Theme Layout

Boxed or Wide or Framed

Theme Translation

Display Featured Slider

Yes

Featured Slider Styles

[Centred][caption]

Display Grid Slider

No

Grid Slider Styles

[style5][caption]

Display Trending Posts

Display Author Bio

Yes

Display Instagram Footer

Yes

Dark or Light Style

পেলিং-এ একটি দিন


র্তমানে বাঙালির কাছে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে পশ্চিম সিকিমের শান্ত ও নির্জন ছোট্ট জনপদ পেলিং। গত বছর জুলাইয়ে অফিসে ছুটি নিয়ে কয়েকদিনের জন্য ঘুরতে গিয়েছিলাম দার্জিলিং ও তার সাথে গ্যাংটক। দার্জিলিং এবং গ্যাংটক দু'জায়গায় আগে থেকেই হোটেল বুকিং করা ছিল। ভাবলাম দার্জিলিং থেকে গ্যাংটক যাওয়ার পথে একবার পেলিং দর্শন করলে কেমন হয়। হুজুগে বাঙালি ভাবনার সাথে সাথেই যাওয়ার প্রস্তুতি সেরে ফেললাম। সেদিন রাতেই দার্জিলিং-এর ম্যালে গিয়ে "এডভেঞ্চার দার্জিলিং" নামে একটি ট্যুর এজেন্সির অফিসে গিয়ে পেলিংয়ের হোটেল ও সাইট সিইং ট্যুরের গাড়ি বুক করে ফেললাম। পরেরদিন সকালে যথাসময়ে আমাদের হোটেলের সামনে একটি বোলেরো গাড়ি এসে হাজির। মালপত্র গাড়িতে তুলে হোটেলের বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

চলেছি পেলিং-এর উদ্দেশ্যে
—গন্তব্য পেলিং। পাশে বসা সুদর্শন নেপালি যুবক গাড়ির ড্রাইভার ছেলেটি কমবয়সি ও খুব মিশুকে, গাড়ির ভেতরে গল্প করতে করতে চললাম। যাওয়ার পথে রাস্তার দুপাশে পাহাড়ের ঢালে সবুজের ঢেউ জানান দেয় চা বাগানের মধ্যে দিয়ে চলেছি। দিগন্ত বিস্তৃত চা বাগান দেখে মনে হবে যেন পাহাড়ের ঢালে সবুজ গালিচা বিছানো রয়েছে। রাস্তার ধারে পাহাড়ের কোলে ছোট ছোট জনপদ পার করে ছুটে চলছে আমাদের গাড়ী। পাহাড়ের ফাঁকে-ফাঁকে গড়ে ওঠা এই গ্রাম্য প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য সত্যিই মনোরম।

পাহাড়ের ঢালে চা বাগান
প্রায় ঘন্টা খানেক পরে একটি ছোট্ট গ্রামে এসে গাড়ি থামাল ড্রাইভার। গ্রাম বলতে দু'চারটে বাড়ি। অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। জনমানবহীন এই জনপদে যে কয়জন মানুষের দেখা মেলে তারাও প্রকৃতির মতো। ছোট্ট একটা কাঠের বাড়ির সুসজ্জিত ঘরে আমাদের নিয়ে গেল। ভেতরে ঢুকতেই দেখি চেয়ার টেবিল পাতা, সেখানে আমাদের বসতে বললো। এটা তার বোনের বাড়ি। ওখানে খানিক সময় কাটালাম।

আমাদের গাড়ির ড্রাইভারের বোনের বাড়ি
পাহাড়ি গ্রাম মানেই অপার সবুজের হাতছানি আর শান্তির ডাক। পাহাড়ের গায়ে গায়ে ছোট ছোট বাড়ি, সবজি ক্ষেত। বিবরণের ভাষা নেই, একটা অনুভূতি। চোখের সামনে সবুজ পাহাড় আর নয়নাভিরাম পার্বত্য অঞ্চলের দৃশ্য দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না, ফটোসেশনের আদর্শ স্থান। ফটোগ্রাফির শখেই ছবি তুলতে লাগলাম ঘুরে ঘুরে। একটা শান্ত, নিরিবিলি পাহাড়ি গ্রাম। সেই পরিবেশে তারা কিভাবে জীবনযাপন করে তা কিছুটা আন্দাজ করলাম। কিছুক্ষণ পরে আমাদের জন্য এলো গরম চা, সঙ্গে জলখাবার। পেটপূর্তির পরে সকলে মিলে আবার গাড়িতে উঠে বসলাম।

শান্ত, নিরিবিলি পাহাড়ি গ্রাম
আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে এগিয়ে চলেছে আমাদের গাড়ি। আমাদের কোনো তাড়া ছিল না। পথে যেতে যেতে যেখানে থামতে ইচ্ছে করছিল, আমরা সেখানে থেমেছি। ক্যামেরায় ছবিটবিও তুলেছি। কখনো গাড়ি থেকে নেমেছি, পথের পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মেঘের রাজ্যের আহ্বান অনুভব করেছি। মাঝে মাঝে বৃষ্টি এসে আমাদের পরশ বুলিয়ে দিয়েছে।

ড্রাইভারের সাথে আমরা দু'জন
আমাদের গাড়ি আবার আগের মতো পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে চললো। বেশ কিছুটা পাহাড়ি পথ পাড়ি দেওয়ার পর দূরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম পাহাড়ঘেরা মনোরম এক লেক আর তার মাঝে মধ্যমণি হয়ে নির্মীয়মান একটি বিশালাকার শিবমূর্তি ও ঠিক তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট রঙ্গিত নদী। মনোরম প্রাকৃতিক সেই দৃশ্য যে কোনো পর্যটককেই আকৃষ্ট করবে। স্থানটির নাম জামুনি, গাড়ির ড্রাইভারের কাছে সেটা জেনে নিলাম। জামুনির কাছে এসে দেখলাম পার্কটি সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি, এখনো কাজ চলছে। তাই নেমে দেখার ইচ্ছে হলো না। দূর থেকেই এক নজরে দেখে নিলাম সেই বিশালাকার অসম্পূর্ণ শিবমূর্তি ও তার সাথে চোখ ধাঁধানো মোগল গার্ডেন, কৃত্রিম লেক এবং স্বপ্নের বাড়ির মতো তৈরি কয়েকটি কুটির। ব্রিজের উপর থেকে গল্পের মত সেই সুন্দর দৃশ্য দেখে ক্যামেরা বন্দি করলাম। নদীর উপরে তৈরি ব্রীজ পেরোনোর সময়ে ড্রাইভার জানালো ওখানে "Barfi!” সিনেমার শ্যুটিং হয়েছিল। জামুনি এমন একটি জায়গায় অবস্থিত, যেখান থেকে অনায়াসে সিকিম যাওয়া যায় এবং সিকিম থেকে পর্যটকরা জামুনিতে ঘুরতে আসতে পারেন। জামুনিকে পাশ কাটিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম...

জামুনি লেক
গাড়ি এবার চড়াই উঠতে শুরু করলে। খানিকটা গিয়ে রামাম ব্রীজ পেরিয়ে সিকিমে প্রবেশ করলাম। পাহাড়ি জঙ্গল, নাম না জানা ঝর্ণা ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রাম দেখতে দেখতে আর শোভা উপভোগ করতে করতে এগোতে লাগলাম। এমনি করেই 'জোরথাং' পৌঁছলাম।

রামাম ব্রীজ
পাহাড়ের কোলে একটা মাঝারি শহর। আক্কর ব্রীজকে ডানদিকে রেখে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল নয়াবাজারের দিকে। জোরথাং ছাড়িয়ে একটু একটু উঠতে লাগলো, সঙ্গী এবার রঙ্গিত। বিশাল পাহাড়ের একপাশ দিয়ে চলেছে আমাদের গাড়ি অন্য দিকে গভীর খাদ নেমে গিয়েছে কয়েক হাজার ফুট নীচে বয়ে চলা রঙ্গিত নদী পর্যন্ত।

আক্কর ব্রীজ, জোরথাং
রঙ্গিত নদীর পাড়ে মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে দেওয়ালের মতো সবুজ পাহাড়, যেন সেখানেই পৃথিবীর শেষ! ও প্রান্তে অসীম শূন্যতা ছাড়া যেন কিছু নেই। মনে হয়, ওই সবুজ পাহাড়ি দেওয়াল টপকে যাওয়া কারও ক্ষমতা নেই। কিছু দূর পরে অবশ্য সেই দেওয়াল নেমে এসেছে নীচের গ্রামের কাছে। পাহাড়ের পর পাহাড় অতিক্রম করছি তার সাথে অপরূপ নৈসর্গিক এই সৌন্দর্যের দৃশ্য দু'চোখ ভরে উপভোগ করছি।

রঙ্গীত নদী
জোরথাং থেকে রাস্তার দুদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সুন্দর হলেও রাস্তা কিছু জায়গায় প্রচন্ড খারাপ। চলার পথে রাস্তায় আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা 'এডভেঞ্চার দার্জিলিং' ভ্রমণ সংস্থার পক্ষ থেকে অনুভব ভাইয়া এবং প্রীতি ম্যাম ঘন ঘন ফোন করে খোঁজ নিচ্ছেলেন। কিছুটা গিয়ে আর একটা ছোট শহর 'লেগশিপ'। লেগশিপের কাছে রঙ্গিত নদীর উপত্যকার অসাধারণ সৌন্দর্য মন ভুলিয়ে দেয়। এইখানেই রঙ্গিত নদীর ধারে রয়েছে কিরাতেশ্বর মহাদেবের মন্দির। এই মন্দিরটি মহাভারতের কাহিনীতেও উল্লেখ করা আছে। গাড়ি শহর লেগশিপ ছাড়িয়ে পাহাড় জঙ্গলের রাস্তা ধরল।

লেগশিপে জঙ্গলের রাস্তা
কিরাত উপজাতি নেপালের বহু প্রাচীন একটি শিকারী জাতি। মহাভারতেও এই কিরাত উপজাতির নাম পাওয়া যায়। শোনা যায়, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরুর আগে অর্জুন ভগবান শিবের কাছে যুদ্ধে সাফল্য অর্জনের জন্য এই কিরাতেশ্বর মন্দিরের এখানে প্রার্থনা করেছিলেন। অর্জুনের তপস্যা দেখে সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান শিব তাঁর সামনে কিরাত অর্থাৎ শিকারীর রূপ ধারণ করে বর্তমান মন্দিরের অবস্থানে উপস্থিত হয়ে অর্জুনকে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার আশীর্বাদ করেছিলেন। আর এইখানেই না কি অর্জুন কিরাতেশ্বর মহাদেব বা শিবের কাছ থেকে পশুপত অস্ত্র পান। সিকিমের অসংখ্য মন্দিরের মধ্যে এই মন্দিরটিকে রাজ্যের প্রাচীনতম মন্দির বলে মনে করা হয়। মন্দিরের ভেতরে যায়নি, গেটের বাইরে থেকেই ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে এগিয়ে চললাম।

কিরাতেশ্বর মন্দিরের গেট
লেগশিপ থেকে গাড়ি পাকদণ্ডী বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করল। একটা ব্রীজ পার হয়ে গাড়ি থামাল ড্রাইভার। রাস্তার একপাশে প্যাগোডার মতো দেখতে সুন্দর একটা ছোট টংঘর। সেখানে চা-বিস্কুট বিক্রি হচ্ছে। সামনে লেখা রয়েছে 'ডায়মন্ড ফাস্ট ফুড' নামের একটি সাইনবোর্ড। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার সোজা চলে গেলো টংঘরের ভেতরে। পরে নিজেই চা-বিস্কুট এনে আমাদের পরিবেশন করলো। দশ মিনিটের বিরতি, গরম চায়ে চুমুক দিয়ে একটু উষ্ণতার স্বাদ নিয়েই আবার চলা শুরু।

ছোট টংঘর
লেগশিপ ছাড়িয়ে সামান্য কিছু গিয়েই দেখি রাস্তার এক জায়গায় ধ্বস নেমেছে, পাহাড়ে ঘোরার অভিজ্ঞতা নেই তাই রাস্তায় সামান্য ধ্বস দেখে কিছুক্ষনের জন্যে হলেও মনটা বিষাদে ভরে গেলো। গাড়ির ড্রাইভার জানালো ভয়ের কোনো কারণ নেই এইরকম দৃশ্য প্রায় দেখা যায়! অবশেষে ড্রাইভারের আশ্বাসে আবার মনটা আগের মতো উৎফুল্ল হয়ে উঠলো।

রাস্তায় ধ্বস
উঁচু-নিচু এবড়ো-খেবড়ো সেই রাস্তার ওপর দিয়েই চললো আমাদের গাড়ি। একসময় গাছের পাতার আড়ালে দূরে দেখা গেলো সারি সারি ইট সিমেন্টের তৈরি বড় বড় বিল্ডিং! বুঝলাম গন্তব্যস্থলের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি। এদিক ওদিক করতে করতে আমরা 'পেলিং' এ প্রবেশ করলাম। তখনও পেলিংয়ের আকাশে মেঘ। মিডল পেলিংয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর ১২ টা পেরিয়ে গেল। সকাল সাড়ে ৭ টায় দার্জিলিং থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। আমাদের 'হোটেল হেভেন' এ রুম নেওয়া ছিল। হোটেলটা খুব ভালো জায়গায়। প্রায় পাঁচ ঘন্টা সফরের পর আমরা যখন হোটেলের দরজায় পৌঁছলাম তখন সকলে উদভ্রান্ত।

নজরে এলো পেলিং শহর
হোটেলের সামনেই চোখে পড়লো সাইট সিইং ট্যুরের জন্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে দুটি আল্টো। দার্জিলিং থেকেই ঠিক করেছিলাম পেলিংয়ে পৌঁছে যতটুকু সময় পাবো, সেই সময়ের মধ্যে আমরা আশেপাশের কিছু সাইট সিইং দেখে নেবো। পেলিং পৌঁছানোর পর যাতে গাড়ি খুঁজতে সময় নষ্ট না হয়, সেজন্য দার্জিলিং থেকেই গাড়ি বুক করে রেখেছিলাম। আমরা গাড়ি থেকে নামার আগেই দেখি অল্টোর ড্রাইভার এসে হাজির। তখন দুপুর পেরিয়ে গেছে। হাতে সময় কম। আকাশে মেঘ, যে কোনো সময়ে বৃষ্টি নামতে পারে। সাইট সিইং ট্যুরের জন্য তাড়াতাড়ি যেতে হবে। এতটা দীর্ঘপথ আসতে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তারপর দুপুরের খাবার খাওয়াও হয়নি। তারমধ্যেই তাড়াতাড়ি করে কোনোরকমে হোটেলে মালপত্র রেখে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়লাম।

পেলিং-এ প্রবেশ করলাম
আমাদের গন্তব্য সিংশোর ব্রীজ। পেলিং থেকে প্রায় ২১ কিলোমিটার পথ। আঁকা বাঁকা, এবড়ো খেবড়ো পাহাড়ি পথে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে। আমাদের দুপুরের খাওয়াটা যে হয়নি সেটা গাড়ির ড্রাইভারকে জানিয়ে দিলাম। খানিক বাদে ডেন্টাম ভ্যালি পার হয়ে আমাদের গাড়ি এসে গাড়ি এসে দাঁড়াল সিংশোর ব্রীজের সামনে। ব্রীজের পাশে একটি ট্যুরিস্ট ক্যাফেটেরিয়াতে আমরা খাবার খেতে ঢুকলাম। এখানে পৌঁছানোর আগে আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ফোন করে এখানে খাবারের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। 'ক্যাফেটেরিয়া' নামটা বেশ খাসা, কিন্তু খাবারের মান তার নামের সাথে অতি বেমানান। খিদের মাথায় কোনো রকমে পেটটা ভরে নিলাম।

ট্যুরিস্ট ক্যাফেটেরিয়া
খাওয়াদাওয়া সেরে সকলে পায়ে হেঁটে ঘুরতে গেলাম সিংশোর ব্রীজে। এশিয়ার মধ্যে এটি দ্বিতীয় উচ্চতম ঝুলন্ত সেতু। পশ্চিম সিকিমের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রগুলির মধ্যে একটি। পেলিংয়ে ভ্রমণ করতে গেলে এই জায়গাটিতে অবশ্যই যেতে হবে, তা না হলে ভ্রমণ সম্পূর্ণ হবে না। পাহাড় ঘেরা এক নৈসর্গিক পরিবেশ। অনেক নীচে খাদের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে একটি পাহাড়ি নদী। টিকিট কেটে উঠলাম ব্রীজে।

ব্রীজের দিকে এগিয়ে চললাম
সিংশোর ব্রীজের একদিকে ডেন্টাম ও আরেকদিকে নেপাল সীমান্তের কাছে পাহাড়ি গ্রাম উত্তরে। দুই দিকের পাহাড়কে জুড়ে রেখেছে এই ব্রীজ। আগে সিংশোর ব্রীজ পেরিয়েই রাস্তা ছিল উত্তরে যাবার। এই সেতুটির উপর দিয়ে গাড়ি চলাচল করত। এখন ব্রীজে গাড়ি চলাচল বন্ধ। এই জায়গাটি সেইসব পর্যটকদের জন্য আদর্শ যারা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং রোমাঞ্চ একসাথে উপভোগ করতে চান।

সিংশোর ব্রীজ
ঝুলন্ত ব্রীজের ওপর দিয়ে দুলতে দুলতে ওপারে চলেছি। চারপাশে উঁচু সবুজে ঘেরা পাহাড়, কোনটার মাথায় রোদের ছোঁয়া তো কারও মাথায় জমাট মেঘ ঘুরছে। একটি প্যানোরামিক ফ্রেমে সবকিছুই ধরা পড়ে এই ব্রীজের ওপর দাঁড়ালে। ব্রীজের মাঝামাঝি চলে এলাম। নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে পুঞ্চাচু নদী। অনেক নীচে থেকে সেই নদীর গর্জন ভেসে আসছে। ব্রীজের উপর থেকে নীচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। খাদ এতই গভীর যে, উপর থেকে পাথর ফেললে নাকি নিচের মাটি স্পর্শ করতে ৮ সেকেন্ড লাগে। ঘুরে ঘুরে ছবি তুলে বেশ কিছুক্ষণ কাটালাম এই ব্রীজে।

ব্রীজের ওপরে হেঁটে চলা নেই মানা
যে পথে সিংশোর ব্রীজে এলাম, সেই পথেই ফেরার পথে একটু এগিয়েই দেখতে পেলাম অনেকটা উঁচু থেকে একটা ঝর্ণা পাহাড়ের গা বেয়ে নীচে আছড়ে পড়ছে। পর্যটকরা সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ঐ সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করছে। ড্রাইভারকে গাড়িটা থামাতে বললাম। ঝর্ণাটার বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য নেই, আর পাঁচটা পাহাড়ী ঝর্ণার মতোই। তবে খুব সুন্দর উপভোগ্য দৃশ্য। মুক্ত বাতাসের ঝিরিঝিরি আর ঝর্ণার কলকল শব্দ মিলেমিশে এক অদ্ভুত জলতরঙ্গ সৃষ্টি করেছে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে এটা ছাঙ্গে ফলস্। ঝর্ণার জলে ছোটদের হৈ চৈ শুরু, এই অবস্থায়ই চলল কয়েক দফায় ক্লিকবাজি। এখানে খানিক সময় কাটিয়ে আবার চললাম। ধীরে ধীরে আকাশ কালো হয়ে আসতে লাগল। এবারে টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হল। অদ্ভুত সুন্দর সেই বৃষ্টি। সাইট সিইং ট্যুরের ইতি পড়লো এখানেই। আমরা ফিরতে শুরু করলাম পেলিংয়ে হোটেলের দিকে। সন্ধের খানিক আগে ক্লান্ত শরীরে আমাদের সাময়িক আশ্রয়ে ফিরে এলাম।

ছাঙ্গে ফলস্
হোটেলে ফিরে ঠান্ডা ও বৃষ্টিতে ভেজার কারণে মেয়ের এলো জ্বর। দিনের আলো ফিকে হয়ে এসেছে, কালো মেঘে ঢাকা চারিদিক। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি ঝরেই চলেছে। কাল পেলিং থেকে গ্যাংটক যাওয়ার কথা, একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হু হু করে পাহাড়ের দিক থেকে বয়ে আসছে ঠান্ডা হাওয়া। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশের মধ্যে দিয়ে যতই এগোচ্ছি ঠান্ডা বাড়ছে। আমাদের হোটেলের কাছেই ছিল একটা ট্রাভেল এজেন্সির অফিস। সেখান থেকেই গ্যাংটকের জন্য একটা বোলেরো গাড়ি ভাড়া করলাম। এদিকে মেয়ের ওষুধের প্রয়োজন, সেই চিন্তাটা আবার আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। হোটেলে ঢোকার আগে চারদিক ঘোরাঘুরি করে একটাও ফার্মেসি খুঁজে পেলাম না! সঙ্গে নিয়ে আসা জ্বরের প্রাথমিক ওষুধ দিয়ে এই অবস্থায় কোনোরকমে রাত্রিটা পার করলাম।

দিনের আলো কমে এলো
সন্ধায় চলছে এমন বৃষ্টি!! হচ্ছে তো হচ্ছেই। থামার কোন লক্ষণ নেই। হোটেল রুমে শুয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনছি। কি অদ্ভুত, সেই বৃষ্টির শব্দ। এসবের ফাঁকেই জানলার পাল্লা খুলে একবারে দেখার চেষ্টা করেছিলাম কাঞ্চনকে দেখা যায় কিনা। না, আকাশটা মেঘলা। কাঞ্চনজঙ্ঘার ওদিকটাতো আরও মেঘলা। মন ও মেঘলা হয়ে গেলো। শুনেছি এখানের বেশিরভাগ হোটেলের ঘরের জানালা খুলে বা ব্যালকনি থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। মনটা একটু দমে গেলেও আশা কিন্তু ভেসেই থাকল।

হোটেল হেভেন
বেশ ঠাণ্ডা, তারমধ্যেই নেমে এলাম খাওয়ার জন্য। এই হোটেলে খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। খাবারদাবারের স্বাদও খুব ভালো। এতটা দীর্ঘ যাত্রাপথ পেলিং আসতে। শরীরে ক্লান্তি ছিলই। খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়েই পড়লাম। মনের মধ্যে এই ইচ্ছেটাকে রেখে যে কাল সূর্যোদয়ের সময় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখবই। এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েছি যে ভোরে ঘুম ভাঙলে দেখি চারটে বাজে। একবার জানালার পর্দাটা সরিয়ে দেখে অবাক হয়ে গেলাম!! চোখের একদম সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা! কিন্তু কাঞ্চনের সেই দুর্লভ মায়াবী দৃশ্য দেখতে পেলাম না। তুষার শৃঙ্গের দিকটা মেঘে ঢাকা। ফলে যা দেখতে চাই, দেখে বিস্মিত হতে চাই, তা অধরাই থেকে গেল।

দূরে মায়াবী কাঞ্চন
সকালে দেখি আকাশ পরিষ্কার না হলেও বৃষ্টি কমেছে। একটু পরেই পেলিংকে বিদায় জানিয়ে গ্যাংটকের পথ ধরব। হাতে সময় কম। গাড়ি আসার আগেই স্নানটান সেরে নিয়ে, লাগেজ গুছিয়ে নিলাম। আগের দিন পেলিং শহরের কিছুই দেখতে পায়নি। তাই ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম।

বাস স্ট্যান্ড
লোয়ার, মিডল ও আপার এই তিন ভাগে বিভক্ত পেলিং। আমরা ছিলাম মিডল পেলিং-এ। রাস্তায় পায়চারি করছি। সেই একই মেঘলা আকাশ, মাঝেমধ্যে গাছ থেকে টুপটাপ জল পড়ছে গায়ে মাথায়। শহরটা বেশ ছিমছাম, নীরব। পাইন গাছ, মেঘের খেলা, আর কাঞ্চনজঙ্ঘা তো আছেই। সকাল ৯ টায় গাড়ি বলা আছে। একটু তাড়াতাড়ি করতে হবে। তাই, ক্যামেরায় কিছু ছবি তুলে হোটেলে ফিরে গেলাম।

পেলিং-এর রাস্তায়
সব গোছগাছ সেরে হোটেলের রিসেপশন বসে আছি, এখানে বসার ব্যাবস্থা আছে। একটু পরেই শুনতে পেলাম গাড়ির হর্ন। বাইরে বেরিয়ে দেখি আমাদের জন্য একটা বোলেরো গাড়ি এসে হাজির। হোটেলের পেমেন্ট মিটিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। অসম্পূর্ণ ভ্রমণ ও হতাশা সহ বৃষ্টি সঙ্গে নিয়ে পেলিং ছাড়লাম। ঠিক সকাল ৯ টায় গাড়ি আমাদের নিয়ে গ্যাংটকের দিকে রওনা দিল...

পেট্রল পাম্প
» প্রয়োজনীয় তথ্য

এখানে কোনো ওষুধের দোকান নেই, তাই প্রয়জনীয় ওষুধগুলো অবশ্যই সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে। খুব জরুরি দরকার পড়লে এখান থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে জেলা সদর 'গেইজিং' শহরে সব কিছু পাওয়া যাবে।

» থাকার ব্যবস্থা

পেলিং শহরটি মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা - আপার পেলিং, মিডিল পেলিং এবং লোয়ার পেলিং। পেলিং-এ রয়েছে বেশকিছু হোটেল এবং হোম-স্টে। হোটেলগুলিও আপার, মিডিল এবং লোয়ার এই রকম অবস্থানগতভাবে ভাগ করা আছে। আপার পেলিংয়ে হোটেলের ভাড়া বেশি, লোয়ারে কম। সকলের সুবিধার্থে এখানে সাধ্যের মধ্যে থাকার জন্য কয়েকটা হোটেলের নাম দিলাম যেমন - আপার পেলিংয়ে 'সিকিম ট্যুরিস্ট সেন্টার', 'হোটেল কাঞ্চনজঙ্ঘা'। মিডিল পেলিংয়ে 'হোটেল হেভেন', 'হোটেল চিমান্ডা ইন্টারন্যশানাল', 'হোটেল পেমাসোনাম' এবং লোয়ার পেলিংয়ে হোটেল 'সিলভার পিক', 'হোটেল ট্যুরিস্টো', 'হোটেল পেমাচেন'।

» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল
PELLING, SIKIM
Arabinda Pal
4 Comments
Share This Post :

You Might Also Like

4 comments:

  1. অসাধারণ বর্ণনা আর খুব সুন্দর ছবি।

    ReplyDelete
  2. বাহ্। খুব ভালো

    ReplyDelete
  3. বাহ্। খুব ভালো।

    ReplyDelete
  4. Khub bhalo lekha.chaliye jao Dada.Description er Sathe akta cost estimate dile aro valo hobe bole Amar mone hoy.

    ReplyDelete

[name=Arabinda Pal] [img=https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEia50rmuKEAcbGUbQKvAbzUmdviiIhm-LeVlsEEdFx_xtGfyvx8O02yFVuJemgswzSA8PoMcN-XW0AcinKr9iq28lHK43Z4TFFyL7pJyGGxLNx9LGn0cLvPz0lUJzNrWBo9n_NyxGLjDII/h120/IMG_2788.jpg] [description=পর্যটক হিসাবে নয়, একজন ভ্রমণকারী হিসাবে বেড়ানোটা আমার কাছে একটা নেশা এবং ফটোগ্রাফিতেও আমার ভীষণ শখ। তাই একজন ভ্রমণকারী হিসাবে আমার এই ব্লগে নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে লেখা ও ছবিগুলো যদি আপনাদের ভালো লাগে তাহলে অবশ্যই আপনাদের মতামত কমেন্টসের মাধ্যমে জানাতে ভুলবেন না।] (facebook=https://www.facebook.com/groups/2071066419824586/user/100002484831922) (twitter=Twitter Profile Url) (instagram=https://www.instagram.com/arabindapal2020/) (bloglovin=Blogvin Profile Url) (pinterest=https://www.pinterest.com/arabindapalbrb/) (tumblr=Tumblr Profile Url)

Follow @Arabinda Pal