Theme Layout

Boxed or Wide or Framed

Theme Translation

Display Featured Slider

Yes

Featured Slider Styles

[Centred][caption]

Display Grid Slider

No

Grid Slider Styles

[style5][caption]

Display Trending Posts

Display Author Bio

Yes

Display Instagram Footer

Yes

Dark or Light Style

কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী'র স্মৃতিবিজড়িত আড়রাগড়


টানা তিন মাস ধরে লকডাউন। আর ঘরে টেকে না মন। শরীরটাও যেন লকডাউন হয়ে যাচ্ছে। আর কত দিন কত সময় এভাবে বন্দি থাকা যায়? অফিস কলিগ অরিন্দমকে কাজী নজরুল ইসলামের 'সংকল্প' কবিতার লাইন দুটি মনে করিয়ে দিলাম – "থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে"। চাকরিসূত্রে শালবনিতে থাকা। কাজের ফাঁকে একবার অরিন্দমকে বললাম, এখানে গ্রামের ভিতরে একটা ঐতিহাসিক স্থানের খোঁজ পেয়েছি চলো সেখান থেকে ঘুরে আসি। আমরা বাঙালিরা চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কথা প্রত্যেকেই জানি। মুকুন্দরাম ছিলেন চন্ডীমঙ্গল কাব্যধারার শ্রেষ্ঠ কবি। তার রচয়িতা কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী'র স্মৃতিবিজড়িত স্থান আমাদের এতো কাছে আছে সেটা জানতাম না। চললাম সেই কবিকঙ্কণের স্মৃতিবিজড়িত স্থান জয়পুরে। জয়পুর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আনন্দপুরের অন্তর্গত শোলডিহার একটি ছোট্ট গ্রাম। এই গ্রামেই অবস্থিত মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের রচয়িতা কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী’র স্মৃতিবিজড়িত জয়চন্ডী মাতার মন্দির। বদ্ধ ঘরে বসে না থেকে মাভৈঃ মাভৈঃ বলে অর্থাৎ নির্ভয়ে দুজনে দুটো গাড়ি নিয়ে অফিস শেষ করে বিকেল বেলায় বেরিয়ে পড়লাম।

এই বটগাছের নীচে দেবী চন্ডীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন
শালবনি ছাড়িয়ে আড়াবাড়ি জঙ্গল শুরু হওয়ার কিছুটা আগে ন্যাশনাল হাইওয়ে থেকে ডানদিকে একটি রাস্তা চলে গেছে আনন্দপুরের দিকে। পিচঢালা রাস্তা, দু'পাশে সবুজ ক্ষেত আর শালের জঙ্গল ঘেরা পথ ধরে এগিয়ে চলেছি। একটু পরে পড়লো বাজার আড়রা।

দু'পাশে সবুজ ক্ষেত
বাজার আড়রা পার হতেই দেখি ডানদিকে একটা রাস্তা চলে গেছে। এই পথে একটু যাওয়ার পরে পৌঁছে গেলাম আড়রাগড়ে। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম এই আড়রা গ্রামেই জমিদার বাঁকুড়া রায়ের আশ্রয়ে ছিলেন এবং আমৃত্যু সেখানে বেশ সুখেই কাটিয়েছিলেন। তবে এখন এই গ্রামে কবিকঙ্কণের কোনও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া কঠিন। রয়েছে কেবল গ্রামের একপ্রান্তে মাঝারি গোছের উঁচু পাড় যুক্ত প্রায় মজে আসা একটি পুকুর।

মাটির দোতলা বাড়ি
আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম। গ্রামটা মূলত দু'টো ভাগে বিভক্ত, ভিতর আড়রা আর বাজার আড়রা। শোনা যায়, একদা এই গ্রামে ছিল জমিদার বাঁকুড়া রায়ের পরিখা দিয়ে ঘেরা এক প্রাসাদ। ছিল উঁচু পাড় দেওয়া বিশাল দীঘি। চারপাশে বড় বড় স্নানের ঘাট। 'আড়রা' নামকরণ গ্রামের এই জমিদার বাড়িকে উপলক্ষ করেই। সাঁওতালী ভাষায় 'আড়' মানে উঁচু পাঁচিল এবং 'অড়া' মানে বাড়ি। আড়-অড়া একসাথে উচ্চারণ করলে হয় 'আড়ড়া'। লোকমুখে এভাবেই আরড়া বা আড়রা নামের উৎপত্তি হয়। আড়রাগড়ে যখন এসে পৌছালাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। পাকা রাস্তা ছেড়ে ডানদিকের লাল মাটির মেঠো পথে চলতে শুরু করলাম। একটু দূরে চোখে পড়ল একটা জলাশয়, চারিদিকে বুনো ঝোপজঙ্গল। এই জলাশয় ঘিরেই ছিল বাঁকুড়া রায়ের প্রাসাদ। এখন একটা বিশাল স্তূপ ছাড়া সেই প্রাসাদের কিছুই নজরে এলো না। হতে পারে এটাই সেই প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। তবে দেখলাম ঝোপজঙ্গলে বহু মাকড়া পাথরের নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে। রয়েছে মজে যাওয়া দীঘি। পরিখার অস্তিত্বও বোঝা যায়।

আড়রাগড়
মুকুন্দরামের পৈতৃক নিবাস ছিল বর্ধমান জেলার রায়না থানার অন্তর্গত দামুন্যা বা দামিন্যা গ্রামে। খাজনা না দিতে পারায় মুসলিম ডিহিদার মামুদ শরীফের অত্যাচারে তিনি দামিন্যা ছাড়তে বাধ্য হন। একদিকে মামুদ শরীফের অত্যাচার আবার অন্যদিকে মুঘল সেনাদের হাতে ধরা পড়ে প্রাণ সংশয়ের ঝুঁকি থাকার ফলে রাতের অন্ধকারে কবি সপরিবারে দামিন্যা ছেড়ে পালিয়ে যান। গন্তব্যহীন কবি অধিকাংশ পথই পায়ে হেঁটে এবং মুড়াই (মুণ্ডেশ্বরী), দ্বারকেশ্বর, পরাশর, আমোদর এবং নারায়ণ নদী নৌকায় পেরিয়ে পৌঁছালেন চন্দ্রকোনা থানার অন্তর্গত 'গুচুড়ে' বা 'গোচড্যা' গ্রামে। গুচুড়ে গ্রামের বর্তমান নাম বিষ্ণুদাসপুর। গুচুড়ে যাওয়ার পথে কবি ভালিয়া গ্রামে তেলো-ভেলোর মাঠে একবার দুর্বৃত্তদের হাতে পড়েছিলেন। এখানে মা সারদাও একবার ডাকাতের হাতে পড়েছিলেন। ক্ষুধায় অবসন্ন হয়ে কবি গুচুড়ে গ্রামের একটা পুকুরপাড়ে বটগাছের নীচে বিশ্রাম নেন। এখানেই নিদ্রামগ্ন অবস্থায় দেবী চণ্ডীর আদেশ পেয়ে কবি চণ্ডীমঙ্গল কাব্য লেখার প্রেরণা পেয়েছিলেন। এরপর কবি গুচুড়ে থেকে জঙ্গল পথে শিলাই (শিলাবতী) নদী পার হয়ে এসে পৌঁছালেন অবিভক্ত মেদিনীপুরের এই আড়রাগড় গ্রামে। সেই সময় আড়রাগড় ছিল উৎকল রাজ্যের অন্তর্গত একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এই অঞ্চলকে তখন বলা হত ব্রাহ্মণভূম। এই ব্রাহ্মণভূমের জমিদার ছিলেন বাঁকুড়া রায়। সম্ভবত গ্রামের জমিদার বাঁকুড়া রায়ের আশ্রয় নিরাপদ ভেবেই কবি তাঁর সভায় উপস্থিত হন। কবির শ্লোক রচনার পারদর্শিতা দেখে জমিদার বাঁকুড়া রায় মুগ্ধ হন। কবি বাঁকুড়া রায়ের কাছে বিশ পঁচিশ মণ ধান এবং থাকার জায়গা পেলেন এবং জমিদার বাড়ির শিশুদের অর্থাৎ বাঁকুড়া রায়ের পুত্র রঘুনাথ রায়ের এবং সম্ভবত তাঁর ভাইয়ের শিশু পুত্রদের জন্য গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করলেন। শুরু হলো নূতন জীবন এবং অতিশয় সুখের জীবনই বলতে হবে। এরপর যখন বাঁকুড়া রায়ের পুত্র রঘুনাথ রায় জমিদার হলেন তখন তিনি কবিকে গুরুতুল্য সম্মান ও সেবা করতে লাগলেন। রঘুনাথ রায়ের উৎসাহেই স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনধারার উপর ভিত্তি করে কবি মুকুন্দরাম রচনা করেন 'চণ্ডীমঙ্গল' কাব্যটি। কবি তাঁর 'চন্ডীমঙ্গল' কাব্যের নামকরণ করেন 'অভয়ামঙ্গল'। কবির আশ্রয়দাতা রাজা রঘুনাথ রায় এরপর মুকুন্দরামকে 'কবিকঙ্কণ' উপাধিতে ভূষিত করেন বলে মনে করা হয়।

কবিকঙ্কণের স্মৃতিবিজড়িত বটগাছ
আড়রাগড় থেকে ফিরে আবার শোলডিহার পথে কিছুটা গিয়ে পৌঁছালাম জয়পুর গ্রামে। আজও এই গ্রামটা আশেপাশের ছোটখাট অন্যান্য গ্রামের ন্যায় শাল অরণ্যে বেষ্টিত। গ্রামে রাস্তার ধারে বেশ কয়েকটি টিনের চালের মাটির দোতলা বাড়ি দেখা গেলো। বর্তমানে গ্রামের এই মাটির ঘরের ঐতিহ্য প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। এই জয়পুর গ্রামে রয়েছে জয়চণ্ডীর মন্দির।

জয়চণ্ডী মন্দির
শোনা যায়, এখানেই মুকুন্দরাম চণ্ডীমঙ্গলের পালাগান প্রথম গেয়েছিলেন। তবে মন্দিরের আশেপাশে এবিষয়ে কোনও তথ্য দেওয়া নেই। মন্দিরটি সংস্কার করে নতুন চণ্ডীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পুরনো বিগ্রহটা এখন মন্দিরের বাইরে একপাশে খোলা জায়গায় রাখা আছে।

মন্দিরের পুরনো বিগ্রহ
জয়চন্ডী মন্দিরের পিছনে রয়েছে প্রায় মজে আসা একটা পুকুর ও পাশে বিশাল একটা প্রাচীন বটগাছ। গ্রামবাসীদের দাবি, এই বটগাছের তলেই কবি মুকুন্দরাম দেবী চন্ডীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে জমিদার রঘুনাথ রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় চন্ডীমঙ্গল কাব্যটি রচনা করেছিলেন। ঐতিহাসিক গুরুত্ব প্রকাশ করে এমন কোনো সরকারি তথ্য দেওয়া নেই। ঐ বটগাছের নীচে একটা হাতে লেখা বোর্ড দেখতে পেলাম। দেখভালের অভাবে এখন সেই বোর্ডের লেখাও অস্পষ্ট।

মন্দিরের পুকুর
গাছগাছালির মধ্যে অবস্থিত মন্দিরের শান্ত ও স্নিগ্ধ পরিবেশে প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। প্রতিদিন অগণিত ভক্ত তাদের মনস্কামনা পূরণের জন্য এখানে পূজো দিতে আসেন, তবে শনিবার ও মঙ্গলবার সবচেয়ে বেশী ভক্ত সমাগম হয়। প্রতিদিন মাকে অন্নভোগ দেওয়া হয়। অন্নভোগ গ্রহন করতে হলে মন্দিরের সেবায়েতকে আগে থেকে জানাতে হবে। দুপুরের পরে মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে।

শান্ত ও স্নিগ্ধ পরিবেশ
বর্তমানে মন্দির দেখভালের জন্য রয়েছে একটি কমিটি। এই কমিটির উদ্যোগে মন্দিরের পাশে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের নামে একটা চিলড্রেন পার্ক তৈরি হয়েছে। তবে ঐ পার্কে পরিচর্যার অভাব রয়েছে। মন্দির চত্বরে দেখলাম লোহার তৈরি একটি রাবণের কাঠামো পড়ে আছে, জানতে পারলাম প্রতি বছর বিজয়া দশমীর দিন এখানে রাবণ পোড়া হয়। তখন আগত পর্যটকেরা বটগাছের তলায় রাখা ধুলোমাখা ওই বোর্ডে উঁকিঝুঁকি দিয়ে স্মৃতিচারণ করেন।

মন্দিরের সামনে আমরা
» প্রয়োজনীয় তথ্য
  • অন্নভোগ গ্রহণ করতে হলে মন্দিরের সেবায়েত অর্ঘ্য ব্যানার্জী'র সাথে আগে থেকে যোগাযোগ করতে হবে
  • মোবাইল নম্বর: +৯১ ৮১৭০৯৮৮৬৩৪
» পথ নির্দেশিকা
© ছবি ও লেখাঃ- অরবিন্দ পাল (তথ্যসূত্রঃ- 'কবিকঙ্কণ মুকুন্দ' - আচার্য ক্ষুদিরাম দাস এবং 'মেদিনীপুর সংস্কৃতি ও মানবসমাজ' - তারাপদ সাঁতরা)
ARRAGARH, PASCHIM MEDINIPUR, JAYPUR, WEST BENGAL
Arabinda Pal
1 Comments
Share This Post :

You Might Also Like

1 comment:

[name=Arabinda Pal] [img=https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEia50rmuKEAcbGUbQKvAbzUmdviiIhm-LeVlsEEdFx_xtGfyvx8O02yFVuJemgswzSA8PoMcN-XW0AcinKr9iq28lHK43Z4TFFyL7pJyGGxLNx9LGn0cLvPz0lUJzNrWBo9n_NyxGLjDII/h120/IMG_2788.jpg] [description=পর্যটক হিসাবে নয়, একজন ভ্রমণকারী হিসাবে বেড়ানোটা আমার কাছে একটা নেশা এবং ফটোগ্রাফিতেও আমার ভীষণ শখ। তাই একজন ভ্রমণকারী হিসাবে আমার এই ব্লগে নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে লেখা ও ছবিগুলো যদি আপনাদের ভালো লাগে তাহলে অবশ্যই আপনাদের মতামত কমেন্টসের মাধ্যমে জানাতে ভুলবেন না।] (facebook=https://www.facebook.com/groups/2071066419824586/user/100002484831922) (twitter=Twitter Profile Url) (instagram=https://www.instagram.com/arabindapal2020/) (bloglovin=Blogvin Profile Url) (pinterest=https://www.pinterest.com/arabindapalbrb/) (tumblr=Tumblr Profile Url)

Follow @Arabinda Pal