হুগলী জেলার পান্ডুয়া এক ঐতিহাসিক শহর। প্রাচীন ঐতহ্যমন্ডিত এই শহরটিতে ইতিহাসের ছোঁয়া পেতে এখনও বহু পর্যটক এসে থাকেন। মালদহ জেলাতেও পান্ডুয়া নামে আর একটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান আছে। তাই আলাদা করে চেনার জন্য হুগলীর এই পান্ডুয়াকে অনেকে 'ছোট পান্ডুয়া'-ও বলে থাকেন। এখানকার অন্যতম দর্শনীয় স্থান 'পান্ডুয়া মিনার' বা 'শাহ সুফির মিনার'। এটা পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। পান্ডুয়া শহরের জি টি রোডের গা-ঘেঁষে এক বিশাল মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এই সুউচ্চ মিনারটি, তার ঠিক উল্টোদিকে একটু দূরে রয়েছে প্রাচীন বড়ি মসজিদের ভগ্নাবশেষ যা এখনও অতীতের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। মিনারের ঠিক বিপরীতেই জি.টি. রোডের ধারে রয়েছে হজরত শাহ সুফি সুলতানের মাজার।
| 'বড়ি মসজিদ' বা ‘বাইশ দরওয়াজা’ মসজিদ |
পান্ডুয়ার মিনারকে ছবিতে অনেক দেখেছি, নিজের চোখে কখনো দেখা হয়নি। তাই ঠিক করলাম এবার আমি ছবিতে নয় নিজের চোখে দেখে আসবো। ছুটি কাটাতে কয়েকদিনের জন্য নৈহাটীতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম। অতএব সুযোগ পেতেই ক্যামেরা প্যাক করে ব্যাগ পিঠে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পান্ডুয়ার উদ্দেশ্যে। নৈহাটী থেকে ব্যান্ডেল। ব্যান্ডেল থেকে বর্ধমান লোকাল ধরে পান্ডুয়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নামলাম। স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে অটোস্ট্যান্ডে এসে একটা অটোয় চেপে বসলাম। সাত আট মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম মিনারের কাছে। অটোওয়ালার কাছে জায়গাটার নাম জেনেছিলাম মেলাতলা। মেলাতলায় অটো থেকে নেমেই দেখি একপাশে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এক বিশাল মাঠ। গরু ছাগলের অবাধ চারণভূমি। সেই ফাঁকা মাঠের মধ্যে একাকী দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল গগনচুম্বী মিনার। মিনারের উল্টোদিকে চোখ ফেরাতেই নজরে পড়লো এক প্রাচীন মসজিদের ভগ্নাবশেষ যা 'বড়ি মসজিদ' বা ‘বাইশ দরওয়াজা’ মসজিদ নামে পরিচিত। রাস্তার অন্যপাশে শাহ সুফি সুলতানের মাজার। অটোর ভাড়া মিটিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিনারের কাছে এগিয়ে গেলাম।
| চলে এলাম মিনারের কাছে |
এক বিশাল ময়দান। সেই ময়দানের এক পাশে একটি শতাব্দী প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসস্তূপ। এই ধ্বংসস্তূপটি 'বড়ি মসজিদ' বা ‘বাইশ দরওয়াজা’ মসজিদের। মসজিদটি 'বাইশ-দরওয়াজা' অর্থাৎ বাইশটি ইটের খিলান দরজা দিয়ে তৈরি ছিল তাই এটি ‘বাইশ-দরজা’ নামে পরিচিত। এখনও খিলান দরজা সহ চারপাশের ইটের দেওয়ালগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে।
| টেরাকোটা অলঙ্করণ সমৃদ্ধ মিহরাব |
মসজিদের ভগ্নাবশেষের কাছে গিয়ে দেখি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার দেওয়া একটা বোর্ড। বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী এই বড়ি মসজিদটি আনুমানিক খ্রিস্টীয় ১৩০০ শতকে নির্মিত হয়েছিল। ৭০.৪ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১২.৮০ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট এই মসজিদটিতে তিনটি বারান্দা ছিল। নামে বাইশ-দরজা হলেও এই মসজিদের দরজা আসলে চব্বিশটি। একুশটি সামনের দিকে আর দুপাশে বাকি তিনটি। একটি বাদে দুপাশের দুটো দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত এই কারণেই মসজিদটির নাম রাখা হয়েছিল বাইশ-দরজা মসজিদ। ছিল ৬৩টি ছোট ছোট গম্বুজ। এখন একটাও গম্বুজ নেই। খিলানের উপর নির্মিত গম্বুজের ছাদ এখন পুরোপুরি উধাও হয়ে গিয়েছে। ভগ্নাবশেষ দেখেই বোঝা যায়, এই বাইশ দরওয়াজা যখন অক্ষত ছিল তখন এটি যে কি অসাধারণ স্থাপত্য ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়।
| মসজিদের ছাদ পুরোপুরি উধাও |
অতীতে পান্ডুয়া 'পুন্ডুনগর' বা 'পান্ডুনগর' নামে পরিচিত ছিল। হুগলির এই অঞ্চল ছিল তখন হিন্দু রাজা পান্ডুর অধীনে। ঐতিহাসিক মতে, শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ নামান্তরে শাহ সুফিউদ্দিন হিন্দু রাজা পান্ডুকে তুমুল যুদ্ধে পরাজিত করে হিন্দু রাজ্য পান্ডুনগর দখল করে নেন। শাহ সুফিউদ্দীন পান্ডুয়ার শাসনভার গ্রহণের পর তিনি এখানকার পান্ডু রাজার তৈরি প্রাচীন মন্দিরটি ধ্বংস করেন এবং সেই মন্দিরের উপকরণ দিয়ে এই মসজিদটি গড়ে তোলেন।
| উঁচু ভিত্তিবেদী |
মসজিদের গায়ে হিন্দু মন্দিরের স্থাপত্যের বেশ কিছু চিহ্ন লক্ষ্য করা গেলো। বিশেষভাবে যা চোখে পড়লো তা হলো নকশাযুক্ত ছোট ছোট ইটের তৈরি খিলান ও ব্যাসাল্ট পাথরের তৈরী বেশ কিছু পিলার। মসজিদের ভিতরে কালো ব্যাসল্ট পাথরের তৈরি সিংহাসনের ন্যায় একটি বেদী লক্ষ্য করা যায়। ঐ বেদি দেখে ঐতিহাসিকগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে এটি পূর্ব্বে কোনো হিন্দু মন্দির ছিল এবং ঐ বেদীতে কোনো বিগ্রহ-মূর্তি থাকতো। ব্যাসল্ট পাথরের তৈরি এই বেদীটি পর্যটকদের কাছে একটি বিশেষ আকর্ষণ। মন্দিরের চারদিকে বহু মিনার বা স্তম্ভ ছিল, অনুমান করা হয় সেকালে হিন্দু রাজারা প্রাতঃকালে উঁচুস্থান থেকে সূর্য্যদেবকে দর্শন করার জন্য এগুলো তৈরি করেছিলেন। শাহ সুফিউদ্দিন ছোট ছোট স্তম্ভগুলো ধ্বংস করে কেবল বড় স্তম্ভটিকে নামাজের আজানের জন্য রেখে দিয়েছিলেন।
| ব্যাসাল্ট পাথরের তৈরি সিংহাসন |
মসজিদের সমস্ত অংশ জুড়ে রয়েছে কারুকার্য করা প্রচুর কালো ব্যাসল্ট পাথরের স্তম্ভ, কিছু দাঁড়িয়ে আছে আবার কিছু কিছু মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে, সেই সব কালো ব্যাসল্ট পাথরের স্তম্ভে সূক্ষ্ম নকশা করা ফুল আর লতাপাতার কাজ দেখে অতীতে এখানে প্রাচীন কোনো দেবদেবীর মন্দির ছিল বলে অনুমান করলে ভুল হবে না। বর্তমানে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার উদ্যোগে এই মাঠের চারদিকে সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে, তবে প্রবেশ অবাধ। সমাজবিরোধীদের আনাগোনা রয়েছে বলে অনুমানিত হলো।
| সূক্ষ্ম কারুকার্য করা কালো ব্যাসল্ট পাথরের স্তম্ভ |
বড়ি মসজিদের উল্টোদিকে রয়েছে বিশাল গগনচুম্বী মিনার যা শাহ সুফির মিনার নামে পরিচিত। পান্ডুয়া-বিজয়ী শাহ সুফিউদ্দিন মন্দিরের সর্বোচ্চ উঁচু এই মিনারটি বিজয় স্মারক হিসাবে রেখে দেন। পরে এই মিনারকে পাশের বড়ি মসজিদের আজানের জন্য ব্যবহার করা হতো। এটা পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। পূর্ব্বে এই মিনারের উচ্চতা ছিল ১৩৬ ফুট। ভূমিকম্পে উপরের অংশ ভেঙে যাওয়ায় ফলে এই মিনারের উচ্চতা এখন ১২৫ ফুটে দাঁড়িয়েছে। মিনারটি গোলাকার এবং পাঁচ তলায় বিভক্ত, নিচের তিনটি তলা নকশা করা। মিনারের প্রবেশপথ পশ্চিমদিকে ও মসজিদমুখী। প্রবেশের মুখে দরজার দুইধারে দেখা গেলো হিন্দু মন্দিরের ন্যায় কারুকার্য খচিত স্তম্ভ রয়েছে। মিনারের উপরে সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছানো যায়। ওঠার জন্য রয়েছে ১৬১ টি সিঁড়ি। দরজায় এখন তালা লাগানো। পর্যটকদের জন্য উপরে ওঠা বন্ধ। তাই মিনারের উপরে ওঠা হল না।
| পান্ডুয়া মিনার |
এখানে আসার সময়ে অটোওয়ালা আমাকে হজরত শাহ সুফি সুলতানের মাজারের কথা বলেছিলো, তাই একবার জায়গাটা ঘুরে দেখার আগ্রহ হলো। শাহ সুফি সুলতান এই অঞ্চলের মুসলমানদের ধর্মযাজক এবং 'ফকির' হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। মিনার চত্বর থেকে বেরিয়ে রাস্তার উল্টোদিকে হজরত শাহ সুফি সুলতানের মাজারে ঢুকলাম। এটা একটা সমাধি সৌধ এবং শাহ সুফিউদ্দীনের আস্তানা নামে পরিচিত। মাজারে ঢুকতে গিয়ে দেখি দরজার উপরে লেখা রয়েছে 'মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ'। কারণ হিসেবে জানা যায়, শাহ সুফি সুলতান অবিবাহিত ছিলেন সেই জন্য মাজারের ভিতরে তাঁর সমাধির কাছে মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ। মহিলারা বাইরে থেকে প্রার্থণা করে চলে যায়। কিছুক্ষন এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে শাহ সুফিউদ্দীনের আস্তানা থেকে বেরিয়ে জি.টি. রোডে এসে অটোয় চেপে সোজা চলে এলাম স্টেশনে। পান্ডুয়া দর্শন শেষ, বাড়ি ফেরার জন্য ট্রেনের অপেক্ষায় বসে রইলাম।
| হজরত শাহ সুফি সুলতানের মাজার |
» পথ নির্দেশিকাহাওড়া থেকে মেইন লাইনের বর্ধমান কিংবা মেমারি লোকাল ট্রেন ধরে পান্ডুয়া স্টেশনে নামতে হবে। তারপর স্টেশন থেকে থেকে টোটো ধরে মেলাতলা বা মিনারে যেতে হবে। সেখানে রাস্তার একপাশে রয়েছে শাহ সুফি সুলতানের মাজার আর রাস্তার অন্যপাশে ফাঁকা মাঠের মধ্যে দেখতে পাওয়া যাবে 'পান্ডুয়া মিনার' ও 'বড়ি মসজিদ' বা ‘বাইশ দরওয়াজা’ মসজিদের ভগ্নাবশেষ। টোটোতে ভাড়া ১০ টাকা এবং আনুমানিক সময় লাগবে ১০ মিনিট। সড়কপথে যেতে হলে বালি পেরিয়ে ডানকুনি থেকে পুরোনো দিল্লী রোড ধরে মগরা। খন্নান পেরিয়ে পাণ্ডুয়া চৌমাথার আগে ডানদিকে দেখতে পাওয়া যাবে পাণ্ডুয়া মিনার ও বড়ি মসজিদ। মসজিদ আর মিনার দুটোই পাশাপাশি, একদম হাইওয়ের উপর। মিনারের চূড়া অনেক আগে থেকেই নজরে পড়বে।
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ- 'হুগলি জেলার ইতিহাস' - সুধীর কুমার মিত্র)
দারুন তথ্য
ReplyDelete