখতে যাচ্ছি। পথে মেল্লিতে দেখলাম তিস্তার বুকে রিভার র‍্যাফটিং হচ্ছে। ইচ্ছা হলে কেউ একটু সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে তিস্তায় রাফটিং করে নিতে পারে। অনেকে দেখলাম সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছে।

রংপো ব্রীজ
গাড়ি চলার কিছুক্ষণ পরে পাহাড়ি রাস্তার সৌন্দর্য একটু একটু করে সামনে আসছিল। গাড়ি থেকে বহু দূরে পাহাড় দেখা যায়, ধীরে ধীরে সেই দূরের পাহাড় স্পষ্ট হয়, আবার সেই পাহাড়ের বাঁক থেকে আরেক পাহাড়ের দেখা মেলে। দু'চোখ দিয়ে দেখছি এক অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা। চলন্ত গাড়ী থেকে ফটো তুলতে গিয়ে মন ভরলো না। তাই যাওয়ার পথে কোনো জায়গা ভালো লাগলে সেখানে গাড়ি থামিয়ে ফটো তুলতে থাকলাম।

সঙ্গী যখন তিস্তা
দেখতে দেখতে তিস্তা বাজার। তিস্তা বাজারে তিস্তার রূপ যেন আরও বিকশিত। এই তিস্তা বাজার ব্রীজ থেকে একটি পথ দার্জিলিং চলে গেছে। আমরা তিস্তা নদীর উপর ব্রীজ পার হয়ে তিস্তার ধার ধরে এগিয়ে চলেছি। রংপো থেকেই তিস্তা আমাদের সঙ্গী। এ পথে তিস্তা আবার সঙ্গী, রাস্তার বাঁ দিকে। এভাবেই অনেকটা পথ অতিক্রম করার পর আমাদের গাড়ি থামল এক রেস্টুরেন্টের সামনে। সাদামাটা একটা হোটেল। যা-ই হোক, ঢুকে পড়লাম। খাবার অর্ডারের কাজ শেষ। একটু ফ্রেশ হয়ে বসে পড়লাম রেস্টুরেন্টের বারান্দাতে। তিস্তা এখানে অনেক কাছে, একেবারে গা ঘেঁসে। রেস্টুরেন্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম পাহাড় ঘেরা তিস্তার এক মনোরম দৃশ্য।

রেস্টুরেন্টের বারান্দায়
এর মাঝে আমাদের অর্ডার করা খাবার চলে এসেছে। খাবারের স্বাদ আহামরি না হলেও ঐরকম দৃশ্যের কারণেই হয়তো খাবারটাকে সুস্বাদু মনে হচ্ছিল। লাঞ্চ সেরে আবার রওনা দিলাম। আসার পথে প্রথমে পড়ল রাম্ভি ড্যাম। এই রাম্ভি থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবাহী মংপুর বাড়িতে যাওয়া যায়। এটাকে বলা হয় লো ড্যাম। এরপর লোহাপুল পেরিয়ে পড়ল কালিঝোরা ড্যাম। এই বাঁধে রয়েছে সাতটা স্লুইসগেট।

সুন্দরী তিস্তা
কালিঝোরা পেরিয়ে সেবকের কাছে দূরে এক ঝলক দেখা দিল করোনেশন ব্রীজ। ব্রীজের আর্চটা নজরকাড়া। কিন্তু ছবি তোলার সুযোগ হয়নি।রাজা পঞ্চম জর্জ ও রাণীর স্মৃতি রক্ষার জন্য এই ব্রীজটা তৈরি হয়েছিল। এই ব্রীজের অন্য নাম সেবক ব্রীজ। সেবকে অবস্থিত বলে এ নাম। একটু বাদেই আমরা সেবক ব্রীজের কাছে পৌঁছে গেলাম। করোনেশন ব্রীজ বাম দিকে রেখে হাইওয়ে ধরে এগোতে লাগলাম।

করোনেশন ব্রীজ
সেবক পেরোতেই ধীরে ধীরে দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে থাকল। পাহাড়ি পথ নীচু হয়ে নেমে চলেছে সমতলের দিকে। যত এগিয়ে চলেছি সুউচ্চ কঠিন পর্বতও উচ্চতা কমার সাথে ধীরে ধীরে তার রুক্ষতা ছেড়ে শ্যামল হচ্ছে এবং তাপমাত্রাও বেড়ে চলেছে। মহানন্দা ফরেস্টের মধ্য দিয়ে গিয়ে শিলিগুড়ি শহর পেরিয়ে যখন আমরা নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছালাম তখন দুপুর পেরিয়ে গেছে। বিকাল তিনটে থেকে স্টেশনের ফুটব্রীজে সকলে মিলে বসে রইলাম ট্রেনের অপেক্ষায়!

সেবক
» প্রয়োজনীয় তথ্য

সোম ও মঙ্গলবার বাদ দিয়ে সপ্তাহের বাকি পাঁচ দিনই নাথুলা যাত্রার অনুমতি মেলে। ছাঙ্গু-বাবামন্দির যেতে হলেও অনুমতিপত্র প্রয়োজন। গ্যাংটক পৌঁছেই দু’কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি ও এক কপি ভোটার পরিচয়পত্রের ফোটোকপি দিয়ে আবেদন করলে সহজেই মেলে এই অনুমতিপত্র। গ্যাংটকে পৌঁছে হোটেলে জমা দিলে তারাও আনিয়ে নিতে পারে অনুমতিপত্র। গ্যাংটক থেকে ছাঙ্গু-নাথুলা-বাবামন্দির সফরের গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। স্করপিও, ইনোভার মতো বড়ো গাড়ি ছাড়া সেখানে ছোট গাড়ি যাওয়ার অনুমতি নেই। সিকিম রাজ্যের সকল জায়গায় প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ।


© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল
Arabinda Pal
0 Comments
Share This Post :

You Might Also Like

No comments:

Post a Comment

[name=Arabinda Pal] [img=https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEia50rmuKEAcbGUbQKvAbzUmdviiIhm-LeVlsEEdFx_xtGfyvx8O02yFVuJemgswzSA8PoMcN-XW0AcinKr9iq28lHK43Z4TFFyL7pJyGGxLNx9LGn0cLvPz0lUJzNrWBo9n_NyxGLjDII/h120/IMG_2788.jpg] [description=পর্যটক হিসাবে নয়, একজন ভ্রমণকারী হিসাবে বেড়ানোটা আমার কাছে একটা নেশা এবং ফটোগ্রাফিতেও আমার ভীষণ শখ। তাই একজন ভ্রমণকারী হিসাবে আমার এই ব্লগে নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে লেখা ও ছবিগুলো যদি আপনাদের ভালো লাগে তাহলে অবশ্যই আপনাদের মতামত কমেন্টসের মাধ্যমে জানাতে ভুলবেন না।] (facebook=https://www.facebook.com/groups/2071066419824586/user/100002484831922) (twitter=Twitter Profile Url) (instagram=https://www.instagram.com/arabindapal2020/) (bloglovin=Blogvin Profile Url) (pinterest=https://www.pinterest.com/arabindapalbrb/) (tumblr=Tumblr Profile Url)

Follow @Arabinda Pal