নাড়াজোল রাজবাড়ীর নামটি ভ্রমণপিপাসু ইতিহাস-প্রেমীদের কাছে সুপরিচিত। মেদিনীপুর শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ঘাটালের দাসপুরের কাছে ছোট্ট একটি জনপদ নাড়াজোল। নাড়াজোল রাজবাড়ী বহির্গড় ও অন্তর্গড় নামে দুই ভাগে বিভক্ত। রাজবাড়ীকে কেন্দ্র করে অন্তর্গড়ের চারিদিক পরিখা দিয়ে ঘেরা। বহির্গড়ে নিম্নশ্রেণীর বহু হিন্দু ও মুসলমানেরা বসবাস করতো যারা সেকালে বর্গী আক্রমনের হাত থেকে রাজভাবনকে বাঁচানোর জন্য নিযুক্ত ছিল। অন্তর্গড়ের মধ্যে সুন্দর কারুকার্য বিশিষ্ট কয়েকটি দোতালা ও তিনতলা ঘর রয়েছে। অন্তর্গড়ে রাজবাড়ীতে দেবালয়, পুজোর দালান, বৈঠকখানা, তোষাখানা, সদরমহল, অন্দরমহল প্রভৃতি বিভিন্ন খন্ডে ভাগ করা আছে। বর্ধমান নিবাসী উদয়নারায়ণ ঘোষ এই নাড়াজোল রাজবাড়ীর প্রতিষ্ঠাতা। কথিত আছে তিনি দেবী জয়দূর্গার স্বপ্নাদেশ পেয়ে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হয়ে এই নাড়াজোলে জমিদারি পত্তন করেন এবং জয়দূর্গার অষ্টধাতুর মূর্তিটি উদ্ধার করে মায়ের পুজোর জন্য রাজবাড়ীতে একটি মন্দির নির্মাণ করেন। ইতিহাসের বহু ঘটনার সাক্ষী নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে এই নাড়াজোল রাজবাড়ী। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পদধুলি পড়েছিল এই রাজবাড়ীতে। নাড়াজোল রাজবাড়ী আজ ধ্বংসের পথে শুধু সাক্ষী আছে ভগ্ন মন্দির, রাজবাড়ী, হাওয়ামাহল, গড় দুর্গ ও পরিখার খাত।
 |
| রাজবাড়ীর সম্মুখভাগ |
রাজবাড়ী দর্শনের আগে আমার প্রথম গন্তব্য ছিল লঙ্কাগড়। নাড়াজোল বাজারের মেন রাস্তার উপরে লঙ্কাগড়। লঙ্কাগড়ের মূল আকর্ষণীয় জায়গাটি হলো তৎকালীন নাড়াজোলের অধিপতি মোহনলাল খাঁন কর্তৃক নির্মিত 'জলহরি'। রাস্তার পাশে সারি সারি দোকানের ফাঁকফোকর দিয়ে বহুকষ্টে এদিক ওদিক ঘুরে উঁকি মেরে নজরে পড়লো জলহরি। একটি বিশাল সরোবরের মধ্যস্থলে কৃত্রিম দ্বীপের মাঝে নির্মিত একটি ছোট বর্গাকার আকৃতির প্রাসাদ হলো এই 'জলহরি'। এই সুন্দর ভবনটি রাজার গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ হিসাবে ব্যবহৃত হতো। সরোবরের পাড়ে ছিল রাজার সাজানো বাগান। আগাছায় ভরে যাওয়া জমিতে এখনো তার কিছু নমুনা রয়েছে। ১৯৮৮ খ্রীষ্টাব্দে এই সরোবরে সরকারি উদ্যোগে নৌকাবিহারের ব্যবস্থা শুরু হলেও পরবর্তীকালে নানা অসুবিধার কারণে সেটি বন্ধ হয়ে যায়।
 |
| লঙ্কাগড়ের জলহরি |
লঙ্কাগড়ের জলহরি দর্শনের পরে চললাম রাজবাড়ীর দিকে। যাওয়ার পথে রাস্তার একপাশে হঠাৎ নজরে পড়লো সাদা রঙের কারুকার্য করা ইটের তৈরি রথের ন্যায় আকৃতি বিশিষ্ট একটি কাঠামো। পঁচিশটি চূড়া বিশিষ্ট তিনতলা এই ইটের কাঠামোটি হলো রসমঞ্চ। এই রাসমঞ্চটি রাজা চুনীলাল খাঁন কর্তৃক নির্মিত একটি বিরল স্থাপত্যের উদাহরণ।
 |
| রসমঞ্চ |
রাসমঞ্চের উল্টোদিকে দেখলাম আটচালা স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত শ্রেণীবদ্ধ ছয়টি শিবালয়। মন্দিরের মাথায় লেখা ফলক দেখে জানা গেলো এই ছয়টি শিবালয় ১২৮৩ খ্রীষ্টাব্দে রাজা মোহনলালের পঞ্চম পুত্র ব্রজ কিশোরে খাঁন কর্তৃক নির্মিত।
 |
| ষষ্ঠ শিবালয় ও রাজসমাধি মন্দির |
রাসমঞ্চ ও শিবালয় গুলি ছাড়িয়ে সামান্য কিছুদূর গিয়ে একটি পরিখার পাশ দিয়ে লাল মোরামের রাস্তা ধরে চলে এলাম অন্তর্গড়ে। অন্তর্গড়ে ঢোকার মুখে দেখি 'নাড়াজোল রাজ কলেজ' নাম খোদাই করা একটি গেট। নাড়াজোল রাজার দান করা জমির উপরে ১৯৬৬ খ্রীষ্টাব্দে মন্দির সংলগ্ন রাজবাড়ীর কিছু অংশ জুড়ে এই নাড়াজোল রাজ কলেজ স্থাপিত হয়। আগে এই রাজবাড়ীতেই নাড়াজোল রাজ কলেজের নিয়মিত ক্লাস চলতো। এখন কলেজটি এখান থেকে অনত্র স্থানান্তরিত করা হয়েছে। কিন্তু নাড়াজোল রাজ কলেজের বেশ কিছু নিদর্শন এখনো রয়ে গিয়েছে।
 |
| অতীতের নাড়াজোল রাজ কলেজ |
সিংহদুয়ার পার হয়ে অন্তর্গড়ে প্রবেশ করে সামনেই দেখতে পেলাম আগাছায় ভরা পলেস্তারা খসা কালজীর্ণ এক নহবত খানা। নহবত খানা পেরিয়ে বাঁদিকে বিস্তৃত ময়দানের একপাশে দেখা গেলো কাছারিবাড়ি যা সেই সময় প্রতিদিন সরগরম থাকতো জমিদারি কাজকর্ম সংক্রান্ত ব্যস্ততায়। নানা লোকজনের আসা যাওয়ার মধ্যে দিয়ে সরগরম থাকতো এই কাছারিবাড়ি। পরবর্তীকালে নাড়াজোল রাজ কলেজ স্থাপিত হলে এই কাছারিবাড়িটি কলেজের ছাত্র সংসদ ও ক্যান্টিন হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখনো তার নমুনা দেখা গেলো।
 |
| কাছারিবাড়ি |
কাছারিবাড়ির ডানদিকে রয়েছে একটি ছোট্ট আটচালার মৃত্যুঞ্জয় শিব মন্দির ও তার পাশে ভেঙে পড়া পরিত্যক্ত একটি নাটমন্দির। মৃত্যুঞ্জয় শিব মন্দিরের দেওয়ালে সুন্দর টেরাকোটার কাজ করা। এই মন্দিরের যে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ হয় তা বোঝা গেলো। মন্দিরের খিলানের ওপর পুরোনো পঙ্খের কাজ আজও রয়েছে। একটু দূরেই রয়েছে ভগ্নপ্রায় সরস্বতী দালান।
 |
| কাছারির মাঠ (পাশে মৃত্যুঞ্জয় শিবমন্দির ও দুর্গা উৎসবের নাটমন্দির) |
কাছারি মাঠ পেরিয়ে রাজবাড়ীতে ঢোকার ঠিক বাঁ হাতে একটি দরজা দিয়ে ঠাকুরবাড়ি চত্বরে প্রবেশ করলাম। প্রথমেই নজরে পড়লো নবরত্ন গোবিন্দজীর মন্দিরটি। এই মন্দিরেই জয়দুর্গা মূর্তি নিত্যপূজিত হন। কারণ অন্দরমহলে পুরনো জয়দুর্গা মন্দির আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। এই মন্দিরের দরজার ওপরে, দেওয়ালে ও কার্নিশের নীচে কিছু পৌরাণিক দেব-দেবীর মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। মন্দিরটির বয়স প্রায় আড়াইশো বছর। তার ঠিক পাশেই রয়েছে রাজপরিবারের কুলদেবতা সীতারাম জিউর মন্দির।
 |
| জয়দুর্গা মন্দির |
ঠাকুরবাড়ি চত্বরের আরেকটি জিনিস নজর কাড়লো সেটি নাটমন্দির। লোহার কারুকাজ করা কাঠামোতে রঙিন বেলজিয়াম গ্লাসের শিল্পকুশলতায় তৈরি এই নাটমন্দিরের গঠনরীতির সঙ্গে শান্তিনিকেতনের উপাসনা গৃহের অদ্ভুত সাদৃশ্য পাওয়া যায়। কথিত আছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ছোট ছিলেন তখন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার তাঁকে নিয়ে এই নাড়াজোল আসেন এবং বেলজিয়াম কাঁচ সমৃদ্ধ এই নাটমন্দির তাঁকে এতোটাই প্রভাবিত করে যে তিনি এর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই নাটমন্দিরের অনুকরণে শান্তিনিকেতনে ছাতিমতলার উপাসনা গৃহটি তৈরি করেছিলেন।
 |
| নাটমন্দির ও সীতারাম জিউর মন্দির |
ঠাকুরবাড়ি চত্বর পেরিয়ে পৌঁছালাম মূল রাজবাড়ীতে। প্রায় ছ'শ বছরের অতীত নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই রাজবাড়ী। সেই আভিজাত্যের রাজ আড়ম্বর আজ আর নেই। রাজবাড়ীর অন্দরমহলে ঢুকতেই একটা আলাদা গন্ধ অনুভূত হলো। অনাদরে আর অবহেলায় হারিয়ে যাওয়া বটগুল্মে ঢাকা বিধ্বস্ত প্রাসাদোপম তিনতলা প্রাচীন রাজমহল কোনক্রমে দাঁড়িয়ে আছে শুধুই স্মৃতি হিসেবে। রাজবাড়ীটি আজ কালের গর্ভে সমাহিত... দেওয়ালে ধরেছে ফাটল, খসে পড়েছে চুনসুরকির পলেস্তরা কোথাও আবার ধ্বসে পড়েছে কড়িবরগা দেওয়া ছাদ। রাজবাড়ীর অন্দরমহলে আগাছায় ঢাকা পরিতক্ত্য অবস্থায় নাটমন্দিরের অনুরূপ আরো একটি কাঠামো দেখতে পেলাম।এই কাঠামোটি রাজবাড়ীর দুর্গামন্দিরের দালান।
 |
| দুর্গামন্দিরের দালান ও ভোগঘর |
ধুলোবালি ও আগাছার জঙ্গল ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলাম। সংকীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দোতালার বারান্দা থেকে চারদিক একনজরে দেখে নিলাম। রাজবাড়ীর দেওয়ালে বেশকিছু ঠাকুর দেবতার টেরাকোটার ফলক লাগানো দেখলাম। এই রাজবাড়ীতেই আগে রাজ কলেজের ক্লাস চলতো। এখনো রাজবাড়ীর দেওয়ালে বেশ কিছু শ্রেণীকক্ষের নেমপ্লেট নজরে পড়লো।
 |
| রাজবাড়ীর অন্দরমহল |
পুরো রাজবাড়ী পরিখাবেষ্টিত। অন্তর্গড় থেকে বেরিয়ে রাস্তার উল্টোদিকে একটি খিলানযুক্ত তোরণদ্বার দেখতে পেলাম। এই তোরণদ্বার পেরিয়ে সামনে খোলা মাঠের মাঝে দেখতে পেলাম এক প্রাচীন মহল। রাজকীয় ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই মহলটি। এটি রাজা মোহনলাল খাঁনের একটি স্মরণীয় কীর্তি হাওয়া মহল বা নৃত্যশালা। স্থানীয় ভাবে এটি চাপা বাগান নামে পরিচিত। তৎকালীন জমিদার পরিবার অবসরকালীন প্রমোদভবন হিসেবে এটিকে ব্যবহার করতেন। হওয়া মহলের ঠিক পিছনেই রয়েছে একটি সুসজ্জিত ফোয়ারা ও দীঘি। দীঘির দু'পাশে রয়েছে দুটি শিব মন্দির যা এখন লতা-গুল্মের আগাছায় ঢাকা।
 |
| হাওয়া মহলের তোরণদ্বার |
মীরাক্কেল খ্যাত কৃষ্ণেন্দু চ্যাটার্জীর পরিচালনায় ও মীর অভিনীত শর্ট ফিল্ম ‘সত্যদার কোচিং’ এই নাড়াজোল রাজবাড়ীতে শ্যুটিং হয়েছে। সম্প্রতি এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর "জীবিত ও মৃত" এটির শ্যুটিং হয়েছে। অনাদরে আর অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় সাড়ে চারশো বছরেরও বেশি পুরোনো এই নাড়াজোল রাজবাড়ীটি ও রাজবাড়ী সংলগ্ন সমস্ত ঐতিহাসিক নির্মাণসমূহ। আশার কথা এই ভবনটি বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন কর্তৃক হেরিটেজ ভবন হিসাবে ঘোষিত হয়েছে, এবং সংস্কারের কাজ চলছে। আশা করি অচিরেই এই রাজবাড়ী ও তার সংলগ্ন স্থানটি বাংলার পর্যটনের তালিকায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে উঠবে।
 |
| জীর্ণ হওয়া মহলের সংস্কার |
» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ- 'মেদিনীপুরের ইতিহাস' - যোগেশচন্দ্র বসু, 'নাড়াজোল রাজবাড়ী' - সৌমেন জানা)
No comments:
Post a Comment