'বিদেশ ভ্রমণ'-শব্দটির মধ্যেই বেশ রোমান্টিকতা আর রোমাঞ্চ লুকিয়ে থাকে। জীবনে প্রথম বিদেশ যাচ্ছি, তাও আবার জাপান। অনেকটা ভাগ্যবানও বটে। এক ধরনের শিহরণ অনুভব করছিলাম মনে মনে। জাপানের মাটিতে পা রাখব ভাবতেই কেমন লাগছিল। আনন্দে ভাসছি। কোলকাতা দিল্লি হয়ে জাপানের হানেডা এয়ারপোর্টে যেতে হবে। আর একটা দিন, তারপরেই ওই আকাশ বেয়ে পাড়ি দেওয়া এক অজানা দেশে, স্বপ্নের টানে। অনেক বছর, অনেক দশক পেরিয়ে হঠাৎ করেই গতবছর নভেম্বর মাসে জাপান যাওয়ার সুযোগ ও সৌভাগ্য হল। জাপান বলা যদিও ঠিক হবে না। ছুটির দিনগুলোতে কেবল টোকিও এবং তার আশপাশের কিছু জায়গাতেই আবদ্ধ ছিলো আমাদের পনেরো দিনের বেড়ানো।
কোলকাতা থেকে জাপানের সরাসরি কোনো ফ্লাইট নেই। আমাদের দিল্লি থেকে ফ্লাইট ধরতে হবে। পরের দিন সকাল সাড়ে দশটায় কোলকাতা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে দিল্লির ফ্লাইট। তাই ঠিক করলাম আগের রাতটা কোনো হোটেলে থেকে কাটাবো। সেইমতো হোটেলের ঘরও আগে থেকেই বুক করা ছিল। আমাদের বুকিং ছিল এয়ারপোর্টের খুব কাছে 'হলিডে ইন এক্সপ্রেস' হোটেলে। হোটেলের রুমগুলো নিঃসন্দেহে খুব সুন্দর।| 'হলিডে ইন এক্সপ্রেস' হোটেল |
পরের দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম, তারপর ব্রেকফাস্ট করার জন্য নিচে চলে গেলাম, এই হোটেলের সাথেই আছে রেস্টুরেন্ট। আমরা নিজেদের মতো খাবার পছন্দ করে ব্রেকফাস্টটা করে নিলাম। হোটেল থেকে চেক আউট করে সকাল আটটায় হোটেলের দেওয়া গাড়িতে চেপে এয়ারপোর্টে চলে এলাম। ফ্লাইট ঠিক সময়মতো সাড়ে দশটাতেই ছাড়লো। পাক্কা দু'ঘণ্টার জার্নি। পৌঁছে গেলাম দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে।
| দিল্লী এয়ারপোর্ট |
কোলকাতা থেকে আমরা দিল্লি এয়ারপোর্টের T1 টার্মিনালে এসে নেমেছিলাম। আমাদের জাপানের ফ্লাইট T3 টার্মিনালে। T1 থেকে T3 মোটামুটি ভালোই দূরত্ব। আলাদা আরেকটা বিল্ডিং। ডোমেস্টিক থেকে ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালে যাওয়ার ঝক্কি সেরে বোর্ডিং এরিয়াতে চেক ইন করতে গেলাম। যেহেতু আমাদের কানেক্টিং ফ্লাইট ছিল তাই আমাদের নতুন করে লাগেজ রি চেকিং করাতে হয়নি,হানেডার জন্য পরবর্তী ফ্লাইট রাত সাড়ে আটটায় কাজেই দুপুর দুটো থেকে প্রায় ঘন্টা চারেক আমাদের প্রায়োরিটি লাউঞ্জে বসে কাটাতে হলো। সিকিউরিটি চেক হয়ে গেলে গেট নম্বর দেখে অপেক্ষা করতে থাকলাম। ফ্লাইট এর পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে বোর্ডিং শুরু হলো। আমরা আবার আমাদের হ্যান্ড লাগেজ নিয়ে রওনা হলাম আমাদের নির্দিষ্ট গেটের দিকে। সীট দেখে নিয়ে বসে পড়লাম। কপাল বেশ ভালোই ছিল, উইন্ডো সীটই জুটেছে। দিল্লি থেকে হানেডা পৌঁছাতে ঘণ্টা সাতেক সময় লাগবে। মনের ভেতর এক অদ্ভুত ভাললাগার অনুভূতি কাজ করছিল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। প্লেন এখন মেঘের ওপর। আকাশে সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে।
| জাপান এয়ারলাইন্স |
কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর প্লেন নিচে নামতে শুরু করল। জাপানের ভূখণ্ড দেখতে পেলাম। এয়ারপোর্টের রানওয়ে মূল ভূখণ্ড থেকে সমুদ্রের মাঝে চলে আসায় আমার মনে হচ্ছিল বিমানটি বুঝি সমুদ্রেই অবতরণ করছে। তখন সকাল ৬টা মতো বাজে। অল্প কিছুক্ষণ পর প্লেন হানেডা এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলো। এটা ছিল আমার কাছে সেরা ল্যান্ডিং অভিজ্ঞতা। দীর্ঘ ফ্লাইটের ধকল সহ্য করে জাপানের মাটিতে পা রেখেছি। বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে আমি এখন সূর্যোদয়ের দেশ জাপানে। এত কষ্টের অবসান হতে চলছে। ইমিগ্রেশনে চলে গেলাম। কোভিডের জন্য ভয়াবহ চেকিং। খুব কড়াকড়ি। দেখি অনেক ভিড়, পেঁচানো লম্বা লাইন। ইমিগ্রেশন, কাস্টমস, ব্যাগেজ কালেকশন সবকিছু কমপ্লিট করে নিজেরা ফ্রেশ হয়ে যখন এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে এলাম তখন জাপানের সময়নুযায়ী ঘড়িতে ঠিক সকাল সাতটা।
| অপেক্ষারত গাড়ি |
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের পরিচিত অতুলজিকে দেখতে পেলাম, সঙ্গে এক জাপানি তরুণীও আছেন যিনি আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে গাড়ির কাছে নিয়ে গেলেন। তখন ঘড়িতে সকাল ১০টা। ব্যাগ লাগেজ গাড়িতে উঠিয়ে রওনা দিলাম সুকুবার (Tsukuba) উদ্দেশ্যে। এয়ারপোর্ট থেকে আমদের গাড়ি সাঁই সাঁই করে সুকুবার দিকে ছুটছে। কোন হর্ন নেই, নেই কোন জ্যাম। রাস্তাঘাট চমৎকার। কি সুন্দর সাজানো গোছানো সব কিছু! কোথাও এতটুকু ময়লাও চোখে পড়লোনা। রাস্তার শব্দ যাতে লোকালয়ে পৌঁছাতে না পারে এজন্য পথের দুধারে রয়েছে সাউন্ডপ্রুফ দেওয়াল।
| সুকুবার পথে |
ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে আমরা হোটেলের লবিতে পৌঁছে গেলাম। হোটেল বেস্টল্যান্ড। সুকুবা এক্সপ্রেস (Tsukuba Express) বা TX লাইনে কেনকিউ-গাকুয়েন (Kenkyū-gakuen) স্টেশনের ঠিক পাশেই। এখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা। দুপুর ১২টায় আমরা হোটেলে চেক-ইন করলাম। কাউন্টার থেকে রুমের চাবি নিয়ে লিফটে ৬ তলায় সোজা রুমে চলে গেলাম।এটি সমস্ত আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সহ স্টার রেটেড হোটেল হলেও রুমের আয়তন খুব ছোট। হিসেব করে মাপা। বিছানা বাদে সামান্য একটু খালি জায়গা। জানা গেল জাপানে অধিকাংশ হোটেলের রুম ছোটই হয়। তবে, রুমগুলো ছিল খুবই আধুনিক, পরিষ্কার এবং সুসজ্জিত। বাথরুমটিও খুব সুন্দর। আর টয়লেট? আমাদের শোবার ঘরের চেয়ে বেশি পরিষ্কার। কমোডে লাগানো রয়েছে বিডেট। বিডেট থেকে ঠাণ্ডা, গরম জল প্রয়োজন মতো ব্যবহার করা যায়। এমনকি বের হয় ঠান্ডা বা গরম হাওয়াও। যেহেতু হোটেলে পৌঁছাতে আমাদের একটু দেরি হয়ে গিয়েছে, তাই আর সময় নষ্ট না করে ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি লাঞ্চ করতে বেরিয়ে পড়লাম।
| হোটেল বেস্টল্যান্ডের সামনে |
হোটেল থেকে বেরিয়ে মেট্রো স্টেশনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। রাস্তাঘাটে তেমন মানুষ নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। TS-19 সুকুবা এক্সপ্রেসের কেনকিউ-গাকুয়েন স্টেশন। ছোট্ট স্টেশন। স্টেশনে ঢুকেই PASMO কার্ড রিচার্জ করে নিলাম। PASMO জাপানের প্রিপেইড ট্রান্সপোর্টেশন কার্ড। এটি PASMO Co. দ্বারা ইস্যু করা একটি IC কার্ড। কার্ডটি রিচার্জেবল এবং বারবার ব্যবহার করা যায়। টোকিও সহ পুরো জাপানে রেল ও বাসের ভাড়া এই কার্ডের মাধ্যমে দেওয়ার যায়। কার্ডটি বিভিন্ন স্টোরে ও ভেন্ডিং মেশিনে কেনাকাটার জন্য ইলেকট্রনিক মানি হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। মেট্রোর গেটে PASMO কার্ড ব্যবহার করে এসকেলেটর করে চলে এলাম প্লাটফর্মে। ওখান থেকে মেট্রো ধরে চলে এলাম পরের স্টেশন সুকুবাতে। জাপানে এটাই আমার প্রথম রেল ভ্রমণ।
| কেনকিউ-গাকুয়েন স্টেশন |
সুকুবা স্টেশনের সাথে সরাসরি সংযুক্ত ছিল 'টোনারি সুকুবা স্কোয়ার' (Tonarie Tsukuba Square) মল। একটি স্টেশন বিল্ডিংয়ের মতো। সেখানে রকমারি দোকান। টোনারিতে তিনটি বিল্ডিং রয়েছে; টোনারি ক্রিও (tonarie CREO), টোনারি কিউ'টি (tonarie Q’t) এবং টোনারি এমওজি (tonarie MOG)। এখানে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ছাড়াও সুপারমার্কেট, পোশাকের দোকান, বইয়ের দোকান, ১০০ ইয়েনের দোকান 'ডাইসো' (Daiso) এবং আরও অনেক দোকান রয়েছে।
| 'টোনারি সুকুবা স্কোয়ার মল' |
ট্রেন থেকে নেমে টোনারি Q't বিল্ডিংয়ের থার্ড ফ্লোরে এলাম। লিফ্ট থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে একটু এগোতেই দেখি একটা দোকানের সামনে ইংরেজিতে লেখা 'সাইনো' (Saino) ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টের বাইরে কাঁচের শোকেসের ভেতর বিভিন্ন খাবারের নাম সহ প্লাস্টিকের তৈরি হুবহু মডেল রাখা আছে। জাপানের অনেক রেস্টুরেন্টেই এরকম খাবারের নকল ডিসপ্লে সাজিয়ে রাখা হয় আসল খাবার দেখতে কেমন হবে তা বোঝানোর জন্য। ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট দেখে আমরাও সেখানে খেতে ঢুকলাম। এখানে কর্মীরা বেশিরভাগই ইন্ডিয়ান। একজন নেপালিও ছিল। দু'জন বাঙালিকেও পেয়ে গেলাম, তাদের মধ্যে একজন বাংলাদেশি। এতদূরে বিদেশ বিভুঁইয়ে এসে বাঙালির দেখা পেয়ে মনে মনে খুব খুশি হলাম।
| সাইনো |
'সাইনো' তে ডিনার সেরে মেট্রো করে আবার হোটেল বেস্টল্যান্ডে ফিরে এলাম। হোটেল ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। বিছানায় শুতেই ঘুম। তখন বাইরে ছিল খুব ঠাণ্ডা। কিন্তু ঘরের মধ্যে তা বোঝার উপায় নেই। প্রথম দিনেই মন ভাল হয়ে গেল যা আজ পর্যন্ত থেকে গেছে।
| হোটেলের রুম |
পরদিন সকাল থেকে শুরু হলো আমার নতুন পথ চলা। অফিসের কাজে আজ নাকায়মা (Nakayama) যেতে হবে। ঠিক পৌনে আটটায় বাস। ঘুম ভাঙল সাড়ে ছটায়, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে নেমে গেলাম ব্রেকফাস্ট করতে। হোটেলে ঢোকার মুখেই ছিল 'লা পোর্টা' রেস্টুরেন্ট। 'লা পোর্টা' ইতালিয়ান রেস্টুরেন্ট হলেও এখানে ট্রাডিশনাল জাপানি খাবার থেকে আমেরিকান খাবার সব কিছুই পাওয়া যেত।
| লা পোর্টা রেস্টুরেন্ট |
ব্রেকফাস্টের বুফেতে দেখি স্যুপ, পাউরুটি, ডিম, বাটার, স্যালাড, গ্রিন টি, নুডলস, গ্রিল করা মাছ, রাইস ইত্যাদি নানারকম খাবারের আইটেম। বিভিন্ন ড্রিঙ্কসও ছিল। আবার বেশ কিছু জাপানী মেন্যুও ছিলো। তবে, আমার পছন্দের খাবার হয়ে উঠেছিল গ্রিলড স্যামন। সব জাপানি রেস্টুরেন্টের মতো এখানেও ব্রেকফাস্ট আইটেমের মধ্যে ছিল গ্রিলড স্যামন। জাপানে এটি খুব জনপ্রিয়। এই মাছের স্বাদের কথা শোনার পর আমার ট্রাই করার একটা ইচ্ছা ছিলো। জীবনে প্রথম এখানে স্যামন ফিশ খেলাম। প্রথমে খেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। কাচুমাচু করে এক টুকরো মুখে দিতেই আমার ধারণা পাল্টে গেল। কী সুস্বাদু! কাঁটা নেই, তুলতুলে নরম! সত্যি এই মাছের স্বাদ অসাধারণ, এর স্বাদ ইউনিক এবং মনে রাখার মত। বেশ তৃপ্তির সাথেই খেলাম ওটা। যতদিন জাপানে ছিলাম এই 'লা পোর্টা'-তেই ব্রেকফাস্ট করেছি।
| ব্রেকফাস্ট আইটেম |
এদিন অফিস ওয়ার্ক সেরে নাকায়মা থেকে বাসে চেপে সোজা রওনা দিই টোকিওর দিকে। সন্ধ্যায় টোকিওর গিনজাতে একটা ছোট্ট মিট আছে, ওটা এটেন্ড করে বেস্টল্যান্ড হোটেলে ফিরব। সন্ধে সাড়ে পাঁচটায় বাস এসে থামলো গিনজার চুও সিটি এরিয়ার একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের সামনে। 'আন্নাম ইন্ডিয়ান'-টোকিও তথা জাপানের অন্যতম প্রাচীন রেস্টুরেন্ট। ভেতরে সুন্দর কাশ্মীরি খোদাই করা কাঠের আসবাবপত্র, লাল রঙের সোফা সবই যেন ভারতীয় জাতিগত সাজসজ্জায় সজ্জিত।
| আনাম ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট |
বিশ্বের অতিব্যয়বহুল শহরগুলোর অন্যতম এই 'গিনজা'। ঝকঝকে, তকতকে গিনজা নগরী দেখতে ঠিক যেন ছবির মতো। চারদিকে চোখ ধাঁধানো বিশাল বিশাল বিল্ডিং। বিভিন্ন ফ্লোরে রয়েছে কমার্শিয়াল অফিস, দোকাপাট, রেস্টুরেন্ট, বার ইত্যাদি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, চাকচিক্যের চেয়েও জাপানিদের নম্র-ভদ্র ব্যবহার, শৃঙ্খলাই বেশি মুগ্ধ করেছে আমাকে। জাপানে কাটানো চোদ্দ দিনে খালি ধন্যবাদ বা 'আরিগাতো গোজাইমাস' শুনেছি। অভিবাদনেরও আবার রকমভেদ আছে। কোমর থেকে কতটা সামনের দিকে ঝুঁকে স্বাগত জানাবেন সেটা নির্ভর করে সামনের ব্যক্তিটির বয়স ও পদমর্যাদার ওপর। তবে হ্যান্ডশেক একদম নয়।
| গিনজা |
টোকিওর আশেপাশের সবকিছুই ছবির মতো সাজান। রাস্তাঘাট চমৎকার। কোথাও এতটুকু ময়লাও চোখে পড়লোনা। রাস্তায় প্রচুর গাড়ি। কোন হর্ন নেই, নেই কোন জ্যাম। ব্যস্ততা আছে। ঠেলে এগিয়ে যাওয়া নেই, বাক্যালাপ আছে, হয়তো চাপা বিরক্তিও আছে কোথাও কোথাও- কিন্তু উঁচুগলা নেই। নেই মানে নেইই! এত আধুনিকতা অথচ একটা শহর এতো শান্ত এবং শিষ্ট হয় কী করে?
| চুও-কু, গিনজা |
ট্যুরে গিয়ে সেখানকার ট্র্যাডিশনাল ফুড ট্রাই না করলে যেন ট্যুর কমপ্লিটই হয় না। শুনেছি জাপানে সুশি খুব জনপ্রিয়। সুশি মাছের নাম না! খাবারের নাম! জাপানের ট্রাডিশনাল ফুড। অনেক ধরনের সুশি আছে। যেমন - চিরাশি, মাকি, নিগিরি, ওরামাকি, ইনারি, নামনারে, টেমাকি, ওশি ইত্যাদি। হরেক রকমের সামুদ্রিক মাছকে স্লাইস করে কেটে, ভিনিগার মাখানো স্টিকি রাইস বা সামান্য আঠালো নরম তুলতুলে ভাতের (গোহান) সঙ্গে মাছ দিয়ে সাজিয়ে তৈরি করা হয় এই সুশি। সুশি বানাতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় বিশেষ প্রজাতির 'স্যামন মাছ', যা নরওয়ে থেকে আসে। সামুদ্রিক মাছ ছাড়াও ভেজিটেবল পাল্প, আধসেদ্ধ মাংস ও ডিম দিয়েও ভিন্ন স্বাদের সুশি তৈরি করা হয়। জাপানের প্রতিটি শহরেই KFC, McDonald's, Domino's-এর মতো নামকরা ব্রান্ডের সুশি রেস্টুরেন্ট আছে।
| সুশির সন্ধানে |
সন্ধ্যার দিকে হোটেলের কাছে রাস্তায় পায়চারি করতে বেরিয়েছি। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে রাস্তার পাশে এক জায়গায় দেখলাম 'উওবেই সুশি' (Uobei Sushi)। কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। আলো ঝলোমল সুশি খাবারের দোকানে হরেক রকমের জাপানি খাবার। মেনু কার্ডের ছবি দেখে কম্বো ফুটোমাকি অর্ডার দিলাম। এতে ছিল ছ'টি কাপ্পা মাকি এবং ছ'টি নিগিরি। মাকিজুশি স্টিকি রাইস ও সামুদ্রিক শৈবাল দিয়ে জড়ানো এক ধরনের রোল। এই ছোট জাপানি রোলগুলিতে যথাক্রমে শসা ও টুনা বা স্যামন মাছের একটি করে ছোট টুকরো ছিল। এর সাথে ছিল দু'টো ইনারি। এটি ভাজা টোফু দিয়ে মোড়ানো। টোফু সয়ামিল্ক থেকে তৈরি হয় ঠিক যেন পনিরের মতো। সাইড ডিশ হিসাবে ছিল দু'টো তামাগো যা এক ধরনের জাপানি অমলেট। সঙ্গে মিসো স্যুপ, ওয়াশাবি অর্থাৎ এক ধরনের অতি ঝাঁঝালো আচার, গারি বা পিকলড আদা এবং সয়া সস।
| উওবেই সুশি |
হাকোনে (箱根)
আগে থেকেই প্ল্যান ছিল মাউন্ট ফুজি দেখতে যাব। আমরা হাকোনে নামের একটা শহরে গিয়েছিলাম। পাহাড়ঘেরা ছোট্ট, ছিমছাম শহর। জাপানের অন্যতম সেরা সুন্দর শহর এটি। হাকোনে! এমন একটা জায়গা যেখান থেকে ফুজি পাহাড়, আশি লেক আর আগ্নেয়গিরি তিনটেই দেখা যায়। আগ্নেয়গিরি থাকায় ঐতিহ্যবাহী হট স্প্রিংয়ের জন্যও বিখ্যাত এই শহরটা। রাজধানী টোকিও থেকে বেশ কিছুটা দূরে এই শহর। প্রচুর পর্যটক ভিড় করেন এই হাকোনেতে।
| হাকোনে |
জাপানে আসার পর থেকে অপেক্ষা করছি কাছে থেকে মাউন্ট ফুজির মোহনীয় রূপ দেখার জন্য। সেদিন ছিল রবিবার। সকল আটটায় গাড়ি এলো। রওনা দিলাম হাকোনের উদ্দেশ্য। এক্সপ্রেস হাইওয়ে ধরে আমাদের বাস ছুটে চলেছে। গাড়ি চলছে আর চলছে। শহর ছাড়ার পর কিছু দূর যেতেই শুরু হয় উচুঁ নীচু আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথ। কোথাও আবার পাহাড়ের নীচ দিয়ে টানেল। একটার পর একটা টানেল পার হতে থাকলাম। রিলাক্সের জন্য মাঝে একবার একটা ধাবায় এসে বাস দাঁড়ালো।
| এক্সপ্রেস হাইওয়ে ধরে বাস ছুটে চলেছে |
বেশ খানিকটা পথ চলার পর দূর দিগন্তে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য নজরে এল। গাছপালা, ছোট ছোট পাহাড়ের ফাঁকফোকর ভেদ করে মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছিল সাদা রংয়ের এক পর্বতের চূড়া। মনে হল বরফের টুপি পরে আছে। সবাই আগ্রহ নিয়ে সেদিকে তাকাই। ঠিক হাকোনের আগে সাদা বরফে ঢাকা পর্বত দেখে আমার বুঝতে বাকি রইল না যে এটাই 'মাউন্ট ফুজি'। ওয়াও এত সুন্দর! পুরো সাদা পাহাড় এই প্রথম দেখলাম। মোটামোটি আবহাওয়া ভালই। তাই সৌভাগ্যবশত মাউন্ট ফুজি দেখা গেল। প্রকৃতি আমাদের প্রতি সদয় ছিল, তাই মাউন্ট ফুজি খুব সুন্দরভাবে চোখে পড়ল। অসাধারণ সে দৃশ্য। তাড়াতাড়ি ক্যামেরা বের করে চলন্ত গাড়ি থেকে ভাল শট নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। শুরু হলো ফটো তোলা, আর ধরা পড়লো মাউন্ট ফুজির প্রতিবিম্ব আমার ক্যামেরায়। সব সময় কিন্ত মাউণ্ট ফুঁজি এমন দেখা যায় না। প্রায়ই কুয়াশার একটা পাতলা আঁন্তরণ থাকে, তার ভেতর দিয়ে ঝাঁপসা ঝাপসা! দেখতে পাওয়া যায় । আজ আমাদের ভাগ্য ভাল। এই ৪০ মিনিটের রাস্তায় প্রায় পুরোটা সময় ধরেই মাউন্ট ফুজির ভিউ ছিল।
![]() |
| ফুজি দর্শন |
গোতেম্বা শহর পেরিয়ে ওটোম টানেলের ঠিক আগে আমাদের বাস এসে থামল। পাশেই ফুজিমি ক্যাফে। এই ক্যাফের সামনে বসে মাউন্ট ফুজিকে খুব কাছে থেকে উপভোগ করা যায়। এখানে একটা ভিউ পয়েন্ট আছে যেখান থেকে মাউন্ট ফুজির অসাধারণ ভিউ পাওয়া যায়। ফুজিমি ক্যাফের পার্কিং লটের পাশেই পাহাড়ের গা বেয়ে সরু একটা সিঁড়ি উঠে গেছে। সেই সিঁড়িতে কয়েক পা ফেলতেই হাঁপিয়ে গিয়েছি। দাঁড়িয়ে পড়তে হল। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। তাই এখানে একটু রেস্ট নিয়ে আবার উঠতে লাগলাম। তবে বেশি সিঁড়ি নয়। তাই দু তিন বার দাঁড়িয়ে উঠে গেলাম ভিউ পয়েন্টে। চোখের সামনে মাউন্ট ফুজি। কিন্তু এ কেমন দৃশ্য! খানিক আগে যে সাদা চূড়াটি উঁকি দিচ্ছিল তা এখন বেমালুম গায়েব! কোথা থেকে যেন এক পাল মেঘ এসে ফুজির চুড়াটা ঢেকে দিয়েছে। মনটা কেমন ভারী হয়ে উঠল! আকাশের মন বোঝা সত্যিই ভার! এখানে দেখি একটা বসার বেঞ্চও রয়েছে আর তার পাশে একটা বড় ঘন্টা। ওটোম নো কেন (দ্য বেল অফ মেডেন) এর সামনে দাঁড়িয়ে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুললাম। আমরা এখানে খানিকটা সময় কাটিয়ে আবার উঠে পড়লাম বাসে।
| ফুজিমি ক্যাফে |
বাস এসে থামল আশি লেকের পাশে। হকোনে মাচি... প্রচুর টুরিস্টের আনাগোনা। বিভিন্ন দেশের পর্যটক চোখে পড়ল। চারিদিকে ছোট-বড় পাহাড়ে ঘেরা, হাজার হাজার গাছ। আর সেই গাছের পাতায় লাল, সবুজ, কমলা আর হলুদের নানা বর্ণের রঙ। সামনে ছবির মত দৃশ। সুন্দর সাজানো গোছানো সব বাড়ি, দোকানপাট। চারপাশে ছোট কয়েকটা দোকান, স্যুভিনির শপ, রেস্টুরেন্ট। পর্যটন শহর হলেও অসম্ভব রকমের নীরবতা হাকোনেতে। নীরবতার চিত্র আসলে পুরো জাপানেই। সবাই খুব মৃদু স্বরে কথা বলে। এমনকি বাস-ট্রেনেও প্রয়োজন ছাড়া কেউ কথা বলে না। কারণ, অন্য যাত্রীরা বিরক্ত হতে পারেন।
| হাকোনেমাচি |
হাকোনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ আশি লেক, যাকে হাকোন লেক বা আশিনোকো লেকও বলা হয়। এই আশি লেকে ক্রুজশিপে চড়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। আশি লেকে সাইট সিইং ট্যুরের জন্য মোট তিনটি ক্রুজশিপ বা বিলাসবহুল জাহাজ আছে। রয়্যাল II, বিজয় এবং কুইন আশিনোকো। এই জাহাজগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিলাসবহুল কুইন আশিনোকো। রয়্যাল II জাহাজটি ফরাসি নৌবাহিনীর রয়্যাল লুইসের আদলে তৈরি এবং বিজয় জাহাজটি বিখ্যাত ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির জাহাজ HMS ভিক্টরির একটি মডেল। আমাদের ক্রুজশিপ রয়্যাল II তরতর করে এগিয়ে চলেছে আশি লেকের বুক চিরে তোগেন্ডাইয়ের দিকে। হাকোনেমাচি-কো থেকে মোতোহাকোন হয়ে তোগেন্ডাই-কো পর্যন্ত প্রায় পঁচিশ মিনিটের ক্রুজ যাত্রা।
| রয়্যাল II ক্রুজশিপ |
আশি লেকের তীরে রয়েছে প্রাচীন শিন্তো ধর্মের কয়েকশ বছরের পুরোনো মন্দির। মন্দিরটি হাকোনে-জিনজা নামেও পরিচিত। জাহাজটি যখন মাঝপথে ছিল তখন জলের মধ্যে মন্দিরের লাল টোরি গেট দেখতে পেলাম। ক্রুজ শেষে লেক পাড় থেকে পায়ে হেঁটে গেলাম সামনে তোগেন্ডাই রোপওয়ে স্টেশনে। মাউন্ট ফুজি যাওয়ার রাস্তা আর 'হাকোনে' টুরিস্ট স্পটের দৃশ্যাবলি যেন একেবারে স্বপ্নের মতো!
| মোতোহাকোন |
ওয়াকুদানি (大涌谷)
তোগেন্ডাই (Tōgendai) রোপওয়ের উপরের তলায় কেবল কার স্টেশন। নীচতলায় একটি রেস্টুরেন্ট এবং স্যুভেনিরের দোকান। আমরা যখন রোপওয়ের লাইনে দাঁড়ালাম তখন বেশ ভিড়। লম্বা লাইনে প্রায় আধ ঘন্টা পরে কেবল কারের মূল স্টেশনে পৌঁছালাম। তার বেয়ে একের পর এক কেবল কার স্টেশনে আসছে। গতি একটু কমতেই সেখানে চড়ে বসলাম। কেবল কারগুলি বেশ বড়; এক একটা কেবল কারে আঠেরো জন করে যাওয়া যায়।
| তোগেন্ডাই রোপওয়ে স্টেশন |
তোগেন্ডাই স্টেশন থেকে রোপেওয়েতে একটু গিয়েই শুরু হলো পাহাড়ি পথ। উপর থেকে দেখা যাচ্ছে ঘন পাহাড়ী বন আর পাশের আরেকটা পাহাড়। রুক্ষ, পাথুরে এলাকা। চারপাশে কুয়াশার মতো ছড়িয়ে রয়েছে সালফারের বাষ্প। আমাদের রোপওয়ে কেবল কার যাত্রা শুরু তোগেন্ডাই স্টেশন থেকে, পরেরটি উবাকো স্টেশন, তারপর ওয়াকুদানি স্টেশন। মাঝেমধ্যে একটি দুটি করে কেবল কার চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। তারের ওপর দিয়ে চলা আমাদের ছোট গাড়িটি গিয়ে থামল ওয়াকুদানি (Owakudani) স্টেশনে। পনেরো মিনিটের কেবল কার ভ্রমণ শেষ হলো। ওয়াকুদানিতে নেমে দেখি চারপাশে ধোঁয়া বের হচ্ছে আর নাকে এসে লাগলো পঁচা ডিমের ঝাঁঝালো গন্ধ। না, ওটা আসলে ডিমের গন্ধ না। সালফারের গন্ধ। এই ওয়াকুদানি উপত্যকাটি একটা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। এটাকে গ্রেট বয়েল ভ্যালিও বলা হয়। উপত্যকাটি এখনও রীতিমতো ফুটছে। এখানে যত ঝর্ণা আর জলাশয় আছে, সব জায়গায় জল ফুটছে আর ধোঁয়া উঠছে।
| ওয়াকুদানি |
পর্যটনের জন্য মোটেও আদর্শ জায়গা নয়। তবু এখানে প্রতিদিনই পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। এখানে পর্যটকরা ভিড় করেন মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, পাশেই আছে মাউন্ট ফুজি। ওয়াকুদানি থেকে মাউন্ট ফুজি পরিষ্কার দেখা যায়। তবে মূল কারণ অন্যটি - কুচকুচে কালো ডিম। এই কালো ডিম পুরো হাকোনেতেই জনপ্রিয়। তাই বহু পর্যটক এখানে এই কালো ডিম খেতে আসেন। এই ডিমগুলোকে বলা হয় কুরো-তামাগো। এই ডিমগুলো আসলে বিশেষ কোনো ধরনের ডিম না। এগুলো সাধারণ মুরগির ডিমই। সিদ্ধ করার আগে এগুলোর রং সাদাই থাকে। ওয়াকুদানির উষ্ণ প্রস্রবনের জলাশয়গুলোতে ফুটিয়ে সিদ্ধ করলে এই ডিমগুলো কালো হয়ে যায়। এগুলি একটি বড় ধাতব ক্রেটে ভরে এক ঘণ্টা উষ্ণ প্রস্রবনের জলে ডুবিয়ে রাখা হয়। উষ্ণ প্রস্রবনের এই জলে প্রচুর পরিমাণে সালফার রয়েছে। এই জল ডিমের খোসার সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া করলে তা কালো হয়ে যায়, ভেতরের অংশ কিন্তু থাকে ওই সাদা-হলুদই।
| ওয়াকুদানি |
স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই ডিম খেলে নাকি সাত বছর আয়ু বাড়ে। আমিও ওয়াকুদানির এই কালো ডিম খেতে চাই। সামনে একটা দোকানে দেখলাম বিক্রি হচ্ছে। ৫০০ ইয়েন দিয়ে একটা কালো ডিমের প্যাকেট কিনলাম। প্যাকেট খুলে দেখি পাঁচটা কালো ডিম রয়েছে। খেলাম কয়েকটা। অন্যরকম কিছু মনে হলো না। সাধারণ ডিমের মতোই। আয়ু বাড়ল কিনা কে জানে?
| কালো ডিম |
এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে থাকলাম। এরপর এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়ালাম যেখান থেকে ফুজি পাহাড় খুব সুন্দর দেখা যায়। উফ! এত সুন্দর। কিন্তু সারাদিন তো আর এখানে থাকা যাবেনা তাই চলে এলাম পার্কিং লটে। পার্কিং লটে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই দেখি বাস এসে হাজির। ড্রাইভার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা সেই বাসে উঠলাম। ঘণ্টাদেড়েক পর বাস আমাদের নামিয়ে দিল ওদাওয়ারা (Odawara) রেল স্টেশনে।
শিনকানসেন
জাপানে এসে বুলেট না চড়লে হয়! তাই এবার জাপান ট্রিপে বুলেট ট্রেনে উঠবো বলে ঠিক করে রেখেছিলাম। ওদাওয়ারা স্টেশনে বুলেট ট্রেন শিনকানসেনের জন্য অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন এসে গেল প্লাটফর্মে। এবার ট্রেনে ওঠার পালা। প্ল্যাটফর্মের প্রায় দু'ফুট ভেতরের দিকে প্ল্যাটফর্মের ধারে সমান্তরাল ভাবে রেলিং দেওয়া আছে। নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর তাতে গেট লাগানো। ট্রেন ঢোকার মুখেই তৈরি হয়ে যায় অপেক্ষারত যাত্রীদের অতি সুভদ্র এক লাইন। যাত্রীরা সবাই রেলিংয়ের এপারে। একে অপরের থেকে প্রায় দুই ফুট দূরত্ব বজায় রেখে একটি নির্দিষ্ট লাইনে দাঁড়িয়ে। ওঠার লাইন শুধু গেটের বাঁদিকে। ট্রেন এসে দাঁড়ালো। ট্রেনের দরজা ঠিক সেখানে, যেখানে রেলিংয়ের গেট। আমাদের মতো ধাক্কাধাক্কি করে ঠেলে ফেলে ট্রেনে ওঠানামা জাপানিদের জানা নেই। প্রথমে যাত্রীরা নামলেন। তারপর ওঠার পালা।
| ওদাওয়ারা স্টেশন |
আমাদের টিকিট ছিল কোদামা (Kodama) এক্সপ্রেসের। লোকাল ট্রেনের মতো সব স্টেশনে দাঁড়ায়। এছাড়া আরও দু'টি শিনকানসেন হিকারি (Hikar) ও নোজোমি (Nozomi) এই লাইনে চলাচল করে। নোজোমি হল টোকাইডো শিনকানসেনের সবচেয়ে দ্রুততম ট্রেন। বুলেট ট্রেনের নাম কেবল শুনেছি, কখনো দেখিনি। আজ দেখলাম সত্যি কি ঝকঝকে সুন্দর। ট্রেনে উঠে একটাও বসার জায়গা পেলাম না। অগত্যা দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না! ভেতরটা অনেকটাই প্লেনের মত। ট্রেন চলছে তার নিজের গতিতে। ভেতরে ডিসপ্লেতে সব দেখা যাচ্ছে, কত স্পিডে চলছে, কোন স্টেশনে পৌঁছলো আর সামনে কোন স্টেশন আছে। ট্রেনের ভেতরের মানুষগুলোর কোন সাড়াশব্দ নেই, নেই কোন ট্রেন চলার শব্দ, শুধু বাতাসের একটি শব্দ কানে বাজছে। মনে মনে ভাবছি, জানালার পাশে সিটটা পেলে ভালো হয়। পরের স্টেশনে ট্রেন থামতেই কেমন যেন হঠাৎ করেই কামরাটা খালি হয়ে গেল। ফাঁকা হয়ে গেল পুরো বগি, খালি হয়ে গেল অনেক সিট। জানালার পাশে বসতে পারলাম এতোক্ষণে।
| বুলেট ট্রেনের ভেতরে |
টোকিও স্টেশনে পৌঁছে দেখি ও বাবা ষ্টেশনে মানুষ গিজ গিজ করছে। কিন্তু কোথাও কোন শব্দ নেই, হৈ-চৈ নেই, বিশৃঙ্খলা নেই। সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে ট্রেনের অপেক্ষা করছে। এখানে লাইন ভেঙে সামনে যাওয়ার হীন মানসিকতা কারো নেই।
| টোকিও স্টেশন |
টোকিও স্কাই ট্রি
কেনকিউ-গাকুয়েন স্টেশন থেকে সুকুবা এক্সপ্রেস লাইনের মেট্রোতে চেপে বসলাম। ৫০ মিনিটের মধ্যেই চলে এলাম কিতা সেঞ্জু স্টেশনে। টোকিও স্কাই ট্রি-এর নিজস্ব স্টেশন রয়েছে যার নাম টোকিও স্কাই ট্রি স্টেশন। আমরা কিতা সেঞ্জু স্টেশন থেকে টোবু লাইনের মেট্রো ধরে টোকিও স্কাই ট্রি স্টেশনে এসে নামলাম। ট্রেন থেকে নেমে টোকিও সোলামাচি বিল্ডিংয়ের স্কাই ট্রি লেখা গেট দিয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। টাওয়ারের বেসে 'টোকিও স্কাই ট্রি টাউন' একটি বিশাল শপিং কমপ্লেক্স। স্কাই ট্রির বেসমেন্ট ফ্লোর থেকে মাটির উপরে পাঁচতলা পর্যন্ত এই টোকিও সোলামাচি মলে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, রেস্টুরেন্ট, ফুড কোর্ট ও ক্যাফে রয়েছে। এছাড়াও প্রচুর দোকান রয়েছে যেখানে স্যুভেনির থেকে শুরু করে খেলনা সবকিছু পাওয়া যায়। জাপানে এসে দেখি সকলে মাস্ক পরে আছে। এই সময় করোনা-ত্রাস ছিল না! তবুও জাপানের ট্রেনে বাসে রাস্তায় শপিংমলে যেখানেই দেখি সকলের মুখে মাস্ক পরা।
| টোকিও স্কাই ট্রি টাউন কমপ্লেক্স |
টোকিও স্কাই ট্রি টাওয়ার থেকে পর্যবেক্ষণের জন্য দুটি গ্যালারি আছে। ঐ অবজারভেশন ডেকে পৌঁছানোর জন্য চারটি হাই স্পিড এলিভেটর বা লিফট রয়েছে। স্কাই ট্রি অবজারভেশন ডেকের এন্ট্রান্স টোকিও সোলামাচি শপিং কমপ্লেক্সের চার তলায়। টিকিট কাউন্টারের সামনে দেখি লম্বা লাইন। যেহেতু গ্রুপে গিয়েছিলাম তাই টিকিট পেতে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। টেম্বো ডেকের টিকিট দেখিয়ে ভেতরে ঢুকতেই এক জাপানি তরুণী আমাদের গাইড করে টাওয়ারে উঠার লিফটে নিয়ে গেলেন। মাত্র ৪৫-৫০ সেকেন্ডের ব্যাপার। ৩৫০ মিটার উঁচুতে টেম্বো ডেকে এসে লিফট থামলো।
| লিফটে ওঠার অপেক্ষায় |
দুটি ডেকের নীচের ডেক এটি। এই অবজারভেশন ডেকে তিনটি ফ্লোর। আমরা এখন উপরের তলায়। চারিদিকে কাঁচের দেওয়াল। দেওয়ালের ওপারে টোকিও শহরের এক চমৎকার প্যানোরামিক ভিউ। কি যে অপূর্ব লাগছে এই দৃশ্য! প্রচুর ট্যুরিস্ট, কেউ ভিডিও করছে কেউ ছবি তুলছে। মাঝের তলায় একটি স্যুভেনির শপ ও একটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। একদম নীচের তলায় রয়েছে একটি ক্যাফে। এর মেঝেতে একটি কাঁচের ব্লক বসানো আছে যেখান থেকে টাওয়ারের গোড়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ দেখা যায়। সেই মোহনীয় দৃশ্য যেমন চমৎকার, তেমনি ভয়ানক। ভয়ে বুক কেঁপে ওঠাটাই স্বাভাবিক।
| টোকিও শহরের প্যানোরামিক ভিউ |
টেম্বো ডেক থেকে টিকিট কেটে উপরের টেম্বো গ্যালারিতে যাওয়া যায়। ৪৫০ মিটার উঁচুতে এই টেম্বো গ্যালারি। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোটা পার করেছে। আমাদের আসল উদ্দেশ্য 'সেন্সো-জি' যাওয়া তাই টেম্বো গ্যালারিতে না গিয়ে লিফটে করে নেমে এলাম পাঁচতলায়। সোলামাচি মলের পাঁচতলায় টাওয়ারের এক্সিট গেট দিয়ে বেরিয়ে সোজা মেন রোডে।
| টোকিও সোলামাচি মল |
স্কাই ট্রি থেকে নেমে আমরা আসাকুসার দিকে হাঁটা শুরু করি। এই আসাকুসা (Asakusa) অঞ্চলেই রয়েছে 'সেনসো-জি' (Sensō-ji) শ্রাইন। হেঁটেই চলেছি হেঁটেই চলেছি। কখনো আমাদের সাথে লোকগুলোকে অনুসরণ করি, কখনো তারা হারিয়ে যায়। এরকম করে প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট হাঁটার পর রাস্তায় পড়লো আজুমাবাশি ব্রিজ। যার নীচে বয়ে গেছে টোকিও-র সেই বিখ্যাত নদী সুমিদা। কি অপূর্ব সেই নদী! ব্রিজের নীচে বড় বড় স্টীমারের মতো জলযান চলে যাচ্ছে এদিক থেকে ওদিকে। নৌ-ভ্রমণের চমৎকার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে।
| সুমিদা নদী |
সুমিদা নদী পেরিয়ে টোকিও শহর দেখতে দেখতে হেঁটে চলেছি আসাকুসা স্টেশনের দিকে। সামনে বিশাল উঁচু উঁচু বিল্ডিং, তাও অদ্ভুত সব আকারের। হঠাৎ একটা বিল্ডিংয়ের দিকে আমার নজর গেল। 'দ্য গোল্ডেন পু' নামে এই বিল্ডিংটির আকৃতি ঠিক ফেনাযুক্ত বিয়ারে ভরা একটি মগের মতো। এর শীর্ষে রয়েছে দ্য ফ্ল্যামে ডি'অর বা গোল্ডেন ফ্লেম। ফরাসি ডিজাইনার ফিলিপ স্টার্ক এই বিল্ডিংটির ডিজাইন করেছেন। এটি স্থানীয়ভাবে কিন নো উনকো বা 'গোল্ডেন টার্ড' নামে পরিচিত।
| দ্য গোল্ডেন পু |
গোল্ডেন টার্ড পেরিয়ে কিছুটা এগোতেই ডান দিকে চোখে পড়ে আসাকুসা স্টেশন। স্টেশনের সামনে রাস্তায় একটা জেব্রা ক্রসিং। এই ট্রাফিক সিগন্যাল ক্রসিংটা একটু অন্যরকম, এদিক ওদিক না হয়ে চারিদিক থেকে সেই রাস্তা পার হয়ে যায়। একে বলে স্ক্র্যাম্বল ক্রসিং। যদিও টোকিওর রাস্তায় এটা নতুন কিছু নয়। আসাকুসার এই স্ক্র্যাম্বল ক্রসিং পেরিয়ে চলে এলাম হিসাগো-ডোরি শপিং স্ট্রিটের কাছে সাউথ পার্ক রেস্টুরেন্টে। এই ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টেই দুপুরের লাঞ্চ সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সেনসো-জি শ্রাইন দেখতে।
| টোকিও স্কাই ট্রি টাওয়ার |
সেনসো-জি শ্রাইন (浅草寺)
সাউথ পার্ক রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে কয়েক পা হেঁটে যেতেই নাকামিসে স্ট্রিট। নাকামিসে স্ট্রিটের শুরুতেই একটা বিশাল গেট। জাপানিরা বলে 'কামিনারিমন' যার অর্থ হলো 'থান্ডার গেট'। অফিসিয়াল ভাষায় এটাকে বলা হয় 'ফুরাইজিনমন'। সেনসো-জি টেম্পলের প্রধান আকর্ষণ হলো এই 'কামিনারিমন গেট'। গেটের ডানদিকে বায়ুর দেবতা ফুজিন এবং বাঁদিকে বজ্রের দেবতা রাইজিনের মূর্তি রয়েছে। তৎকালীন মুসাশি জেলার গভর্নর তাইরা-নো-কিমিমাসা এই গেটটি নির্মাণ করেছিলেন। গেটে ঢোকার মুখে প্রথম যে জিনিসটি চোখে পড়ল তা হল বিশাল আকারের লণ্ঠন, সে সত্যিই বিশাল। তার গায়ে লাল আর কালো রঙের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কাগজের মণ্ড দিয়ে তৈরি এই লণ্ঠনকে জাপানিরা চোচিন বলে। গেটের মাঝখানে ঝোলানো নয়নাভিরাম এই চোচিনের নীচে দাঁড়িয়ে দর্শনার্থীরা দেখি টপাটপ ছবি তুলছে। তা দেখে আমিও ক'টা তুললাম।
| কামিনারিমন গেট |
থান্ডার গেটের ঠিক পরেই শুরু হয়েছে নাকামিসে-ডোরি শপিং স্ট্রিট, যার দু'পাশে সেই পুরনো আমলের দোকান। এই শপিং স্ট্রীটে জাপানের অনেক কিছু ট্রাডিশনাল জিনিস পাওয়া যায়। কি নেই সেখানে! ইয়োকাতা, টাইউকা, কিমোনো এবং ফোল্ডিং হাতপাখার মতো বিভিন্ন জাপানি স্যুভেনির ছাড়াও আসাকুসা জেলার নানারকম স্থানীয় ট্রাডিশনাল স্ন্যাকস জাতীয় খাবার বিক্রি হচ্ছে এই নাকামিসে স্ট্রীটে। এরকমই একটি স্টলে দেখি একটি পাতলা বাঁশের কাঠিতে একসাথে তিন থেকে পাঁচটি গোলাকার আকৃতির রাইস বল রাখা আছে। এ আবার কি জিনিস? পরে জাপানিদের কাছ থেকে জেনেছি এর নাম ডাঙ্গো। জাপানের একটি জনপ্রিয় স্ন্যাক এবং ডেজার্ট। মোচিকো অর্থাৎ মিষ্টি চালের আটা দিয়ে তৈরি একধরনের রাইস বল। এতে সশ ও শিচিমি ছিটিয়ে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। শিচিমি হল এক ধরনের সুস্বাদু জাপানি মশলা যা সাতটি মশলার মিশ্রণে তৈরি। কেনাকাটা তো আছেই। ট্যুরিস্টদের কাছে ফটো তোলার আদর্শ জায়গা।
| ডাঙ্গো |
পৃথিবীর নানা দেশে নানা অঞ্চলের পুরনো মার্কেটগুলোতে গেলে সেখানকার পুরাতন জীবন, সংস্কৃতি ও লাইফস্টাইল দেখতে পাওয়া যায়। সেনসো-জিতে এসে সেই একই অনুভূতি হলো। মাঝে মাঝেই দেখতে পাচ্ছি অল্পবয়সী জাপানি মেয়েরা দলবেঁধে কিমোনো, ইয়োকাতা পরে মাথায় ফুল গুঁজে গল্প করতে করতে চলেছে। মন্দির চত্বরে বেশির ভাগ লোক জনের ওয়েস্টার্ন পোশাক। সেলফি তুলতে ব্যস্ত অনেকে। মন্দিরের কাছে রয়েছে কিমোনোর দোকান। 'কিমোনো' যেহেতু খুবই দামি তাই ভাড়াও পাওয়া যায়। বিদেশী পর্যটকরা তো বটেই, অনেক জাপানিরাও এখানে এসে সারাদিনের জন্য কিমোনো ভাড়া করে তাই পরে মন্দির এলাকায় ঘুরে বেড়ায়, ছবি তোলে, আর কেনাকাটায় মগ্ন থাকে।
| নাকামিসে-ডোরি |
এই নাকামিসে স্ট্রিটের শেষে আবার আরেকটি গেট। তাইরা-নো-কিমিমাসা এটি নির্মাণ করেছিলেন। গেটে তিনটি বড় লণ্ঠন ঝুলছে। একটি কাগজের লণ্ঠন আর দুটো ধাতব লণ্ঠন। গেটের দুপাশে দু'টো নিও মূর্তি। ডানদিকের নিওকে বলা হয় উঙ্গিও, মুখ বন্ধ রয়েছে তার আর বাঁদিকের মূর্তিটি আগিও, যার মুখ থাকে খোলা। নিও মূর্তি থাকার জন্য একসময় এই গেটটি "নিওমন গেট" নামে পরিচিত ছিল। এটিকে এখন "হোজোমন" বা ট্রেজার-হাউস গেট বলা হয়। হোজোমন গেটের ভেতরে ঢুকে, পেছন ফিরে তাকাতে দেখি গেটের দুপাশে বিশাল দু'টো চটি জুতো লাগানো। এই চটিগুলোকে ও-ওয়ারাজি বলা হয়। এগুলো এক ধরনের খড়ের দড়ি দিয়ে তৈরি। নিওকে পরার জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে যা পরে সেনসো-জিকে অশুভ শক্তি এবং প্রতিকূল জিনিসের প্রভাব থেকে তারা রক্ষা করতে পারে। হোজোমন গেট পেরোতেই বিশাল এক বৌদ্ধ মন্দির। সেনসো-জি শ্রাইন। এটি টোকিওর সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির ও দর্শনীয় স্থান। মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে বৌদ্ধ দেবী কান্ননকে উৎসর্গ করে।।
| হোজোমন গেট |
সেনসো-জির মূল মন্দিরের সামনে ধূপ জ্বালানোর একটি বিশাল পাত্র যাকে বলা হয় জোকোরো। চারপাশে সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়ে। কড়াই আকৃতির পাত্রটিতে অজস্র ধুপ জ্বলছে। আশেপাশে এমন কিছু লোক রয়েছে যারা দেখি সেই ধূপের ধোঁয়া দিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে। তারা বিশ্বাস করে যে এই ধোঁয়া তাদের শরীর এবং আত্মাকে শুদ্ধ করে। ঠিক যেন আমাদের বাড়ির পুজোতে পঞ্চপদীপের আশীর্বাদ।
| জোকোরো |
জোকোরোর পেছনে হোন্ডো। সেনসো-জি শ্রাইনের প্রধান হল, এটিকে কান্নন-ডো বলা হয়। মন্দিরের সামনে হাত ধোয়ার জায়গা, যেখানে সব মানুষ আগে হাত ধোয়, তারপর মন্দিরে প্রবেশ করে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দর্শনার্থী আর পূজারীদের আনাগোনা থাকে এ মন্দিরে। জাপানের এবং বাইরের দেশের অনেক ট্যুরিস্ট চোখে পড়ল। মন্দিরের সামনের ঘন্টা আর লণ্ঠন দুটোই বিশালাকায় আর মন্দিরের দরজাটা এতটাই বড়, মনে হচ্ছিলো যেন এটা কোনো রাজার প্রাসাদ। ভেতরে বুদ্ধের মূর্তি।
| কান্নন-ডো |
সেনসো-জি শ্রাইন গড়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে প্রচলিত এক কাহিনী। একটু পেছন ফেরা যাক। সালটা তখন ৬২৮। একদিন ভোরে দুই জেলে হিনোকুমা হামানারি এবং তার ভাই হিনোকুমা তাকেনারি, সুমিদা নদীতে মাছ ধরছিলেন। হঠাৎ কিছু একটা টের পেয়ে তারা জাল টেনে দেখেন একটি বুদ্ধ মূর্তি। কিন্তু তাদের কোন ধারণা ছিল না এটা কি! হিনোকুমা ভাইরা আসাকুসা গ্রামের প্রধান হাজিনো নাকামোতোকে বৌদ্ধ মূর্তিটি দেখালেন। মূর্তিটি দেখে তিনি বুঝতে পারেন যে এটি বৌদ্ধ দেবতা বোধিসত্ব কান্ননের মূর্তি। তখন তিনি নিজের বাড়িকে বৌদ্ধ মন্দিরে পরিণত করে সেই মূর্তিটি সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন। এই গল্পটি সারা জাপানের অনেক তীর্থযাত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং মন্দিরটি ধীরে ধীরে খ্যাতি ও গুরুত্ব লাভ করে। এই ঘটনার ১৭ বছর পরে অর্থাৎ ৬৪৫ সালে শোকাই শোনিন নামে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বৌদ্ধধর্ম পালনের উদ্দেশ্যে দেশব্যাপী ভ্রমণে বেরিয়ে সেনসো-জিতে এসেছিলেন। একই বছরে, শোকাই সেনসো-জি মন্দিরের প্রধান হল কান্নন-ডো নির্মাণ করেন এবং সেখানে বোধিসত্ব কান্নন মূর্তিটিকে স্থাপন করেন। মন্দিরটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। এডো যুগে তৃতীয় শোগুন তোকুগাওয়া ইয়েমিৎসু সেনসো-জি কমপ্লেক্সের বেশিরভাগ ভবনই নির্মাণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনসো-জি মন্দিরের প্রধান হল সহ অনেকগুলি ভবন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এগুলো পরে পুননির্মিত হয়েছিল যা আমরা আজ দেখতে পাই।
| বোধিসত্ত্ব কান্নন |
মন্দির কমপ্লেক্সটা বেশ বড়। বেশ ভিড়। তবে জাপানে সব কিছু সুশৃঙ্খলভাবে সাজান। কোন বিশৃঙ্খলা চোখে পড়েনা। একসঙ্গে একটা জায়গায় এত ইতিহাস, ঐতিহ্য আবার এত আধুনিকতা, এত নাগরিক প্রাণচঞ্চলতা, স্থানীয় মানুষজন এবং পর্যটক সব্বাই মিলে এত ফুর্তি, অথচ একইসঙ্গে কী করে এত শান্তি বিরাজ করতে পারে, তা যেন বুঝেই ওঠা যায় না!
হোজোমনের ঠিক পাশে রয়েছে এক জোড়া ব্রোঞ্জের তৈরি বুদ্ধ মূর্তি। এডো যুগে নির্মিত এই বুদ্ধ মূর্তি দু'টি 'নিসোনবুৎসু' নামে পরিচিত। একটি কান্নন বোসাৎসু (অবলোকিতেশ্বর) অন্যটি সেশি বোসাৎসু (মহাস্থানপ্রাপ্ত) মূর্তি। বোধিসত্ব কান্নন করুণার আর বোধিসত্ব সেশি জ্ঞানের প্রতীক।
| নিসোনবুৎসু |
উল্টোদিকে মা ও শিশু জিজোর মূর্তি। জাপানের দেবতাদের মধ্যে জনপ্রিয়তার নিরিখে সামনের সারিতে রয়েছেন জিজো। এই মূর্তি প্রায়ই জাপানের প্রায় সব গ্রামের রাস্তার পাশে পাওয়া যায়। সে দেশে একে বোধিসত্ত্বের রূপ বলে মান্য করা হয়। কথিত রয়েছে, পর্যটকদের পাশাপাশি শিশুদের আত্মারও রক্ষাকর্তা জিজো। জিজোর গলায় ঝোলা বিবের রং লাল কেন? এ নিয়েও লোকগাথা রয়েছে। লোকে বলে, জাপানে অসুকা আমলে অর্থাৎ ৫২২ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টপূর্বে জলবসন্তে ভোগা শিশুদের চিহ্নিত করতে তাদের গলায় লাল রঙের বিব ঝুলিয়ে দেওয়া হত। পাশাপাশি, লাল রংকে সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার রং হিসাবেও মান্য করা হয়। শিশুদের রক্ষাকর্তা হিসাবে তাই জিজোর মাথায় লাল টুপি এবং গলায় লাল বিব ঝোলানো থাকে।
| জিজোর মূর্তি |
সেনসো-জির মন্দিরের পাশেই রয়েছে পাঁচতলা প্যাগোডা। প্যাগোডার একপাশে গাছের নিচে শো-কানজিয়ন বোসাৎসুর স্মৃতিস্তম্ভ। উল্টোদিকে ছোট একটি গার্ডেন। এই গার্ডেনে রয়েছে পদ্ম ফুলের উপর উপবিষ্ট একটি বুদ্ধ মূর্তি। এটি 'আমিদা নিয়োরাই' মূর্তি। এর ঠিক পাশেই ব্রোঞ্জের তৈরি 'হোকিওইন্টো'। প্যাগোডার আকারে তৈরি দৃষ্টিনন্দন এই বৌদ্ধ মেমোরিয়াল টাওয়ারটি পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়।
| আমিদা নিয়োরাই মূর্তি, পাশে হোকিওইন্টো |
সেনসো-জি থেকে বেরিয়ে পায়ে-পায়ে চলে এলাম আসাকুসা স্টেশনে। আসাকুসা থেকে সুকুবা এক্সপ্রেস লাইনের মেট্রো ধরে আকিহাবাড়ায় এসে নামলাম। এটি টোকিওর অন্যতম বড় স্টেশন। মোট পাঁচটি রেলওয়ে লাইন গিয়েছে এখান দিয়ে। ইয়ামানোতে লাইন, কেহিন-তোহোকু লাইন, টোকিও মেট্রো হিবিয়া লাইন, চুও-সোবু লাইন এবং সুকুবা এক্সপ্রেস লাইন। প্রত্যেক ট্রেন ও ট্রেন লাইনের রং আলাদা, যা দেখে সহজেই যে কেউ জেনে যাবে যে কোনটা কোন লাইন। আকিহাবাড়া স্টেশনের তিনটি এক্সিট আছে। সেন্ট্রাল গেট, ইলেকট্রিক টাউন এবং শোওয়া ডোরি। সেন্ট্রাল গেট এক্সিট দিয়ে স্টেশন থেকে বের হলাম। সেন্ট্রাল গেটটি সুকুবা এক্সপ্রেস লাইনের নিকটতম পথও। জাপানের সবচেয়ে বড় ইলেক্ট্রোনিক্স মার্কেট এই আকিহাবাড়ায়। শুধু জাপান নয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইলেক্ট্রনিক্স মার্কেট আকিহাবাড়া।
| আকিহাবাড়া |
টোকিওর ডেনকি-গাই (Denki-gai) নামে পরিচিত এই ইলেকট্রিক টাউনে অনেক ইলেকট্রনিক্স পণ্যের দোকান রয়েছে। ইয়োদোবাশি আকিবা (Yodobashi-Akiba) তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং জাপানের জনপ্রিয় ইলেকট্রনিক্স রিটেল চেইনগুলির মধ্যে একটি। এখানে দেশীয় কাস্টমারদের জন্য যেমন দোকান আছে, তেমনি বিদেশী কাস্টমারদের জন্যও রয়েছে টাক্স-ফ্ৰী দোকান। স্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তার ওপারে দেখি - ইয়োদোবাশি আকিবা।
| ইয়োদোবাশি আকিবা |
ইয়োদোবাশি আকিবার নয়টি তলের মধ্যে ছয়টিতে রয়েছে ইয়োদোবাশি ক্যামেরা মাল্টিমিডিয়া আকিবা স্টোর। একেক তলায় একেক ধরনের পণ্য। বড় বড় দোকানের সামনেও ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার ব্যবস্থা আছে। প্রায় প্রতিটি দোকানেই রয়েছে ডিসকাউন্টের সাইনবোর্ড। এমন কিছু ইলেকট্রনিক্স জিনিস নেই যা সেখানে নেই। স্মার্টফোন, ল্যাপটপ থেকে শুরু করে ক্যামেরা, হোম অ্যাপ্লায়েন্স বিশ্বের প্রায় সব ধরনের ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য রয়েছে। স্যুভেনির হিসেবে মেয়ের জন্য একটা 'মেড ইন জাপান' লেখা দেখে ঘড়ি কিনলাম। জাপানে সস্তায় কিছু পাওয়া যায়না! সবকিছুই খুব দামী মনে হচ্ছিল। যেটা একটু দাম কম সেটাই দেখি মেড ইন চায়না। এখানেও দেখি চায়না জিনিসের আধিপত্য। কেনাকাটা শেষ করে আমরা আবার ষ্টেশনের দিকে গেলাম। মনে রাখার মত একটা দিন কাটল।
| প্রথম তলায় দোকান |
উশিকু দাইবুতসু (牛久大仏)
জাপানে থাকার সময় ফুরিয়ে আসছিল। ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না। আর মাত্র পাঁচ দিন হাতে ছিল। এর মধ্যে একদিন সুকুবার উপকন্ঠে ইবারাকির উশিকু দাইবুতসুতে গিয়েছিলাম। উশিকু দাইবুতসু আমাদের হোটেল থেকে গাড়িতে মাত্র কয়েক ঘন্টার পথ। সুকুবা থেকে ডে ট্রিপে ঘোরার জন্য একটি দুর্দান্ত জায়গা। আমার এই রোড জার্নিটা স্মরণীয় ছিল, শুধু সুন্দর দৃশ্যের জন্য নয়। কারণ এই রোড রোড জার্নিতে জাপানের গ্রাম্য জীবনকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। সুকুবা থেকে উশিকু যাওয়ার সময় অনেকটাই গ্রামাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। দুপাশে চাষবাসের জমি, এখানে একটা বাড়ি তো ওখানে একটা বাড়ি।
| উশিকু দাইবুতসু |
উশিকু দাইবুতসু (Ushiku Daibutsu) যাওয়ার জন্য সকাল আটটায় গাড়ি আসবে বলা আছে। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচতলায় লা-পোর্টাতে চলে এলাম। ঘড়ির কাঁটা মেপে হোটেলের কাছে গাড়ি এলো। ব্রেকফাস্ট সেরে রেডি হয়েই ছিলাম তাই ঝটপট গাড়িতে উঠে বসলাম। রাস্তার আশপাশে যেদিকে তাকাই সেদিকেই লাল মেরুন হলুদ সবুজের বিভিন্ন শেড। গাছের নিচে বাদামী ঝরা পাতা। জিনকো, ম্যাপেল ট্রি সহ হাজারো প্রজাতির গাছ। এর মধ্য অন্যতম হল ম্যাপেল ট্রি। প্রচুর ম্যাপল ট্রি আছে। শীতের আগের মুহূর্তে ম্যাপেল, জিনকো এবং অন্যান্য গাছের পাতা ধীরে ধীরে হলুদ, লাল, কমলা এবং লালচে হয়ে যায়।
| ইবারাকির পথে |
জিনকো ও ম্যাপেল গাছের এই পাগল করা রূপ দেখতে দেখতে উশিকু দাইবুতসু মূর্তির কাছে চলে এলাম। কেনকুই-গাকুয়েন থেকে উশিকু পৌঁছাতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে গেল। সুকুবার উপকন্ঠে 'উশিকু' একটি ছিমছাম ছোট্ট শহর। রাস্তাঘাটে ভিড় নেই। জাপানের অন্যান্য আবাসিক এলাকার মতো এটাও ভীষন গোছানো, পরিচ্ছন্ন, শান্ত। গাড়ি থেকে নেমে দেখি সামনে বিশাল এক ব্রোঞ্জের বুদ্ধ মূর্তি। এটি একটি আমিদা বুদ্ধের মূর্তি। যাঁকে আমরা বলি 'তথাগত বুদ্ধ'। সত্যিই দেখার মতো। উশিকু দাইবুতসু বিশ্বের উচ্চতম মূর্তিগুলির মধ্যে একটি।
| উশিকু দাইবুতসু |
উশিকু দাইবুতসু চত্বরে ঢোকার মুখে একটি ছোট শপিং আর্কেড। এই শপিং স্ট্রিটে মূলত ইবারাকি প্রিফেকচারের তৈরি স্ন্যাকস ও স্যুভেনির বিক্রি হয়। বিভিন্ন স্ট্রিট ফুডও রয়েছে। শপিং আর্কেডের মধ্যে দিয়ে হেঁটে এসে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। কিছুটা হাঁটার পর একটা সুদৃশ্য গেটের কাছে এসে দাঁড়ালাম। উশিকু দাইবুতসুর কাছে যাওয়ার জন্য এই গেটের নাম হাক্কেনমন গেট। গেটের মাথায় রয়েছে একটি ছোট বুদ্ধ মূর্তি। গেট পেরিয়ে কয়েক মিটার এগিয়ে দেখি ডাইকোরো নামে একটি বড় ধূপ দানি। এটি জাপানের সবচেয়ে বড় ধুপ দানি। ডাইকোরোর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মূর্তির ঠিক নিচে এসে দাঁড়ালাম।
![]() |
| হাক্কেনমন গেট |
এই চিত্তাকর্ষক মূর্তির সামনে দেখি বিশাল বড় একটা ব্রোঞ্জের ঘণ্টা। সিকিউরিটি চেক করে মূর্তির পেছন দিকের একটি গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। এই অতিকায় মূর্তির ভেতরে একটি চারতলা মিউজিয়াম রয়েছে। জুতো খুলে খুলে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ঢুকিয়ে আমরা প্রথম তলার লবিতে প্রবেশ করলাম যা সম্পূর্ণ অন্ধকার। প্রথম তলাকে বলা হয় 'দ্য ওয়ার্ল্ড অফ ইনফিনিট লাইট অ্যান্ড লাইফ' অর্থাৎ 'অনন্ত আলো ও জীবনের জগত'। এটি অন্ধকার জগতের প্রতীক।সামনে এগোতেই আর একটা ঘরে ঢুকলাম যেটা পুরোপুরি অন্ধকার ছিল না। নীল, সবুজ, হলুদ বিভিন্ন শেডের আলোয় অস্পষ্টভাবে আলোকিত। এই ঘরের মধ্যে খুব হাল্কা মিউজিকের সাথে উপরে থেকে আলোর একটি রশ্মি পড়ছে। সেখানে একটি সোনালী বুদ্ধমূর্তি রয়েছে। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে কিছুটা যেতেই অন্য তলায় যাওয়ার জন্য একটি লিফট দেখতে পেলাম।
| বুশারি স্তূপ |
লিফটে দ্বিতীয় তলায় গেলাম। এই তলাটিকে বলা হয় 'দ্য ওয়ার্ল্ড অফ গ্রাটিটুড এন্ড থ্যাংকফুলনেস'। এই তলটি সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় শিক্ষা দীক্ষা ও অধ্যয়নের জন্য নির্ধারিত। এখানে অনেক সূত্র (বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ) রাখা আছে। দর্শনার্থীরা চাইলে ফুদে ব্যবহার করে সূত্র কপি করে লেখার চেষ্টা করে দেখতে পারে; ফুদে এক ধরণের ট্রাডিশনাল জাপানি ক্যালিগ্রাফি ব্রাশ। এছাড়াও এই তলটিতে একটি ফটো গ্যালারি দেখতে পেলাম যেখানে উশিকু দাইবুতসু কিভাবে নির্মিত হয়েছিল তার বিভিন্ন পর্যায়ের অসংখ্য ফটোগ্রাফ এবং মডেল রয়েছে। এখানে বুদ্ধের একটি পূর্ণ আকারের মডেলও রয়েছে।
| বুদ্ধের লাইফ সাইজ মডেল |
এরপর লিফট বেয়ে উঠে গেলাম চতুর্থ তলায়। এটাই বুদ্ধের শেষ তল। এই তলটিকে বলা হয় 'দ্য রুম অফ মাউন্ট গৃধ্রকূট'। এখানে বুদ্ধের জীবন সম্পর্কে প্রচুর তথ্য রয়েছে। একটি ছোট বুশারি স্তুপও দেখতে পেলাম। এই সোনার পাত্রটির মধ্যেই নাকি রাখা আছে বুদ্ধের দেহাবশেষ। এই তলায় দাইবুতসুর বুকের সামনে চারটি সরু জানালা আছে। প্রায় পঁচাশি মিটার উপরে এই জানলা দিয়ে নীচের গার্ডেন ও চারপাশের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা যায়। তৃতীয় তলার লিফটে ঢোকার আগে ঘরের মাঝখানে একটি সর্পিল সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম। এই তলায় একটি ছোট স্যুভেনির শপ রয়েছে যেখানে বিভিন্ন বৌদ্ধ সামগ্রী যেমন ধূপ, মূর্তি ইত্যাদি রয়েছে।
| চতুর্থ তলায় সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে |
চতুর্থ তল থেকে লিফটে নেমে আসি তৃতীয় তলায়। এই তলটিকে বলা হয় ''দ্য ওয়ার্ল্ড অফ লোটাস স্যাংচুয়ারি'। লিফট থেকে বের হয়ে দেখি একটি গোলাকার করিডোরে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বুদ্ধের প্রায় কয়েক হাজার মূর্তি। দেওয়ালের গায়ে অসংখ্য ছোট আয়াতকার কাঠের কুলুঙ্গি। প্রায় প্রতিটি কুলুঙ্গিতে একটি করে ছোট সোনালি বুদ্ধের মূর্তি রাখা আছে। যাকে 'তাইনাইবুতসু' বলা হয়, বড় বুদ্ধের মধ্যে একজন বুদ্ধ। এগুলো এক একটি পরিবারের একজন মৃত সদস্যের স্মরণে কেনা একটি সমাধি। প্রতিটি কুলুঙ্গির গায়ে একটি ফলকে সেই পরিবারের নাম খোদাই করা আছে।
| বুদ্ধ মূর্তি দিয়ে সজ্জিত দেয়াল |
মূর্তি থেকে বেরোনোর আগে দ্বিতীয় এবং শেষ তলায় করিডোরের শেষে রয়েছে একটি অবজারভেশন ডেক, যেখান থেকে চারপাশের গার্ডেনের একটি সুন্দর প্যানোরামিক ভিউ পাওয়া যায়। এই বিশাল মূর্তিটি এখানের প্রধান আকর্ষণ হলেও এই চত্বরের মধ্যে রয়েছে একটি খুব সুন্দর ছোট্ট পার্ক, মাছ সহ একটি পুকুর, এনিমল পার্ক এবং একটি বিশাল ফুলের বাগান। উশিকু দাইবুতসু সংলগ্ন জোডো ফ্লাওয়ার গার্ডেনে চারপাশে ঘুরে বেড়ানোর পরে পার্কে গেলাম।
| জোডো ফ্লাওয়ার গার্ডেন |
পার্কে ঢুকেই দেখি একটি ঝর্ণা, যার নাম সুকুবাই। দর্শনার্থীরা এই সুকুবাইয়ের জলে হাত ও মুখ ধুয়ে দাইবুতসুর ভেতরে প্রবেশ করেন। জায়গাটা এত সুন্দর যে ছবি না তুলে থাকতে পারি না। একই ছবি বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে তুলতে লাগলাম। অনেকটা সময় আমরা এখানে কাটিয়ে রওনা দিলাম সুকুবার দিকে।
| সুকুবাই ঝর্ণা |
উশিকু দাইবুতসু থেকে বেরিয়ে সুকুবা সায়েন্স সিটির কাছে তাজমহল রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে JAXA (জাপান এরোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি) মিউজিয়ামে গেলাম। সুকুবা স্পেস সেন্টারের মেন গেট দিয়ে ঢুকতেই রকেট প্লাজাতে জাপানের তৈরি একটি ৫০ মিটার লম্বা H-II রকেট দেখতে পেলাম। এটি একটি আসল রকেট যা পর্যটকদের দেখার জন্য রাখা আছে। ফটো তোলার জন্য একেবারে আদর্শ জায়গা।
| সুকুবা স্পেস সেন্টারে H-II রকেট |
রকেট প্লাজা থেকে চলে গেলাম স্পেস ডোমে। সুকুবা স্পেস সেন্টারের প্রধান প্রদর্শনী হল। এই স্পেস ডোমে কিছু রকেট ইঞ্জিন, স্যাটেলাইট এবং অন্যান্য পরীক্ষার মডেল রয়েছে যা দেখে মহাকাশ বিজ্ঞান, স্যাটেলাইট, রকেট, স্পেস স্টেশন, মহাকাশচারী কি খায়, পরিধান করে এবং কিভাবে তাদের কাছে খাবার পরিবহন করা হয় তা জানা যায়। পর্যটকদের জন্য এখানে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের জাপানি এক্সপেরিমেন্ট মডিউল 'কিবো'-র একটি পূর্ণ আকারের মডেল রাখা আছে। স্পেস ডোম হল থেকে বেরিয়ে পাশেই দেখি 'প্ল্যানেট কিউব' নামে মিউজিয়ামের একটি ছোট স্যুভেনির শপও রয়েছে।
| জাপানিজ এক্সপেরিমেন্ট মডিউল 'কিবো' |
মাঝে আর একটা দিন, তারপরেই বাড়ি ফেরা। সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে! বিকেলে হোটেলে ফিরে চায়ের খোঁজ করি। কিন্তু কোথায় চা পাব? হোটেলের করিডোরে চোখ পড়ল একটা ভেন্ডিং মেশিন। জাপানিরা যাকে বলে জিদোহামবাইকি (Jidōhanbaiki)। সেখানে প্রতিটি পণ্যের একটি করে নমুনা ও তার গায়ের উপর দামও লেখা। ওই মেশিনে পরিমাণ মতো ইয়েন ঢুকিয়ে পছন্দের সামগ্রীর ওপর লেখা মূল্যের বাটন প্রেস করলেই সেগুলো মূহুর্তের মধ্যেই বেরিয়ে আসে। ভেন্ডিং মেশিনে দেখি কোকাকোলা, জুস, বিয়ার ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের পানীয় রাখা আছে। কিন্তু চা নেই! ঠাণ্ডার মধ্যেও দেখি সবাই ঠাণ্ডা খায়। কোল্ড কফি তাদের বেশি পছন্দ। চা খেতে খুব কম লোককেই দেখা যায়।
| ইয়াস সুকুবা মল |
বাড়ির জন্য কিছু টুকিটাকি জিনিস কেনার ছিল। কি আর করা? সন্ধ্যার দিকে হোটেলের রিসেপশন থেকে একটা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কেমন যেন অলস লাগানো আবহাওয়া। টিপটিপ বৃষ্টি, মাঝে মঝে জোরে জোরেও বইছে। আমাদের মাথার উপর ছাতা। শহরটা পরিষ্কার ঝকঝকে বলে বৃষ্টির মধ্যেও ছাতা মাথায় হাঁটার মধ্যে এক ধরনের রোমান্টিকতা আছে। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম ডন কুইজোটে। ডন কুইজোট (Don Quijote) সাধারণত ডনকি (Donki) নামে পরিচিত। জাপানের একটি জনপ্রিয় ডিসকাউন্ট চেইন স্টোর যেখানে ইলেকট্রনিক্স থেকে শুরু করে পোশাক, কসমেটিক্স, মুদিখানা, খেলনা, জুতা এবং অন্যান্য সমস্ত গৃহস্থালীর জিনিসপত্র পর্যন্ত পাওয়া যায়।
| রাতের শহর |
ডন কুইজোটে টুকটাক কিছু কেনাকাটা করে তারপর হেঁটে হেঁটে চলে এলাম ইয়াস সুকুবা (iias Tsukuba) মলে। বিশাল শপিং মল। এখানে একবার এমাথা-ওমাথা হাঁটাহাঁটি করলে দিনের হাঁটাহাঁটি পুরোটা হয়ে যায়। এখানে ঘন্টাখানেক সময় কাটিয়ে টুকটাক কিছু শপিং করে হোটেলে ফিরে আসি।
| ইয়াস সুকুবা মল |
ইউরিকামোম
টোকিওতে শিমবাশি (Shimbashi) স্টেশন থেকে ইউরিকামোম (Yurikamome) মনোরেলে উঠলাম। এটি একটি এলিভেটেড ট্রেন। জাপানে এটি আমার প্রিয় ট্রেন যাত্রা ছিল। শিমবাশি থেকেই ইউরিকামোম লাইনটি শুরু হয়েছে। ইউরিকামোম হল একটি অটোমেটেড গাইডওয়ে ট্রানজিট। এটি টোকিওর সাধারণ ট্রেন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ইউরিকামোমে আমাদের গন্তব্য ছিল শিন-টোয়োসু (Shin-toyosu)। ট্রেনে উঠে সামনের সিটে বাসার চেষ্টা করলাম কারণ এই ট্রেনে সামনের সিটে বাসার মজাটাই অন্যরকম। সামনে সিট পেলাম না। এগিয়ে গেলাম পেছনে। এবারে কিন্তু একদম সামনের সিটে বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। ট্রেন চলতে শুরু করলো। খুব বেশি জোরে চলে না। তবে জার্নিটা বেশ উপভোগ্য ছিল।
| ইউরিকামোম লাইন |
| ইউরিকামোমের ভেতর |
মিনাটোতে শিবাউরা ফুটো (Shibaura-futō) স্টেশন পেরোতেই চোখে পড়লো রেইনবো ব্রিজ। এটি টোকিওর বিখ্যাত একটি সাসপেনশন সেতু। অসাধারণ সেই দৃশ্য। প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে এলাম শিন-টোয়োসুতে। ট্রেন থেকে নেমে খানিকটা পায়ে হেঁটে চলে এলাম টিমল্যাব প্ল্যানেট মিউজিয়ামে।
| রেইনবো ব্রিজ |
টোয়োসুর টিমল্যাব প্ল্যানেট
আমার জীবনে এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। ভেতরে প্রবেশের আগে লকার রুম। ওই লকার রুমের ফ্রি লকারে জুতো মোজা খুলে এবং লাগেজ রেখে ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। কারণ এখানকার কিছু কিছু প্রদর্শনী হাঁটু জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে উপভোগ করতে হয়। মোবাইল ফোন ও ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া যাবে, তবে সাবধানে ব্যবহার করতে হবে। অসাবধানতায় হাত ফসকে জলে পড়ে গিয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। জুতো মোজা খুলে লকারে রাখলাম। সেখান রাখা চটি জোড়া বের কর পরে নিলাম।
| টিমল্যাব প্ল্যানেট |
লকার রুম পেরিয়ে প্রবেশ করলাম। ... ভেতরটা অন্ধকার। ওয়াটার এরিয়ার শুরু এখান থেকেই। আবছা আলো আঁধারিতে সামনে এগিয়ে চলেছি। পায়ের নিচে বয়ে চলছে জলের ধারা। তার উপর একটা হালকা আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে! সেই আলোতে জলের কণা চিকচিক করছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন একটি জলপ্রপাতে পৌঁছে গেছি। এরপর ভেজা পা ঝেড়ে শুকিয়ে নেওয়ার জন্য সফ্ট ব্ল্যাক হোলের মধ্যে দিয়ে হাঁটা। ঢেউ খেলানো বালিশের মতো নরম মেঝে। এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে কেউ এর উপর পা রাখলেই এর আকার পরিবর্তন হয়। এই ঘর পেরোনোই একটা চ্যালেঞ্জ। মেঝের উপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম। পা ঢুকে যাচ্ছে, একরকম প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে পেরিয়ে অন্য একটি ঘরে ঢুকে পড়লাম।
দ্য ইনফিনিটি ক্রিস্টাল ইউনিভার্স। ... যথাযথ নামকরণ করা হয়েছে কারণ সেখানে দেখি প্রচুর পরিমাণে এলইডি স্ট্রিং লাইট রয়েছে যা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সাথে বৃষ্টিপাতের মতো ঝরে পড়ে আবার উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। ঐ আলোগুলো কাঁচের মেঝেতে প্রতিফলিত হয়ে বিভিন্ন প্যাটার্ন তৈরি করছে। এই প্রতিফলন সত্যিই অনন্তকাল ধরে চলে বলে মনে হচ্ছে।
| দ্য ইনফিনিটি ক্রিস্টাল ইউনিভার্স |
এখানে হাঁটুর উপরে প্যান্ট গুটিয়ে জলে নামলম। আলোর ছটায় জলের মধ্যে ফুটে উঠেছে ভিন্ন এক জগৎ। হাঁটু গভীর পুলের জলে দাঁড়িয়ে মনে হল যেন দূর মহাবিশ্বের কোনো এক কালো সাগরে পা রেখেছি। অসীম এলাকা জুড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ডিজিটাল কই কার্প সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো একটা কই কার্প আমার পায়ের কাছে এসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর সেটিকে ধরার জন্য হাত ছোঁয়াতেই দেখি ফুল হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। ঋতুর সাথে সাথে এই ফুলেরও পরিবর্তন হয়। প্রতি সেকেন্ড তৈরি হচ্ছে সম্পূর্ণ নতুন দৃশ্য। আগের দৃশ্যগুলি পুনরাবৃত্তি হয় না। এটি একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে তৈরি, তাই একেক সময় একেক রকম দৃশ্য তৈরি হচ্ছে।
| আর্ট লাইট প্রজেকশন শো |
কিছুক্ষণ উপরের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। অদ্ভূত এক অনুভূতি হয়। ডুবে যায় এক শিল্পের জগতে। অন্যদের দেখে কাঁচের মেঝেতে শুয়ে পড়ি। শরীর ভাসতে শুরু করে। চোখের উপর ভেসে ওঠে ঝরে পড়া ফুলের মহাজগত। ফুলের কুঁড়ি গজায়, ফোটে এবং সময়ের সাথে সাথে পাপড়ি ঝরে গিয়ে তা শুকিয়ে মরে যায়। এই ভাবে জন্ম-মৃত্যুর চক্র চলতেই থাকে, অবিরত।
![]() |
| ফ্লোটিং ইন দ্য ফলিং ইউনিভার্স অফ ফ্লাওয়ার্স |
পরের প্রদর্শনী 'ওয়েটলেস ফরেস্ট অফ রেজোনেটিং লাইফ'। এই জায়গাটি গোলকের মত বিশাল আকারের সব বেলুন দিয়ে ভরা। মনে হল যেন এক বেলুনের জগৎে প্রবেশ করেছি। মুক্ত-ভাসমান বেলুনগুলির মধ্য দিয়ে চলার সময় যদি তাদের গায়ে ধাক্কা লাগে অথবা হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখি তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের রং বদলাতে থাকে এবং এই রং অন্যান্য বেলুনে ছড়িয়ে পড়ে। বেলুন তাড়া করে খেলতে খেলতে কিছুক্ষণের জন্য হলেও নিজের বয়স ভুলে ফিরে যায় শৈশবের সেই পুরানো দিনগুলিতে।
| ওয়েটলেস ফরেস্ট অফ রেজোনেটিং লাইফ |
ওয়াটার জোন পেরিয়ে চলে এলাম গার্ডেন এরিয়াতে। ফ্লোটিং ফ্লাওয়ার গার্ডেনে দর্শনার্থীর সংখ্যা সীমিত। এখানে কেবল পাঁচ মিনিট ঘোরা যাবে। ...এই 3D ভাসমান ফুলের বাগানটি অর্কিডে ভরা। এখানে, রং-বেরঙের জীবন্ত অর্কিড ঝুলে আছে বলে মনে হচ্ছে। গার্ডেনে ঢোকার আগে মনে হলো অর্কিডগুলো মাটি ছুঁয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গার্ডেনের মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে দেখলাম হাজার হাজার অর্কিড উপরে নিচে ঝুলে হাওয়ায় ভাসছে।
| ফ্লোটিং ফ্লাওয়ার গার্ডেন |
এই গার্ডেনে দেখি শ্যাওলা ঢাকা ঢিপির মধ্যে কিছু ধাতব চকচকে ডিম্বাকার বস্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ধাক্কা দিলে সেগুলো পড়ে গিয়ে আবার উঠে যায়। দিনের বেলায় তেমন কিছু আকর্ষণীয় ছিল না। তবে শুনেছি সূর্যাস্তের পরে এই ডিম্বাকার বস্তুগুলি জ্বলজ্বল করে ওঠে এবং তারা নিজেদের রং পাল্টাতে থাকে।
| মস গার্ডেন অফ রেজোনেটিং মাইক্রোকসমস |
মস গার্ডেনটি ছিল লকার রুমের লাগোয়া। এই গার্ডেনের পাশে এক জায়গায় দেখি বের হওয়ার পথ নির্দেশ করে একটি চিহ্ন দেওয়া রয়েছে। সেই চিহ্ন দেখে গার্ডেন এরিয়া থেকে বেরিয়ে চলে এলাম লকার রুমে, যেখানে আমরা আমাদের জুতো এবং জিনিসপত্র রেখেছিলাম। লকার থেকে জুতো মোজা বের করে পায়ে দিয়ে চলে এলাম শিন-টোয়োসু স্টেশনে। শিন-টোয়োসু থেকে ইউরিকামোম লাইনের ট্রেনে চড়ে এলাম শিমবাশিতে।
| শিমবাশি |
শিমবাশি থেকে আসাকুসার জন্য ইয়ামানোতে লাইনের (Yamanote Line) ট্রেন ধরলাম। আসাকুসা থেকে আবার ট্রেন পরিবর্তন করে সুকুবা লাইনের ট্রেনে চেপে সুকুবাতে এসে নামলাম। শেষবারের মতো ডিনার করতে আমরা আবার সেই সাইনোতে ঢুঁ মারলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে হোটেলে ফিরে এসে রাতের মধ্যেই লাগেজ সব গুছিয়ে নিলাম।
| হোটেল বেস্টল্যান্ডের সম্মুখভাগ |
জাপানের শেষ সকাল। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে নিলাম। বাসে সুকুবা থেকে হানেদা যেতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। সকাল সাড়ে এগারোটায় আমাদের ফ্লাইট, তাই আমরা হোটেলে আর খেলাম না। সরাসরি বাসে উঠে হানেদার দিকে রওনা দিলাম। বাস একেবারে এয়ারপোর্টের বাইরে নামিয়ে দিল। সেখান থেকে জাপান এয়ারলাইন্সের প্লেনে উঠে বসলাম। প্লেনের সময় হল। প্লেন রানওয়েতে ছুটতে শুরু করলো। তারপর একটা হালকা ঝাটকা মেরে মাটি ছেড়ে উপরে উঠে পড়ে। প্লেন এবার ভাসতে শুরু করেছে। উঁচুতে। আরও উঁচুতে। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম ঘরবাড়ি খুব ছোট দেখাচ্ছে। মিনিট দশেক পর মেঘ আর নীলাকাশ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না...
» বিশেষ সতর্কতাঃমনে রাখবেন জাপানে নির্দিষ্ট প্রজাতির উদ্ভিদ আনার উপর বিধিনিষেধ রয়েছে। যেমন আম, তাজা পেঁপে ইত্যাদি ফল জাপানে আনা নিষিদ্ধ। নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করলে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা দশ লক্ষ ইয়েন পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। তাই ফ্লাইট থেকে নামার আগে আপনার সাথে আনা যেকোনো ফল খেয়ে ফেলুন।
TOKYO, TSUKUBA, HAKONE, SENSO-JI, BULLET TRAIN, TEAM LAB PLANET
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল


